'আমার এখন হাজারটা পা'
গত ১৭ মে মঙ্গলবার বুদ্ধ পূর্ণিমার সরকারি ছুটির সুবাদে আমরা বাংলাদেশের খুব সাধারণ কয়েকজন নাগরিক ও ইন্টারনেটে ফেসবুকনির্ভর গ্রুপ 'লিমনের জন্য, জীবনের জন্য'র জনা তিন-চারজন সদস্য ঢাকার শ্যামলীর পঙ্গু হাসপাতালে লিমনকে দেখতে যাই।
পঙ্গু হাসপাতালের তিনতলার করিডোরে গিয়ে একে-ওকে শুধাতেই কয়েকজন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল লিমনের ওয়ার্ড এবং তাদের কাছ থেকেই জানা গেল যে, লিমন হাসপাতালে আছে। লিমনের ওয়ার্ডে ঢুকবার মুখেই দাড়িঅলা এক অনতি মধ্যবয়সী ব্যক্তিকে দেখিয়ে কেউ কেউ বলল, 'তিনি লিমনের আব্বা।' লিমনের বাবা আমাদের সালাম দিয়ে অসুস্থ পুত্রের শয্যাপাশে নিয়ে গেলেন। তখন গোধূলির আলো ঈষৎ লম্বমান হয়ে লিমনের শয্যার ওপর পড়েছে এবং সেই লালাভ আলোয় এক হালকা-পাতলা কিশোরকে আমরা দেখলাম বিছানায় বালিশে ঠেস দিয়ে বসে একটি ইংরেজি ডিকশনারি পড়ছে। তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে বেশকিছু সংবাদপত্র ও পত্রিকা। একটি নীল রঙের টি-শার্ট ও লুঙ্গি পরা এই কিশোর আমাদের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হেসে জিজ্ঞেস করল, 'কেমন আছেন আপনারা?' এবার হতবিহ্বল হওয়ার অবস্থা আমাদেরই।
'তুমি কেমন আছ লিমন?'
'জি। আল্লাহর ইচ্ছায় এবং আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছি,' একটু থামে লিমন। তারপর আবার শুরু করে, 'কত মানুষ দেখতে এসেছে আমাকে। মিজানুর রহমান স্যার, ব্যারিস্টার সারা হোসেন... এই আপনারা এলেন... এত মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি।'
'তুমি এটা কী পড়ছিলে?'
'ডিকশনারি। এবার পরীক্ষা দিতে পারলাম না। ইচ্ছা আছে সামনেরবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেব।'
লিমনের চোখ নয়, এবার আমাদের চোখই ঝাপসা হয়ে আসতে চায়। এই অপাপবিদ্ধ কিশোরের একটি পা কেন গুলি করে কেটে নিতে হলো দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এলিট ফোর্সের সশস্ত্র সদস্যদের? কেনই-বা সরকার এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে লিমনের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসছে না? কেন এই অসহায় কিশোরকে দেখার সময় অদ্যাবধি করে উঠতে পারলেন না আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রী?
ষোলো বছরের লিমন আমাদের শোনায় তার জীবনের সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া রক্ত হিম হওয়া আখ্যান।
'মানুষের কাছে ধারকর্জ কইরা পাঁচ হাজার টাকায় একটা মাইক্রো ভাড়া কইরা আমার বাবা-মা আমারে ঢাকায় নিয়া এলো'_ লিমন বলে চলে।
"ঢাকায় প্রথমে আমারে আনছে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। তারপর সেইখান থিকা আমারে রেফার করছে পঙ্গুতে। পঙ্গুতে ডাক্তাররা কইল আমার পা কাইটা ফেলতে হবে। ২৭ এপ্রিল দুপুর ১টায় আমারে ওটিতে নিব কইল। আমার মা ডাক্তারদের বলল, আমার ছেলের পা'টা বাঁচান। কিন্তু ডাক্তাররা দ্যাখে কি সেপটিক প্রতি ইঞ্চি লাফায় লাফায় উপরে উঠতেছে। ডাক্তার আমারে বলল, 'তুমি তোমার পা চাও না জীবন চাও?' আমি তখন শুধু কানতেছি।"
তবু জীবন নিয়ে এখনও অনেক স্বপ্ন ও আশা লিমনের। 'আমার বাসা থিকা কলেজ প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূর। আসতে-যাইতে বাসভাড়া লাগে দশ টাকা। তাই দুই টাকায় খেয়া পার হইতাম তিন-চাইর কিলোমিটার আর বাকি এক-দুই কিলোমিটার হাঁটতাম। তা সমস্যা হবে না।
আহা, লিমনের সব স্বপ্ন ও আশা পূরণ হোক! পড়ূয়া লিমন আমাদের আব্রাহাম লিঙ্কনের গল্প শোনায়। দেখায় প্রথম আলো, সমকাল ও সাপ্তাহিকসহ নানা পত্রিকায় ওর ওপর লেখা সংবাদ ও নিবন্ধ।
'গতকাল সাভারে তুমি কোথায় গেছিলে?'
