শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতার নেপথ্যে কারা? by ড. মিল্টন বিশ্বাস
১৬ জুলাই কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয় থেকে জানা গেল, এ মুহূর্তে ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩৭টি কলেজ ও আটটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অস্থিরতা বিরাজ করছে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি চরম হুমকি হিসেবে গণ্য হয়েছে। বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমাগত অস্থিরতা চলছে।
অন্যদিকে কিছুদিন আগে সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। ভস্মীভূত ছাত্রাবাসটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত। ১৫ জুলাই রাজধানীর সিটি ও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ১৭ জুলাই ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ধর্মঘট হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসবই বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাট সাফল্যের ধারাবাহিকতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের তরফ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যা সমাধানে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের মধ্যে তথাকথিত ১৮ দলের বিক্ষোভ ও আন্দোলনের স্বার্থে এ ধরনের পরিস্থিতি তাদের ক্ষোভের জালের ভেতর নেওয়ার চেষ্টা থাকতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। এ জন্য অশান্ত শিক্ষাঙ্গনে দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনের কঠোর অবস্থান নেওয়া জরুরি।
১৫ জুলাই মধ্যরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি হলের ছাত্রলীগকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং এতে একজন গুলিবিদ্ধও হয়। ছাত্ররা কেন সশস্ত্র? আমাদের দেশের কোনো বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ কিংবা সুশীল সমাজের কাউকে ছাত্রদের হাতে ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র থাকার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুনলাম না। যদিও কিছুদিন আগে যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মেধাবীদের রাজনীতি করার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। অতীতের মতো বর্তমানেও দেখা যাচ্ছে, ছাত্ররা কুপিয়ে হত্যা করছে প্রতিপক্ষ দলের ছাত্রদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবিরের রগকাটা ও হত্যা করে উল্লাস প্রকাশের ধারা এখনো কেন চলতে থাকবে? তাহলে সরকারের প্রথমদিকে অভিযোগ উঠেছিল যে সরকারসমর্থিত ছাত্র সংগঠনের ভেতর অনেক জঙ্গি ও মৌলবাদী ঢুকে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টে বেপোয়ারা- সেটাই কি সত্য?
নতুন উপাচার্য নিয়োগ ও ২০ জুলাই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও কয়েকজন শিক্ষক প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যাঁরা একসময় ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুসারে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের জন্য দাবি তুলেছিলেন, তাঁরাই আবার নির্বাচন নিয়ে আতঙ্কিত! তাঁদের আশঙ্কা, ভূতপূর্ব অপসারিত উপাচার্য নির্বাচনের মাধ্যমে ফিরে আসতে পারেন। তবে সৌভাগ্যের কথা, সেখানকার শিক্ষার্থীরা এখনো এ আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। যদিও শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সংকটময় পরিস্থিতির জন্য সেশনজট বাড়ার আতঙ্কে রয়েছে শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য উভয়ে সৎ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও সেখানে বিরোধী পক্ষের শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ১৫ জুলাই বর্তমান প্রশাসনবিরোধী শিক্ষক সমিতি স্মারকলিপি দিয়েছে আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে। সমস্যা সমাধানে ১৬ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক হয়েছে। অন্যদিকে বুয়েটের উপাচার্যের পক্ষে একটি গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করায় সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উপাচার্য ও অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ নিজেদের মতের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে থাকায় অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া গোয়েন্দা রিপোর্টের তথ্যের বরাত দিয়ে 'বুয়েটে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুতকে মদদ দিচ্ছে এক শ্রেণীর শিক্ষক' শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদটিও উদ্বেগের। জানা গেছে, কোনো অনিয়ম নয় বরং মহাজোট সরকারবিরোধী মৌলবাদী আদর্শের অনুসারীরা আধিপত্য বিস্তার করতেই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বুয়েটকে অশান্ত করছে। প্রগতিশীল উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগের ফলে জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীর প্রভাবিত শিক্ষক সমিতির একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হওয়াই বুয়েটের অস্থিরতার মূল। কিছুদিন আগে কালের কণ্ঠে হিযবুত তাহ্রীরের জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলাম। সেখানে আমি তথ্য দিয়েছি, কিভাবে তারা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিকড় গেড়েছে। এ ক্ষেত্রে বুয়েটে তাদের তৎপরতা থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। গোয়েন্দা তথ্য মতে, বুয়েটের ৭০ শতাংশ শিক্ষকই বিএনপি-জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে ২২ শতাংশ শিক্ষক বর্তমান সরকার ও প্রগতিশীল মতাদর্শের অনুসারী। বাকি ৮ শতাংশ মোটামুটি নিরপেক্ষ। ১৩ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষক সমিতির বেশির ভাগই সরকারের ঘোরতর বিরোধী এবং তাঁরাই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রদের মদদ দিচ্ছেন।
দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসের পরও বুয়েটের শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে দুঃখ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, 'তাঁদের দাবি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগসহ বিভিন্ন অনিয়মের তদন্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন পড়তে বলা হলেও না পড়েই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা। শিক্ষকদের এ ধরনের আন্দোলনে আমরা দুঃখিত, মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন।' বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বন্দ্ব-বিবাদে শিক্ষকদের পদত্যাগের হুমকি, ক্লাস বর্জন, অবস্থান ধর্মঘট চলতে থাকলে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার মান দুর্বল হয়ে পড়বে। সেশনজট বাড়বে, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সমাজে খারাপ ধারণা তৈরি হবে। এসব ঘটনার পেছনে চক্রান্ত আছে কি না, তাও দেখতে হবে। বর্তমানে পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে। নতুনগুলোতে রয়েছে আর্থিক দুর্বলতা ও শিক্ষক সংকট। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নতুন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপাচার্য এরই মধ্যে পদ্মা সেতুর জন্য এক কোটি টাকা সরকারের তহবিলে জমা দিয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তবে ঢাকার বাইরের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক একেবারেই মিলছে না বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য সিনিয়র ও অভিজ্ঞ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ। আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা দিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে উৎসাহী করতে হবে তাঁদের।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্থিরতার নেপথ্যে কারা তা খুঁজে বের করা দরকার। অশান্ত পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিনের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি করতে হবে। রাজনীতিবিদদের অনুসারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মুক্তবুদ্ধির চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রাখবেন; কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন। সরকার ও প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আন্তরিক হলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে আমরা মনে করি। দেশের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন ও অন্যান্য দাবি নিয়ে ১৫ জুলাইও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। পুলিশের সঙ্গে নিত্যদিন দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন তাঁরা। অন্যদিকে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ মিলনায়তন বুকিং দিয়ে ক্রমাগত বিভিন্ন বিষয়ে সরকারবিরোধীরা অপপ্রচার ও বিতর্কিত মন্তব্য করছেন। সরকারকে চাপে রাখতে চাইছেন তাঁরা। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্থিরতাকে ইন্ধন দেওয়া, সমর্থন জানানো ও আন্দোলনকে লুফে নেওয়া তাঁদের জন্য স্বাভাবিক। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যেকোনো হঠকারিতার বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
১৫ জুলাই মধ্যরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি হলের ছাত্রলীগকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং এতে একজন গুলিবিদ্ধও হয়। ছাত্ররা কেন সশস্ত্র? আমাদের দেশের কোনো বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ কিংবা সুশীল সমাজের কাউকে ছাত্রদের হাতে ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র থাকার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুনলাম না। যদিও কিছুদিন আগে যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মেধাবীদের রাজনীতি করার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। অতীতের মতো বর্তমানেও দেখা যাচ্ছে, ছাত্ররা কুপিয়ে হত্যা করছে প্রতিপক্ষ দলের ছাত্রদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবিরের রগকাটা ও হত্যা করে উল্লাস প্রকাশের ধারা এখনো কেন চলতে থাকবে? তাহলে সরকারের প্রথমদিকে অভিযোগ উঠেছিল যে সরকারসমর্থিত ছাত্র সংগঠনের ভেতর অনেক জঙ্গি ও মৌলবাদী ঢুকে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টে বেপোয়ারা- সেটাই কি সত্য?
