আসমান ভাইঙা জোছনা পড়ে by সুমনকুমার দাশ
প্রতি রাতে হাওর আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রমত্ত আফালের গর্জন শুনে চমকে তাকাই। আহা! ফেলে আসা শৈশবটা কত না সুন্দর ছিল! এক যুগ আগে যে হাওর ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী, সেই হাওর এখন স্বপ্নে আমাকে ডাকে।
এই তো গত বর্ষার কথা। প্রকৃতি তখন বৃষ্টিস্নাত।
এই তো গত বর্ষার কথা। প্রকৃতি তখন বৃষ্টিস্নাত।
বর্ষার শেষ সময়, হাওরে ভাটার টান, তবুও হাওরে অবারিত জলরাশি। সেই জলরাশির টানে ছুটে গিয়েছিলাম জন্মমাটি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার সুখলাইন গ্রামে। কত দিন পর দেখলাম—আকাশে মাছরাঙা আর পরিযায়ী পাখিদের ওড়াউড়ি। জলরাশির আশপাশে সারি সারি বসত। তখনো শরৎ আসেনি, অথচ গ্রামের পাশে হাওরের লিলুয়া বাতাসে কাশবন আপনমনে ঠিকই দুলছিল।
সেদিন একটা ইঞ্জিন নৌকা করে হাওর পাড়ি দিয়ে জন্মমাটির উদ্দেশে রওনা হই। ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়ে হিজলগাছ থেকে সাদা বক দ্রুত উড়ে গেল দূর আকাশে। পদ্ম ফুল আর কেওড়ালি মিতালি পেতেছে স্বচ্ছ জলে। লিলুয়া বাতাস শরীরে কোমল পরশ বুলিয়ে দিতে থাকে।
এখন বর্ষা মৌসুম চলছে। সেই একই দৃশ্য, একই রূপ। সব হাওর মিলেমিশে একাকার রূপ ধারণ করেছে। এ যেন অন্য রকম সমুদ্র। হাওর শব্দটি এসেছে কিন্তু সমুদ্রের অপভ্রংশ হয়ে। এই মৌসুমটায় হাজারো প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে পড়ে।
রংবেরঙের কত কত পালতোলা নৌকা হাওরের বুকে দিনমান আসা-যাওয়া করছে। মাঝিরা মনের আনন্দে গেয়ে উঠছেন ভাটিয়ালি গান। জেলেরা ভাসান পানিতে মাছ ধরতে ব্যস্ত। দূরে দ্বীপের মতো ভেসে থাকে সবুজ-শ্যামল গ্রামগুলো। কী বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক শোভা! দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। আর মাথার ওপর যখন সূর্য থাকে, তখন দুপুরের কড়কড়ে রোদ হাওরের পানিতে পড়ে চিকচিক খেলা করে। ছোট ছোট ঢেউয়ে রুপালি আলো দোল খায়। সেই ঢেউয়ে ছন্দময় তালে দুলুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলে নৌকাগুলো।
পানিতে ভাসমান অসংখ্য হিজল-করচগাছ স্বাগত জানায়। গাছের সবুজ পাতার ভেতর থেকে কিচিরমিচির শব্দ করে মাঝেমধ্যে উড়ে যায় এক ঝাঁক অচেনা পাখি। পানির নিচে তাকালেই অনেকটা স্পষ্টভাবে দেখা যায় সবুজ জলজ উদ্ভিদ।
গত বছরের পর চলতি বর্ষা মৌসুমে আবারও বাড়ি যাওয়ার সুবাদে হাওরযাত্রার সুযোগ হয়। আমি একটি ইঞ্জিন নৌকায় করে বাড়ির পথে রওনা দিই। যতই নৌকা এগোচ্ছিল, ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। নৌকার গলুইয়ে বসে ধীরে ধীরে হাতটা পানিতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার পুরো শরীর শীতল হয়ে এসেছিল।
হাওর দেখতে দেখতে কখন যে বিকেল হয়ে গেছে টেরই পাইনি। আকাশও ধীরে ধীরে রূপ বদল করতে থাকে। কোথাও নীল আকাশের ফাঁকে তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘ, কোথাও আকাশের বুকে থোকা থোকা হলুদের পরশ। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে হাওরের প্রাকৃতিক দৃশ্য।
