পুলিশি সেবা-এই যদি হয় মডেল থানা...

'মডেল' ইংরেজি হলেও সাধারণ ভাববিনিময়ে বেশ চেনা শব্দ। মডেল শব্দের অর্থ 'আদর্শ'। বাংলাদেশে থানাগুলোকে কেন আদর্শ বা মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে তা নিশ্চয় কাউকে বিশদ ব্যাখ্যা করে বলবার অবকাশ নেই। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নাগরিকদের সেবায় বন্ধুও, সহযোগীর ভূমিকায় পুলিশ সবসময়ই প্রস্তুত থাকে।


কিন্তু এ দেশে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও গঠনমূলক সভা-সমিতিতেই শুধু শোনা যায়, জনবিরোধী ভূমিকায় নয়_ পুলিশকে জনগণের বন্ধু হতে হবে। লোকে পুলিশের কাছে বন্ধুত্ব প্রত্যাশা করে বটে, বন্ধুস্থানীয় কেউ পুলিশে থাকলে স্বস্তিও পায়। কিন্তু পুলিশ যদি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েও দেয় তবু যেন স্বস্তি নেই সাধারণের। কেননা, স্মরণাতীতকাল থেকেই এ দেশে পুলিশের ভূমিকা জনগণের সেবক হিসেবে নয়, শাসকের হুকুম তামিল করে তাদের উদ্দেশ্য সাধনের বাহিনী হিসেবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে হতে এ দেশে পুলিশের যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তাতে চাইলেও লোকে আর পুলিশকে বন্ধু ভাবতে পারে না। 'বাড়ালে হাত বন্ধু পাওয়া যায় না', কেননা একজন নির্যাতিত, নিপীড়িত, সন্ত্রাসের শিকার মানুষের হাত ধরার জন্য পুলিশ আজও প্রস্তুত নয়। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ আছে পুলিশ সংস্কারের জন্য। কিন্তু শত সংস্কারেও ময়লা পরিচ্ছন্ন হচ্ছে না। জাপান সরকারের সহযোগিতায় দেশে 'মডেল থানা' তৈরির কর্মসূচিও পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রামের অংশ। পুলিশি সেবা উন্নত করার জন্য বাইরের সাহায্য আসছে, আমাদের সরকারও থানার সেবার মান উন্নীত করার চেষ্টা চালাচ্ছে_ এ খবর সকলকেই আশান্বিত করবে। মডেল থানা নিয়েও আশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ধন্য আশা কুহকিনী! দৈনিক সমকালে খোদ রাজধানীর মডেল থানা নিয়ে যে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তাতে যে কেউ হতাশ হবেন। মডেল থানা নির্মাণের বরাদ্দ নিয়ে থানাগুলো বাইরে থেকে ফিটফাট হয়েছে, কিন্তু একটু ভালো করে তাকালেই দেখা যাচ্ছে ভেতরের সদরঘাটের অবস্থা তথৈবচ। থানার সামনে বাগান, ভেতরে সোফা, কম্পিউটার, আধুনিক টেলিফোন সেট সবই আছে। কিন্তু অনেক থানা চত্বরই জব্দ করা গাড়ি রাখার ডাম্পিং গ্রাউন্ড। বাইরের চাকচিক্য ভেতরকে ছুঁতে পারেনি। থানার ভেতরে, বাথরুমে পুলিশের থাকার জায়গায়, হাজতে নোংরা-আবর্জনা, দুর্গন্ধ, ময়লা আগের মতোই। বহিরঙ্গের পুরোটাই যখন এত আয়োজনে পরিষ্কার হয়নি তখন ভেতরে সেবার কী হাল তাতে পরিবর্তন আশা করা বাহুল্য বটে। থানার ছোটবাবু-বড়বাবুরা আজও রাজনৈতিক নেতাদের সেবা দিতেই ব্যস্ত। রাজনৈতিক কর্মসূচি তদারক করতে গিয়ে অনেক থানাই নাকাল। এর বাইরে আছে জনবল সংকট, যানবাহন সংকটের নানা অজুহাত। বড়বাবুর অনুপস্থিতিতে ছোটবাবুদের অবসর বিলাস, ব্যক্তিগত খোশগল্পের তো অন্ত নেই। পাশাপাশি আছে রাস্তার ধারের দোকান, ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলার ঝক্কি, নাকের ডগায় মাদকের আখড়া অপরাধীদের আড্ডা রাখার নানা ব্যস্ততাও। এত সব পেরিয়ে সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষকে সেবা দেওয়ার সময় কোথায়? সাধারণ ডায়েরি করতে গেলে কাগজ-কলম পর্যন্ত সরবরাহ করতে পারে না মডেল থানা। আছে দালাল, সোর্সদের উপদ্রবও। সঠিকভাবে সাধারণ ডায়েরি নথিবদ্ধ না করা এমনকি ডায়েরিকেও দুর্বল করে ফেলার জন্য চেনা গৎ বেঁধে দেওয়া নানা নির্দেশনা। সমকালের বিস্তারিত প্রতিবেদনে যা জানা গেল তাতে সেবার ব্যবস্থা আগের মতোই আছে। পুলিশের সঙ্গে মানুষের প্রত্যাশিত বন্ধুত্ব এখনও গড়ে ওঠেনি। কমেনি হয়রানি, সেবার নামে প্রতীক্ষার প্রহর গোনা, নিরাপত্তা চেয়ে না পাওয়ার বঞ্চনা। মডেল থানা এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুসরণীয় আদর্শ হতে পারেনি। অর্থাৎ নতুন খোসলে পুরনো ব্যবস্থা বহাল-তবিয়ত। এ অবস্থায় অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠতে পারে, এই যদি হয় মডেল থানা তবে মডেলের বাইরে যে থানা সেসবের কী হাল? মডেল থানা নিয়ে যে নতুন করে ভাবতে হবে তা নিশ্চিত। কিন্তু পুলিশের গোড়ায় সংস্কার না করে আগায় মডেল করলে যে ফল মিলবে না, তা কবে আমাদের বোধগম্য হবে? বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যথাযথ তদারকির আওতায় আনতে হবে, দুর্নীতি কমাতে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে, নতুন কারিকুলামে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, পুলিশের বেতন-ভাতা, থাকার জায়গা, সুবিধার দিকে খেয়াল করতে হবে। আমরা আশা করব, মডেল থানা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য কার্যকর করার জন্য সঙ্গে বুনিয়াদি ব্যবস্থাগুলোও নেওয়া হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.