রেলে দুর্নীতি-রেলে চলে নম্বর ঘষামাজা নিয়োগ পান অনুত্তীর্ণরা-ইউসুফ মৃধাকে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু by রেজা রায়হান

রেলের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় বহুল আলোচিত রেলওয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত ইউসুফ আলী মৃধাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রেলওয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিডিআর গেট কেলেঙ্কারি'তে মৃধার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া


চলছে। ইতিমধ্যেই বিভাগীয় মামলাও শুরু হয়েছে। মৃধা জবাব দেওয়ার জন্য বর্ধিত সময়ের আবেদন করেছেন।
রেলওয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, একাধিক উচ্চপর্যায়ের তদন্তে রেলওয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি, জালিয়াতি, সরকারের নিয়ম-নীতি লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ইউসুফ আলী মৃধার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ইউসুফ আলী মৃধা রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) হিসেবে কর্মরত থাকাকালে গত ৯ এপ্রিল মধ্যরাতে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার এবং রেলওয়ের কমানড্যান্ট মো. এনামুল হকের সঙ্গে গাড়িতে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থসহ পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরের গেটে (সাবেক বিডিআর গেট) বিজিবি সদস্যদের হাতে আটক হন। ঘটনাটি গণমাধ্যমসহ সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এ ছাড়া রেলওয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়োগে তাঁর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও ব্যাপক প্রচার পায়। ইতিমধ্যে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায় তিনি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন।
রেলওয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর নিয়োগসংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে গত ১৬ এপ্রিল রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালককে (মেকা.) আহ্বায়ক করে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি এবং রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে ২ মে অতিরিক্ত মহাপরিচালককে (অপারেশন) আহ্বায়ক করে (সংশোধিত) কমিটি গঠন করা হয়। বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গত ২২ মে ও ৪ জুন এবং মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি ৭ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে সাম্প্রতিককালে পূর্বাঞ্চলে নিয়োগ সম্পন্ন হওয়া ২৫ ক্যাটাগরির মধ্যে ১৬টিতেই বিভিন্ন গুরুতর দুর্নীতি, অনিয়মের জন্য ইউসুফ মৃধাকে দায়ী করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালের ২৯ আগস্ট মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে নিয়োগসংক্রান্ত সভার সিদ্ধান্ত ছিল, কমিটিতে একই বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা রাখা যাবে না। এ ছাড়া কমিটির কোনো সদস্য যাতে অন্য সদস্যের সরাসরি অধীন না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করে এবং নবনিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানের সুপারিশক্রমে অতিরিক্ত বিভাগীয় প্রধান পর্যায়ের কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করে নিয়োগ কমিটি গঠন করতে হবে। কিন্তু ওই নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া তৃতীয় শ্রেণীর সব ক্যাটাগরির নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, খাতা মূল্যায়ন, টেব্যুলেশন তৈরি ইত্যাদি যাবতীয় কার্যক্রমে নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ও অন্য সদস্যদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। এর বদলে সরাসরি মৃধার নিয়ন্ত্রণে এককভাবে সিনিয়র ওয়েলফেয়ার অফিসারের (পূর্ব) তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মূল্যায়িত উত্তরপত্রের নম্বর ঘষামাজা, কাটাকাটি ও ওভাররাইটিং করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে লিখিত পরীক্ষার ৩৩টি খাতায় কাটাকাটি/ওভাররাইটিং, ২৮টি খাতায় নম্বর কেটে বাড়িয়ে এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে গ্রেস নম্বর দিয়ে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ২৫০ জন প্রার্থীকে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১৫১ জন প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ দেখিয়ে নিয়োগবঞ্চিত করা হয়।
