জনপরিবহন-বাস শ্রমিকরাই যেন নন্দঘোষ by শেখ রোকন
সপ্তাহ দুয়েক ধরে ঢাকা মহানগরীর জনপরিবহন ব্যবস্থায় কী নৈরাজ্য চলছে, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন_ এমন নয়। ভাড়া নিয়ে বাসযাত্রী ও শ্রমিকদের বিবাদ, কখনও কখনও সংঘর্ষ এখন সংবাদমাধ্যমের প্রতিদিনের শিরোনাম। উদ্বৃত্ত মানুষ ও অপর্যাপ্ত জনপরিবহনের এই নগরীতে যাতায়াতের নিত্যবিড়ম্বনা যাদের সইতে হয় না, তাদেরও বিষয়টি নিয়ে নির্লিপ্ত থাকার উপায় নেই।
রাশ আওয়ারে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা রোববার রাজধানীর কয়েকটি স্থানে বাস ভাংচুর করেছে। জনরোষ যে বাস ছেড়ে অন্যান্য যানবাহনের দিকেও তেড়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কি? দেড় কোটি মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নাগরিক সমস্যা স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক ইস্যুতেও পরিণত হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল যদিও এটাকে সরকারের 'সামগ্রিক ব্যর্থতার' অংশ হিসেবে দেখছে; অপেক্ষাকৃত ছোট দু'একটি রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যেই যাত্রীসাধারণের পক্ষে বিবৃতি প্রদান ও সীমিত কর্মসূচি নিয়েছে। বেশ কয়েকটি এলাকায় 'যাত্রী অধিকার' সুরক্ষা কমিটি তৈরি হয়েছে। আর বাস মালিকদের শক্তিশালী সংগঠন তো আগে থেকেই আছে। তারাও তৎপর। ঢাকা মহানগরীর জনপরিবহন সংকট এখন জাতীয় ইস্যু।
এটা ঠিক যে এ মাসের গোড়ায়, ৫ তারিখে পেট্রোলিয়াম ও ১২ তারিখে সিএনজির দাম বৃদ্ধি করার পর থেকেই ঢাকার পরিবহন খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু এও স্বীকার করতে হবে যে, সরকার আন্তরিকভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। আমরা দেখেছি, খানিকটা বিলম্বে হলেও মে মাসের ১৯ তারিখই সরকারের পক্ষ থেকে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। ঠিকমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে কি-না, তা দেখার জন্য এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী নিজে সাধারণ যাত্রীর মতো বাসে উঠে তদারক করেছেন। ওই উদ্যোগে অবশ্য আকর্ষণীয় সংবাদ তৈরি হলেও কাজের কাজ খুব একটা হয়নি। বরং কারও কারও বিবেচনায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। বিভিন্ন রুটের লোকাল বাসগুলো হঠাৎ করেই 'সিটিং সার্ভিস' দেওয়া শুরু করে। ফলে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীরা বিপদে পড়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাসের দেখা মেলে না। আর সব ধরনের বাসের ভাড়াই এক লাফে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে যাত্রী ও বাস শ্রমিকদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা, ধাক্কাধাক্কি, মারপিট হতে থাকে। এমনও অভিযোগ ওঠে যে, কেবল মারপিট করার জন্যই বাসে বাসে কয়েকজন করে ক্যাডার মজুদ রাখা হয়। ফলে দলে হালকা-ভারি হওয়ায় কোথাও যাত্রী, কোথাও বাস শ্রমিকরা প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হতে থাকে। রাশ আওয়ারগুলোতে ঢাকার রাজপথে যেন যুদ্ধাবস্থা, নিখুঁত নৈরাজ্য।
পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগমন্ত্রী শনিবার বাস মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাদের বলে দেন যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতেই কিন্তু বাসের নতুন ভাড়া তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এখন যদি সেটা না মানা হয় সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট_ মালিকদের পক্ষ থেকে পাল্টা হুমকি দেওয়া হয়, বেশি কঠোর পদক্ষেপ নিলে তারা ধর্মঘট ডাকবেন (ডেইলি স্টার, ২৯ মে)।
