গণমাধ্যম-সংবাদপত্রের ভূত-ভবিষ্যৎ by সাখাওয়াত আলী খান
সন্দেহ নেই, আমাদের দেশে এখন সংবাদপত্রের সংখ্যা অনেক। কেউ কেউ এটাকে সংবাদপত্রের 'বিস্ফোরণ' বলেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। জনপ্রিয় ধারণাটি হচ্ছে, এখানে পাঠকের তুলনায় সংবাদপত্রের সংখ্যা বেশি। জাতীয় দৈনিকগুলোর কথাই ধরা যাক। এগুলোর মোট প্রচার সংখ্যা সম্ভবত কমবেশি ১০ লাখ।
দেশের প্রধান কয়েকটি দৈনিক মিলেই এই প্রচার সংখ্যা। এর বাইরে আরও শত শত যেসব সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, সেগুলোর মিলিত প্রচার সংখ্যা নগণ্য। এখন প্রধান প্রধান দৈনিকের প্রচার সংখ্যা যদি ১০ লাখ ধরি, এগুলোর মোট পাঠক সংখ্যা ৪০ লক্ষাধিক হতে পারে। কারণ ধরে নেওয়া হয়, একটি সংবাদপত্র গড়ে চারজন পাঠক পাঠ করে থাকেন। এই গড় সংখ্যা বেশি হলে হয়তো পাঠক সংখ্যায়ও হেরফের হতে পারে। অন্যদিকে আমাদের দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি বা এর কিছু বেশি। তার মানে, মোট জনসংখ্যার তুলনায় পাঠকের শতকরা হার তিন ভাগের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কথাটা ঘুরিয়ে বললে বলা যায়, এ দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষই সংবাদপত্র পড়ে না। ওই ৯৭ ভাগের মধ্যে অবশ্য নিরক্ষর মানুষ ও শিশুরা রয়েছে, যাদের সংবাদপত্র পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। যদিও দেশের প্রধান দৈনিকগুলো নিয়েই এই হিসাব, তবু এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, সংবাদপত্র পাঠের এই চিত্র আশা জাগানিয়া নয়।
সংবাদপত্র দেশের কতভাগ মানুষের কাছে পেঁৗছতে পারছে_ সে প্রশ্ন তো আছেই; অনেক সংবাদপত্র সম্পর্কে এ অভিযোগও রয়েছে যে, তারা সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে চলে না। কোনো কোনোটির মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে মানহীন ও প্রশ্নবিদ্ধ সংবাদপত্রগুলো পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও পায় না। অর্থাৎ দেশে মানসম্মত, গ্রহণযোগ্য ও প্রচার সংখ্যায় সমৃদ্ধ সংবাদপত্রের সংখ্যা বেশি নয়। সে ক্ষেত্রে তথাকথিত বিস্ফোরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার তেমন কারণ আমি দেখি না। আর যেসব পত্রিকার পাঠক নগণ্য, সেগুলোর সু বা কুপ্রভাব নিয়ে আলোচনার কী আছে? পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতাহীন সংবাদপত্রগুলো একপর্যায়ে স্বাভাবিক নিয়মে বিলীন হয়ে যাবে। আর যেসব সংবাদপত্র সাংবাদিকতা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়, সেগুলো অর্থের জোরে হয়তো কিছুদিন টিকে থাকবে; কিন্তু জনগণের ওপর তাদের প্রভাবও নগণ্য হবে বিধায় দুশ্চিন্তার তেমন কোনো কারণ নেই।
এ কথা সত্য, দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চালু হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি সম্প্রচারের অপেক্ষায়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এই মিছিলে যুক্ত হয়েছে বেশকিছু বেসরকারি এফএম রেডিও। যদিও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন, শেষ পর্যন্ত সব টেলিভিশন চ্যানেল টিকে থাকতে পারবে কি-না। কিন্তু কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল তো ইতিমধ্যেই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। সামনের দিনগুলোতে এমন সফল চ্যানেলের সংখ্যা হয়তো কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু অজনপ্রিয় চ্যানেলগুলোর ভাগ্য সম্পর্কে উপরোক্ত সংবাদপত্রগুলোর মতো একই মন্তব্য করা সমীচীন হবে বলে মনে হয় না।
সংবাদপত্রের মুদ্রণ ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। অন্যতম প্রধান একটি দৈনিকের সম্পাদক কিছুদিন আগে আমাকে হিসাব দিয়ে বলেছিলেন, প্রতি সংখ্যা পত্রিকার জন্য তাদের খরচ পড়ে ১৯ টাকা। পত্রিকাটি বিক্রি হয় আট টাকায়। হকার ও এজেন্টদের কমিশন ও পরিবহন খরচ বাদ দিলে তাদের কাছে তিন-চার টাকার বেশি ফেরত আসে না। এটা সহজেই বোধগম্য, সংবাদপত্র প্রকাশের এই বিপুল খরচ পুষিয়ে নেওয়ার প্রধান উপায় হচ্ছে যথেষ্ট বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি। পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির প্রশ্নে ইলেকট্রনিক মাধ্যমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফলে এই পরিস্থিতির স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে প্রধান প্রধান দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বড় বড় বিজ্ঞাপনদাতার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়া। সাংবাদিকতার জন্য এটি সুখবর নয়। এফএম রেডিওর ক্ষেত্রে কী ঘটবে, সেটা বলার সময় সম্ভবত এখনও আসেনি।
