নেতৃত্ব-রাজনীতি হোক জনকল্যাণে, আত্মপ্রচারে নয় by কেয়া চৌধুরী
আমাদের আজকের বাংলাদেশে অনেক সমস্যা। সাধারণের সমস্যা দূর করার দায়িত্ব সরকার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের, যারা সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসব নেতার দেশসেবার উদাত্ত আহ্বানে, স্লোগানে সাধারণের কান ঝালাপালা। যেদিকে চোখ যায় পোস্টার-ব্যানার-বিলবোর্ডজুড়ে দেশপ্রেমিকের হিড়িক।
অথচ এসব বড় বড় নেতার নিজ পরিচয় বহনের এত আয়োজন ম্লান হয়ে যায়, যখন রাস্তায় বের হলেই রুগ্ণ, কঙ্কালসার মানুষ জানান দেয় এত জননেতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বৈষম্যের কথা, তাদের বঞ্চনার কথা
ঢাকার রাস্তায় বের হওয়া মানে চরম দুর্ভোগ। ঠাসা গাড়ি, গাড়ির স্থবিরতা দেখলে মনে হয়, কেউ যেন পেরেক ঠুকে রেখেছে রাস্তাজুড়ে। পুরান ঢাকার জনসন রোডে জজকোর্টে যেতে সাধারণত যেখানে সময় লাগে এক ঘণ্টা, সেখানে গত ক'দিন সময় খরচ করতে হয়েছে দু্্্্্্্্ই ঘণ্টা। কোনো দিন তারও বেশি। অবশ্য জনসন রোডের জটলা প্রতিদিনকার। তবে সমগ্র ঢাকা শহরের গত ক'দিনের গাড়ির জটলার যে ভয়াবহ রূপ, তা সত্যিই দুর্বিষহ। মানুষের তুলনায় অপ্রতুল গণপরিবহন, তার সঙ্গে বিভিন্ন অব্যবস্থায় যাত্রীসাধারণের নিরাপত্তাহীনতা তুঙ্গে। তার মধ্যে স্বল্প আয়ের ব্যক্তি যদি কোনো কারণে জরুরি কাজে সময় বাঁচাতে বাসে না চড়ে মিটারচালিত কোনো মোটরযানের আরোহী হন, তবে তার দৃষ্টি ঘড়ির কাঁটা আর সিএনজি অটোরিকশার মিটারের পাগলা ঘোড়ার দিকেই স্থির থাকতে বাধ্য। বর্ষার দিনে আবহাওয়া ঠাণ্ডা হলেও মাথা থেকে মুখ বেয়ে অঝোরে ঝরতে থাকে ফোঁটা ফোঁটা ঘামের বিন্দু। মিটার চার্জ কোথায় গিয়ে যে ঠেকে, তার ঠিক নেই! তার সঙ্গে চালকের পূর্বনির্ধারিত ২০ থেকে ৫০ টাকার বাধ্যতামূলক বাড়তি বকশিশের আবদার। সব মিলিয়ে অস্থিরতা চেপে বসে মগজে। বর্ষা ঋতুতে আমাদের চেনা ঢাকা শহর অন্যরকম মনে হয়। গাছপালাবিহীন এ নগরী বর্ষায় বিস্তর আবর্জনার শহরে পরিণত হয়। বোধ করি, ঢাকা শহর বাংলাদেশের সবচেয়ে অসুন্দর, অপরিচ্ছন্ন নগরী। বর্ষায় কার না বৃষ্টিতে ভিজতে মন চায়! কিন্তু ঢাকার মানুষ বৃষ্টিতে ভেজার কথা ভাবার আগেই হাঁটু পর্যন্ত দুর্গন্ধময় পানিতে ডুবতে বাধ্য হয়। অস্থায়ী জলাবদ্ধতা ভাসিয়ে নিতে চায় নর্দমায়। মানুষ ভুলে যায় বর্ষার সবুজের যৌবন প্রকৃতির চিরচেনা সি্নগ্ধতা, কদম কিংবা বেলি এ মাসেই ফোটে, তা জানা। গাছপালাহীন ইটপাথরের এ শহরের বাসিন্দা আমরা। অথচ কত নির্দয়ভাবে প্রতিদিন আমরা আমাদের প্রিয় ঢাকাকে অসুন্দর করছি; সচেতনভাবে। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলছি। ময়লা জমতে জমতে দুর্গন্ধ এত প্রকট হচ্ছে, মূহূর্ত ঠায় দাঁড়ানো সেখানে কঠিন। এ দেশে আমরা এমনি নাগরিক, বৃক্ষরোপণের মৌসুম এলেও একটি বৃক্ষও লাগানোর আগ্রহ দেখাই না। বৃক্ষহীন এ ঢাকা শহরে বৃক্ষ লাগানো না হলে ও মাথার ওপরে চোখের সামনে দেয়ালে দেয়ালে, গাছে গাছে, দরজা-জানালায় বড়-ছোট ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড_ চোখভর্তি বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। নেতাদের মুখ আর মুখ। পণ্য বিজ্ঞাপনের চেয়ে লাভজনক ব্যবসা যেন রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন। রঙিন পোস্টার, বেমানান আকারের একটি মুখ, কোনায় ছোট করে নেতার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। ব্যস! হয়ে গেল সংগ্রামী জননেতা!
