আদালতের রায় পেয়ে চাকরি ফিরে পেতে ৩০০ কর্মীর আবেদন-চাকরি, পদোন্নতি ও ছাঁটাই নিয়ে বিমানের ইঁদুর-বিড়াল খেলা by টিপু সুলতান

কর্মীদের চাকরি, পদোন্নতি, ছাঁটাই, চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি ও মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস নিজ কর্মী ও আদালতের সঙ্গে অনেকটা ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ খেলছে। কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একের পর এক কর্মী আদালতে যাচ্ছেন। আর চাকরিচ্যুত বা ছাঁটাই হওয়া কর্মীরা মামলায় রায় পেয়ে চাকরি ফেরত চাচ্ছেন।


আবার আদালতের রায় পাশ কাটানোর অভিযোগে বিমান কর্তৃপক্ষের প্রতি আদালত অবমাননার রুল জারির ঘটনাও ঘটছে। আবার মামলা পরিচালনা খাতে বিমানের বিপুল অর্থ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ জন্য তদন্ত কমিটিও হয়েছে।
এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্বেচ্ছা অবসর কর্মসূচির (ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট স্কিম-ভিআরএস) ছাঁটাই হওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আদালতের রায় পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ইতিমধ্যে তিন শতাধিক ব্যক্তি চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পদে পদোন্নতির পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। এ জন্য ৯ জুলাই বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ চার কর্মকর্তার প্রতি আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। তাঁদের ২২ জুলাই সশরীরে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর কর্তৃপক্ষ ওই পদোন্নতি পরীক্ষা স্থগিত করে এবং ভিআরএসের কর্মীদের বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে।
এর আগে চাকরিচ্যুত ও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া ২৫৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী হাইকোর্টে মামলায় জিতে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। তবে এর বিরুদ্ধে আপিল করে বিমান। এরই মধ্যে ৫৩ জন আপিল বিভাগেও রায় পেয়েছেন এবং পদোন্নতিসহ বকেয়া বেতন পেয়েছেন। বাকিদের ব্যাপারে আপিল বিভাগে মামলা চালাতে মোটা ফি দিয়ে আইনজীবী নিযুক্ত করেছে বিমান। অবসর বয়সসীমার ব্যাপারেও বেশ কয়েকজন কর্মী আদালতের আদেশে চাকরি ফিরে পান। তবে বিমান তাঁদের কাজে যোগ দিতে না দিলেও বেতন দিচ্ছে। আবার এমন কয়েকজনের ব্যাপারে আপিল বিভাগেও গেছে বিমান।
ভিআরএসের কর্মীদের জন্য কমিটি: গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিমানের জনবল কমানোর জন্য ভিআরএসের মাধ্যমে এক হাজার ৮৭০ জন বিমানকর্মীকে ছাঁটাই করা হয়। তাঁদের মধ্যে এক হাজার ১৫০ জন কর্মী হাইকোর্টে কয়েকটি রিট আবেদন করেন। এরপর ২০০৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিমানের পরিচালনা পর্ষদের ৪০তম সভায় ভিআরএসের অধীন যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারান, তাঁদের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। তাতে বলা হয়, যাঁরা মামলা করেননি তাঁরা এবং মামলা করলে তা প্রত্যাহার করে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন।
কিন্তু কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তে খুব একটা সাড়া মেলেনি। পরে চলতি বছরের ৪ মার্চ হাইকোর্ট রায় দেন। তাতে বিমানের ৬০৮টি অনুমোদিত শূন্য পদের বিপরীতে ভিআরএসে যাওয়া কর্মীদের নতুন করে নিয়োগ দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বিমান সূত্র জানায়, লিখিত রায় গত ২৬ জুন বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছায়। এরপর রায় পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরির জন্য আবেদনপত্র জমা দেওয়া শুরু করেন।
বিমানের মহাব্যবস্থাপক (গণসংযোগ) খান মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ পর্যন্ত তিন শতাধিক আবেদনপত্র জমা পড়েছে। এসব যাচাই-বাছাই করে আদালতের শর্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে একটি কমিটি করা হয়েছে।
