সময়ের প্রতিধ্বনি-সহিংসতার রাজনীতি বন্ধ হোক by মোস্তফা কামাল

সোমবার কালের কণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ছিল_'হরতালের আগেই সহিংসতা'। এ প্রতিবেদনের সঙ্গে গাড়ি পোড়ানোর একটি ছবিও ছাপা হয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও যেন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। হরতাল ডাকলেই গাড়ি পোড়াতে হবে। তাহলে গাড়ির মালিকরা ভয়ে হরতালের দিন গাড়ি বের করবেন না।


এতে হরতাল আহ্বানকারীদের পিকেটিংয়ের জন্য রাস্তায় নামতে হয় না। হরতাল ডেকে স্বস্তিতে বাসায় ঘুমানো যায়। আর টোকাই ছেলেপেলেদের কিছু টাকা দিয়ে মাঠে রাখলে হরতাল পালিত হয়ে যায়। কিন্তু হরতালের কারণে মানুষকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, সে কথা কেউ ভাবে না। কারণ তারা গোবেচারা পাবলিক! সেই পাবলিকের ভোটেই যে তাঁদের ক্ষমতায় আসতে হয়, সে কথাও তাঁরা বেমালুম ভুলে যান। ধ্বংসাত্মক রাজনীতির আশ্রয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসে, আবার ধ্বংসাত্মক রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে তাদের নামানো হয়। আর সেই ধ্বংসাত্মক রাজনীতির জাঁতাকলে আমাদের মতো পাবলিককে পিষে মারা হচ্ছে।
আমরা বারবারই বলে আসছি, হরতাল এখন আর প্রতিবাদের ভাষা নয়। প্রতিহিংসার ভাষা, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ। হরতাল পরিহার করে বিরোধী দল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে পারে। সভা-সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘটের পাশাপাশি সংসদে বিরোধী দল তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পারে। কিন্তু বিরোধী দলের সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই। এখন সংসদ অধিবেশন চলছে। অথচ বিরোধী দল সংসদে যাচ্ছে না। তারা রাজপথে হরতাল ডেকে ঘরে বসে আছে। এ ধরনের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করে তারাই আবার ক্ষমতায় আসবে। তারাই দেশের উন্নয়নের কথা বলবে। তাদের মুখেই দেশ উদ্ধারের বড় বড় বুলি শোনা যাবে।
এবার বিএনপি হরতাল ডাকল কেন? এ বিষয়ে বিএনপির বক্তব্যই এখানে তুলে ধরছি। আড়িয়াল বিলে বঙ্গবন্ধুর নামে বিমানবন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত এবং সেখানে সহিংসতায় ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার প্রতিবাদে হরতাল ডাকা হয়। সরকার ইতিমধ্যেই আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও মামলা করতে দেওয়া হয়নি। ফলে হরতাল ডাকার আর কোনো যৌক্তিকতা নেই। তার পরও বিএনপির এই হরতাল কেন, কার স্বার্থে?
এর আগে বিএনপি হরতাল ডেকেছিল খালেদা জিয়ার বাড়ি এবং তাঁর দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে রক্ষার জন্য। তখনো তারা সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে হরতাল ডাকেনি। বক্তৃতা-বিবৃতি, সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট কিছুই করেনি। বিএনপির পুরো কর্মকাণ্ডই ছিল পরিবারকেন্দ্রিক। তখনো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ সমস্যা, ঢাকায় পানি ও গ্যাস সমস্যায় মানুষের নাস্তানাবুদ অবস্থা ছিল। এখন সেই সমস্যা আরো প্রকট। অথচ এসব নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মাথাব্যথা নেই। তারা আছে তাদের ব্যক্তিগত ও দলীয় ইস্যু নিয়ে।
সবাই বলছেন, এবার বিএনপির হরতাল ডাকার কারণ হচ্ছে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক সাকাকে মুক্ত করার জন্য বিএনপি হরতাল ডেকেছে। এটা পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে গেছে। এর আগে সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার শর্তের মধ্যে সাকা চৌধুরীর মুক্তির দাবিটি যুক্ত করা হয়। তাতে বলা হয়, সাকাকে নিয়েই বিএনপি সংসদে যেতে চায়। এর অর্থ কী? তারা জেনেশুনে একজন যুদ্ধাপরাধীকে রক্ষার আন্দোলনে নেমেছে। এর আগে জামায়াত নেতাদের রক্ষায় বিএনপির নানা তৎপরতা দেখা গেছে।
এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা সোমবার সংসদে বলেছেন, বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বানচালের জন্য হরতাল ডেকেছে। এ হরতাল বিএনপির সুগভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।
ষড়যন্ত্র কি না জানি না। তবে এটা ঠিক, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাত্র ১০ দিন আগে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। এ হরতাল দেশের ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ সময় বিএনপির উচিত ছিল হরতাল প্রত্যাহার করে নেওয়া। তারা বলতে পারত, যেহেতু বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসছে, সেটা আয়োজনে যাতে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না হয় সে জন্য তারা হরতাল প্রত্যাহার করে নিয়েছে। একই সঙ্গে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার কথাও বিএনপি বলতে পারত। তাতে বিএনপি জনগণের বাহবা পেত।
সম্প্রতি পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে, সংসদে সদস্যপদ টেকাতে হলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে এবারের অধিবেশনে যোগ দিতে হবে। তিনি হয়তো সে কারণেই এক দিনের জন্য যাবেন। আবার চলে আসবেন। সংসদে যেতে যদি এতই অনাগ্রহ থাকে, তাহলে আর সদস্যপদ টিকিয়ে রেখে লাভ কী? তিনি পদত্যাগ করলেই পারেন! তা তো বিএনপির কেউ করবেন না। সুযোগ-সুবিধা সবই নেবেন, শুধু সংসদে যাবেন না!