টেলিভিশন চ্যানেল, এফএম রেডিও কিংবা অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একটি আশঙ্কার কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়, ইলেকট্রনিক মাধ্যমের দাপটে মুদ্রণ মাধ্যম ক্ষীয়মাণ হয়ে যাবে। পশ্চিমা বিশ্বে এমন নজির দেখাও যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, পশ্চিমা বিশ্ব ও আমাদের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে এ ক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ফলে আমার ধারণা, সংবাদপত্র 'বিস্ফোরণ' অদূর ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। আমাদের দেশের সংবাদপত্রের জন্য বরং প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশের নিরক্ষরতা। শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে মানুষকে আরও সচেতন করে তোলা গেলে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা আশাতীত বেড়ে যাবে বলেই ধারণা করা যায়। এ কথাও মনে রাখতে হবে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমের জনপ্রিয়তা নানা কারণে অপ্রতিরোধ্য হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুদ্রণ মাধ্যম তার গ্রাহকের জন্য সুবিধাজনক। মুদ্রণ মাধ্যম বেশি স্থায়িত্বশীল, সংরক্ষণ করা যায়। একই সংবাদ বারবার, নিজের মতো করে, আয়েশ করে পড়া যায়। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে পাঠকের প্রাথমিক ব্যয় অধিকাংশের নাগালের মধ্যে থাকে ইত্যাদি। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় না, টেলিভিশন চ্যানেলের বিস্তারে এ দেশে অদূর ভবিষ্যতে মুদ্রণ মাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উভয় মাধ্যমের ক্ষেত্রে একটি কথা সত্য, তারা এ দেশের পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের চাহিদা সম্ভবত ষোলোআনা পূরণ করতে পারছে না_ এই অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। সংবাদমাধ্যমের অত্যধিক রাজনীতিকীকরণ এবং সাংবাদিকতায় নীতিহীনতা ও দুর্নীতির অভিযোগও একটি অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে থাকে। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে যথেষ্টসংখ্যক ব্যাখ্যামূলক ও অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনের অভাবও অনুভূত হচ্ছে। মোদ্দা কথায়, সাংবাদিকতার মূলধারায় ইতিবাচকতার মাত্রা যথেষ্ট নয়। কোনো কোনো সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত প্রচারও লক্ষ্য করা যায়। তারা সম্ভবত ভুলে যায়, পাঠক-দর্শকের এসব বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ নেই।
সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আরেকটি ঢালাও অভিযোগ হচ্ছে, তারা নেতিবাচক খবরকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, খবর তো খবরই। খবরকে ভালো-খারাপ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করার সুযোগ নেই। নেতিবাচক ঘটনা ঘটলে, এমনকি তা বারবার ঘটতে থাকলে গণমাধ্যমকে তা প্রকাশ করতেই হবে। অন্যথায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে নেতিবাচক সংবাদের জন্য সংবাদমাধ্যমকে নয়, দোষারোপ করতে হবে অন্য কোথাও। এ অভিযোগের অবশ্য সারবস্তু আছে যে, আমাদের সংবাদপত্র যতটা শহরমুখী ততটা গ্রামমুখী নয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সমস্যা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা তাদের কাছে অনেকটাই উপেক্ষিত।
এই নিবন্ধের কলেবর না বাড়িয়েও আরেকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করা যায়। তা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের মালিকানা কাঠামো। আমাদের দেশে এ বিষয়টির ওপর যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। তবে সাদা চোখে দেখলে বলা যায়, প্রধানত ধনবানরাই এখানে সংবাদপত্র প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত। কোনো কোনো প্রকাশনার পেছনের শক্তি প্রধানত রাজনৈতিক। ফলে এই কাঠামো দরিদ্র ও শ্রমজীবীবান্ধব হওয়ার সুযোগ তেমন নেই। কেউ কেউ বলতে পারেন 'মুক্তবাজার' অর্থনীতিতে এটাই স্বাভাবিক। কথাটা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। এ বিষয়ে সিরিয়াস আলোচনা ও গবেষণা দরকার। অথচ আজ থেকে বহু বছর আগে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও আমরা কাঙাল হরিনাথ হিসেবে বিখ্যাত হরিনাথ মজুমদারের 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' পেয়েছিলাম। এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রায় নিঃস্ব মানুষটি কল্যাণমূলক সাংবাদিকতার সম্ভবত উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। দুঃখের সঙ্গে হলেও মেনে নিতে হবে, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে কাঙাল হরিনাথদের পুনরায় দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে সংস্কৃতিবান, রুচিবান, ধনবান ও সৎ মালিক এবং দক্ষ ও নীতিবান সম্পাদকের পরিচালিত সংবাদপত্র এ অভাব অনেকটাই পূরণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আদর্শ সাংবাদিকদের নেতৃত্বে আমরা হয়তো পাব নিরপেক্ষ, সুবিবেচক, বস্তুনিষ্ঠ, সৎ, রুচিশীল ও দায়িত্বশীল সংবাদপত্র।
