লিবিয়ার নির্বাচনোত্তর চ্যালেঞ্জগুলো by মুহাম্মদ রুহুল আমীন

সংগ্রাম-ক্লান্ত লিবীয়দের সুনিয়তি শেষ পর্যন্ত দেশটি প্রলম্বিত গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি, যে আশঙ্কা ছিল অনেক বিশ্লেষকের। ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ৬০ লাখ মানুষ অধ্যুষিত তেলসমৃদ্ধ দেশটির নিবন্ধিত ২৮ লাখ ভোটারের সিংহভাগ ভোট দিয়েছেন।


এ নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো নির্বাচনোত্তর লিবিয়ায় চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে এর উত্তরণ-কৌশল নির্দেশ করা।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় উত্তরণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালের পর এমন একটি নির্বাচনে উচ্ছ্বসিত আবেগে লিবীয়রা তাদের মতপ্রকাশের আনন্দ-উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। ২০১১ সালের আগস্টে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী গাদ্দাফির মসনদ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং ২০ অক্টোবর বিদ্রোহীদের হাতে তিনি নিহত হওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় কাউন্সিল দেশটি পরিচালনা করে আসছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে লিবিয়ার ভবিষ্যতের জন্য নির্বাচনটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। গণতান্ত্রিক জাগরণের বৈশ্বিক ইতিহাসে লিবিয়ার নির্বাচন নজিরবিহীন। ধারণা করা হয়েছিল, দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশটিতে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতার অভাব গণতন্ত্রায়ণে বড় বাধা হতে পারে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, জনগণের চাপা দীর্ঘশ্বাসের উৎস থেকে সৃষ্ট হয়েছে অসংখ্য রাজনৈতিক প্রতিভা। প্রায় তিন হাজার ৭০০ প্রার্থীর মধ্যে দুই হাজার ৫০০ প্রার্থী স্বতন্ত্রভাবে এবং অবশিষ্ট মাত্র এক হাজার ২০০ প্রার্থী রাজনৈতিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। মোট ২০০ আসনের জাতীয় পরিষদের ১২০টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং বাকি ৮০টি আসন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দল বা সামষ্টিক নেতৃত্বের তুলনায় স্বতন্ত্র বা ব্যাষ্টিক অথবা ব্যক্তিক নেতৃত্ব নতুন লিবিয়ার ভাগ্য গঠনে ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে।
এদিক থেকে নির্বাচনোত্তর লিবিয়ার জনগণের স্বপ্ন পূরণে এবং বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনে ওই সব প্রতিভাবান ব্যক্তি-নেতার ওপরই জনগণের প্রথম ভরসা। বর্তমান সময়ে তাই নির্বাচিত প্রতিনিধি বা রাজনৈতিক দলের সামনে আধুনিক, গণতান্ত্রিক এবং উন্নত রাষ্ট্র গঠনে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ ও ইস্যু দাঁড়িয়ে আছে তাদের যাত্রাপথে; পথ চলতে হবে তাই অতিসাবধানে, সতর্কভাবে। প্রথম ও প্রধান ইস্যু হলো নির্বাচনের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলো অর্জন করার দীপ্তিময় প্রত্যয় অক্ষুণ্ন রাখা।
এ নির্বাচনের আশু লক্ষ্যগুলো হলো : ১. নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রিসভা গঠন করা; ২. লিবিয়ার গণমানুষের মূল্যবোধের ভিত্তিতে সহজে গ্রহণযোগ্য গণহিতৈষী সংবিধান প্রণয়ন করা; ৩. গণভোটের মাধ্যমে রচিত সংবিধানের গ্রহণযোগ্যতা ও গণতান্ত্রিকতা নির্ধারণ করা; ৪. সংবিধান প্রণয়নের পর পরবর্তী এক বছরের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গঠন করা।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো : ১. লিবিয়াকে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা; ২. লিবিয়ার সাধারণ জনগণের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং জীবন-আচার জাতীয় নীতিগুলোয় অন্তর্ভুক্ত করে সবার জন্য স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, গ্রহণযোগ্য ও গতিময় নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করা; ৩. রাষ্ট্রিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গণমুখী করে পুনর্বিন্যস্ত করা; ৪. অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিময়তার সম্যকজ্ঞান আহরণ করা এবং সব ক্ষেত্রে প্রতিভাবান, যোগ্য, পারদর্শী, ভিশনারি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা; ৫. ন্যাটোর বিমান হামলা গাদ্দাফিবিরোধীদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে বিধায় পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলোর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও ষড়যন্ত্র অনুধাবনপূর্বক সেই পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে পাশ্চাত্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বহীন পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করা যায়।
