স্মরণ-ডা. খালেক : চিকিৎসাক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় একটি নাম
চিকিৎসাসেবা, শিক্ষাদান ও মানবসেবাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে দেশের যে কয়জন চিকিৎসাবিদ বরেণ্য-প্রয়াত অধ্যাপক ডা. এম এ খালেক তাঁদের অন্যতম। বিশ্বস্বীকৃত সর্বোচ্চ সম্মানজনক চিকিৎসা ডিগ্রি নিয়েও দেশ, মাটি ও এলাকার মায়ায় তিনি বিশ্বের নামিদামি মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির লোভনীয় অফার উপেক্ষা করেন।
সুশৃঙ্খল ও সহজ-সরল জীবনাচারে অভ্যস্ত এ গুণী ব্যক্তিটি প্রচারবিমুখ ছিলেন। সিলেট বিভাগে চিকিৎসাক্ষেত্রে ডা. খালেক তাই অবিস্মরণীয় একটি নাম। ডা. খালেক ১৯৩১ সালের ১ মার্চ হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক আবদুল বারী, মা ছুরতুন্নেছা। ছাত্রজীবন থেকেই মেধাবী ও মিতভাষী এ গুণী ১৯৪৭ সালে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ডা. খালেক ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান। সেখানেও তিনি তাঁর মেধার অনন্য স্বাক্ষর রেখে বাঙালিকে গর্বিত করেন। ১৯৬৪, ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে পরপর তিন বছরে 'রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস' (গ্লাসগো) ও (এডিনবরা) থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশ্বস্বীকৃত সর্বোচ্চ সম্মানজনক ডিগ্রি এফআরসিপি অর্জন করেন। ওই প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, প্রয়াত অধ্যাপক ডা. খালেকই প্রথম বাঙালি, যিনি ট্রিপল এফআরসিপি। এর পর তিনি দেশে চলে আসেন। মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন আইপিজিএমআরে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) ১৯৬৬ সালে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক থাকাকালীন (একই বছরে বদলিজনিত কারণে সিলেট মেডিক্যাল কলেজে আসার পর) চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮৩ সালে 'রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস' (গ্লাসগো) তাঁকে সম্মানসূচক এফআরসিপি ডিগ্রি প্রদান করে। পরে ১৯৮৬ সালেও একই ডিগ্রি পান এডিনবরা থেকে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও পরিচালকের গুরুদায়িত্বও তিনি পালন করেন। অবসর জীবনে কর্মপাগল এ গুণী চিকিৎসক চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি নিজেকে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নিয়োজিত করেন। তাঁর উদ্যোগেই সিলেট শহরে প্রথম 'সিটিস্ক্যান' স্থাপন করা হয়। সিলেটের প্রথম ও একমাত্র উইমেনস মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষও ছিলেন প্রয়াত এ চিকিৎসাবিদ। স্পষ্টবাদী অধ্যাপক ডা. খালেক কোনো অনিয়মের সঙ্গে আপস করতেন না। সিলেট বিভাগের চিকিৎসক কমিউনিটির অভিভাবক হিসেবে তিনি ছিলেন সবার মধ্যমণি ও শ্রদ্ধার পাত্র। ডা. খালেকের রোগী পরীক্ষার স্টাইলও ছিল ব্যতিক্রম। দেশ-বিদেশের নামিদামি ডাক্তার দেখিয়ে, গাদা গাদা ওষুধ সেবন করে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই তাঁর শরণাপন্ন হতেন। তিনি সামান্য ব্যবস্থাপত্র দিয়ে রোগীদের সুস্থ করে তুলতেন। তাই তাঁর চিকিৎসাসেবা সিলেট অঞ্চলে 'মিথ' পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ডা. খালেককে অনেক রোগীই বদমেজাজি বলে ভয় পেত। আসলে সে ধারণা ছিল ভুল। ব্যক্তিজীবনে অধ্যাপক খালেক ছিলেন বিশাল হৃদয়ের এক পরোপকারী, নির্লোভ মানুষ। সিলেট তথা বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার কিংবদন্তি পুরুষ অধ্যাপক ডা. এম এ খালেক ২০০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। পরিণত বয়সে তাঁর মৃত্যু হলেও তাঁর জীবনাচার, কর্মস্পৃহা, দেশপ্রেম ও আদর্শ আমাদের প্রেরণা। মাসুক মসলন্দ
No comments