বিচারালয়ের দুর্নীতি তদন্তে নেমেছে দুদক by আশরাফ-উল-আলম ও মোশতাক আহমদ

অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি অনুসন্ধানে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে অনেকের বিরুদ্ধেই দুদক অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য খুঁজে পেয়েছে। অনুসন্ধান চলছে। বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশেই দুদক মাঠে নেমেছে বলে জানা গেছে।


ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জরিপে বিচারালয়ে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ উঠে আসার পর বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে দুদককে বলা হয়। এর পর থেকে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে দুদক। তবে কতজনের বিরুদ্ধে, তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তদন্ত অব্যাহত থাকবে। অভিযোগ প্রমানিত হলে দুদক আইনগত ব্যবস্থাও নেবে। তিনি আরো বলেন, দুদক দেশের যেকোনো নাগরিকের বিরুদ্ধেই তদন্ত করতে পারে। তাই আদালতের সাবেক বিচারপতিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে বাধা নেই। সাবেক কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধেও দুদক ব্যবস্থা নিয়েছে ও নিচ্ছে।
জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (অবসরকালীন ছুটিতে) মো. গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ১৪ জুন দুদক রাজধানীর রমনা মডেল থানায় এ মামলা দায়ের করে। দুদকের উপপরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদার বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। দুদক আইনের ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারায় দায়ের করা এ মামলায় অবৈধ সম্পদ অর্জনে সহযোগিতা করার অভিযোগে গোলাম ফারুকের দ্বিতীয় স্ত্রী সৈয়দা মমতাজকেও আসামি করা হয়েছে। মামলাটি এখন তদন্তাধীন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, গোলাম ফারুক স্বনামে/বেনামে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক বলে দুদকের অনুসন্ধানে জানা যায়। ২০১১ সালের ১৮ এপ্রিল দুদক গোলাম ফারুকের সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে নির্দেশ দেয়। একই বছরের ২২ মে সুপ্রিম কোর্টের এই প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিজের ও তাঁর স্ত্রীর সম্পদের তথ্য দুদকে জমা দেন। সম্পদের তথ্য বিবরণী থেকে দেখা যায়, গোলাম ফারুক ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী সৈয়দা মমতাজের নামে ৬১ লাখ টাকার জমি এবং মমতাজের নামে ঢাকার রায়েরবাজার সিকদার রিয়েল এস্টেটে আড়াই কাঠা জমির ওপর ছয়তলা ভবন রয়েছে। রায়েরবাজার ও আদাবরে গোলাম ফারুক ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে মোট সাড়ে ১৭ কাঠা জমি রয়েছে। দাখিল করা হিসাবমতে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় এক কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তবে দুদক অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছে, গোলাম ফারুক ৭৩ লাখ টাকার বেশি মূল্যের সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়।
এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ঘুষ-দুর্নীতি করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়ে ২০০৯ সালে দুদক সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ অফিসার এহতেশামের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। ২০১০ সালের ১৮ জুলাই দুদক তাঁকে সম্পদের হিসাব দেওয়ার নোটিশ দেয়। ওই বছরের ৫ আগস্ট তিনি সম্পদের হিসাব জমা দেন। দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তিনি স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে সম্পদের হিসাব দেন ৪২ লাখ ৫০ হাজার ২০৭ টাকার। পরবর্তী সময়ে দুদক তাঁর হিসাব যাচাই-বাছাই করে ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৯৮১ টাকার বৈধ কোনো উৎস খুঁজে পায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে কমিশনে।
সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দুর্নীতির বিষয়ে দীর্ঘদিন আগে অনুসন্ধানকাজ শুরু করে দুদক। দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ অনুসন্ধান শেষে ইতিমধ্যে কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করেছেন। এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন অধিকতর তথ্য জানতে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের সঙ্গেও চিঠিপত্র আদান-প্রদান করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এই বিচারকের ৮০ লাখ টাকা ছিল বলে জানা যায়। এ ছাড়া দামি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে তাঁর। দুদকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তাঁর যেসব সম্পদ অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর উৎস হিসেবে তিনি তাঁর প্রবাসী ছেলের কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
৩১ লাখ ১০ হাজার ৪০০ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক ও তাঁর স্ত্রী চমন আরা হকের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ১৮ মে রাজধানীর রমনা মডেল থানায় দুদক মামলা দায়ের করে। দীর্ঘ পাঁচ মাস তদন্ত শেষে বিচারপতি দম্পতিকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলার চার্জশিটও দাখিল করে কমিশন।