ছোটবেলায় মফস্বল থেকে মাঝে মধ্যে রাজধানীতে এলে মনে মহাআনন্দ জাগত তিনটি জিনিসের কারণে। এক. বাংলা সিনেমার রঙিন পোস্টার; দুই. নতুন বৌ সাজে সাজানো রঙিন জমকালো রিকশা; তিন. রাস্তার পাশে দণ্ডমান লাল-নীল-সবুজ বাতি। অনেকের কাছে ঢাকা মানে ছিল রঙ্গিলা এক জগৎ। যেদিকে দু'চোখ যায় রঙে রঙে রঙিন! কিন্তু আজ? প্রতিদিনই দীর্ঘ সময় গাড়িতে বসতে বসতে অনন্যোপায় হয়ে বিচিত্র, অসহনীয় কত কিছুই না চোখে পড়ে! প্রথম প্রথম মনে খারাপ অনুভূতি জাগ্রত হলেও সময়ের ব্যবধানে তা যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। বসে আছি, এমন সময় দাদার বয়সী বৃদ্ধ যখন কঙ্কালসার শরীর নিয়ে সামনে উপস্থিত হয়, বাড়িয়ে দেয় বিকলাঙ্গ বা পেয়ারা গাছের মরা ডালের মতো পুষ্টিহীন ময়লা হাত; তখন আমরা এমন ভাব দেখাই, যেন সামনে বা পাশে কিছু নেই। মানুষ কত যে মূল্যহীন হতে পারে_ বাংলাদেশের রাজধানীতে এলে তা বোঝা যায়। ভূপেন হাজারিকার 'মানুষ মানুষের জন্য' গানটি সত্যিই অর্থহীন আমাদের সমাজে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতরে নীলাভ স্বচ্ছ কাচের ভেতর থেকে বেলি ফুলের সি্নগ্ধতা কতই না ভালো লাগে দেখতে! কিন্তু যে ছোট শিশুটি আমাকে এ সি্নগ্ধতার আনন্দ বিলাচ্ছে, তার খোঁজ কতটুকু নিচ্ছি আমরা? আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ কি আদৌ আছে? রাস্তায় রাস্তায় এই যে এত ক্ষুধার্ত, জরাজীর্ণ মানুষ; যাদের স্থায়ী ঘর নেই, কাপড় নেই; রাস্তায়-ফুটপাতে যত্রতত্র বাস করছে এত কোমলমতি শিশু; তাদের প্রতি কি আমাদের কোনো অনুভূতি, সহানুভূতি থাকার প্রয়োজন নেই? একই সমাজের বাসিন্দা হিসেবে নেই কোনো দায়িত্ব? সব দায়িত্ব সরকারের বা নির্দিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয়ের। এখানেই সব শেষ! সমাজের এ স্তরের মানুষ কি শুধু আমাদের ৫০ থেকে ১০০ টাকার বিনিময়ে রোদেপোড়া দুপুরে মিছিল-সমাবেশ কিংবা কাঙালিভোজের অংশীদার হবে?
বলব না_ সবই লোক দেখানো। সমাজে অনেকেই আছেন, যারা সৎ মন নিয়ে দান করছেন। কষ্ট হয় যখন অল্প মূল্য অল্প পুঁজি ভেবে হতদরিদ্র মানুষকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি হয়। হাসি পায় যখন দেখি, শ্রদ্ধাঞ্জলি বা অভিনন্দনবার্তায় শোক বা আনন্দ প্রকাশকারী ব্যক্তির মুখের ছবির গুরুত্ব এত বেশি যে, যার প্রতি তার অনুভূতি প্রকাশ করছেন, সে বিষয়টাই তখন গৌণ হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি কি এত সস্তা বিষয়? জনগণ কি আজ এত বোকা!
