দক্ষিণ এশিয়া-রাজনৈতিক অচলাবস্থায় নেপাল by জ্ঞান বাসনেত
প্রায় এক মাস হলো নেপালের সংবিধান সভা বিলুপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও কাটার কোনো লক্ষণ নেই। গৃহযুদ্ধের অবসানে ২০০৬ সালে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তির পরে দেশটি এখন আবার গভীর সংকটে পড়েছে।
রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের জন্য নেতারা প্রায় কিছুই করেননি।
রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের জন্য নেতারা প্রায় কিছুই করেননি।
সংবিধান সভার ব্যর্থতার জন্য তাঁরা কেবল একে অন্যকে দুষে গেছেন। লজ্জার বিষয়, এখন তাঁরা রাজপথে শক্তি দেখানোয় মেতেছেন। অথচ দরকার ছিল আলোচনায় বসে সমাধানের রাস্তা খুঁজে বের করা।
দলগুলো দৃশ্যত গণতন্ত্রের প্রথম উপাদানটির কথাই ভুলে গেছেন, সমাজের ভিন্ন ভিন্ন অংশের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে একটি সাধারণ ও ন্যায্য পথ রচনা করা। সংবিধান সভার দুঃখজনক বিলুপ্তি একটি চিত্তচাঞ্চল্যকর প্রশ্ন সামনে আনছে: কোথাও কি আছে কোনো সমাধান? কীভাবে নেপাল চলতি সংকট থেকে মুক্ত হবে? সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধানে কি পৌঁছতে পারবে দেশটি?
সংকট থেকে বেরিয়ে আসায় বেশ কিছু প্রস্তাব এসেছে। কেউ কেউ বিলুপ্ত সংবিধান সভা পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব আনছেন। অন্যরা প্রেসিডেন্ট রামবরণ যাদবের হস্তক্ষেপ আশা করছেন—এমনকি সংসদের ক্ষমতাও নিয়ে নেওয়ার কথা তুলছেন। আমি এই দুটো মতেরই ঘোরতর বিরোধী। সংবিধান সভা পুনরুজ্জীবিত করায় বাস্তবত কোনো ফায়দা নেই। আইনগত ও সংবিধানগতভাবে এটা করা জটিল এবং রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী। এই কাজের কোনো গণতান্ত্রিক ভিত্তি নেই এবং উল্টো পথে হাঁটার সময়ও নেই। রাষ্ট্রপতির ভূমিকাও আনুষ্ঠানিকতার বেশি হওয়া উচিত নয়। তাঁর কাজ হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় কাজ করা, ক্ষমতা প্রয়োগ করা নয়।
রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে সুযোগ এসেছে দেশের জন্য ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়ার। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আবার তাদের জনগণের দুয়ারে টোকা দেওয়ার সময় এসেছে। এ দেশটার জন্য এখন নতুন একটি সংসদীয় নির্বাচনই সবচেয়ে ভালো ও গণতান্ত্রিক পথ।
কেবল নির্বাচনের জন্য নির্বাচন করলেই হবে না। প্রথমত, সংস্কার বিষয়ে নেপালে ব্যাপকভিত্তিক জনমত গঠন করা দরকার। পাশাপাশি ভবিষ্যতে নির্বাচিত সংস্থার কার্যাবলি ও দায়িত্বও নির্ধারণ করতে হবে। সে কারণে সংসদীয় নির্বাচনের পাশাপাশি, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর ব্যাপারেও একটা আলাদা ব্যালট পেপার থাকতে পারে, যেমন: ফেডারেলিজম, প্রদেশের অবস্থান এবং সরকার পরিচালনার নীতি।
নতুন এই জনমত যাচাই হতে পারে দেশকে রাজনৈতিক রূপান্তরের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। ‘গতানুগতিক রাজনীতি’ কোনোভাবেই আর নেপালে কোনো কাজ করবে না। আবার গোড়া থেকে শুরু করা অর্থাৎ সংবিধান সভা পুনরুজ্জীবিত করাও সম্ভব নয়। একটি নির্বাচনের পর সমঝোতামুখী রাজনৈতিক সংলাপই হলো জনগণের মধ্যে, জনগণ ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু করার বৈধ উপায়।
এই নির্বাচনের মাধ্যমেই জানা সম্ভব যে এ মুহূর্তে নেপালি জনগণ আসলে কী চায়। কেননা, গত চার বছরে কিন্তু কোনো নির্বাচন হয়নি। এ সময়ের মধ্যে নিশ্চয়ই জনগণের চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রয়োজন বদলেছে। তাই এখনই সময় জনগণের নিজের কথা বলার।
