ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক-পারস্পরিক অনাস্থা কবে দূর হবে? by কুলদীপ নায়ার

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দর কুমার গুজরাল বলতেন, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এগোবে, কিন্তু দুই দেশের সমস্যার নাটকীয় কোনো সমাধান হবে না। গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে যে বৈঠক হয়ে গেল, তা দেখে গুজরালের ওই ভাবনাই সঠিক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।


বৈঠকে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি, কিন্তু বৈঠক যে বিষণ্ন পরিবেশে শেষ হয়েছে, তাও বলা যাবে না। বরং উভয় পররাষ্ট্রসচিব এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পাশাপাশি বক্তব্য রেখেছেন, উভয়েই বলেছেন, ভবিষ্যতে আলোচনা আবার শুরু হবে। অবশ্য পরবর্তী তারিখটা তাঁরা কেউই উল্লেখ করেননি।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার অনিষ্পন্ন সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না—এটা উভয় দেশের জনগণের জন্য হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে সংলাপ চালু আছে, ২৪ জুলাই পাকিস্তানে দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে সংলাপ হবে—এসব লক্ষ করে সান্ত্বনাও বোধ হয় যে দুই দেশের সরকারই সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, উল্টো বৈরিতা বাড়ে এমন কিছু করছে না।
আমার মনে পড়ে, অতীতে যখনই দুই দেশের মধ্যে কোনো পর্যায়ে আলোচনা হতো, বৈঠক শেষ হওয়ামাত্রই পারস্পরিক দোষারোপের খেলা শুরু হয়ে যেত। আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়ার জন্য এক পক্ষ অপর পক্ষকে দায়ী করত। এভাবে পরিবেশটাকে বিষাক্ত করে তোলা হতো। তবে, স্বীকার করতেই হবে, দু-তিন বছর ধরে পারস্পরিক দোষারোপ বন্ধ আছে, দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো উভয় পক্ষই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের যে আন্তরিকতা এখন লক্ষ করা যাচ্ছে, তা নষ্ট হতে পারে—এমন অনভিপ্রেত কথাবার্তাও আর বলা হচ্ছে না। আমি আশা করি, অন্তত পক্ষে ‘বানগঙ্গা’ (ভারতের গুজরাট ও পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের মধ্যে বয়ে যাওয়া একটি অভিন্ন নদী) নিয়ে দুই দেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, এটা করা সম্ভব।
আমার ধারণা, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সব অনিষ্পন্ন সমস্যার মধ্যে সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে জটিল সমস্যাটির সমাধান পাকিস্তান চায় সবকিছুর আগে। এই সমস্যাটির সমাধান হওয়ার পরই কেবল তারা অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে। হিমবাহটি হওয়া উচিত নো ম্যানস ল্যান্ড, ১৯৮২ পর্যন্ত তা-ই ছিল। তাই এ দাবিটি যুক্তিসংগত। ওই এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের ইঙ্গিতসংবলিত একটি খসড়া চুক্তিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী প্রাথমিক দস্তখতও করেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি এই সমস্যাটি নিয়ে সেই পুরোনো অনাস্থা দেখা দিয়েছে।
ভারতের সামরিক বাহিনী মনে করে, যে মুহূর্তে তারা সিয়াচেন হিমবাহ থেকে সরে আসবে, সেই মুহূর্তেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সেখানে অবস্থান নেবে। ৪০ বছর আগে স্বাক্ষরিত শিমলা চুক্তি দুই দেশকে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে ধরে রেখেছে, অথচ অব্যাহতভাবে সংলাপ চালিয়েও পারস্পরিক আস্থা কোনো পক্ষে তৈরি হয়টি। এটি বড়ই দুর্ভাগ্যজনক। শিমলা চুক্তিতে যে দ্বিপক্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছিল, তার ফলে উভয় পক্ষের সব বৈরী মনোভাব মুছে গিয়ে কিছু মাত্রায় আস্থা গড়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, উভয় দেশ ইতিহাস ও জাত্যাভিমানের নিগড়েই স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে রয়েছে।