ড. সাখাওয়াত আলী খান : সুপারনিউম্যারারি অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনুলিখিত
সংবাদপত্র দেশের কতভাগ মানুষের কাছে পেঁৗছতে পারছে_ সে প্রশ্ন তো আছেই; অনেক সংবাদপত্র সম্পর্কে এ অভিযোগও রয়েছে যে, তারা সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে চলে না। কোনো কোনোটির মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে মানহীন ও প্রশ্নবিদ্ধ সংবাদপত্রগুলো পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও পায় না। অর্থাৎ দেশে মানসম্মত, গ্রহণযোগ্য ও প্রচার সংখ্যায় সমৃদ্ধ সংবাদপত্রের সংখ্যা বেশি নয়। সে ক্ষেত্রে তথাকথিত বিস্ফোরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার তেমন কারণ আমি দেখি না। আর যেসব পত্রিকার পাঠক নগণ্য, সেগুলোর সু বা কুপ্রভাব নিয়ে আলোচনার কী আছে? পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতাহীন সংবাদপত্রগুলো একপর্যায়ে স্বাভাবিক নিয়মে বিলীন হয়ে যাবে। আর যেসব সংবাদপত্র সাংবাদিকতা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকাশিত হয়, সেগুলো অর্থের জোরে হয়তো কিছুদিন টিকে থাকবে; কিন্তু জনগণের ওপর তাদের প্রভাবও নগণ্য হবে বিধায় দুশ্চিন্তার তেমন কোনো কারণ নেই।
এ কথা সত্য, দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চালু হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি সম্প্রচারের অপেক্ষায়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এই মিছিলে যুক্ত হয়েছে বেশকিছু বেসরকারি এফএম রেডিও। যদিও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন, শেষ পর্যন্ত সব টেলিভিশন চ্যানেল টিকে থাকতে পারবে কি-না। কিন্তু কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল তো ইতিমধ্যেই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। সামনের দিনগুলোতে এমন সফল চ্যানেলের সংখ্যা হয়তো কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু অজনপ্রিয় চ্যানেলগুলোর ভাগ্য সম্পর্কে উপরোক্ত সংবাদপত্রগুলোর মতো একই মন্তব্য করা সমীচীন হবে বলে মনে হয় না।
সংবাদপত্রের মুদ্রণ ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। অন্যতম প্রধান একটি দৈনিকের সম্পাদক কিছুদিন আগে আমাকে হিসাব দিয়ে বলেছিলেন, প্রতি সংখ্যা পত্রিকার জন্য তাদের খরচ পড়ে ১৯ টাকা। পত্রিকাটি বিক্রি হয় আট টাকায়। হকার ও এজেন্টদের কমিশন ও পরিবহন খরচ বাদ দিলে তাদের কাছে তিন-চার টাকার বেশি ফেরত আসে না। এটা সহজেই বোধগম্য, সংবাদপত্র প্রকাশের এই বিপুল খরচ পুষিয়ে নেওয়ার প্রধান উপায় হচ্ছে যথেষ্ট বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি। পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির প্রশ্নে ইলেকট্রনিক মাধ্যমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফলে এই পরিস্থিতির স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে প্রধান প্রধান দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বড় বড় বিজ্ঞাপনদাতার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়া। সাংবাদিকতার জন্য এটি সুখবর নয়। এফএম রেডিওর ক্ষেত্রে কী ঘটবে, সেটা বলার সময় সম্ভবত এখনও আসেনি।
টেলিভিশন চ্যানেল, এফএম রেডিও কিংবা অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একটি আশঙ্কার কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়, ইলেকট্রনিক মাধ্যমের দাপটে মুদ্রণ মাধ্যম ক্ষীয়মাণ হয়ে যাবে। পশ্চিমা বিশ্বে এমন নজির দেখাও যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, পশ্চিমা বিশ্ব ও আমাদের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে এ ক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ফলে আমার ধারণা, সংবাদপত্র 'বিস্ফোরণ' অদূর ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। আমাদের দেশের সংবাদপত্রের জন্য বরং প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশের নিরক্ষরতা। শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে মানুষকে আরও সচেতন করে তোলা গেলে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হলে সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা আশাতীত বেড়ে যাবে বলেই ধারণা করা যায়। এ কথাও মনে রাখতে হবে, ইলেকট্রনিক মাধ্যমের জনপ্রিয়তা নানা কারণে অপ্রতিরোধ্য হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুদ্রণ মাধ্যম তার গ্রাহকের জন্য সুবিধাজনক। মুদ্রণ মাধ্যম বেশি স্থায়িত্বশীল, সংরক্ষণ করা যায়। একই সংবাদ বারবার, নিজের মতো করে, আয়েশ করে পড়া যায়। