দূরের দূরবীনে-আন্তর্জাতিকায়নের কাজ কবে শুরু হবে? by অজয় দাশগুপ্ত
বাঙালি নিঃসন্দেহে আবেগপ্রবণ এক জাতি। আবেগ সব সময় মন্দ কিছু, এমনও নয়। আবেগহীন জাতির ললাটে দুর্ভোগ বা লাঞ্ছনা যেমন কম, তেমনি তার জীবনও নিস্তরঙ্গ এক নদীর মতো। খুব দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা আমাদের মতোই ডাল-ভাত, মাছে-ভাতে মানুষ। পোশাক, আহার, ব্যবহার, সংস্কৃতিও অভিন্ন।
অথচ তাদের জীবনের উত্থান-পতন আমাদের মতো নয়। ভাষার কথাই ধরি না কেন। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি এক জগদ্দল পাথর। সেই পাথর ব্যক্তিজীবন-কর্মজীবন তো বটেই, এদের শিল্প-সংস্কৃতিকেও চাপা দিয়ে রেখেছে। ওই বঙ্গের টিভি শো থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত বাংলাকে অনায়াসে জগাখিচুড়ি বলে চিহ্নিত করা সম্ভব। রেডিও-টিভিতে দৃশ্যমান প্রায় সেলিব্রিটি গোছের এক তরুণী তার বন্ধুপ্রীতি বোঝাতে গিয়ে আমাকে জানাল : 'জানেন, ওর জন্যে আমার অনেক হামদর্দি আছে'। আমার তো মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা_হামদর্দ তো ঢাকার এক প্রাকৃতিক ওষুধ কম্পানি ও শরবতওয়ালাদের নাম; তাকে কবেই বিদায় দিয়েছি আমরা। আরো আছে_বিশাল বপুর এক স্বনামধন্যা গায়িকা জো জো। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কলকাতা নিউমার্কেটে। তার বাংলা শুনে হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। বরেণ্য এক বঙ্গদেশি বুদ্ধিজীবীর তরুণী বন্ধু ওই জো জো কথায় কথায় বলছিল, 'বাতচিত যেসা হ্যায় ভি নেহি, আমরা সবাই কিন্তু বাঙালি, গরব হওনা চাহিয়ে না।' আমার দৌড় রবীন্দ্রনাথ। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম, 'আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে।' পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি এর পরও ভাষা নিয়ে সংগ্রামে নামেনি, নামবেও না। বহুজাতিক ভারতে মিশ্র জাতিসত্তার মতো ভাষাকেও তারা সংমিশ্রণের হাতিয়ার বলে মেনে নিয়েছে।
আমরা নিইনি। নিইনি বলেই একুশে ফেব্রুয়ারি। সেই সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের দান সময় কখনো অপূর্ণ রাখেনি। আজ বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার মূল দায়িত্ব বর্তেছে আমাদের ওপর। বাংলাদেশই তার জাতিসংঘ স্বীকৃত অভিভাবক। বিশ্বব্যাপী অন্য ভাষার মানুষজনের চেতনা আর আবেগের উৎস আমরা। কেন? সংস্কৃতে একটি কথা আছে 'মুখং মারিতং জগতং', অর্থাৎ শুরু বাগাড়ম্বর আর কথায় দুনিয়া জয়। একুশে ফেব্রুয়ারি ঠিক তার উল্টোটি। সেখানে কথা বা বাক্য নিয়ে উচ্চাশা ছিল না, ছিল না প্রতিশ্রুতি আর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের বেদনা। ২৮ বছর আগে মুষ্টিমেয় সাহসী বাঙালি 'কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হয়ে উঠেছিলেন'। সেই কাজ যে কত বড়, যত সময় যাচ্ছে, ততই তা প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। তাঁদের আত্মত্যাগে শুধু ভাষা মুক্ত হলে সে হতো ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের ইতিহাস। মূলত সেই আত্মদান আরো অনেক বিস্তৃত, অনেক সুদূরপ্রসারী। তা-ই যদি না হবে, অস্ট্রেলিয়ার মতো আদিবাসীদের লুণ্ঠিত ভাষার দেশে আমাদের শহীদ মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে কোন সাহসে? কোন আনন্দে বিলাতের শহীদ আলতাফ আলী পার্কের মিনার হয় ইউরোপের ইতিহাস?