আমাদের দেশের এমন অনেক নেতা ছিলেন. যারা তাদের কর্ম দিয়ে আজও মহামহিমান্বি্বত ও স্মরণীয় হয়ে আছেন। মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতারা কতই না সাধারণ জীবন অতিবাহিত করেছেন! রাজনীতির নাম যে সমাজসেবা, গণমানুষের উন্নয়ন, তাই যেন তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন সারাজীবন দিয়ে। তাদের চলনে-বলনে সাধারণ মানুষের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যেত। তাই তো তারা হতে পেরেছিলেন মানুষের নেতা, প্রকৃত জননেতা। এসব নেতা নিজেকে প্রচারে ব্যস্ত রাখেননি। রেখেছেন কর্মে। তাদের আচরণে ছিল অমায়িকতা। তাই তারা জাতিকে দিয়েছেন মূল্যবান স্বাধীনতা। আজ আমরা সেই নেতা কেন পাই না! কারণ আজকের প্রচারপ্রিয় নেতাদের নিজেকে পরিচিত করতে ব্যয় করতে হয় প্রচুর অর্থ। তারা তারকা জগতের তারার মতো ঝলমল করতে চান। সিনেমা মার্কা বিজ্ঞাপনভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী উড়ন্ত নেতারা নিজেই নিজেকে পরিচিত করেন 'সংগ্রামী জননেতা' বলে। কিন্তু জনগণ জানে না, তিনি কোন জাতীয় আন্দোলনে এমন মহান নেতা হলেন! এভাবে কি জননেতা হওয়া যায়, নাকি কখনও হয়েছে কেউ? যেসব মানুষের এই সাধারণ ভাবনাটুকু নেই যে, একটি গাছের গায়ে বা কোনো দেয়ালে এমন বিজ্ঞাপন অশোভন। সেই ব্যক্তি মানুষের কল্যাণের চিন্তা করবে কীভাবে?
জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ তার দিনলিপিতে রাজনীতিবিদ হিসেবে যোগ্য করে নিজেকে গড়ে তুলতে পরামর্শ দিয়ে লেখেন_ 'একজন সৎ রাজনৈতিক কর্মী কোন রকমের দুর্নীতি বা কোন ধরনের স্বজনপ্রীতি তোষণবাদ না করে শুধুমাত্র নিজের কাজ নিজের সৎ চরিত্র ও গণসংযোগের মাধ্যমে রাজনীতিতে সার্থক হতে পারে। পদ দখল করার প্রয়োজন হয় না। মানুষই তাকে পদে বসায়।'
অর্থাৎ জননেতা হতে হলে জনগণের ভালোবাসা পেতে হবে। ভালো কর্ম থেকে যোজন যোজন দূরে থেকে শুধু নেতার স্লোগান আউড়ে নেতার ছবির সঙ্গে নিজের ছবি প্রচারেই নেতার আদর্শ বা চেতনা ধারণ বা লালন করা যায় না। বরং নেতাকে ভালোবেসে আত্মত্যাগী সৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয়।
আমাদের আজকের বাংলাদেশে অনেক সমস্যা। সাধারণের সমস্যা দূর করার দায়িত্ব সরকার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের, যারা সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসব নেতার দেশসেবার উদাত্ত আহ্বানে, স্লোগানে সাধারণের কান ঝালাপালা। যেদিকে চোখ যায় পোস্টার-ব্যানার-বিলবোর্ডজুড়ে দেশপ্রেমিকের হিড়িক। অথচ এসব বড় বড় নেতার নিজ পরিচয় বহনের এত আয়োজন ম্লান হয়ে যায়, যখন রাস্তায় বের হলেই রুগ্ণ, কঙ্কালসার মানুষ জানান দেয় এত জননেতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বৈষম্যের কথা, তাদের বঞ্চনার কথা। তখন এত যে আয়োজন সবই বিমর্ষ, বিদ্রূপ মনে হয়।
যে পরিমাণ অর্থ নানা প্রচারে খরচ হয়, তার কিছুও যদি নিজ পরিচয় বহনকারী জননেতারা রাস্তার ছিন্নমূল শিশুদের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য, পড়াশোনার উপকরণ, কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের উন্নয়নে ব্যয় করতেন, তবে সত্যিকার অর্থে তারা জননেতার কাজ করতেন। উপকৃত হতো জনগণ, উপকৃত হতো এ দেশ। অনিন্দ্যসুন্দর হতো আমাদের বাসভূমি। এ অর্জন কি অন্য সব প্রাপ্তির চেয়ে বড় নয়?