ওই বৈঠকের পরদিন রোববারও ঢাকার রাজপথের পরিস্থিতি কেমন ছিল, সমকালের সোমবারের প্রতিবেদনে তার খণ্ডচিত্র_ "পরিবহনে 'ভাড়া নৈরাজ্য' পরিস্থিতি রোববার আরও নাজুক হয়েছে। অফিস সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি না পেয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা বেআইনিভাবে 'সিটিং সার্ভিসে' পরিণত হওয়া লোকাল বাসে ভাংচুর চালিয়েছে। এদিকে রোববার ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৫৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় এবং ১৬১টি মামলা ও ৮টি বাস জব্দ করেছেন। এত কিছুর পরও বন্ধ হয়নি মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া আদায়। রোববারও প্রভাবশালী পরিবহন নেতাদের মালিকানাধীন বাস এনা পরিবহন (ডিজেলচালিত) এবং বিকল্প পরিবহনে শেওড়াপাড়া থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত মাত্র তিন কিলোমিটার দূরত্বে আদায় করা হয়েছে ১৩ টাকা ভাড়া। রোববার থেকে গাবতলী-আবদুল্লাহপুর রুটের ডিসকভারি এবং মিরপুর-আবদুল্লাহপুর রুটের বেঙ্গল পরিবহন ও কনক পরিবহনে সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা ঘোষণা করা হয়। নিজেদের ইচ্ছায় নতুন ভাড়া নির্ধারণ করেছে বাস কর্তৃপক্ষ। এদিকে বিকেলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সংবাদ সম্মেলনে এক সপ্তাহ আগে সিটিং সার্ভিসে পরিণত হওয়া বাসকে আগের মতো লোকাল বাসে রূপান্তরের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।"
বাসভাড়া নিয়ে সৃষ্ট নৈরাজ্যে সরকারের ভূমিকা যদি এক বাক্যে মূল্যায়ন করা যায়_ তারা আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন ঢাকার জনপরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্য অব্যাহত থাকবে তাও বাস্তব নয়। ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে যাত্রী ও বাস শ্রমিকদের বিবাদ এবারই প্রথম নয়। আমরা দেখেছি, যতবারই জ্বালানির দাম বেড়েছে, বাসের ভাড়া নিয়ে ততবারই নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। আবার এক সময় চরম অবস্থান নেওয়া দুই পক্ষ_ যাত্রী ও বাস শ্রমিকরা অনেকটা যেন প্রাকৃতিক নিয়মেই কিছুটা ছাড় দিয়ে মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছে। এবারও এর ব্যত্যয় হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে অনিশ্চিত ও অপ্রত্যাশিত শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার এই অগত্যা সমাধান কি বছরের পর বছর ধরে মেনে নিতে হবে?
আসলে জনপরিবহন খাতে বছরের পর বছর ধরে যে বিশৃঙ্খলা আমরা উপেক্ষা করে আসছি, ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। পরিবহন খাতে শ্রমিক নিয়োগ, চালকের সনদ, গাড়ির ফিটনেস_ এগুলো কি সুশৃঙ্খল? রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চলাচল, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো কি আমরা দিনের পর দিন বরদাশত করে আসছি না? কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক কদম হাঁটা এড়াতে যাত্রীরাই কি যেখানে-সেখানে বাস থামানো উৎসাহিত করে থাকে না? হরতাল-ধর্মঘটের মতো নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাস মালিক-শ্রমিকদের কি ব্যবহার করা হয়নি? বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনুৎসাহ দেখানো সুশীল পুঁজিপতিরা এই খাতের দুর্বৃত্তায়নের দায় কি এড়াতে পারেন? দেশে ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ রয়েছে। সেটার প্রয়োগের নিশ্চয়তা কি কর্তৃপক্ষ দিতে পেরেছেন? ইতিমধ্যে সংখ্যা ও গুণগত দিক থেকে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়া একটি খাতের জন্য তিন দশক আগের আইনটি কি যুগোপযোগী করা উচিত ছিল না? সবকিছু বিশৃঙ্খল রেখে কেবল ভাড়ার বিষয়টিতে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা বোকামি ও আত্মকেন্দ্রিকতা ছাড়া আর কী? বড় কথা, বছর বছর বাস শ্রমিকের বেতন বাড়ে, কর বাড়ে, যন্ত্রাংশের দাম বাড়ে, জ্বালানির দাম তো বাড়েই। বাসভাড়া বাড়বে না কেন? জ্বালানির দাম বাড়া ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে বাসভাড়া বৃদ্ধি কি আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত?