অলৌকিক ঘটনা প্রবাহ যুক্তিবাদীদের পছন্দ নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন যুক্তিবাদী মানুষ। অথচ কোনো এক তরুণীর হাতের কব্জিতে বাঁধা লাল সুতা আমার যুক্তিকে যখন খান খান করে ভেঙে দেয়, আমার অবিশ্বাস তখন হাওয়ায় ওড়া এক পায়রা। ঠিক তেমনি একুশের ইতিহাসকে দুনিয়াব্যাপী ফের অভিধা ও বিশেষণে প্রতিস্থাপিত করার জন্য নিবেদিত প্রবাসী বাঙালিদের নামগুলোকে কি লৌকিক মনে হয়? '৫২-এর একুশের অর্ধশতাব্দী পর আবার সালাম, রফিক। তাও যোজন যোজন দূরে বরফাবৃত আমেরিকা মহাদেশে? তাঁরাই তুলে আনলেন '৫২-এর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশ্ব স্বীকৃতি। ক্ষুদিরামের মৃত্যুকে নিয়ে গান বেঁধেছি আমরা 'দশ মাস দশ দিন পরে, জন্ম নেব মাসির ঘরে। তখন যদি চিনতে পারিস, চিনিস গলার ফাঁসি।' প্রশ্ন জাগে, এ কোন সালাম, এ কোন রফিক অথবা জব্বার?
অলৌকিক ইতিহাসের তীর্থভূমি বাংলাদেশ। মানুষগুলোকেই দেখুন না। সালমান রুশদির ভাষায়, ওইটুকু ছোট ছোট ক্ষুদ্র ও কালো মানুষ। তাতে কী? এরাই লাল হয়ে ওঠে, বৃক্ষের কৃষ্ণচূড়া পর্যন্ত লজ্জায় লাল হয়ে লুটিয়ে পড়ে বাঙালির শহীদ বেদিতে। আপাত রাগী ও ক্ষুব্ধ মনে হলেও বাংলাদেশিদের সম্বল আত্মসচেতনতা আর মর্যাদাবোধ। আমার ধারণা, এটা দুই বঙ্গেরও মৌল তফাৎ। এই যে বড় কাজ, বড় ইতিহাস ঘিরে গড়ে ওঠা বইমেলা ক্ষণজন্মা একুশের দীর্ঘ ফেব্রুয়ারি। এর উদ্দীপনা কি আমাদের জাতিকে আসলেই বড় করে তুলছে? আগেই বলে রাখি, চেতনা বা ইতিহাস এক বিষয়, তার শক্তি ও ব্যবহার অন্য। পৃথিবীতে ব্যবহার আর সঠিক উপযোগিতার অভাবে সমাজতন্ত্রের মতো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বিপ্লবও টেকেনি। আমরা তো কোন ছাড়। একুশের শক্তি কেবল একটি বইমেলা, আলোচনা, সেমিনার বা রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি নয়। সর্বতোভাবে বড় হয়ে ওঠার বিষয়টি আজও উপেক্ষিত।
কী ছিল বায়ান্নর মূল চাওয়া? নিজের ভাষা বাঁচানো তো অবশ্যই। ছিল, নিজেকে জানা, নিজের ডানা বিস্তারের অভিপ্রায়। অনেকে আগ্রাসন ও অনুপ্রবেশকে অন্য কিছুর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। উর্দু বা অন্য যেকোনো ভাষাকে আক্রমণ কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলার ব্যাপারটাই হাস্যকর। ধরুন মেহেদী হাসান, নূরজাহান; ধরুন খৈয়াম, কবি হাফিজ, আয়নে রশীদ, কবি ক্যাফে আজমী_উর্দু ছাড়া এঁদের বোঝা সম্ভব? এঁদের বোঝা বা অনুষ্ঠানে অসমর্থ মানুষকে আর যা-ই হোক সংস্কৃতি সমাজ বলতে পারি? পারি না। হিন্দি বা ফ্রেঞ্চ, আরবি কিংবা রুশ_কোনো ভাষার সঙ্গেই বিরোধ নেই বাংলার। থাকতে পারে না। যা থাকবে, তার নাম প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতার জন্য নিজের আগল খোলার কাজটি করছি না আমরা। বইমেলায় অন্য ভাষার পুস্তক খুব একটা চোখে পড়ে না। চোখে পড়লেও তার পরিচর্যা নেই। অথচ বাংলা নিয়ে আবেগসর্বস্ব বাংলাদেশ নিজেই অস্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের দেশে জ্ঞানী, পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও শিক্ষাবিদের অভাব নেই। আজকাল অর্থায়ন, অর্থের উৎসেরও অভাব দেখি না। অভাব উদ্যোগের। বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশক কাউন্টি বুকসের সংকলন গ্রন্থ 'স্পিচিসেস দ্যাট চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড' বইটি পড়ছিলাম। দুনিয়া বদলে দেওয়া শতাধিক বক্তৃতার অনবদ্য সংকলন, ধর্মবিজ্ঞান, দেশপ্রেম, মানবিকতা, রাজনীতি নানা বিষয়ে বিশ্বশ্রেষ্ঠ উক্তি ও বক্তৃতার নির্যাসে ভরা সংকলন। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায়ী ভাষণ; সাঁধীজীর বক্তৃতা; রুজভেল্ট, লেনিন, চার্চিল, ম্যান্ডেলা, এমনকি হিটলারও আছেন এতে। রাজনীতি বিষয়ে অনেক বক্তৃতা বা উক্তি বঙ্গবন্ধুর মতোই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কাছে নগণ্য এবং তুচ্ছ। কিন্তু তিনি নেই। না থাকার কারণ তিনি বা তাঁর ভাষণ নয়, কারণ আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পেঁৗছতে জানি না। আমাদের এত হম্বিতম্বি সব ভূখণ্ডের ভেতর। নিজেদের নিয়ে, নিজেদের ছায়াশত্রু বানিয়ে লড়াইরত জাতি উদার দিগন্তে পেঁৗছতে পারবে কোন দুঃখে?
বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকায়ন তো দূরের কথা, ভাষাকে জনগণের দুয়ারে পেঁৗছানোর মৌল কাজটি কি হয়েছে? একটি উদাহরণ দিয়েই শেষ করব। চেকস্লোভাকিয়া নামের পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি এখন দুইটি দেশ_চেক ও স্লোভাক। চেক প্রজাতন্ত্রের আয়তন আমাদের চেয়ে কম। জনসংখ্যা ১৬ ভাগের ১ ভাগ_এক কোটি সাত লাখের মতো। সেই দেশটির এক চিকিৎসক বলছিলেন, 'আশ্চর্য কি জানো! তোমরা ভাষা নিয়ে গর্ব কর, প্রাণ দিয়ে ইতিহাস তৈরি করেছ। সবই ঠিক আছে। অথচ তোমাদের ভাষার চর্চা নেই।' আমি ভাবি, বলে কি লোকটা? প্রশ্ন করি, 'কেন, কিভাবে তা মনে হলো তোমার?' উত্তর দেন, "চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা অন্য যেকোনো শাস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে তৈরি হওয়ার মতো বাংলা কিতাব আছে তোমাদের? আমাদের দেশের জনসংখ্যা দেখ। তার পরও 'ইউ নেইম ইট', আমরা চেক ভাষার সেই বই বের করে দেখিয়ে দিতে পারব।" না, নেই আমাদের। আবেগ আছে, অনুভূতি আছে, সেমিনার আছে, কিন্তু লিখিত পুস্তক নেই। ব্যাকরণ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র, অণু-পরমাণু থেকে দালান-কোঠা নির্মাণ, আইন থেকে উড্ডয়নবিদ্যা_স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলা বই নেই। একুশের অঙ্গীকার কি তাই? শুধু বইমেলা আর ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তির বাইরে একুশের অর্জন এবং মাতৃভাষা দিবস নিয়ে উদ্দীপ্ত প্রবাসীদেরও আগ্রহ নেই এতে। তাঁরা ব্যস্ত মিনার, সৌধ নির্মাণ আর সংগঠন নিয়ে। অথচ ফেব্রুয়ারি আছে, ভাষাসৈনিক আছে, চেতনাও আছে দাঁড়িয়ে। কবে শুরু হবে আন্তর্জাতিকায়নের কাজ? কত দিনে?
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com
আমরা নিইনি। নিইনি বলেই একুশে ফেব্রুয়ারি। সেই সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের দান সময় কখনো অপূর্ণ রাখেনি। আজ বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার মূল দায়িত্ব বর্তেছে আমাদের ওপর। বাংলাদেশই তার জাতিসংঘ স্বীকৃত অভিভাবক। বিশ্বব্যাপী অন্য ভাষার মানুষজনের চেতনা আর আবেগের উৎস আমরা। কেন? সংস্কৃতে একটি কথা আছে 'মুখং মারিতং জগতং', অর্থাৎ শুরু বাগাড়ম্বর আর কথায় দুনিয়া জয়। একুশে ফেব্রুয়ারি ঠিক তার উল্টোটি। সেখানে কথা বা বাক্য নিয়ে উচ্চাশা ছিল না, ছিল না প্রতিশ্রুতি আর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের বেদনা। ২৮ বছর আগে মুষ্টিমেয় সাহসী বাঙালি 'কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হয়ে উঠেছিলেন'। সেই কাজ যে কত বড়, যত সময় যাচ্ছে, ততই তা প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। তাঁদের আত্মত্যাগে শুধু ভাষা মুক্ত হলে সে হতো ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের ইতিহাস। মূলত সেই আত্মদান আরো অনেক বিস্তৃত, অনেক সুদূরপ্রসারী। তা-ই যদি না হবে, অস্ট্রেলিয়ার মতো আদিবাসীদের লুণ্ঠিত ভাষার দেশে আমাদের শহীদ মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে কোন সাহসে? কোন আনন্দে বিলাতের শহীদ আলতাফ আলী পার্কের মিনার হয় ইউরোপের ইতিহাস?