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে পাঠকের প্রাথমিক ব্যয় অধিকাংশের নাগালের মধ্যে থাকে ইত্যাদি। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় না, টেলিভিশন চ্যানেলের বিস্তারে এ দেশে অদূর ভবিষ্যতে মুদ্রণ মাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উভয় মাধ্যমের ক্ষেত্রে একটি কথা সত্য, তারা এ দেশের পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের চাহিদা সম্ভবত ষোলোআনা পূরণ করতে পারছে না_ এই অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। সংবাদমাধ্যমের অত্যধিক রাজনীতিকীকরণ এবং সাংবাদিকতায় নীতিহীনতা ও দুর্নীতির অভিযোগও একটি অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে থাকে। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে যথেষ্টসংখ্যক ব্যাখ্যামূলক ও অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনের অভাবও অনুভূত হচ্ছে। মোদ্দা কথায়, সাংবাদিকতার মূলধারায় ইতিবাচকতার মাত্রা যথেষ্ট নয়। কোনো কোনো সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত প্রচারও লক্ষ্য করা যায়। তারা সম্ভবত ভুলে যায়, পাঠক-দর্শকের এসব বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ নেই।
সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আরেকটি ঢালাও অভিযোগ হচ্ছে, তারা নেতিবাচক খবরকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, খবর তো খবরই। খবরকে ভালো-খারাপ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করার সুযোগ নেই। নেতিবাচক ঘটনা ঘটলে, এমনকি তা বারবার ঘটতে থাকলে গণমাধ্যমকে তা প্রকাশ করতেই হবে। অন্যথায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে নেতিবাচক সংবাদের জন্য সংবাদমাধ্যমকে নয়, দোষারোপ করতে হবে অন্য কোথাও। এ অভিযোগের অবশ্য সারবস্তু আছে যে, আমাদের সংবাদপত্র যতটা শহরমুখী ততটা গ্রামমুখী নয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সমস্যা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা তাদের কাছে অনেকটাই উপেক্ষিত।
এই নিবন্ধের কলেবর না বাড়িয়েও আরেকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করা যায়। তা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের মালিকানা কাঠামো। আমাদের দেশে এ বিষয়টির ওপর যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। তবে সাদা চোখে দেখলে বলা যায়, প্রধানত ধনবানরাই এখানে সংবাদপত্র প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত। কোনো কোনো প্রকাশনার পেছনের শক্তি প্রধানত রাজনৈতিক। ফলে এই কাঠামো দরিদ্র ও শ্রমজীবীবান্ধব হওয়ার সুযোগ তেমন নেই। কেউ কেউ বলতে পারেন 'মুক্তবাজার' অর্থনীতিতে এটাই স্বাভাবিক। কথাটা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। এ বিষয়ে সিরিয়াস আলোচনা ও গবেষণা দরকার। অথচ আজ থেকে বহু বছর আগে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও আমরা কাঙাল হরিনাথ হিসেবে বিখ্যাত হরিনাথ মজুমদারের 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' পেয়েছিলাম। এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রায় নিঃস্ব মানুষটি কল্যাণমূলক সাংবাদিকতার সম্ভবত উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। দুঃখের সঙ্গে হলেও মেনে নিতে হবে, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে কাঙাল হরিনাথদের পুনরায় দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে সংস্কৃতিবান, রুচিবান, ধনবান ও সৎ মালিক এবং দক্ষ ও নীতিবান সম্পাদকের পরিচালিত সংবাদপত্র এ অভাব অনেকটাই পূরণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আদর্শ সাংবাদিকদের নেতৃত্বে আমরা হয়তো পাব নিরপেক্ষ, সুবিবেচক, বস্তুনিষ্ঠ, সৎ, রুচিশীল ও দায়িত্বশীল সংবাদপত্র।
ড. সাখাওয়াত আলী খান : সুপারনিউম্যারারি অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অনুলিখিত
No comments