কেয়া চৌধুরী :আইনজীবী ও সমাজকর্মী
kchowdhury71@gmail.com
ঢাকার রাস্তায় বের হওয়া মানে চরম দুর্ভোগ। ঠাসা গাড়ি, গাড়ির স্থবিরতা দেখলে মনে হয়, কেউ যেন পেরেক ঠুকে রেখেছে রাস্তাজুড়ে। পুরান ঢাকার জনসন রোডে জজকোর্টে যেতে সাধারণত যেখানে সময় লাগে এক ঘণ্টা, সেখানে গত ক'দিন সময় খরচ করতে হয়েছে দু্্্্্্্্ই ঘণ্টা। কোনো দিন তারও বেশি। অবশ্য জনসন রোডের জটলা প্রতিদিনকার। তবে সমগ্র ঢাকা শহরের গত ক'দিনের গাড়ির জটলার যে ভয়াবহ রূপ, তা সত্যিই দুর্বিষহ। মানুষের তুলনায় অপ্রতুল গণপরিবহন, তার সঙ্গে বিভিন্ন অব্যবস্থায় যাত্রীসাধারণের নিরাপত্তাহীনতা তুঙ্গে। তার মধ্যে স্বল্প আয়ের ব্যক্তি যদি কোনো কারণে জরুরি কাজে সময় বাঁচাতে বাসে না চড়ে মিটারচালিত কোনো মোটরযানের আরোহী হন, তবে তার দৃষ্টি ঘড়ির কাঁটা আর সিএনজি অটোরিকশার মিটারের পাগলা ঘোড়ার দিকেই স্থির থাকতে বাধ্য। বর্ষার দিনে আবহাওয়া ঠাণ্ডা হলেও মাথা থেকে মুখ বেয়ে অঝোরে ঝরতে থাকে ফোঁটা ফোঁটা ঘামের বিন্দু। মিটার চার্জ কোথায় গিয়ে যে ঠেকে, তার ঠিক নেই! তার সঙ্গে চালকের পূর্বনির্ধারিত ২০ থেকে ৫০ টাকার বাধ্যতামূলক বাড়তি বকশিশের আবদার। সব মিলিয়ে অস্থিরতা চেপে বসে মগজে। বর্ষা ঋতুতে আমাদের চেনা ঢাকা শহর অন্যরকম মনে হয়। গাছপালাবিহীন এ নগরী বর্ষায় বিস্তর আবর্জনার শহরে পরিণত হয়। বোধ করি, ঢাকা শহর বাংলাদেশের সবচেয়ে অসুন্দর, অপরিচ্ছন্ন নগরী। বর্ষায় কার না বৃষ্টিতে ভিজতে মন চায়! কিন্তু ঢাকার মানুষ বৃষ্টিতে ভেজার কথা ভাবার আগেই হাঁটু পর্যন্ত দুর্গন্ধময় পানিতে ডুবতে বাধ্য হয়। অস্থায়ী জলাবদ্ধতা ভাসিয়ে নিতে চায় নর্দমায়। মানুষ ভুলে যায় বর্ষার সবুজের যৌবন প্রকৃতির চিরচেনা সি্নগ্ধতা, কদম কিংবা বেলি এ মাসেই ফোটে, তা জানা। গাছপালাহীন ইটপাথরের এ শহরের বাসিন্দা আমরা। অথচ কত নির্দয়ভাবে প্রতিদিন আমরা আমাদের প্রিয় ঢাকাকে অসুন্দর করছি; সচেতনভাবে। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলছি। ময়লা জমতে জমতে দুর্গন্ধ এত প্রকট হচ্ছে, মূহূর্ত ঠায় দাঁড়ানো সেখানে কঠিন। এ দেশে আমরা এমনি নাগরিক, বৃক্ষরোপণের মৌসুম এলেও একটি বৃক্ষও লাগানোর আগ্রহ দেখাই না। বৃক্ষহীন এ ঢাকা শহরে বৃক্ষ লাগানো না হলে ও মাথার ওপরে চোখের সামনে দেয়ালে দেয়ালে, গাছে গাছে, দরজা-জানালায় বড়-ছোট ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড_ চোখভর্তি বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। নেতাদের মুখ আর মুখ। পণ্য বিজ্ঞাপনের চেয়ে লাভজনক ব্যবসা যেন রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন। রঙিন পোস্টার, বেমানান আকারের একটি মুখ, কোনায় ছোট করে নেতার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। ব্যস! হয়ে গেল সংগ্রামী জননেতা!