বুদ্ধিজীবী সমাজ, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজকে গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে। দেশ পরিচালনার অনিয়ম বিষয়ে তাঁদেরই নজরদারি করার কথা। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের অসংগতির ব্যাপারে তাঁরাই তো সোচ্চার হবেন। এই এলিট সমাজেরই কাজ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা। কিন্তু খুবই শোচনীয় ব্যাপার হলো, নেপালে এই গোষ্ঠীগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। সবদিক দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা দলীয় রাজনৈতিক যন্ত্রের কাছে নিজেদের চিন্তা-চেতনা, বিবেক-বুদ্ধি সব সঁপে দিয়েছেন। তাঁরা দলীয় রাজনীতির দাস বনে গেছেন। নিজ নিজ দলের হয়ে ওকালতি করাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান।
ক্ষমতা যেখানে জনগণের হাতে থাকার কথা, সেখানে নেপালে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক এলিটদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আইনের শাসনকে জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতিই যেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম। স্বার্থবুদ্ধি ও দলবাজির জায়গায় এখনই তাই বিবেকচালিত মূল্যবোধের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের উচিত, দলীয় রাজনীতির গ্রাস থেকে নিজেদের বের করে আনা। এর মাধ্যমে তাঁরাই হতে পারেন গঠনমূলক পথপ্রদর্শক ও নিরপেক্ষ সমালোচক। তাঁদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, পৌনে তিন কোটি নেপালিকে সক্রিয় নাগরিক হিসেবে দেশগঠনের কাজে জড়িত হতে উৎসাহিত করা।
রাজনীতি তখনই সুষ্ঠু সমাধানের রাস্তায় হাঁটবে, যখন এসব সাধারণ নেপালি নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করবেন এবং অধিকারের রক্ষক হিসেবে নিজেদের ভাববেন। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে তাঁদের আরও সক্রিয় হয়ে ওঠার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সত্যিকার গণতন্ত্রের চাবিকাঠি।
জনগণকেও প্রমাণ করতে হবে, তাঁরা কেবল দলগুলোর অন্ধ সমর্থক নন। তাঁরা নিছক ভোটার নন। তাঁরাই দেশের সত্যিকার পথপ্রদর্শক। সম্মিলিতভাবে জনগণকে দেশ পরিচালনার নীতিগুলো এবং সেগুলোর দুর্বলতা বিষয়ে সচেতন হতে হবে। জনসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদেরও মতামত দেওয়ার মতো বুঝমান হতে হবে এবং দাঁড়াতে হবে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে। সে জন্য এখনই দরকার একটি সংসদীয় নির্বাচন, এর মাধ্যমেই বেরিয়ে আসতে হবে চলমান অচলাবস্থা থেকে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, সংক্ষেপিত অনুবাদ
জ্ঞান বাসনেত: গবেষক, ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য। নেপালের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
দলগুলো দৃশ্যত গণতন্ত্রের প্রথম উপাদানটির কথাই ভুলে গেছেন, সমাজের ভিন্ন ভিন্ন অংশের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে একটি সাধারণ ও ন্যায্য পথ রচনা করা। সংবিধান সভার দুঃখজনক বিলুপ্তি একটি চিত্তচাঞ্চল্যকর প্রশ্ন সামনে আনছে: কোথাও কি আছে কোনো সমাধান? কীভাবে নেপাল চলতি সংকট থেকে মুক্ত হবে? সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধানে কি পৌঁছতে পারবে দেশটি?