'আমারে সিআরপি হাসপাতালে নিছিল। সেইখানে আমার পায়ের মাপ নিছে। কৃত্রিম পায়ের জন্য। জানেন, ডাক্তাররা বলছেন আমার কাটা পায়ের উপরের যে অংশটা এখনও বাকি আছে, সেইটায় অনেক জোর আছে। আমি অনেক ফুটবল খেলছি তো। এই জোরঅলা অংশটার নিচে কৃত্রিম পা ভালোই জোড়া লাগতে পারে। তখন তো আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে যাব'_ প্রগাঢ় উদ্দীপনায় লিমনের চোখ জোড়া চকচক করে। হে অলক্ষ্য ডানার কিশোর দেবদূত! তুমি বাঁচো, তুমি হাঁটো!
অসুস্থ লিমন আমাদের সঙ্গে আতিথেয়তাও করতে চায়, 'আপনারা আমার জন্য যে ফল আনছেন... অনেকেই অনেক কিছু আনে... এইখান থেকেই কিছু খান!' অশ্রু সংবরণ করা তখন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
বের হয়ে আসার সময় লিমনের বাবা আমাদের বলেন, 'আমি আর কিছু চাই না- আমি শুধু ন্যায়বিচার চাই। আমারে এর মধ্যেই কেউ কেউ আপসরফার প্রস্তাব দিছে। বলছে, আমার ছেলেরে সিঙ্গাপুরে পাঠায় চিকিৎসা করাবে। শুধু যেন আমি মামলা তুইলা নিই। আমি গরিব দিনমজুর হইতে পারি, কিন্তু আমি লোভী না। যে সাংবাদিকরা, মিজানুর রহমান স্যার, যে উকিলরা মামলা লড়ছেন, যারা যারা আমার ছেলের পক্ষে দাঁড়াইছেন, তাদের মত নিয়াই আমি লিমনের চিকিৎসা করাব। বাংলাদেশে থাইকাই যেটুকু চিকিৎসা হবে, সেটুকু চিকিৎসায় আমার ছেলে বাঁচলে বাঁচবে আর মরলে মরবে। আমি নির্লোভ বইলাই গরিব হওয়া সত্ত্বেও আমার তিনটি ছেলেমেয়েই শিক্ষিত। বড় দু'জন বিএ পড়তেছে আর লিমন এইবার ইন্টারমিডিয়েট দিত। লিমনরে যে রাতে বরিশাল জেল থিকা বেইলে বাইর কইরা হাসপাতালে নিয়া যাচ্ছি, অত রাতে রাস্তার দুই পাশে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ শুধু আমার ছেলেরে একনজর দেখতে দাঁড়ায় আছে। মানুষের এই ভালোবাসা ক্যামনে ভুলি?' লিমনের বাবার চোখে জল।
'প্রথম প্রথম একটা পা যাওয়ার পর আমার খুব কষ্ট লাগছে। কিন্তু এখন আর কষ্ট লাগে না। মনে হয় বাংলাদেশের হাজারটা মানুষ আমার সঙ্গে আছে। তাদের সবাইর পায়ে ভর করে আমার তো এখন হাজারটা পা'_লিমন স্বপ্নভরা চোখে বলে।
'তুমি কেমন আছ লিমন?'
'জি। আল্লাহর ইচ্ছায় এবং আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছি,' একটু থামে লিমন। তারপর আবার শুরু করে, 'কত মানুষ দেখতে এসেছে আমাকে। মিজানুর রহমান স্যার, ব্যারিস্টার সারা হোসেন... এই আপনারা এলেন... এত মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি।'
'তুমি এটা কী পড়ছিলে?'
'ডিকশনারি। এবার পরীক্ষা দিতে পারলাম না। ইচ্ছা আছে সামনেরবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেব।'
লিমনের চোখ নয়, এবার আমাদের চোখই ঝাপসা হয়ে আসতে চায়। এই অপাপবিদ্ধ কিশোরের একটি পা কেন গুলি করে কেটে নিতে হলো দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এলিট ফোর্সের সশস্ত্র সদস্যদের? কেনই-বা সরকার এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে লিমনের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসছে না? কেন এই অসহায় কিশোরকে দেখার সময় অদ্যাবধি করে উঠতে পারলেন না আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রী?