ছোটবেলায় মফস্বল থেকে মাঝে মধ্যে রাজধানীতে এলে মনে মহাআনন্দ জাগত তিনটি জিনিসের কারণে। এক. বাংলা সিনেমার রঙিন পোস্টার; দুই. নতুন বৌ সাজে সাজানো রঙিন জমকালো রিকশা; তিন. রাস্তার পাশে দণ্ডমান লাল-নীল-সবুজ বাতি। অনেকের কাছে ঢাকা মানে ছিল রঙ্গিলা এক জগৎ। যেদিকে দু'চোখ যায় রঙে রঙে রঙিন! কিন্তু আজ? প্রতিদিনই দীর্ঘ সময় গাড়িতে বসতে বসতে অনন্যোপায় হয়ে বিচিত্র, অসহনীয় কত কিছুই না চোখে পড়ে! প্রথম প্রথম মনে খারাপ অনুভূতি জাগ্রত হলেও সময়ের ব্যবধানে তা যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। বসে আছি, এমন সময় দাদার বয়সী বৃদ্ধ যখন কঙ্কালসার শরীর নিয়ে সামনে উপস্থিত হয়, বাড়িয়ে দেয় বিকলাঙ্গ বা পেয়ারা গাছের মরা ডালের মতো পুষ্টিহীন ময়লা হাত; তখন আমরা এমন ভাব দেখাই, যেন সামনে বা পাশে কিছু নেই। মানুষ কত যে মূল্যহীন হতে পারে_ বাংলাদেশের রাজধানীতে এলে তা বোঝা যায়। ভূপেন হাজারিকার 'মানুষ মানুষের জন্য' গানটি সত্যিই অর্থহীন আমাদের সমাজে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতরে নীলাভ স্বচ্ছ কাচের ভেতর থেকে বেলি ফুলের সি্নগ্ধতা কতই না ভালো লাগে দেখতে! কিন্তু যে ছোট শিশুটি আমাকে এ সি্নগ্ধতার আনন্দ বিলাচ্ছে, তার খোঁজ কতটুকু নিচ্ছি আমরা? আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ কি আদৌ আছে? রাস্তায় রাস্তায় এই যে এত ক্ষুধার্ত, জরাজীর্ণ মানুষ; যাদের স্থায়ী ঘর নেই, কাপড় নেই; রাস্তায়-ফুটপাতে যত্রতত্র বাস করছে এত কোমলমতি শিশু; তাদের প্রতি কি আমাদের কোনো অনুভূতি, সহানুভূতি থাকার প্রয়োজন নেই? একই সমাজের বাসিন্দা হিসেবে নেই কোনো দায়িত্ব? সব দায়িত্ব সরকারের বা নির্দিষ্ট কোনো মন্ত্রণালয়ের। এখানেই সব শেষ! সমাজের এ স্তরের মানুষ কি শুধু আমাদের ৫০ থেকে ১০০ টাকার বিনিময়ে রোদেপোড়া দুপুরে মিছিল-সমাবেশ কিংবা কাঙালিভোজের অংশীদার হবে?
বলব না_ সবই লোক দেখানো। সমাজে অনেকেই আছেন, যারা সৎ মন নিয়ে দান করছেন। কষ্ট হয় যখন অল্প মূল্য অল্প পুঁজি ভেবে হতদরিদ্র মানুষকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি হয়। হাসি পায় যখন দেখি, শ্রদ্ধাঞ্জলি বা অভিনন্দনবার্তায় শোক বা আনন্দ প্রকাশকারী ব্যক্তির মুখের ছবির গুরুত্ব এত বেশি যে, যার প্রতি তার অনুভূতি প্রকাশ করছেন, সে বিষয়টাই তখন গৌণ হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি কি এত সস্তা বিষয়? জনগণ কি আজ এত বোকা!