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ়করণ। গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলনকারী মিলিশিয়ারা কোনো সুশৃঙ্খল কেন্দ্রে আবদ্ধ নয়। তাই বেপরোয়া বিশৃঙ্খল ঘটনাও ঘটছে। আঞ্চলিক ও গোষ্ঠীগত সংঘাত বৃদ্ধি পেয়ে সহিংসতা বিস্তৃত হচ্ছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ, মিলিশিয়াদের হাতে আটককৃত গাদ্দাফিপন্থী বা কিছু সাধারণ লিবীয়ও রয়েছে, যারা সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্নে লিবিয়া এখন বিভক্তির দোরগোড়ায় নিপতিত হচ্ছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো, ধর্মনিরপেক্ষ, উদারবাদী, গণতন্ত্রী এবং ইসলামপন্থীদের রাজনীতিতে ও সরকারব্যবস্থায় অংশগ্রহণের প্রবল প্রতিযোগিতা। অনেক বিশ্লেষক ভেবেছিলেন, নির্বাচনে এসব পন্থীর মিশ্র অবস্থান লক্ষ করা যাবে। কেউ কেউ মনে করেছিলেন, ইসলামপন্থীরা মোট আসনের অর্ধেকের বেশি জিতে নেবে। উল্লেখ্য, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এনটিসিভুক্ত ন্যাশনাল ফোর্সেস অ্যালায়েন্স, ব্রাদারহুডের জাস্টিস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন পার্টি, হোমল্যান্ড পার্টি, জাস্টিস অ্যান্ড করাপশন পার্টি, ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টি, আল ওয়াতান পার্টি ইত্যাদি। ম্যাগি মিখাইলের গবেষণায় বলা হয়েছে, ব্রাদারহুডের জাস্টিস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন পার্টির তরুণ-তরুণীরা ঘরে ঘরে প্রচারণা চালিয়ে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করেছিল। তবে সেক্যুলার ও উদারবাদীদের যে তিনটি দলও বেশ ভালো করবে বলে ভাবা হয়েছিল, নির্বাচনের ফলাফলে তা-ই সত্য হয়েছে। সে দলগুলো হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিলের ধর্মনিরপেক্ষ অ্যালায়েন্স ফর ন্যাশনাল ফোর্সেস, বেলহাজ আল ওয়াতান এবং প্রাচীন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টি। জিবরিলের এএনএফ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে লিবিয়ায় নেতৃত্ব সুদৃঢ় করতে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল তিউনিসিয়া, মরক্কো ও মিসরের মতো লিবিয়ার নির্বাচনেও ব্রাদারহুডের যুগ (Brotherhood era) প্রবেশ করবে। এ দেশগুলোই ইসলামপন্থীদের জয়ের উপচে পড়া প্রভাব (spillover effect) বা ডোমিনো ইফেক্ট (domino effect) লিবিয়াতেও বাস্তব বলে অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ফলে এখন সবচেয়ে বড় ইস্যু হলো বিভিন্নমুখী দল ও ব্যক্তির মধ্যে একতার সংস্কৃতি স্থাপনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা। মনে হয় জিবরিল সে জাতীয় ঐক্য আনয়নে সক্ষম হবেন।
পরিশেষে আমরা বলব, লিবীয়রা অপরাপর আরব দেশের জনগণের মতো হটকারী, নির্বোধ, সুবিধাবাদী এবং অদূরদর্শী নয়। তারা ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষিত জনগণের মতো সভ্য, শিষ্ট, মার্জিত ও দৃঢ় মূল্যবোধের ধারক-বাহক। বিপ্লবের পর থেকে অদ্যাবধি লক্ষ করা গেছে, লিবিয়ার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক আচার-আচরণ ঐতিহাসিকভাবে অলঙ্ঘনীয় মূল্যবোধ হিসেবে দিকনির্দেশনা হয়ে আছে। গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ত্রিপোলি, বেনগাজিসহ লিবিয়ায় সংগ্রামী রণপ্রান্তরের 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনি, বিদ্রোহীদের হাতে উঁচিয়ে ধরা ধর্মগ্রন্থ কোরআন, গাদ্দাফি-উত্তর লিবিয়ায় শরিয়া আইন প্রবর্তনে এনটিসির ঘোষণা এবং নির্বাচনে বিজয়ের পর জিবরিলের ইসলামের নীতি মেনে চলার নীতি প্রভৃতি সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে বিশ্লেষকদের কাছে। অন্যদিকে সেক্যুলার, উদারবাদী, পাশ্চাত্যবাদীদের রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পাশ্চাত্য আশীর্বাদ। মূলত এ দুই ধারার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য একীভূত করে বহুতার মধ্যে একতা আনয়নের চৌকস কৌশল অবলম্বন করে ইস্পাতসম জাতীয় ঐক্য গঠন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মূল চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নির্বাচিতরা কতটুকু সক্ষম হবেন, আজকের নির্বাচনী ফলাফলের পর তারই পূর্বাভাস পাওয়া যাবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mramin68@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.