আর যে প্রশ্নটি না তুললেই নয়_ অতিরিক্ত বাসভাড়া আদায় কিংবা শৃঙ্খলা না মানার ডামাডোলে সবসময় বাস শ্রমিকরাই ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত হয়। আসলেই কি তারা দায়ী? অতিরিক্ত ভাড়া কি বাস শ্রমিকদের পকেটে যায়? নাকি তারা মালিকপক্ষ ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ক্রীড়নক মাত্র? খোঁজ নিলেই জানা যাবে, পেটের দায়ে কতটা ঝুঁকি নিয়ে, কত কম পারিশ্রমিক তারা উদয়স্ত রাস্তার ধুলোবালি, ধোঁয়ায় ট্রাফিক পুলিশের লাথি-গুঁতো, বাসযাত্রীর তাচ্ছিল্য, পান থেকে চুন খসলেই গালিগালাজ হজম করে চলছে। অস্বীকার করা যাবে না, জনপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া নাগরিক জীবনের বিরাট বিড়ম্বনা হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে; কিন্তু তার জন্য দরিদ্র, খেটে খাওয়া, শোষিত বাস শ্রমিকদের যেন নন্দঘোষ বানিয়ে না ফেলি।
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
এটা ঠিক যে এ মাসের গোড়ায়, ৫ তারিখে পেট্রোলিয়াম ও ১২ তারিখে সিএনজির দাম বৃদ্ধি করার পর থেকেই ঢাকার পরিবহন খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু এও স্বীকার করতে হবে যে, সরকার আন্তরিকভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। আমরা দেখেছি, খানিকটা বিলম্বে হলেও মে মাসের ১৯ তারিখই সরকারের পক্ষ থেকে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। ঠিকমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে কি-না, তা দেখার জন্য এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী নিজে সাধারণ যাত্রীর মতো বাসে উঠে তদারক করেছেন। ওই উদ্যোগে অবশ্য আকর্ষণীয় সংবাদ তৈরি হলেও কাজের কাজ খুব একটা হয়নি। বরং কারও কারও বিবেচনায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। বিভিন্ন রুটের লোকাল বাসগুলো হঠাৎ করেই 'সিটিং সার্ভিস' দেওয়া শুরু করে। ফলে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীরা বিপদে পড়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাসের দেখা মেলে না। আর সব ধরনের বাসের ভাড়াই এক লাফে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে যাত্রী ও বাস শ্রমিকদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা, ধাক্কাধাক্কি, মারপিট হতে থাকে। এমনও অভিযোগ ওঠে যে, কেবল মারপিট করার জন্যই বাসে বাসে কয়েকজন করে ক্যাডার মজুদ রাখা হয়। ফলে দলে হালকা-ভারি হওয়ায় কোথাও যাত্রী, কোথাও বাস শ্রমিকরা প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হতে থাকে। রাশ আওয়ারগুলোতে ঢাকার রাজপথে যেন যুদ্ধাবস্থা, নিখুঁত নৈরাজ্য।
পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগমন্ত্রী শনিবার বাস মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাদের বলে দেন যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতেই কিন্তু বাসের নতুন ভাড়া তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এখন যদি সেটা না মানা হয় সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট_ মালিকদের পক্ষ থেকে পাল্টা হুমকি দেওয়া হয়, বেশি কঠোর পদক্ষেপ নিলে তারা ধর্মঘট ডাকবেন (ডেইলি স্টার, ২৯ মে)।
ওই বৈঠকের পরদিন রোববারও ঢাকার রাজপথের পরিস্থিতি কেমন ছিল, সমকালের সোমবারের প্রতিবেদনে তার খণ্ডচিত্র_ "পরিবহনে 'ভাড়া নৈরাজ্য' পরিস্থিতি রোববার আরও নাজুক হয়েছে। অফিস সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি না পেয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা বেআইনিভাবে 'সিটিং সার্ভিসে' পরিণত হওয়া লোকাল বাসে ভাংচুর চালিয়েছে। এদিকে রোববার ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৫৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় এবং ১৬১টি মামলা ও ৮টি বাস জব্দ করেছেন। এত কিছুর পরও বন্ধ হয়নি মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া আদায়। রোববারও প্রভাবশালী পরিবহন নেতাদের মালিকানাধীন বাস এনা পরিবহন (ডিজেলচালিত) এবং বিকল্প পরিবহনে শেওড়াপাড়া থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত মাত্র তিন কিলোমিটার দূরত্বে আদায় করা হয়েছে ১৩ টাকা ভাড়া। রোববার থেকে গাবতলী-আবদুল্লাহপুর রুটের ডিসকভারি এবং মিরপুর-আবদুল্লাহপুর রুটের বেঙ্গল পরিবহন ও কনক পরিবহনে সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা ঘোষণা করা হয়। নিজেদের ইচ্ছায় নতুন ভাড়া নির্ধারণ করেছে বাস কর্তৃপক্ষ। এদিকে বিকেলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সংবাদ সম্মেলনে এক সপ্তাহ আগে সিটিং সার্ভিসে পরিণত হওয়া বাসকে আগের মতো লোকাল বাসে রূপান্তরের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।"