সংকট থেকে বেরিয়ে আসায় বেশ কিছু প্রস্তাব এসেছে। কেউ কেউ বিলুপ্ত সংবিধান সভা পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব আনছেন। অন্যরা প্রেসিডেন্ট রামবরণ যাদবের হস্তক্ষেপ আশা করছেন—এমনকি সংসদের ক্ষমতাও নিয়ে নেওয়ার কথা তুলছেন। আমি এই দুটো মতেরই ঘোরতর বিরোধী। সংবিধান সভা পুনরুজ্জীবিত করায় বাস্তবত কোনো ফায়দা নেই। আইনগত ও সংবিধানগতভাবে এটা করা জটিল এবং রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী। এই কাজের কোনো গণতান্ত্রিক ভিত্তি নেই এবং উল্টো পথে হাঁটার সময়ও নেই। রাষ্ট্রপতির ভূমিকাও আনুষ্ঠানিকতার বেশি হওয়া উচিত নয়। তাঁর কাজ হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় কাজ করা, ক্ষমতা প্রয়োগ করা নয়।
রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে সুযোগ এসেছে দেশের জন্য ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়ার। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আবার তাদের জনগণের দুয়ারে টোকা দেওয়ার সময় এসেছে। এ দেশটার জন্য এখন নতুন একটি সংসদীয় নির্বাচনই সবচেয়ে ভালো ও গণতান্ত্রিক পথ।
কেবল নির্বাচনের জন্য নির্বাচন করলেই হবে না। প্রথমত, সংস্কার বিষয়ে নেপালে ব্যাপকভিত্তিক জনমত গঠন করা দরকার। পাশাপাশি ভবিষ্যতে নির্বাচিত সংস্থার কার্যাবলি ও দায়িত্বও নির্ধারণ করতে হবে। সে কারণে সংসদীয় নির্বাচনের পাশাপাশি, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর ব্যাপারেও একটা আলাদা ব্যালট পেপার থাকতে পারে, যেমন: ফেডারেলিজম, প্রদেশের অবস্থান এবং সরকার পরিচালনার নীতি।
নতুন এই জনমত যাচাই হতে পারে দেশকে রাজনৈতিক রূপান্তরের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। ‘গতানুগতিক রাজনীতি’ কোনোভাবেই আর নেপালে কোনো কাজ করবে না। আবার গোড়া থেকে শুরু করা অর্থাৎ সংবিধান সভা পুনরুজ্জীবিত করাও সম্ভব নয়। একটি নির্বাচনের পর সমঝোতামুখী রাজনৈতিক সংলাপই হলো জনগণের মধ্যে, জনগণ ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু করার বৈধ উপায়।
এই নির্বাচনের মাধ্যমেই জানা সম্ভব যে এ মুহূর্তে নেপালি জনগণ আসলে কী চায়। কেননা, গত চার বছরে কিন্তু কোনো নির্বাচন হয়নি। এ সময়ের মধ্যে নিশ্চয়ই জনগণের চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রয়োজন বদলেছে। তাই এখনই সময় জনগণের নিজের কথা বলার।
বুদ্ধিজীবী সমাজ, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজকে গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে। দেশ পরিচালনার অনিয়ম বিষয়ে তাঁদেরই নজরদারি করার কথা। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের অসংগতির ব্যাপারে তাঁরাই তো সোচ্চার হবেন। এই এলিট সমাজেরই কাজ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা। কিন্তু খুবই শোচনীয় ব্যাপার হলো, নেপালে এই গোষ্ঠীগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। সবদিক দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা দলীয় রাজনৈতিক যন্ত্রের কাছে নিজেদের চিন্তা-চেতনা, বিবেক-বুদ্ধি সব সঁপে দিয়েছেন। তাঁরা দলীয় রাজনীতির দাস বনে গেছেন। নিজ নিজ দলের হয়ে ওকালতি করাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান।
ক্ষমতা যেখানে জনগণের হাতে থাকার কথা, সেখানে নেপালে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক এলিটদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আইনের শাসনকে জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতিই যেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম। স্বার্থবুদ্ধি ও দলবাজির জায়গায় এখনই তাই বিবেকচালিত মূল্যবোধের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের উচিত, দলীয় রাজনীতির গ্রাস থেকে নিজেদের বের করে আনা। এর মাধ্যমে তাঁরাই হতে পারেন গঠনমূলক পথপ্রদর্শক ও নিরপেক্ষ সমালোচক। তাঁদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, পৌনে তিন কোটি নেপালিকে সক্রিয় নাগরিক হিসেবে দেশগঠনের কাজে জড়িত হতে উৎসাহিত করা।
রাজনীতি তখনই সুষ্ঠু সমাধানের রাস্তায় হাঁটবে, যখন এসব সাধারণ নেপালি নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করবেন এবং অধিকারের রক্ষক হিসেবে নিজেদের ভাববেন। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে তাঁদের আরও সক্রিয় হয়ে ওঠার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সত্যিকার গণতন্ত্রের চাবিকাঠি।
জনগণকেও প্রমাণ করতে হবে, তাঁরা কেবল দলগুলোর অন্ধ সমর্থক নন। তাঁরা নিছক ভোটার নন। তাঁরাই দেশের সত্যিকার পথপ্রদর্শক। সম্মিলিতভাবে জনগণকে দেশ পরিচালনার নীতিগুলো এবং সেগুলোর দুর্বলতা বিষয়ে সচেতন হতে হবে। জনসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদেরও মতামত দেওয়ার মতো বুঝমান হতে হবে এবং দাঁড়াতে হবে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে। সে জন্য এখনই দরকার একটি সংসদীয় নির্বাচন, এর মাধ্যমেই বেরিয়ে আসতে হবে চলমান অচলাবস্থা থেকে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, সংক্ষেপিত অনুবাদ
জ্ঞান বাসনেত: গবেষক, ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য। নেপালের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
No comments