সংসদ অধিবেশনের সুযোগ নিয়ে বিএনপি সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরতে পারত। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যা প্রভৃতি বিষয়ে কথা বলতে পারত। সেগুলো গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হতো। এতে সরকার চাপে থাকত। বিরোধী দলের এমন অবস্থা যে কখনো কখনো মনেই হয় না, দেশে কোনো বিরোধী দল আছে। এ দেশে যদি গণমাধ্যম না থাকত, তাহলে সরকারের সমালোচনা করারও কেউ থাকত না।
গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সব সময়ই বিরোধী দল ছায়া সরকার হিসেবে কাজ করে। জাতীয় ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দল ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বড় কোনো সংকট দেখা দিলে বিরোধী দল সরকারকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে যায়। আমাদের দেশে কাজ হয় উল্টো। সংকট হলে সরকার বিপদে পড়ে। তাতে বিরোধী দলের লাভ। সরকারি কাজের গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে সমালোচনার জন্য সমালোচনা করা হয়। এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। গণতন্ত্রকে সঠিক পথে রাখতে হলে সরকারকে সঠিক পথে রাখতে বিরোধী দলকে ভূমিকা পালন করতে হবে। গণতন্ত্র শুধু সরকারের চর্চার ব্যাপার নয়; বিরোধী দলকেও চর্চা করতে হবে।
বিরোধী দল শুধু গলাবাজি করবে, 'গণতন্ত্র গেল, গণতন্ত্র গেল' আর নিজেরা গণতন্ত্রচর্চার ধারেকাছেও থাকবে না, তা কী করে হয়! আমরা তো দেখছি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো চলে ব্যক্তির ইচ্ছায়। এখানে দুই নেত্রী যা বলেন তা-ই কার্যকর হয়। এখানে অন্য কারো মত প্রকাশের সুযোগ খুব একটা থাকে না। নেত্রীর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করলেই তাঁর রাজনীতি শেষ_কী অদ্ভুত একটা দেশ!
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যাঁরাই রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রচর্চার কথা বলেছিলেন তাঁরা এখন বেকার জীবন যাপন করছেন। রাজনীতি থেকে তাঁরা পুরোপুরি উচ্ছেদ। আর দুই নেত্রীর যাঁরা সমালোচনা করেছেন তাঁদের অবস্থা আরো করুণ। এ অবস্থা চলতে থাকলে গণতন্ত্র অগ্রসর হবে কিভাবে?
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি যে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন। বিগত পৌর নির্বাচনে সরকারি দলের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের জিততে হবে_এমন প্রবণতাও লক্ষ করা যায়নি। ইচ্ছা করলেই সরকারি দল প্রভাব বিস্তার করতে পারত। হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুটি আসনের উপনির্বাচনেও সরকারি দলের কোনো প্রভাব ছিল না। নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একটি আসন হারাতে হয়েছে। তার পরও আওয়ামী লীগপ্রধান নির্বাচনকে কলুষিত করতে দেননি। আর এতে আওয়ামী লীগ কিন্তু কিছুই হারায়নি; বরং বিজয়ী হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে দেশ আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে।
আমরা অতীতে দলীয় সরকারের অধীনে অনেক নির্বাচন দেখেছি। সেসব নির্বাচনে সরকারি দলের ন্যক্কারজনক ভূমিকা দেখেছি। কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাঙ্ ছিনতাই, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধাদান ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। এখন সে চিত্র পাল্টেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইতিবাচক মনোভাবের কারণে ক্ষমতাসীন দল বাড়াবাড়ি করতে পারেনি।
শেখ হাসিনার আরো একটি সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে হয়। আড়িয়াল বিলে বঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েও তা প্রত্যাহার করে নেন তিনি। কয়েক দিন আগে আমি দুটি টিভির আলোচনা অনুষ্ঠানে একটি কথাই বলেছিলাম, গণতান্ত্রিক সরকার কোনো জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আওয়ামী লীগও পারবে না। শেখ হাসিনা দেখেছেন, আড়িয়াল বিল এলাকার জনগণ বিমানবন্দর চায় না। তিনি জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এ কারণেই আমাদের আশা জাগে। এ দেশে গণতন্ত্র একদিন স্থায়ী ভিত্তি পাবে।
আমরা আশা করব, সরকার ও বিরোধী দল দেশের স্বার্থে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেবে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান, তা কাটিয়ে উঠতে হবে। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকে, রাজনৈতিক শত্রু নয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরকে শত্রু মনে করে। এটা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। এ কারণেই এখানে আন্তদলীয় সংঘাত বেশি হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু হলে বিএনপি খুশি হয়। আবার বিএনপির আমলে হলে আওয়ামী লীগ খুশি হয়। এ প্রবণতা বন্ধ না হলে দেশ কিছুতেই এগোবে না।
আমরা মনে করি, সবাই দেশকে ভালোবাসেন, দেশের মঙ্গল কামনা করেন। আসুন, সহিংসতার পথ পরিহার করে সবাই মিলে দেশটাকে গড়ে তুলি। দেশ না টিকলে কোনো রাজনীতিই কাজে আসবে না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.