একইভাবে গুডস সহকারী পদে সাতটি খাতায় ওভাররাইটিং করে নম্বর বাড়ানো হয়েছে। টিঅ্যান্ডটি পদের পরীক্ষায় ১০টি উত্তরপত্রে নম্বর কেটে বাড়িয়ে তাদের থেকে চারজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সহকারী লোকো মাস্টার পদে পরীক্ষায় ৩৯টি খাতার নম্বর বাড়ানো হয় এবং পরে গ্রেস নম্বর দিয়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য যোগ্য করে মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর দিয়ে ২৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর গ্রেস নম্বর ছাড়াই প্রকৃত উত্তীর্ণ ৩৮ জন প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বা কম নম্বর দিয়ে নিয়োগবঞ্চিত করা হয়।
কার্পেন্টার পদে ৫০ নম্বর পাওয়া প্রার্থীর নম্বর কমিয়ে ৩৫ এবং ২৫ নম্বর পাওয়া প্রার্থীর নম্বর বাড়িয়ে ৩৪ করে মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে-কমিয়ে লিখিত পরীক্ষায় ২৫ নম্বর প্রাপ্ত প্রার্থীকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৫০ নম্বর পাওয়া প্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন।
টুলকিপার পদে লিখিত পরীক্ষায় পাঁচজন উত্তীর্ণ হলেও প্রকৃত উত্তীর্ণ ৫৫, ৫১, ৪৬.৫ নম্বর পাওয়া প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় না ডেকে ৪০ ও ৩৪ নম্বর পাওয়া মাত্র দুজনকে এবং অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদের নম্বর কেটে-বাড়িয়ে মোট ১৫ জনের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রকৃত উত্তীর্ণ মাত্র দুজন (কোড নং-৬৪০ ও ৭০৫) এবং অনুত্তীর্ণ পাঁচজনসহ (রোল নং চাঁদপুর-১৭, রাজশাহী-২, ফেনী-১, জামালপুর-৪, চাঁদপুর-২) মোট সাতজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সিনিয়র ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষায় মাত্র ছয়জন উত্তীর্ণ হলেও টেবুলেশন শিট ঘষামাজা করে আরো দুজনকে (কোড নং-২ ও ১৭) উত্তীর্ণ দেখিয়ে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। কোর্ট ইন্সপেক্টর পদে লিখিত পরীক্ষায় একজন উত্তীর্ণ হয় (কোড-সিএল-৫)। তবে মৌখিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ দুজনসহ তিনজনকে ডাকা হয়েছে। রেকর্ডকিপার পদে লিখিত পরীক্ষার খাতায় (কোড নম্বর আরকেএক্স-১১) প্রাপ্ত নম্বর ঘষামাজা করে ৪৬-কে ৪০ করা হয়েছে এবং আরকেএক্স-১৭-এর প্রাপ্ত ৩১ নম্বরকে ঘষামাজা করে ৩৭.৫০ করে মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে টিকিট ইস্যুয়ার পদে লিখিত পরীক্ষার খাতার কোড ১১০৬, ১১৭৫, ১১৯২ ও ১২৩১ এর নম্বর বাড়ানো ও কমানো হয়। ফুয়েল চেকার পদে লিখিত পরীক্ষায় প্রকৃতপক্ষে পাঁচজন পাস করে। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয় ১০ জনকে। আবার এর মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কেবল একজনকে (প্রাপ্ত নম্বর-৩২) মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়েছে। প্রকৃত উত্তীর্ণ তিনজনকে (প্রাপ্ত নম্বর-৫০.৫০ কোড নং-১৩১৭, প্রাপ্ত নম্বর ৩৯.৫০-কোড নম্বর-১৩৩৭ এবং প্রাপ্ত নম্বর ৩৩.৫০-কোড নম্বর ১৪১২) মৌখিক পরীক্ষায় ডাকাই হয়নি।
সহকারী কেমিস্ট পদের লিখিত পরীক্ষায় চারজন উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয় ১২ জনকে। এর মধ্যে ১০ জন মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। টেব্যুলেশন শিটে ওই ১০ জনের লিখিত পরীক্ষার যে নম্বর দেখানো আছে শিক্ষকদের প্রদত্ত নম্বরের সঙ্গে তার কোনো মিলই নেই।
নিয়োগ কমিটি গঠনের পর থেকে চূড়ান্ত সুপারিশ প্রণয়ন পর্যন্ত সব কার্যক্রম কমিটির তত্ত্বাবধানে করার বিধান রয়েছে। তা লঙ্ঘন করে চতুর্থ শ্রেণীর সব ক্যাটাগরির মৌখিক পরীক্ষায় প্রত্যেক সদস্যের প্রদত্ত মূল নম্বরশিট পরীক্ষা শেষে ওই দিনই তাদের কাছ থেকে নিয়ে ইউসুফ মৃধা মাসের পর মাস চট্টগ্রামের সিনিয়র ওয়েলফেয়ার অফিসারের (পূর্ব) কাছে রাখার অবৈধ নির্দেশ দিয়েছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
কোটা পদ্ধতি লঙ্ঘন : সংবিধানের ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৯৮৫ ও ১৯৯২ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী জেলা কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। ২০১০ সালের ২৯ আগস্টের সভায় এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ২৫ ক্যাটাগরির নিয়োগে তা অনুসরণ করা হয়নি। চৌকিদার পদে সাতটি জেলার কাউকে চাকরি দেওয়া হয়নি। ১২ জেলা থেকে ১৭ প্রার্থী কম নিয়ে ২১টি জেলা থেকে ২৬ জন অতিরিক্ত প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে ৩২টি জেলা থেকে প্রাপ্যতা থাকলেও মাত্র ২০ জেলা থেকে ৭১ জনকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। সুইপার পদে ২৯ জেলা থেকে ৫৪ জনকে বাদ নিয়ে ২৪টি জেলা থেকে ৫৪ জন বেশি চাকরি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ট্রলিম্যান পদে ১৫টি জেলাকে প্রাপ্যতার তুলনায় ২১ জন কম এবং তিনটি জেলা থেকে কোনো প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হয়নি। সহকারী লোকো মাস্টার পদে ২৮টি জেলা থেকে ৩২ জন প্রার্থীকে কম এবং চারটি জেলা থেকে কোনো প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.