বিকেলে পশ্চিম আকাশে তাকাতেই দেখলাম আমার জন্য অপেক্ষা করছে সবচেয়ে বড় চমক। অনেকটা শান্তশিষ্ট হয়ে দূরের আকাশের লালচে সূর্যটা টুপ করে ডুব দিল হাওরের জলে। গোধূলিবেলায় এ দৃশ্য যে কাউকেই উতলা করে তুলবে। দেখতে দেখতে মুহূর্তেই চারদিকে অন্ধকার নেমে এল। তবে পূর্ণিমা রাতে সেটা নিছক সামান্য সময়ের জন্য। একসময় সন্ধ্যার সুনসান হাওরে ‘আসমান ভাইঙা জোছনা পড়ে’।
চাঁদের রুপালি আলোয় নতুন করে হাওর জেগে ওঠে। সন্ধ্যারাতের সৌন্দর্য এখনো চোখ ধাঁধাচ্ছে। আমি তো জানি জোছনা রাতে হাওর জেগে থাকে। সারা রাত এখানে চাঁদ জ্বলতে থাকে।
এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা মুঠোফোন আর অন্তর্জালের মাধ্যমে নিমেষেই জেনে নিতে পারেন তাবত বিশ্বের খুঁটিনাটি। কিন্তু হাওরের অন্তহীন উথালপাথাল ঢেউ, রংবেরঙের পালতোলা নৌকা কিংবা বৈশাখের পাকা ধানখেতে লিলুয়া বাতাসের কোমল স্পর্শ—সেটা অনুভব করতে হলে সবাইকে একবার হলেও যেতে হবে জল-মাটি-কাদার কাছাকাছি। আর এর অপূর্ব স্বাদ আস্বাদন করতে হলে নিরবধি আপন গতিতে কুলকুল বয়ে চলা সেই হাওরের দেশেই যেতে হবে।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে ট্রেন কিংবা বাসে চেপে সোজা সিলেট। এরপর সিলেট শহরতলির কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে দিরাইগামী গাড়িতে উঠলে আড়াই ঘণ্টার ভেতরে দিরাইয়ে পৌঁছাবেন। দিরাইয়ে আবাসনের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। দিরাইয়ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা হচ্ছে শাল্লা। এরপর একটু বিশ্রাম নিয়ে উপজেলা নৌকাঘাট থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া নিয়ে দিরাই-শাল্লার সব কটি ছোট-বড় হাওর ঘুরে দেখতে পারেন।
সেদিন একটা ইঞ্জিন নৌকা করে হাওর পাড়ি দিয়ে জন্মমাটির উদ্দেশে রওনা হই। ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়ে হিজলগাছ থেকে সাদা বক দ্রুত উড়ে গেল দূর আকাশে। পদ্ম ফুল আর কেওড়ালি মিতালি পেতেছে স্বচ্ছ জলে। লিলুয়া বাতাস শরীরে কোমল পরশ বুলিয়ে দিতে থাকে।
এখন বর্ষা মৌসুম চলছে। সেই একই দৃশ্য, একই রূপ। সব হাওর মিলেমিশে একাকার রূপ ধারণ করেছে। এ যেন অন্য রকম সমুদ্র। হাওর শব্দটি এসেছে কিন্তু সমুদ্রের অপভ্রংশ হয়ে। এই মৌসুমটায় হাজারো প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে পড়ে।
রংবেরঙের কত কত পালতোলা নৌকা হাওরের বুকে দিনমান আসা-যাওয়া করছে। মাঝিরা মনের আনন্দে গেয়ে উঠছেন ভাটিয়ালি গান। জেলেরা ভাসান পানিতে মাছ ধরতে ব্যস্ত। দূরে দ্বীপের মতো ভেসে থাকে সবুজ-শ্যামল গ্রামগুলো। কী বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক শোভা! দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। আর মাথার ওপর যখন সূর্য থাকে, তখন দুপুরের কড়কড়ে রোদ হাওরের পানিতে পড়ে চিকচিক খেলা করে। ছোট ছোট ঢেউয়ে রুপালি আলো দোল খায়। সেই ঢেউয়ে ছন্দময় তালে দুলুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলে নৌকাগুলো।
