আকাশীর খেলার আকাশ by বদিউজ্জামান

বাংলাদেশের একটা সাধারণ পরিবারের মেয়ে আকাশী। সাইক্লিং করতেন শখের বসে। ৪৮টি সোনার পদক জিতেছেন। জাতীয় পর্যায়ে ২৫টি। আকাশীর খেলা থাকলেই মাঠে ছুটে যান তাঁর স্বামী, সন্তান। এমনকি অনুশীলনের আগে আকাশীর সাইকেলটা তেল দিয়ে পরিচর্যা করে দেন...


সাইকেল চালিয়ে পুরস্কার! এটাও যে সম্ভব—বাংলাদেশ আনসারে যোগ দেওয়ার আগে জানতেনই না আকাশী সুলতানা। নিতান্ত শখের বশেই সাইকেল চালানোটা শিখেছিলেন। তা-ও আবার নিজের বাড়িতে নয়, খালাবাড়ি গিয়ে। খালাতো ভাই তাঁকে শিখিয়েছিলেন ‘দ্বিচক্রযান’ চালানো। সেই যে শিখলেন, এরপর সাইকেল চালিয়েই ৪৮টি সোনার পদক জিতলেন ২৫টি জাতীয় আসরে।
আকাশীর সাইকেল চালানো নিয়ে মজার গল্প আছে। খালার বাড়িতে শিখছেন নতুন প্যাডেল ঘোরানো। হঠাৎ করে চলে গেলেন বড় রাস্তায়। আচমকা সাইকেল উঠিয়ে দিলেন হাট-ফেরতা বয়স্ক লোকের গায়ের ওপর। ব্যস! লোকটা রেগেমেগে অগ্নিমূর্তি। যখন আবিষ্কার করলেন, ‘ব্যাটা ছেলে’ নয় একজন মেয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, রাগ গেল আরও বেড়ে। পরে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভদ্রলোককে ঠান্ডা করেন আকাশীর খালাতো ভাই।
মেয়েবেলা থেকেই আকাশী ছেলেদের সঙ্গে মিশেছেন। বড় হয়েছেন ভাইদের সঙ্গে। ভাইদের সঙ্গে হাল চাষ করতেন খেতখামারে গিয়ে। ছাগল চরিয়েছেন। বড় ভাই তাঁকে ছেলেদের শার্ট-প্যান্টও কিনে দিয়েছিলেন। সেটা পরে সে কী খুশি আকাশী! বাবা মারা যাওয়ার পর আকাশীর ওপর দায়িত্ব পড়ে সংসারের হাল ধরার। একবার আনসারে চাকরিরত পাড়াতো বোন রেহানা পারভীনের সঙ্গে বেড়াতে যান শফিপুর আনসার একাডেমিতে। সেটা ১৯৮৪ সালের ঘটনা। রেহানা আপার কাছে আনসারে যোগ দেওয়ার আগ্রহটা প্রকাশ করলেন। তখন আনসারের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল ওয়াজি উল্লাহ।
হালকা-পাতলা গড়নের আকাশীকে প্রাথমিক পরীক্ষা দিয়ে নির্বাচন করলেন। তবে তাঁকে দিলেন অস্থায়ী নিয়োগ। আনসারে যোগ দিলেও পড়াশোনাটা নিয়মিত করতে পারেননি। জানালেন, ‘ম্যাট্রিকটা দিতে পারিনি। কারণ, খেলাধুলা বেশির ভাগ সময় মার্চ মাসের দিকেই হয়। ওই সময়ই থাকত পরীক্ষা। শুধু বই কিনতাম আর পড়তাম। কিন্তু পরীক্ষা আর দিতে পারিনি।’
আনসারে অ্যাথলেটিকসে ঢুকেছিলেন আকাশী। কিন্তু ফাঁকে সাইকেলটাও চালাতেন। তায়কোয়ান্দো খেলতেন। আবার হকিও খেলতেন। কিন্তু পরের বছর যখন মহিলা হকি বন্ধ হয়ে গেল তখন সাইক্লিং আর অ্যাথলেটিকসেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এরপর ১৯৮৭ সালে প্রথম জাতীয় পর্যায়ে সাইক্লিংয়ে অংশ নেন।
