সেই সত্য যা রচিবে তুমি... by গোলাম সারওয়ার
রবীন্দ্রকাব্যে 'সত্য' নানা অভিধায় আবিষ্কৃত। সত্যনিষ্ঠা, সত্যে আস্থা কিংবা উদ্ঘাটন তার কাব্যে লক্ষণীয়ভাবে উপস্থিত। এই সত্য অনুসরণ এবং তাতে বিশ্বস্ত থাকাই সাংবাদিকতার লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয় বলেই পাঠকের প্রত্যাশা। আমাদের গণমাধ্যম এই লক্ষ্যে কতটা বিশ্বস্ত তা প্রশ্নাতীত নয়।
সমকালের প্রথম পাতায় মাস্টহেডের সঙ্গে মুদ্রিত 'পে অফ লাইনে' 'অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস' এই সত্যানুসন্ধানেরই অঙ্গীকার। রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনেক সময় মনে হয়, এ পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কঠিন। রবীন্দ্রনাথ এই সত্যের কথাই বারবার বলেছেন। 'সেই সত্য যা রচিবে তুমি,/ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি/রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।...' এ হচ্ছে কবির বিশ্বাস ও ভাবনার কথা। কবিকল্পনা ও বাস্তবতার সঙ্গে এই সত্যের বিস্তর ব্যবধান। আবার রবীন্দ্রনাথই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেন : 'সত্য যে কঠিন/কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা 'কঠিন সত্য'কে ভালোবাসা যে সহজ নয় সে কথা রবীন্দ্রনাথ বলেননি। গণমাধ্যমকর্মীরা সেই 'সত্যের মতো বদমাশে'র ভীষণ দর্শন নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হন বারবার। তবে এই লড়াকু সাংবাদিকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে রেখে সমকালের আপন বিশ্বাস ও অঙ্গীকারের পুনরুচ্চারণ : কোনো বাধা মানবো না।
কোনো বাধা না মানার এই অঙ্গীকার পত্রিকাবিশেষেরই নয়, সমগ্র জাতিরই হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ বিগত নির্বাচনে যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছে, তা মূলত সব বাধা লঙ্ঘন করে জনমানুষের স্বপ্নপূরণেরই অঙ্গীকার। এই স্বপ্নপূরণ যে সহজ নয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আড়াই বছরই তার প্রমাণ। চূড়ান্তভাবে অগোছালো, অবিন্যস্ত একটি সংসারের হাল ধরে তাকে সু-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে তোলার যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা পরিপূরণে পথের বাধা দূর করতে তিনি স্বস্তিতে নেই। পায়ে পায়ে বিপদ। পদে পদে বাধা। পথও সুমসৃণ নয়। চাল ডাল তেল নুন জোগাড় করতে যে মধ্যবিত্ত প্রতিদিনই পেরেশান, সে কিন্তু আড়াই বছর আগে উচ্চারিত অঙ্গীকারের বাস্তবায়নই প্রত্যাশা করে। ভোরের আলোর মতো আশার আলো ফুটতে না ফুটতেই নিভে গেলে সে নিরাশ হয়, ক্ষুব্ধও হয়। এই নিরাশ, ক্ষুব্ধ মানুষের প্রত্যাশা পূরণের জন্য সরকারের হাতে আরও আড়াইটি বছর রয়েছে। এ সময় একেবারেই সংকীর্ণ। যথেষ্ট নয়।
প্রাসঙ্গিক কি-না জানি না তবু পশ্চিমবঙ্গের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন এবং তৃণমূল-কংগ্রেসের বিশাল বিজয়ের বিষয় উত্থাপন করছি। আশ্চর্য মিল রয়েছে এ দুটি নির্বাচনে উচ্চারিত অঙ্গীকার ও ফলাফলে। ভয়ঙ্কর অমিল রয়েছে ভাবনা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। নির্বাচনের আগে 'মা, মাটি ও মানুষ' স্লোগানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবর্তনের কথা বলেছেন। বামফ্রন্ট বলেছে প্রত্যাবর্তনের কথা। পশ্চিমবঙ্গবাসী পরিবর্তনে আস্থা রেখেছে। প্রত্যাবর্তনে নয়। সংসদে স্পিকারের ভাষায় বলা যায় : পরিবর্তন জয়যুক্ত হয়েছে। পরিবর্তন জয়যুক্ত হয়েছে। পরিবর্তন জয়যুক্ত হয়েছে। পরাজিত হয়েছে সিপিএমের অহংবোধ, জনপ্রত্যাশার বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীও পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন, তারুণ্যের জয়গান গেয়েছিলেন। জনসমর্থনের প্রাণবন্যায় উপচে পড়েছিল ভোটের বাক্স। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসরণ করেই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে কী হলো? নির্বাচনের ফলাফল সম্পূর্ণ প্রকাশিত হওয়ার আগেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পরাজয় স্বীকার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, আমরা মানুষের পরিবর্তনের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কথা বুঝতে পারিনি। আমরা নতুন সরকারের সব ভালো কাজে সমর্থন জানাব। দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করব। বামফ্রন্ট নেতারা নতুন সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গেলেন। একই সোফায় আঁটসাঁট করে বামফ্রন্টের তিন নেতা বসলেন। মমতা বিনম্র শ্রদ্ধায় নমস্কার জানালেন তাদের। আমাদের নেতা-নেত্রীদের চোখ খুলে দেওয়ার মতো এই ঐতিহাসিক ছবিটি সমকালসহ ঢাকার অনেক পত্রিকায়ই প্রকাশিত হয়েছে। পরাজয় স্বীকার করে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের অঙ্গীকার আমাদের অভিজ্ঞতায় অনুপস্থিত। মমতা একেবারেই সত্যিকার অর্থে তৃণমূল থেকে উঠে আসা জননেত্রী। মানসিকতা ও আচরণে মমতার সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অনেকটা সাযুজ্য রয়েছে। রাজনীতির মর্মমূল থেকেই শেখ হাসিনার উত্থান। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার সুমন সেনগুপ্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথের 'সাধারণ মেয়ে'র আসনে বসিয়ে বলেছেন : 'যিনি টালি ছাওয়া চালের ঘরে থাকেন, পরনে ডুরে শাড়ি, পায়ে হাওয়াই, মুড়ি, তেলেভাজা-পান্তাভাতে রসনা তৃপ্তি, কবজিতে বিপত্তারিণী থেকে শুরু করে নানা বিঘ্ননাশক তাবিজসূত্র মোড়া..., কলকাতার এলিট মানুষজন রাইটার্সের অলিন্দে তথা মসনদে এহেন একজনকে হয়তো সত্যিই দেখতে চান না।'
পরিবর্তনের প্রত্যাশায়ই বাংলাদেশের মানুষ বাক্স ভরে ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগকে_ নৌকায়। একই প্রত্যাশায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কানায় কানায় ভরে দিয়েছে মমতার জোড়া ফুল মার্কা বাক্স। তৃণমূলের সবে শুরু। মহাজোট সরকার মধ্যপথ অতিক্রম করেছে। মানুষ এখন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যকার ব্যবধানের হিসাব-নিকাশ সঙ্গত কারণেই করছে।
পরিবর্তনের এই মৃদুমন্দ হাওয়া সংবাদপত্রেও। এই পরিবর্তন অন্তরঙ্গে, বহিরঙ্গে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রিন্ট মিডিয়ার সামগ্রিক ভাবনা ও কৌশলে পরিবর্তন সহজে দৃশ্যমান। নিছক সংবাদ নয়, এর নেপথ্যকথা ও অন্তঃসলিলা নানা প্রকরণে প্রতিবেদককে অধিক মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। রাজনীতি ও নগর জীবনের ঘাত-অভিঘাতের বাইরে সারা বাংলাদেশে সংবাদের নানা সূত্র ও উপকরণের সন্ধান এবং প্রকাশ এখন সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পনা, সৃজনশীলতায় প্রতিটি পাতা সাজানো, সামাজিক অঙ্গীকার প্রতিপালন_ সংবাদপত্রকে ঘিরে যেন মহাযজ্ঞ। এই পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিয়ে নতুন ধারার সংবাদপত্র পাঠকের দরবারে হাজির হচ্ছে। বিশাল কলেবরে নানা উপকরণে সজ্জিত মূল ধারার সংবাদপত্রের পাশাপাশি একেবারেই সংবাদমনস্ক শীর্ণ কলেবরের সংবাদপত্রেও পাঠকের মনোযোগ কম নয়। গণমাধ্যমে শতফুল ফুটুক, নানা পথ বিস্তৃত হোক। তবে সাংবাদিকতার মৌলিক শর্ত অনুসরণ, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের পথ পরিহার এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার স্বাভাবিক ধারা পাঠককে আকৃষ্ট করবে। সপ্তম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে সমকালের প্রথম পাতা থেকে শুরু করে প্রতিটি পাতায় নতুন বিন্যাসে পরিবর্তনের ভাবনা ঠাঁই পেয়েছে।