বিমানের প্রশাসন শাখা থেকে জানানো হয়, মূলত গত বৃহস্পতিবার এ কমিটি করা হয়। তাতে মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) বেলায়েত হোসেনকে প্রধান করা হয়।
চাকরির বয়সসীমা নিয়ে মামলা: সরকারি কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হলেও বিমানে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিমানকর্মীরা এ নিয়ে আদালতে গেছেন। এর মধ্যে পাঁচটি রিটে হাইকোর্টের রায় বিমানের বিপক্ষে গেছে। আদালতের নির্দেশে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি ফিরে পেয়েছেন বলে বিমান সূত্র জানিয়েছে।
অবশ্য বিমানের আইন শাখার কর্মকর্তারা বলেন, এর মধ্যে চারটি মামলায় আপিল করেছে বিমান। এতে হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ পাওয়ায় চারজন কর্মকর্তার বেতনভাতা দেওয়া আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। কর্মচারীদের মধ্যে চাকরি ফিরে পাওয়া বাকিরা এখনো ঘরে বসেই বেতন পাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত ১৬ জন কর্মচারী রয়েছেন। ৫৭ বছর পার করছেন এমন আরও ২৫ জনের বেশি কর্মচারী আদালতে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
বিমানের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার দাবি, কোম্পানি হওয়ার পর বিমান চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য নয়। তবে আইন মন্ত্রণালয় থেকে এক চিঠিতে বলা হয়, সরকারি এ সিদ্ধান্ত শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন বিমানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
আবার একই কর্তৃপক্ষ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের আপত্তি ও আন্দোলন উপেক্ষা করে ২০১০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এক প্রশাসনিক আদেশ জারি করে ছয়জন বৈমানিকের চাকরির বয়স পাঁচ বছর বাড়িয়ে ৫৭ থেকে ৬২ বছর করে। বিষয়টি পরে হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্ট ওই প্রশাসনিক আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। এরপর বিমান কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। পরে আদালতের নির্দেশে বিষয়টি আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে যায়। গত ২৪ জুন ট্রাইব্যুনাল বিমানের ওই ‘বিতর্কিত প্রশাসনিক আদেশ’কে বেআইনি ঘোষণা করলে ওই ছয় বৈমানিক চাকরি হারান।
মামলায় বিপুল অর্থ ব্যয় নিয়ে তদন্ত: প্রায় ৩০০ মামলায় লড়ছে বিমান। বিমানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, অনেক সময় কর্তৃপক্ষ নিজেই নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে বা একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের মামলার দিকে ঠেলে দেয়। তাঁরা বলেন, মামলায় লড়ার ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত বিমানের পক্ষে সাফল্যের তেমন কোনো নজির নেই। তার পরও চরম আর্থিক সংকটে থাকা জাতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে মামলা পরিচালনা খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের প্রথম তিন বছরে মামলার পেছনে বিমানের খরচ হয়েছে তিন কোটি টাকা। এরপর গত ডিসেম্বরে আবার বাজেটের অতিরিক্ত এক কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। মামলা খাতে ব্যয়িত অর্থ নিয়ে নয়ছয় হচ্ছে বলে অভিযোগও উঠেছে।
মামলার পেছনে আর্থিক লেনদেন ও এর আইন শাখার কর্মদক্ষতার মূল্যায়ন করতে ২৬ জুন বিমানের ফ্লাইট পরিচালন শাখার পরিচালক (ডিএফও) ক্যাপ্টেন ইশরাক আহমেদকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন ইশরাক গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে কমিটি যেসব তথ্য চেয়েছে, তার জন্য আইন শাখা এক সপ্তাহ সময় চেয়েছে। তা হাতে পেলে দ্রুত মূল্যায়ন কাজ শেষ করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.