অলৌকিক ঘটনা প্রবাহ যুক্তিবাদীদের পছন্দ নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন যুক্তিবাদী মানুষ। অথচ কোনো এক তরুণীর হাতের কব্জিতে বাঁধা লাল সুতা আমার যুক্তিকে যখন খান খান করে ভেঙে দেয়, আমার অবিশ্বাস তখন হাওয়ায় ওড়া এক পায়রা। ঠিক তেমনি একুশের ইতিহাসকে দুনিয়াব্যাপী ফের অভিধা ও বিশেষণে প্রতিস্থাপিত করার জন্য নিবেদিত প্রবাসী বাঙালিদের নামগুলোকে কি লৌকিক মনে হয়? '৫২-এর একুশের অর্ধশতাব্দী পর আবার সালাম, রফিক। তাও যোজন যোজন দূরে বরফাবৃত আমেরিকা মহাদেশে? তাঁরাই তুলে আনলেন '৫২-এর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশ্ব স্বীকৃতি। ক্ষুদিরামের মৃত্যুকে নিয়ে গান বেঁধেছি আমরা 'দশ মাস দশ দিন পরে, জন্ম নেব মাসির ঘরে। তখন যদি চিনতে পারিস, চিনিস গলার ফাঁসি।' প্রশ্ন জাগে, এ কোন সালাম, এ কোন রফিক অথবা জব্বার?
অলৌকিক ইতিহাসের তীর্থভূমি বাংলাদেশ। মানুষগুলোকেই দেখুন না। সালমান রুশদির ভাষায়, ওইটুকু ছোট ছোট ক্ষুদ্র ও কালো মানুষ। তাতে কী? এরাই লাল হয়ে ওঠে, বৃক্ষের কৃষ্ণচূড়া পর্যন্ত লজ্জায় লাল হয়ে লুটিয়ে পড়ে বাঙালির শহীদ বেদিতে। আপাত রাগী ও ক্ষুব্ধ মনে হলেও বাংলাদেশিদের সম্বল আত্মসচেতনতা আর মর্যাদাবোধ। আমার ধারণা, এটা দুই বঙ্গেরও মৌল তফাৎ। এই যে বড় কাজ, বড় ইতিহাস ঘিরে গড়ে ওঠা বইমেলা ক্ষণজন্মা একুশের দীর্ঘ ফেব্রুয়ারি। এর উদ্দীপনা কি আমাদের জাতিকে আসলেই বড় করে তুলছে? আগেই বলে রাখি, চেতনা বা ইতিহাস এক বিষয়, তার শক্তি ও ব্যবহার অন্য। পৃথিবীতে ব্যবহার আর সঠিক উপযোগিতার অভাবে সমাজতন্ত্রের মতো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বিপ্লবও টেকেনি। আমরা তো কোন ছাড়। একুশের শক্তি কেবল একটি বইমেলা, আলোচনা, সেমিনার বা রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি নয়। সর্বতোভাবে বড় হয়ে ওঠার বিষয়টি আজও উপেক্ষিত।
কী ছিল বায়ান্নর মূল চাওয়া? নিজের ভাষা বাঁচানো তো অবশ্যই। ছিল, নিজেকে জানা, নিজের ডানা বিস্তারের অভিপ্রায়। অনেকে আগ্রাসন ও অনুপ্রবেশকে অন্য কিছুর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। উর্দু বা অন্য যেকোনো ভাষাকে আক্রমণ কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলার ব্যাপারটাই হাস্যকর। ধরুন মেহেদী হাসান, নূরজাহান; ধরুন খৈয়াম, কবি হাফিজ, আয়নে রশীদ, কবি ক্যাফে আজমী_উর্দু ছাড়া এঁদের বোঝা সম্ভব? এঁদের বোঝা বা অনুষ্ঠানে অসমর্থ মানুষকে আর যা-ই হোক সংস্কৃতি সমাজ বলতে পারি? পারি না। হিন্দি বা ফ্রেঞ্চ, আরবি কিংবা রুশ_কোনো ভাষার সঙ্গেই বিরোধ নেই বাংলার। থাকতে পারে না। যা থাকবে, তার নাম প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতার জন্য নিজের আগল খোলার কাজটি করছি না আমরা। বইমেলায় অন্য ভাষার পুস্তক খুব একটা চোখে পড়ে না। চোখে পড়লেও তার পরিচর্যা নেই। অথচ বাংলা নিয়ে আবেগসর্বস্ব বাংলাদেশ নিজেই অস্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের দেশে জ্ঞানী, পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও শিক্ষাবিদের অভাব নেই। আজকাল অর্থায়ন, অর্থের উৎসেরও অভাব দেখি না। অভাব উদ্যোগের। বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশক কাউন্টি বুকসের সংকলন গ্রন্থ 'স্পিচিসেস দ্যাট চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড' বইটি পড়ছিলাম। দুনিয়া বদলে দেওয়া শতাধিক বক্তৃতার অনবদ্য সংকলন, ধর্মবিজ্ঞান, দেশপ্রেম, মানবিকতা, রাজনীতি নানা বিষয়ে বিশ্বশ্রেষ্ঠ উক্তি ও বক্তৃতার নির্যাসে ভরা সংকলন। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায়ী ভাষণ; সাঁধীজীর বক্তৃতা; রুজভেল্ট, লেনিন, চার্চিল, ম্যান্ডেলা, এমনকি হিটলারও আছেন এতে। রাজনীতি বিষয়ে অনেক বক্তৃতা বা উক্তি বঙ্গবন্ধুর মতোই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কাছে নগণ্য এবং তুচ্ছ। কিন্তু তিনি নেই। না থাকার কারণ তিনি বা তাঁর ভাষণ নয়, কারণ আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পেঁৗছতে জানি না। আমাদের এত হম্বিতম্বি সব ভূখণ্ডের ভেতর। নিজেদের নিয়ে, নিজেদের ছায়াশত্রু বানিয়ে লড়াইরত জাতি উদার দিগন্তে পেঁৗছতে পারবে কোন দুঃখে?
বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকায়ন তো দূরের কথা, ভাষাকে জনগণের দুয়ারে পেঁৗছানোর মৌল কাজটি কি হয়েছে? একটি উদাহরণ দিয়েই শেষ করব। চেকস্লোভাকিয়া নামের পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি এখন দুইটি দেশ_চেক ও স্লোভাক। চেক প্রজাতন্ত্রের আয়তন আমাদের চেয়ে কম। জনসংখ্যা ১৬ ভাগের ১ ভাগ_এক কোটি সাত লাখের মতো। সেই দেশটির এক চিকিৎসক বলছিলেন, 'আশ্চর্য কি জানো! তোমরা ভাষা নিয়ে গর্ব কর, প্রাণ দিয়ে ইতিহাস তৈরি করেছ। সবই ঠিক আছে। অথচ তোমাদের ভাষার চর্চা নেই।' আমি ভাবি, বলে কি লোকটা? প্রশ্ন করি, 'কেন, কিভাবে তা মনে হলো তোমার?' উত্তর দেন, "চিকিৎসাবিজ্ঞান কিংবা অন্য যেকোনো শাস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে তৈরি হওয়ার মতো বাংলা কিতাব আছে তোমাদের? আমাদের দেশের জনসংখ্যা দেখ। তার পরও 'ইউ নেইম ইট', আমরা চেক ভাষার সেই বই বের করে দেখিয়ে দিতে পারব।" না, নেই আমাদের। আবেগ আছে, অনুভূতি আছে, সেমিনার আছে, কিন্তু লিখিত পুস্তক নেই। ব্যাকরণ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র, অণু-পরমাণু থেকে দালান-কোঠা নির্মাণ, আইন থেকে উড্ডয়নবিদ্যা_স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলা বই নেই। একুশের অঙ্গীকার কি তাই? শুধু বইমেলা আর ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তির বাইরে একুশের অর্জন এবং মাতৃভাষা দিবস নিয়ে উদ্দীপ্ত প্রবাসীদেরও আগ্রহ নেই এতে। তাঁরা ব্যস্ত মিনার, সৌধ নির্মাণ আর সংগঠন নিয়ে। অথচ ফেব্রুয়ারি আছে, ভাষাসৈনিক আছে, চেতনাও আছে দাঁড়িয়ে। কবে শুরু হবে আন্তর্জাতিকায়নের কাজ? কত দিনে?
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com
No comments