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আশফাক কায়ানি প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছেন যে ভারত ও পাকিস্তানের ‘সহাবস্থানের’ কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তার পরও দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে সিয়াচেন হিমবাহ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়ে তিনি ভারতকে একটা পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। ইসলামাবাদ এই দাবিতে আপসহীন রয়েছে।
অন্যদিকে নয়াদিল্লি কঠোর ভাষায় বলে চলেছে, পাকিস্তান মুম্বাই হামলার হোতা হাফিজ সায়িদের বিচার না করা পর্যন্ত ইসলামাবাদের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপের সম্ভাবনা কম। সাধারণভাবে মনে হয় দুটি সমস্যাই সরল ও সমাধানযোগ্য। কিন্তু সমাধান হচ্ছে না; দীর্ঘ, নিষ্ফলা ইতিহাসের মধ্যে জট পাকিয়ে রয়েছে। এই ইতিহাস এককথায় পারস্পরিক অনাস্থা, অবিশ্বাসের ইতিহাস।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে মুম্বাই হামলার মামলায় অভিযুক্ত জাবিউদ্দিন আনসারী ওরফে আবু জান্দালের কারণে। পাকিস্তান চায় এই মামলার তদন্তসহ সব ধরনের তথ্য ভারত যেন পাকিস্তানকে জানায়। কিন্তু পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব জলিল আব্বাস জিলানি মুম্বাই হামলার কোনো দায়দায়িত্ব নিতে রাজি নন। তিনি যখন বলেন, তাঁর দেশও সন্ত্রাসবাদী সমস্যায় কাহিল, তখন ঠিকই বলেন। কিন্তু তিনি যখন বলেন, তাঁর সরকার অপরাধীদের সত্যিই শাস্তি চায়, তখন সত্য বলেন না। কারণ, পাকিস্তানের আদালতে আজ পর্যন্ত মামলাটি এগোয়নি। মামলাটির শুনানির জন্য পাঁচ বছরে ছয়জন বিচারক পরিবর্তন করা হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণাও জোর দিয়ে বলেছেন, ভারত-পাকিস্তান সংলাপকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে পাকিস্তানকে মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলার মামলাটির সুরাহা করতে হবে।
তবে যত সামান্যই হোক, দুই দেশ ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নয়াদিল্লিতে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকের সময় পাকিস্তানি পররাষ্ট্রসচিব জলিল আব্বাসের সঙ্গে আমার কথা হয়। তখন আমি জানার চেষ্টা করার চেষ্টা করি, সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় কোনো আলোর রেখা আছে কি না। তাঁর হাসিমাখা মুখ আমাকে আশ্বস্ত করল যে সংবাদমাধ্যমে যত খারাপ চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে, আসল ছবিটা তত খারাপ নয়। তিনি বলেন, মূল ইস্যুগুলোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি শূন্য, কিন্তু পারস্পরিক আস্থা ক্রমশ বাড়ছে। আমার মতো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রসচিবও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর আস্থা রাখেন, দুই দেশের মধ্যে যা চলছে। ভারতে পাকিস্তানের বাণিজ্যের পরিমাণ ছয়-সাত মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হওয়ার কৃতিত্ব তিনিই নিতে চান। তিনি বলেন, সীমান্তের দুই পাশে শত শত পণ্যবাহী ট্রাক অপেক্ষা করছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ইসলামাবাদ যখন নয়াদিল্লিকে সর্বাধিক আনুকূল্যপ্রাপ্ত দেশের মর্যাদা দেবে, তখন থেকে বাণিজ্য বৃদ্ধির পরিমাণ প্রত্যাশার চেয়ে ছাড়িয়ে যাবে।
বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে একবার লন্ডনে দেখা হলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আবার ক্ষমতায় গেলে ভারতীয় উপমহাদেশকে তিনি ‘সীমান্তহীন’ এক অঞ্চলে পরিণত করবেন। আমার মনে হয়, শুধু অবাধ বাণিজ্যের কথা ভেবেই তিনি এ কথা বলেননি, তিনি চেয়েছিলেন এই অঞ্চলে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসুক, যা আজও ঘটেনি। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল পিপিপির উচিত বেনজির ভুট্টোর সেই কথা স্মরণ করে, তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের ভিত তৈরির জন্য অন্ততপক্ষে মুম্বাই হামলার জন্য দায়ী সন্ত্রাসবাদীদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.