আমাদের দেশের এমন অনেক নেতা ছিলেন. যারা তাদের কর্ম দিয়ে আজও মহামহিমান্বি্বত ও স্মরণীয় হয়ে আছেন। মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতারা কতই না সাধারণ জীবন অতিবাহিত করেছেন! রাজনীতির নাম যে সমাজসেবা, গণমানুষের উন্নয়ন, তাই যেন তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন সারাজীবন দিয়ে। তাদের চলনে-বলনে সাধারণ মানুষের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যেত। তাই তো তারা হতে পেরেছিলেন মানুষের নেতা, প্রকৃত জননেতা। এসব নেতা নিজেকে প্রচারে ব্যস্ত রাখেননি। রেখেছেন কর্মে। তাদের আচরণে ছিল অমায়িকতা। তাই তারা জাতিকে দিয়েছেন মূল্যবান স্বাধীনতা। আজ আমরা সেই নেতা কেন পাই না! কারণ আজকের প্রচারপ্রিয় নেতাদের নিজেকে পরিচিত করতে ব্যয় করতে হয় প্রচুর অর্থ। তারা তারকা জগতের তারার মতো ঝলমল করতে চান। সিনেমা মার্কা বিজ্ঞাপনভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী উড়ন্ত নেতারা নিজেই নিজেকে পরিচিত করেন 'সংগ্রামী জননেতা' বলে। কিন্তু জনগণ জানে না, তিনি কোন জাতীয় আন্দোলনে এমন মহান নেতা হলেন! এভাবে কি জননেতা হওয়া যায়, নাকি কখনও হয়েছে কেউ? যেসব মানুষের এই সাধারণ ভাবনাটুকু নেই যে, একটি গাছের গায়ে বা কোনো দেয়ালে এমন বিজ্ঞাপন অশোভন। সেই ব্যক্তি মানুষের কল্যাণের চিন্তা করবে কীভাবে?
জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ তার দিনলিপিতে রাজনীতিবিদ হিসেবে যোগ্য করে নিজেকে গড়ে তুলতে পরামর্শ দিয়ে লেখেন_ 'একজন সৎ রাজনৈতিক কর্মী কোন রকমের দুর্নীতি বা কোন ধরনের স্বজনপ্রীতি তোষণবাদ না করে শুধুমাত্র নিজের কাজ নিজের সৎ চরিত্র ও গণসংযোগের মাধ্যমে রাজনীতিতে সার্থক হতে পারে। পদ দখল করার প্রয়োজন হয় না। মানুষই তাকে পদে বসায়।'
অর্থাৎ জননেতা হতে হলে জনগণের ভালোবাসা পেতে হবে। ভালো কর্ম থেকে যোজন যোজন দূরে থেকে শুধু নেতার স্লোগান আউড়ে নেতার ছবির সঙ্গে নিজের ছবি প্রচারেই নেতার আদর্শ বা চেতনা ধারণ বা লালন করা যায় না। বরং নেতাকে ভালোবেসে আত্মত্যাগী সৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয়।
আমাদের আজকের বাংলাদেশে অনেক সমস্যা। সাধারণের সমস্যা দূর করার দায়িত্ব সরকার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের, যারা সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসব নেতার দেশসেবার উদাত্ত আহ্বানে, স্লোগানে সাধারণের কান ঝালাপালা। যেদিকে চোখ যায় পোস্টার-ব্যানার-বিলবোর্ডজুড়ে দেশপ্রেমিকের হিড়িক। অথচ এসব বড় বড় নেতার নিজ পরিচয় বহনের এত আয়োজন ম্লান হয়ে যায়, যখন রাস্তায় বের হলেই রুগ্ণ, কঙ্কালসার মানুষ জানান দেয় এত জননেতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বৈষম্যের কথা, তাদের বঞ্চনার কথা। তখন এত যে আয়োজন সবই বিমর্ষ, বিদ্রূপ মনে হয়।
যে পরিমাণ অর্থ নানা প্রচারে খরচ হয়, তার কিছুও যদি নিজ পরিচয় বহনকারী জননেতারা রাস্তার ছিন্নমূল শিশুদের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য, পড়াশোনার উপকরণ, কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের উন্নয়নে ব্যয় করতেন, তবে সত্যিকার অর্থে তারা জননেতার কাজ করতেন। উপকৃত হতো জনগণ, উপকৃত হতো এ দেশ। অনিন্দ্যসুন্দর হতো আমাদের বাসভূমি। এ অর্জন কি অন্য সব প্রাপ্তির চেয়ে বড় নয়?
কেয়া চৌধুরী :আইনজীবী ও সমাজকর্মী
kchowdhury71@gmail.com
No comments