মেয়ে হয়ে সাইকেল চালাত বলে কম কথা শুনতে হয়নি আকাশীকে। কষ্টের স্মৃতি মনে করে বলছিলেন, ‘অনেকেই অনেক রকম কথা বলত। বলত, ও তো বেটাছেলে। বেটার মতো সাইকেল চালায়। বলত, ওর ওপর আল্লাহর গজব পড়ব।’ তবে অন্যরা তাঁকে দেখে টিপ্পনী কাটলেও, নিজের সংসারের লোকজন কখনোই আকাশীর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি।
বলছিলেন, ‘আমার তিন ভাই আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছে। ওরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ছিল না বলে সাইকেল কিনে দিতে পারেনি। কিন্তু আমি আনসারে এলে বলেছে, ও যেটা পছন্দ করছে সেটাই করছে। আমাদের সমস্যা নেই।’ স্বামী মিজানুর রহমান আলেম। ছেলে আল মাহমুদ পড়ে মাদ্রাসায়। তবুও তাঁরা আকাশীর খেলা থাকলেই মাঠে ছুটে যান। এমনকি অনুশীলনের আগে আকাশীর সাইকেলটা তেল দিয়ে পরিচর্যা করে দেন।
প্রায় ২৮ বছর আগে যে মেয়ে সাইকেলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সারা দেশ, সেই তিনিই এখন মেয়েদের খেলাধুলায় হতাশ, ‘আগে যত খেলাধুলা ছিল এখন আর তেমন প্রতিযোগিতা নেই। তাই রেজাল্ট করা খুবই সহজ। আমাদের মেয়েরা অনেক পরিশ্রম করতে পারে কিন্তু খেলাধুলায় এসবের ছাপ পড়ছে না।’ নতুন কেউ আসছে না বলেই একজন আকাশীর প্রতিদ্বন্দ্বী আজও তৈরি হয়নি। তবে মেয়েদের আগ্রহ দেখে দারুণ খুশি আকাশী, ‘অনেক মেয়ে মোটা মোটা ভারী সাইকেল (বাংলা সাইকেল) এনে বলে যে সাইক্লিং করব। খুবই ভালো লেগেছে এগুলো দেখে।’ গত এসএ গেমসে পদক জিততে পারেননি। এটাই সবচেয়ে বড় দুঃখ আকাশীর, ‘এখন বয়স হয়েছে। আমি তো আর এসএ গেমসে সুযোগ পাব না।’ কারণটাও বললেন, ‘রূপসা ব্রিজের ঢাল থেকে খুলনায় ওঠার রাস্তায় গিয়ার পরিবর্তন করে সাইকেল চালাতে হয়। ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠার জন্য আমরা কত চেষ্টা করলাম কিন্তু দেখি গিয়ার আর পরিবর্তন হয় না। সঙ্গে থাকা ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মেয়েরা গিয়ার বদলে আমাদের পেছন ফেলে গেল।’
আক্ষেপ রয়েছে ভেলোড্রাম নিয়েও, ‘আমাদের কোনো ভেলোড্রাম নেই। একবার মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলাম, জীবনে প্রথমবারের মতো ভেলোড্রামে উঠিয়ে দিল আমাকে। জিন্দেগিতে ভেলোড্রামে সাইকেল চালাইনি, গড়িয়ে ওপর থেকে পড়ে সারা শরীর ছিলেকেটে সে এক মহা হুলুস্থুল।’ আকাশীর সবচেয়ে বড় দুঃখ ২৮ বছরেও আনসারের চাকরিটা স্থায়ী হলো না।
তবুও আকাশী স্বপ্ন দেখেন চাকরিটা স্থায়ী হবে। সাইক্লিংয়ের কোচ হয়ে গ্রামবাংলা থেকে তুলে আনবেন মেয়েদের।
স্বপ্ন দেখেন মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাবে, কলেজে যাবে। অফিস করবে। নরসিংদীর মেয়ে আকাশী দূষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে, এগিয়ে নিয়ে আসতে চান বাংলার মেয়েদেরই।

No comments

Powered by Blogger.