বাসভাড়া নিয়ে সৃষ্ট নৈরাজ্যে সরকারের ভূমিকা যদি এক বাক্যে মূল্যায়ন করা যায়_ তারা আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন ঢাকার জনপরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্য অব্যাহত থাকবে তাও বাস্তব নয়। ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে যাত্রী ও বাস শ্রমিকদের বিবাদ এবারই প্রথম নয়। আমরা দেখেছি, যতবারই জ্বালানির দাম বেড়েছে, বাসের ভাড়া নিয়ে ততবারই নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। আবার এক সময় চরম অবস্থান নেওয়া দুই পক্ষ_ যাত্রী ও বাস শ্রমিকরা অনেকটা যেন প্রাকৃতিক নিয়মেই কিছুটা ছাড় দিয়ে মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছে। এবারও এর ব্যত্যয় হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে অনিশ্চিত ও অপ্রত্যাশিত শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার এই অগত্যা সমাধান কি বছরের পর বছর ধরে মেনে নিতে হবে?
আসলে জনপরিবহন খাতে বছরের পর বছর ধরে যে বিশৃঙ্খলা আমরা উপেক্ষা করে আসছি, ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। পরিবহন খাতে শ্রমিক নিয়োগ, চালকের সনদ, গাড়ির ফিটনেস_ এগুলো কি সুশৃঙ্খল? রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চলাচল, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো কি আমরা দিনের পর দিন বরদাশত করে আসছি না? কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক কদম হাঁটা এড়াতে যাত্রীরাই কি যেখানে-সেখানে বাস থামানো উৎসাহিত করে থাকে না? হরতাল-ধর্মঘটের মতো নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাস মালিক-শ্রমিকদের কি ব্যবহার করা হয়নি? বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনুৎসাহ দেখানো সুশীল পুঁজিপতিরা এই খাতের দুর্বৃত্তায়নের দায় কি এড়াতে পারেন? দেশে ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ রয়েছে। সেটার প্রয়োগের নিশ্চয়তা কি কর্তৃপক্ষ দিতে পেরেছেন? ইতিমধ্যে সংখ্যা ও গুণগত দিক থেকে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়া একটি খাতের জন্য তিন দশক আগের আইনটি কি যুগোপযোগী করা উচিত ছিল না? সবকিছু বিশৃঙ্খল রেখে কেবল ভাড়ার বিষয়টিতে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা বোকামি ও আত্মকেন্দ্রিকতা ছাড়া আর কী? বড় কথা, বছর বছর বাস শ্রমিকের বেতন বাড়ে, কর বাড়ে, যন্ত্রাংশের দাম বাড়ে, জ্বালানির দাম তো বাড়েই। বাসভাড়া বাড়বে না কেন? জ্বালানির দাম বাড়া ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে বাসভাড়া বৃদ্ধি কি আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত?
আর যে প্রশ্নটি না তুললেই নয়_ অতিরিক্ত বাসভাড়া আদায় কিংবা শৃঙ্খলা না মানার ডামাডোলে সবসময় বাস শ্রমিকরাই ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত হয়। আসলেই কি তারা দায়ী? অতিরিক্ত ভাড়া কি বাস শ্রমিকদের পকেটে যায়? নাকি তারা মালিকপক্ষ ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ক্রীড়নক মাত্র? খোঁজ নিলেই জানা যাবে, পেটের দায়ে কতটা ঝুঁকি নিয়ে, কত কম পারিশ্রমিক তারা উদয়স্ত রাস্তার ধুলোবালি, ধোঁয়ায় ট্রাফিক পুলিশের লাথি-গুঁতো, বাসযাত্রীর তাচ্ছিল্য, পান থেকে চুন খসলেই গালিগালাজ হজম করে চলছে। অস্বীকার করা যাবে না, জনপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া নাগরিক জীবনের বিরাট বিড়ম্বনা হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে; কিন্তু তার জন্য দরিদ্র, খেটে খাওয়া, শোষিত বাস শ্রমিকদের যেন নন্দঘোষ বানিয়ে না ফেলি।
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
No comments