দুদক জানায়, ২০০৯ সালের শেষের দিকে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ ও দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আসে কমিশনে। কমিশন তাঁকে সম্পদের হিসাব দেওয়ার নোটিশ দেয়। দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তিনি জানান, নিজ গ্রাম সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সুবর্ণসারা এলাকায় তাঁর নামে পৈতৃক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটি টিনশেড বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর স্ত্রীর নামে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় স্বাধীনতা সরণির পাশে পাঁচতলা একটি বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো স্থাবর সম্পত্তি নেই তাঁর। তিনি আরো জানান, ২০০০ সালে ওই বাড়ি নির্মাণে তাঁর সর্বমোট ৯২ লাখ টাকা খরচ হয় বলেও কমিশনকে জানানো হয়।
কমিশন পরবর্তী সময়ে তাঁর হিসাব বিবরণীতে দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে। সাবেক এই বিচারপতির বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হওয়া ৯২ লাখ ৪০ হাজার টাকার মধ্যে ৩১ লাখ ১০ হাজার ৪০০ টাকার বৈধ কোনো উৎস খুঁজে পায়নি দুদক। উপরন্তু তাঁর এই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী চমন আরা হকের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায় দুদক।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ কর্মকর্তাসহ আদালত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। টাকা না দিলে মামলা শুনানির জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতের নিত্যদিনের কার্যতালিকার ওপরের সারিতে স্থান পায় না। মামলার রায়, আদেশ বা জামিনের কপিতে বিচারপতির স্বাক্ষর নেওয়া, আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো, মামলার নথি খোঁজা ইত্যাদির কথা বলে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ নেওয়ার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। এ ছাড়া শুনানি শেষে আদালতের আদেশের কপি পেতেও ভোগান্তির কমতি নেই। টাকা দিতে না পারলে সহজে আদেশের কপি ভাগ্যে জোটে না বিচারপ্রার্থীর। নানা অজুহাতে দিনের পর দিন ঘোরানো হয় নিরীহ ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের।
২০১০ সালের ৩ জুন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল হোসেনের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রকাশ্যেই সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি তুলে ধরেন। অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধান বিচারপতিকে দেওয়া সংবর্ধনা সভায় আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আমলা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি উচ্চ আদালতের বিচারকদেরও পরোক্ষভাবে দায়ী করেন। তিনি বলেন, আদালতে এসব আমলার দুর্নীতির পেছনে বিচারপতিদের উদাসীনতা অনেকাংশে দায়ী। একজন বিচারপতি সচেতন থাকলে তাঁর অধীনরা দুর্নীতি করতে পারেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের কর্মচারীদের দুর্নীতির কিছু উদাহরণও তুলে ধরেন। পরে প্রধান বিচারপতি দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের ওই বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরাও খুশি হন। এসব ঘটনার পর সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মাঠে নামে দুদক।
জানা গেছে, বিচারপতি, বেঞ্চ অফিসার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুদকের পৃথক পৃথক টিম অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানকালে সম্পদের হিসাব জমা না দেওয়ায় বেশ কয়েকজন বেঞ্চ অফিসারের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাঁদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মূল অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। অভিযোগ উঠেছে, আয়ের সঙ্গে ব্যয় ও হেফাজতে থাকা সম্পদের সংগতি নেই এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর।
দুদক সূত্রে আরো জানা গেছে, হাইকোর্টের পাঁচ বেঞ্চ অফিসার এহতেশামুল হক, প্রদীপ কুমার দাশ, আবদুল আশিক খান, শাহজাহান কবির ও হাসিব চৌধুরীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগ থাকায় অনুসন্ধান চলছে। শিগগিরই তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মামলা ও দুদকের তদন্তের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. গোলাম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মামলার বিষয়ে জানি না। আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। আমি যতটুকু জানি, তদন্তে আমার বিরুদ্ধে কিছুই পায়নি দুদক।' তিনি আরো বলেন, 'মামলা হলে আইনগতভাবে লড়ব।'
সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ অফিসার হাসিব চৌধুরীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'দুদক আমাকে একবার ডেকেছিল। তারপর আর কিছুই জানি না।'
আরেক বেঞ্চ অফিসার প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, 'দুদক দুবার আমাকে ডেকেছে। আমার দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করে কিছুই পায়নি বলে জেনেছি।' তিনি আরো বলেন, 'আমার স্ত্রী হাউসওয়াইফ। গাড়ি, বাড়ি কিছুই আমার নেই।'

No comments

Powered by Blogger.