নতুন উপাচার্য নিয়োগ ও ২০ জুলাই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও কয়েকজন শিক্ষক প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যাঁরা একসময় ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুসারে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের জন্য দাবি তুলেছিলেন, তাঁরাই আবার নির্বাচন নিয়ে আতঙ্কিত! তাঁদের আশঙ্কা, ভূতপূর্ব অপসারিত উপাচার্য নির্বাচনের মাধ্যমে ফিরে আসতে পারেন। তবে সৌভাগ্যের কথা, সেখানকার শিক্ষার্থীরা এখনো এ আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। যদিও শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সংকটময় পরিস্থিতির জন্য সেশনজট বাড়ার আতঙ্কে রয়েছে শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য উভয়ে সৎ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও সেখানে বিরোধী পক্ষের শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ১৫ জুলাই বর্তমান প্রশাসনবিরোধী শিক্ষক সমিতি স্মারকলিপি দিয়েছে আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে। সমস্যা সমাধানে ১৬ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠক হয়েছে। অন্যদিকে বুয়েটের উপাচার্যের পক্ষে একটি গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করায় সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উপাচার্য ও অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ নিজেদের মতের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে থাকায় অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া গোয়েন্দা রিপোর্টের তথ্যের বরাত দিয়ে 'বুয়েটে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুতকে মদদ দিচ্ছে এক শ্রেণীর শিক্ষক' শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদটিও উদ্বেগের। জানা গেছে, কোনো অনিয়ম নয় বরং মহাজোট সরকারবিরোধী মৌলবাদী আদর্শের অনুসারীরা আধিপত্য বিস্তার করতেই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বুয়েটকে অশান্ত করছে। প্রগতিশীল উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগের ফলে জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীর প্রভাবিত শিক্ষক সমিতির একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হওয়াই বুয়েটের অস্থিরতার মূল। কিছুদিন আগে কালের কণ্ঠে হিযবুত তাহ্রীরের জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে একটি কলাম লিখেছিলাম। সেখানে আমি তথ্য দিয়েছি, কিভাবে তারা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিকড় গেড়েছে। এ ক্ষেত্রে বুয়েটে তাদের তৎপরতা থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। গোয়েন্দা তথ্য মতে, বুয়েটের ৭০ শতাংশ শিক্ষকই বিএনপি-জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে ২২ শতাংশ শিক্ষক বর্তমান সরকার ও প্রগতিশীল মতাদর্শের অনুসারী। বাকি ৮ শতাংশ মোটামুটি নিরপেক্ষ। ১৩ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষক সমিতির বেশির ভাগই সরকারের ঘোরতর বিরোধী এবং তাঁরাই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রদের মদদ দিচ্ছেন।
দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসের পরও বুয়েটের শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে দুঃখ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, 'তাঁদের দাবি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগসহ বিভিন্ন অনিয়মের তদন্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন পড়তে বলা হলেও না পড়েই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা। শিক্ষকদের এ ধরনের আন্দোলনে আমরা দুঃখিত, মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন।' বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বন্দ্ব-বিবাদে শিক্ষকদের পদত্যাগের হুমকি, ক্লাস বর্জন, অবস্থান ধর্মঘট চলতে থাকলে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার মান দুর্বল হয়ে পড়বে। সেশনজট বাড়বে, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সমাজে খারাপ ধারণা তৈরি হবে। এসব ঘটনার পেছনে চক্রান্ত আছে কি না, তাও দেখতে হবে। বর্তমানে পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে। নতুনগুলোতে রয়েছে আর্থিক দুর্বলতা ও শিক্ষক সংকট। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নতুন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপাচার্য এরই মধ্যে পদ্মা সেতুর জন্য এক কোটি টাকা সরকারের তহবিলে জমা দিয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তবে ঢাকার বাইরের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক একেবারেই মিলছে না বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য সিনিয়র ও অভিজ্ঞ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ। আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা দিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে উৎসাহী করতে হবে তাঁদের।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্থিরতার নেপথ্যে কারা তা খুঁজে বের করা দরকার। অশান্ত পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিনের ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি করতে হবে। রাজনীতিবিদদের অনুসারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মুক্তবুদ্ধির চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রাখবেন; কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন। সরকার ও প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আন্তরিক হলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে আমরা মনে করি। দেশের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন ও অন্যান্য দাবি নিয়ে ১৫ জুলাইও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। পুলিশের সঙ্গে নিত্যদিন দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন তাঁরা। অন্যদিকে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ মিলনায়তন বুকিং দিয়ে ক্রমাগত বিভিন্ন বিষয়ে সরকারবিরোধীরা অপপ্রচার ও বিতর্কিত মন্তব্য করছেন। সরকারকে চাপে রাখতে চাইছেন তাঁরা। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্থিরতাকে ইন্ধন দেওয়া, সমর্থন জানানো ও আন্দোলনকে লুফে নেওয়া তাঁদের জন্য স্বাভাবিক। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যেকোনো হঠকারিতার বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
No comments