পানিতে ভাসমান অসংখ্য হিজল-করচগাছ স্বাগত জানায়। গাছের সবুজ পাতার ভেতর থেকে কিচিরমিচির শব্দ করে মাঝেমধ্যে উড়ে যায় এক ঝাঁক অচেনা পাখি। পানির নিচে তাকালেই অনেকটা স্পষ্টভাবে দেখা যায় সবুজ জলজ উদ্ভিদ।
গত বছরের পর চলতি বর্ষা মৌসুমে আবারও বাড়ি যাওয়ার সুবাদে হাওরযাত্রার সুযোগ হয়। আমি একটি ইঞ্জিন নৌকায় করে বাড়ির পথে রওনা দিই। যতই নৌকা এগোচ্ছিল, ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। নৌকার গলুইয়ে বসে ধীরে ধীরে হাতটা পানিতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার পুরো শরীর শীতল হয়ে এসেছিল।
হাওর দেখতে দেখতে কখন যে বিকেল হয়ে গেছে টেরই পাইনি। আকাশও ধীরে ধীরে রূপ বদল করতে থাকে। কোথাও নীল আকাশের ফাঁকে তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘ, কোথাও আকাশের বুকে থোকা থোকা হলুদের পরশ। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে হাওরের প্রাকৃতিক দৃশ্য।
বিকেলে পশ্চিম আকাশে তাকাতেই দেখলাম আমার জন্য অপেক্ষা করছে সবচেয়ে বড় চমক। অনেকটা শান্তশিষ্ট হয়ে দূরের আকাশের লালচে সূর্যটা টুপ করে ডুব দিল হাওরের জলে। গোধূলিবেলায় এ দৃশ্য যে কাউকেই উতলা করে তুলবে। দেখতে দেখতে মুহূর্তেই চারদিকে অন্ধকার নেমে এল। তবে পূর্ণিমা রাতে সেটা নিছক সামান্য সময়ের জন্য। একসময় সন্ধ্যার সুনসান হাওরে ‘আসমান ভাইঙা জোছনা পড়ে’।
চাঁদের রুপালি আলোয় নতুন করে হাওর জেগে ওঠে। সন্ধ্যারাতের সৌন্দর্য এখনো চোখ ধাঁধাচ্ছে। আমি তো জানি জোছনা রাতে হাওর জেগে থাকে। সারা রাত এখানে চাঁদ জ্বলতে থাকে।
এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা মুঠোফোন আর অন্তর্জালের মাধ্যমে নিমেষেই জেনে নিতে পারেন তাবত বিশ্বের খুঁটিনাটি। কিন্তু হাওরের অন্তহীন উথালপাথাল ঢেউ, রংবেরঙের পালতোলা নৌকা কিংবা বৈশাখের পাকা ধানখেতে লিলুয়া বাতাসের কোমল স্পর্শ—সেটা অনুভব করতে হলে সবাইকে একবার হলেও যেতে হবে জল-মাটি-কাদার কাছাকাছি। আর এর অপূর্ব স্বাদ আস্বাদন করতে হলে নিরবধি আপন গতিতে কুলকুল বয়ে চলা সেই হাওরের দেশেই যেতে হবে।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে ট্রেন কিংবা বাসে চেপে সোজা সিলেট। এরপর সিলেট শহরতলির কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে দিরাইগামী গাড়িতে উঠলে আড়াই ঘণ্টার ভেতরে দিরাইয়ে পৌঁছাবেন। দিরাইয়ে আবাসনের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। দিরাইয়ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা হচ্ছে শাল্লা। এরপর একটু বিশ্রাম নিয়ে উপজেলা নৌকাঘাট থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া নিয়ে দিরাই-শাল্লার সব কটি ছোট-বড় হাওর ঘুরে দেখতে পারেন।
No comments