ষোলো বছরের লিমন আমাদের শোনায় তার জীবনের সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া রক্ত হিম হওয়া আখ্যান।
'মানুষের কাছে ধারকর্জ কইরা পাঁচ হাজার টাকায় একটা মাইক্রো ভাড়া কইরা আমার বাবা-মা আমারে ঢাকায় নিয়া এলো'_ লিমন বলে চলে।
"ঢাকায় প্রথমে আমারে আনছে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। তারপর সেইখান থিকা আমারে রেফার করছে পঙ্গুতে। পঙ্গুতে ডাক্তাররা কইল আমার পা কাইটা ফেলতে হবে। ২৭ এপ্রিল দুপুর ১টায় আমারে ওটিতে নিব কইল। আমার মা ডাক্তারদের বলল, আমার ছেলের পা'টা বাঁচান। কিন্তু ডাক্তাররা দ্যাখে কি সেপটিক প্রতি ইঞ্চি লাফায় লাফায় উপরে উঠতেছে। ডাক্তার আমারে বলল, 'তুমি তোমার পা চাও না জীবন চাও?' আমি তখন শুধু কানতেছি।"
তবু জীবন নিয়ে এখনও অনেক স্বপ্ন ও আশা লিমনের। 'আমার বাসা থিকা কলেজ প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূর। আসতে-যাইতে বাসভাড়া লাগে দশ টাকা। তাই দুই টাকায় খেয়া পার হইতাম তিন-চাইর কিলোমিটার আর বাকি এক-দুই কিলোমিটার হাঁটতাম। তা সমস্যা হবে না।
আহা, লিমনের সব স্বপ্ন ও আশা পূরণ হোক! পড়ূয়া লিমন আমাদের আব্রাহাম লিঙ্কনের গল্প শোনায়। দেখায় প্রথম আলো, সমকাল ও সাপ্তাহিকসহ নানা পত্রিকায় ওর ওপর লেখা সংবাদ ও নিবন্ধ।
'গতকাল সাভারে তুমি কোথায় গেছিলে?'
'আমারে সিআরপি হাসপাতালে নিছিল। সেইখানে আমার পায়ের মাপ নিছে। কৃত্রিম পায়ের জন্য। জানেন, ডাক্তাররা বলছেন আমার কাটা পায়ের উপরের যে অংশটা এখনও বাকি আছে, সেইটায় অনেক জোর আছে। আমি অনেক ফুটবল খেলছি তো। এই জোরঅলা অংশটার নিচে কৃত্রিম পা ভালোই জোড়া লাগতে পারে। তখন তো আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে যাব'_ প্রগাঢ় উদ্দীপনায় লিমনের চোখ জোড়া চকচক করে। হে অলক্ষ্য ডানার কিশোর দেবদূত! তুমি বাঁচো, তুমি হাঁটো!
অসুস্থ লিমন আমাদের সঙ্গে আতিথেয়তাও করতে চায়, 'আপনারা আমার জন্য যে ফল আনছেন... অনেকেই অনেক কিছু আনে... এইখান থেকেই কিছু খান!' অশ্রু সংবরণ করা তখন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
বের হয়ে আসার সময় লিমনের বাবা আমাদের বলেন, 'আমি আর কিছু চাই না- আমি শুধু ন্যায়বিচার চাই। আমারে এর মধ্যেই কেউ কেউ আপসরফার প্রস্তাব দিছে। বলছে, আমার ছেলেরে সিঙ্গাপুরে পাঠায় চিকিৎসা করাবে। শুধু যেন আমি মামলা তুইলা নিই। আমি গরিব দিনমজুর হইতে পারি, কিন্তু আমি লোভী না। যে সাংবাদিকরা, মিজানুর রহমান স্যার, যে উকিলরা মামলা লড়ছেন, যারা যারা আমার ছেলের পক্ষে দাঁড়াইছেন, তাদের মত নিয়াই আমি লিমনের চিকিৎসা করাব। বাংলাদেশে থাইকাই যেটুকু চিকিৎসা হবে, সেটুকু চিকিৎসায় আমার ছেলে বাঁচলে বাঁচবে আর মরলে মরবে। আমি নির্লোভ বইলাই গরিব হওয়া সত্ত্বেও আমার তিনটি ছেলেমেয়েই শিক্ষিত। বড় দু'জন বিএ পড়তেছে আর লিমন এইবার ইন্টারমিডিয়েট দিত। লিমনরে যে রাতে বরিশাল জেল থিকা বেইলে বাইর কইরা হাসপাতালে নিয়া যাচ্ছি, অত রাতে রাস্তার দুই পাশে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ শুধু আমার ছেলেরে একনজর দেখতে দাঁড়ায় আছে। মানুষের এই ভালোবাসা ক্যামনে ভুলি?' লিমনের বাবার চোখে জল।
'প্রথম প্রথম একটা পা যাওয়ার পর আমার খুব কষ্ট লাগছে। কিন্তু এখন আর কষ্ট লাগে না। মনে হয় বাংলাদেশের হাজারটা মানুষ আমার সঙ্গে আছে। তাদের সবাইর পায়ে ভর করে আমার তো এখন হাজারটা পা'_লিমন স্বপ্নভরা চোখে বলে।
No comments