সর্বপ্লাবী অবক্ষয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন, পূর্বসূরিদের নিরপেক্ষ, সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার পথ থেকে কি একালের সাংবাদিকরা বিচ্যুত? নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত, নানা ভাবনার আপাত কেন্দ্রবিন্দু সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সঙ্গে সম্প্রতি তার বাড়িতে কথা হলো দীর্ঘক্ষণ। আমরা নিজ নিজ পেশায় আন্তরিক ও পরিশ্রমী কি-না_ সাবেক প্রধান বিচারপতি বদ্ধমূল সংশয়ের কথা অকপটে বললেন। তার ধারণা, সাংবাদিকরা সত্যানুসন্ধানে, বিশেষ করে পূর্ণ সত্য আবিষ্কারে যথেষ্ট পরিশ্রমী নন। অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশিত সংবাদ খণ্ডিত, একদেশদর্শী, পাঠকের নানা প্রশ্নের জবাবদানে অক্ষম। তিনি মনে করেন, সত্য প্রকাশে বাহ্যিক বাধা নয়, সাংবাদিকের মনের ভেতর বসবাসরত মনস্তাত্তি্বক এবং আপন বিশ্বাস অতিক্রম না করার প্রবণতাই সংবাদকে দুর্বল করে। সাবেক এই প্রধান বিচারপতির অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের খুব একটা সুযোগ রয়েছে বলে মনে হয় না।
কোনো বাধা না মানার এই অঙ্গীকার পত্রিকাবিশেষেরই নয়, সমগ্র জাতিরই হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ বিগত নির্বাচনে যে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছে, তা মূলত সব বাধা লঙ্ঘন করে জনমানুষের স্বপ্নপূরণেরই অঙ্গীকার। এই স্বপ্নপূরণ যে সহজ নয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আড়াই বছরই তার প্রমাণ। চূড়ান্তভাবে অগোছালো, অবিন্যস্ত একটি সংসারের হাল ধরে তাকে সু-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে তোলার যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা পরিপূরণে পথের বাধা দূর করতে তিনি স্বস্তিতে নেই। পায়ে পায়ে বিপদ। পদে পদে বাধা। পথও সুমসৃণ নয়। চাল ডাল তেল নুন জোগাড় করতে যে মধ্যবিত্ত প্রতিদিনই পেরেশান, সে কিন্তু আড়াই বছর আগে উচ্চারিত অঙ্গীকারের বাস্তবায়নই প্রত্যাশা করে। ভোরের আলোর মতো আশার আলো ফুটতে না ফুটতেই নিভে গেলে সে নিরাশ হয়, ক্ষুব্ধও হয়। এই নিরাশ, ক্ষুব্ধ মানুষের প্রত্যাশা পূরণের জন্য সরকারের হাতে আরও আড়াইটি বছর রয়েছে। এ সময় একেবারেই সংকীর্ণ। যথেষ্ট নয়।
প্রাসঙ্গিক কি-না জানি না তবু পশ্চিমবঙ্গের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন এবং তৃণমূল-কংগ্রেসের বিশাল বিজয়ের বিষয় উত্থাপন করছি। আশ্চর্য মিল রয়েছে এ দুটি নির্বাচনে উচ্চারিত অঙ্গীকার ও ফলাফলে। ভয়ঙ্কর অমিল রয়েছে ভাবনা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। নির্বাচনের আগে 'মা, মাটি ও মানুষ' স্লোগানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবর্তনের কথা বলেছেন। বামফ্রন্ট বলেছে প্রত্যাবর্তনের কথা। পশ্চিমবঙ্গবাসী পরিবর্তনে আস্থা রেখেছে। প্রত্যাবর্তনে নয়। সংসদে স্পিকারের ভাষায় বলা যায় : পরিবর্তন জয়যুক্ত হয়েছে। পরিবর্তন জয়যুক্ত হয়েছে। পরিবর্তন জয়যুক্ত হয়েছে। পরাজিত হয়েছে সিপিএমের অহংবোধ, জনপ্রত্যাশার বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীও পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন, তারুণ্যের জয়গান গেয়েছিলেন। জনসমর্থনের প্রাণবন্যায় উপচে পড়েছিল ভোটের বাক্স। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসরণ করেই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে কী হলো? নির্বাচনের ফলাফল সম্পূর্ণ প্রকাশিত হওয়ার আগেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পরাজয় স্বীকার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, আমরা মানুষের পরিবর্তনের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কথা বুঝতে পারিনি। আমরা নতুন সরকারের সব ভালো কাজে সমর্থন জানাব। দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করব। বামফ্রন্ট নেতারা নতুন সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গেলেন। একই সোফায় আঁটসাঁট করে বামফ্রন্টের তিন নেতা বসলেন। মমতা বিনম্র শ্রদ্ধায় নমস্কার জানালেন তাদের। আমাদের নেতা-নেত্রীদের চোখ খুলে দেওয়ার মতো এই ঐতিহাসিক ছবিটি সমকালসহ ঢাকার অনেক পত্রিকায়ই প্রকাশিত হয়েছে। পরাজয় স্বীকার করে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের অঙ্গীকার আমাদের অভিজ্ঞতায় অনুপস্থিত। মমতা একেবারেই সত্যিকার অর্থে তৃণমূল থেকে উঠে আসা জননেত্রী। মানসিকতা ও আচরণে মমতার সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অনেকটা সাযুজ্য রয়েছে। রাজনীতির মর্মমূল থেকেই শেখ হাসিনার উত্থান। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার সুমন সেনগুপ্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথের 'সাধারণ মেয়ে'র আসনে বসিয়ে বলেছেন : 'যিনি টালি ছাওয়া চালের ঘরে থাকেন, পরনে ডুরে শাড়ি, পায়ে হাওয়াই, মুড়ি, তেলেভাজা-পান্তাভাতে রসনা তৃপ্তি, কবজিতে বিপত্তারিণী থেকে শুরু করে নানা বিঘ্ননাশক তাবিজসূত্র মোড়া..., কলকাতার এলিট মানুষজন রাইটার্সের অলিন্দে তথা মসনদে এহেন একজনকে হয়তো সত্যিই দেখতে চান না।'
পরিবর্তনের প্রত্যাশায়ই বাংলাদেশের মানুষ বাক্স ভরে ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগকে_ নৌকায়। একই প্রত্যাশায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কানায় কানায় ভরে দিয়েছে মমতার জোড়া ফুল মার্কা বাক্স। তৃণমূলের সবে শুরু। মহাজোট সরকার মধ্যপথ অতিক্রম করেছে। মানুষ এখন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যকার ব্যবধানের হিসাব-নিকাশ সঙ্গত কারণেই করছে।
পরিবর্তনের এই মৃদুমন্দ হাওয়া সংবাদপত্রেও। এই পরিবর্তন অন্তরঙ্গে, বহিরঙ্গে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রিন্ট মিডিয়ার সামগ্রিক ভাবনা ও কৌশলে পরিবর্তন সহজে দৃশ্যমান। নিছক সংবাদ নয়, এর নেপথ্যকথা ও অন্তঃসলিলা নানা প্রকরণে প্রতিবেদককে অধিক মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। রাজনীতি ও নগর জীবনের ঘাত-অভিঘাতের বাইরে সারা বাংলাদেশে সংবাদের নানা সূত্র ও উপকরণের সন্ধান এবং প্রকাশ এখন সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পনা, সৃজনশীলতায় প্রতিটি পাতা সাজানো, সামাজিক অঙ্গীকার প্রতিপালন_ সংবাদপত্রকে ঘিরে যেন মহাযজ্ঞ। এই পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিয়ে নতুন ধারার সংবাদপত্র পাঠকের দরবারে হাজির হচ্ছে। বিশাল কলেবরে নানা উপকরণে সজ্জিত মূল ধারার সংবাদপত্রের পাশাপাশি একেবারেই সংবাদমনস্ক শীর্ণ কলেবরের সংবাদপত্রেও পাঠকের মনোযোগ কম নয়। গণমাধ্যমে শতফুল ফুটুক, নানা পথ বিস্তৃত হোক। তবে সাংবাদিকতার মৌলিক শর্ত অনুসরণ, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের পথ পরিহার এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার স্বাভাবিক ধারা পাঠককে আকৃষ্ট করবে। সপ্তম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে সমকালের প্রথম পাতা থেকে শুরু করে প্রতিটি পাতায় নতুন বিন্যাসে পরিবর্তনের ভাবনা ঠাঁই পেয়েছে।
সর্বপ্লাবী অবক্ষয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন, পূর্বসূরিদের নিরপেক্ষ, সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার পথ থেকে কি একালের সাংবাদিকরা বিচ্যুত? নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত, নানা ভাবনার আপাত কেন্দ্রবিন্দু সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সঙ্গে সম্প্রতি তার বাড়িতে কথা হলো দীর্ঘক্ষণ। আমরা নিজ নিজ পেশায় আন্তরিক ও পরিশ্রমী কি-না_ সাবেক প্রধান বিচারপতি বদ্ধমূল সংশয়ের কথা অকপটে বললেন। তার ধারণা, সাংবাদিকরা সত্যানুসন্ধানে, বিশেষ করে পূর্ণ সত্য আবিষ্কারে যথেষ্ট পরিশ্রমী নন। অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশিত সংবাদ খণ্ডিত, একদেশদর্শী, পাঠকের নানা প্রশ্নের জবাবদানে অক্ষম। তিনি মনে করেন, সত্য প্রকাশে বাহ্যিক বাধা নয়, সাংবাদিকের মনের ভেতর বসবাসরত মনস্তাত্তি্বক এবং আপন বিশ্বাস অতিক্রম না করার প্রবণতাই সংবাদকে দুর্বল করে। সাবেক এই প্রধান বিচারপতির অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের খুব একটা সুযোগ রয়েছে বলে মনে হয় না।
No comments