শিশু শিক্ষা-ছবি গান আর সুর-ছন্দে বিকশিত শৈশব by কামরুননেসা হাসান

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন— ‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’। চিৎকার করে তার আগমনবার্তা জানান দেয় নবজাতক শিশু। ধনাঢ্য মা-বাবা নানা আয়োজনে পেরেশান—কান্না থামাতে—হাসি ফোটাতে—


আর সহায়-সম্বলহীন জীর্ণশীর্ণ মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ভাবে—এ যে বড় আপদ।
ধীরে ধীরে এই আপদ অনাহারে-অনাদরে বেড়ে ওঠে।
পাপ-পুণ্য বোঝে না। ক্ষুধার জ্বালায়, দারিদ্র্যের কশাঘাতে জীবন জর্জরিত।
দুই বেলা অন্ন জোটাতেই মা-বাবার নিরন্তর পরিশ্রম।
আরও করুণ চিত্র দেখা যায়—বাবা তিন-চারজন সন্তান জন্ম দেওয়ার পর সব ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। অভাগিনী মা, বয়স কত হবে ২০-২২ বছর। এতগুলো মুখের অন্ন জোগাড় করা যে একেবারেই অসম্ভব। ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। এই শিশুরাই একটা সময় বখে যায়, হারিয়ে যায় কোনো অন্ধ গলিতে।
অন্ধকারে যার বাস শিক্ষার আলো পৌঁছাবে কি এদের ধারে। সংখ্যায় ওরা কত? তার হিসাব মেলা ভার। ওরা কি অন্ধকারেই থাকবে? এতে করে শুধু ওরাই তলিয়ে যাবে না, একসময় আমাদের আলোও নিভে যাবে, যদি না ওদের আলোকিত করতে পারি।
তাই তো সেই আলোর প্রদীপ নিয়ে এল ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রম। ব্র্যাক স্কুল শিক্ষা কার্যক্রমে একজন শিক্ষিকা একটি শ্রেণীকক্ষে স্থানভেদে ২৫ থেকে ৩৩ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এরপর এই শিশুদের সরকারি বা বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া হয়।
ব্র্যাক তার শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের মাধ্যমে শিক্ষিকাদের মানসম্পন্ন শিক্ষাদান পদ্ধতি ও পেশাগত মানবৃদ্ধির প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ন্যূনতম সুবিধা দেওয়াটাই বাংলাদেশের জন্য একটা বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। নানা জটিলতার আষ্ঠেপৃষ্ঠে জর্জরিত বাংলাদেশের পক্ষে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা খুবই সমস্যা। তাই তো ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠান সরকারের পাশাপাশি এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ভাগ্য পরিবর্তনে এগিয়ে এসেছে। সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমের চর্চা ব্র্যাক স্কুলের কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
এই চর্চা শিশুদের সামাজিক, আবেগিক, ভাষাগত, যোগাযোগের দক্ষতা, সৃজনশীলতা সর্বোপরি সর্বাঙ্গীণ বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। লেখাপড়ার পাশাপাশি ব্র্যাক স্কুলে যে ধরনের সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমের চর্চা হয়ে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নাচ-গান-অভিনয়-গল্পবলা-আবৃত্তি ও চিত্রাঙ্কন।
এই কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেন স্কুলের শিক্ষিকারা। মৌলিক প্রশিক্ষণ ও মাসিক রিফ্রেশার্স প্রশিক্ষণে শিক্ষিকারা সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমের চর্চা করেন। শ্রেণীকক্ষে ক্লাসরুটিন অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের এগুলো চর্চা করানো হয়। তারা এগুলো উপভোগ করে। ব্র্যাক বিশ্বাস করে যে এ ধরনের সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমের চর্চা শিশুদের সৃজনশীলতা ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়ে তাদের প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করে এবং বুদ্ধির স্ফুরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমকে পাঠক্রমের একটি অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রম ব্র্যাক প্রি-প্রাইমারি ও প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ছন্দ ও শৈলীতে বুদ্ধি বিকাশ কার্যক্রম ‘দীপশিখা’র আয়োজন করে।
‘চিত্র-গীতি-সুর ও ছন্দে বিকশিত হোক শৈশব’—এ স্লোগানকে সামনে রেখে আয়োজন করা হয় এক প্রতিযোগিতার। ‘দীপশিখা’র সব শিশুই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশগ্রহণ করে থাকে।
বর্তমানে ব্র্যাক স্কুল শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত সব সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রম ‘দীপশিখা’র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালাতে সকালবেলায় সলতে পাকাতে হয়—তেমনি জীবনকে যত ছোটই ভাবি না কেন তা আসলে অনেক বড়। এই সুদীর্ঘ জীবনের শিকড়টা যে শিশুকাল। তাকে যেভাবে গড়তে চাইবে তাই হবে। দরকার শুধু তার সঠিক পরিচর্চা, যা করতে হবে শিশুকাল থেকেই।
প্রথমত, এই দায়িত্ব মা-বাবার, পরবর্তীকালে শিক্ষকের।
যে সন্তান মা-বাবার আপদ, সে তার দায়িত্ব নেবে কী করে?
তারও যে বড় বিপদ।
তাইতো ব্র্যাক এল আলোর প্রদীপ হাতে।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত করতে।
শুধু জ্ঞানের আলো নয়, মনের আলো জ্বালাতে হবে।
শিশুর মনের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগাতে হবে।
তাইতো ‘দীপশিখা’র আলোয় জমায়েত হলো সব সুবিধাবঞ্চিত শিশু। ‘দীপশিখা’ এদেরদেবে সঠিক পরিচর্যা।
সুবিধাবঞ্চিত সব শিশু আলোর পথের যাত্রী—
পার হবে ঘোর অন্ধকার, যেতে হবে বহুদূর।
‘দীপশিখা’ হবে তার সঙ্গী।
কামরুননেসা হাসান: কলসালট্যান্ট কো-কারিকুলাম কার্যক্রম, ব্র্যাক।

No comments

Powered by Blogger.