বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৫৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।শহীদ ফরিদউদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম সাহসী নৌযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়। স্থলে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী দুর্বার বেগে এগিয়ে যাচ্ছে পিছু হটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ধাওয়া করে। জল ও আকাশেও পাকিস্তানিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।


এ সময় মুক্তিবাহিনীর নৌ-উইংয়ে সদ্য যোগ হওয়া গানবোট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ যাত্রা শুরু করল খুলনা অভিমুখে। তাদের লক্ষ্য খুলনার পাকিস্তানি নৌঘাঁটি দখল করা। একটি গানবোটে আছেন ফরিদউদ্দিন আহমেদ। তিনি গানবোটের আরইএন-১।
৬ ডিসেম্বর অভিযান শুরু হলো ভারতের হলদিয়া নৌঘাঁটি থেকে। দুই গানবোটেরই এটি দ্বিতীয় অভিযান। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন হটপ্যান্টস’। ৭ ডিসেম্বর রায়মঙ্গল নদী অতিক্রম করার সময় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে গানবোটের মাস্তুলে পতাকা ওড়ানো হলো। ৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে আকরাম পয়েন্টে পৌঁছে গানবোট দুটি রাতযাপন করে। এর মধ্যে মিত্রবাহিনীর দুটি জলযানও (গানবোট আইএনএস ‘প্যানভেল’ ও প্যাট্রোল ক্রাফট ‘চিত্রাঙ্গদা’) তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
১০ ডিসেম্বর ভোরে রণতরিগুলো নোঙর তুলে মংলার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। অভিযানের কমান্ডার মিত্রবাহিনীর মণীন্দ্রনাথ রায় সামন্ত (এম এন সামন্ত)। তিনি প্যানভেলের অধিনায়ক। রণতরিগুলো কোনো বাধা ছাড়াই সকাল সাড়ে সাতটায় মংলায় পৌঁছাল। ফরিদউদ্দিন আহমেদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা রণতরি থেকে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে নেমে মংলা হারবার ও কাস্টমস অফিস থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুললেন।
সকাল নয়টায় শুরু হলো চূড়ান্ত অভিযান। সামনে প্যানভেল, মাঝে পলাশ, শেষে পদ্মা। চিত্রাঙ্গদা মংলায় থেকে গেল। প্যানভেল সামনে থাকার কারণ, সেটি অত্যাধুনিক ও মজবুত। বেলা সাড়ে ১১টা। এমন সময় আকাশে দেখা গেল তিনটি জঙ্গিবিমান। শত্রুবিমান মনে করে মুক্তিবাহিনীর গানবোট থেকে নৌমুক্তিযোদ্ধারা বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু কমান্ডার এম এন সামন্ত ওয়্যারলেসে জানালেন ওগুলো ভারতীয় বিমান। তিনি গুলি করতে বারণ করলেন।
এরপর বিমানগুলো কিছুটা নিচে নেমে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গেল। তারপর হঠাৎ ঘুরে এসে বোমাবর্ষণ করল পদ্মার ওপর। পরক্ষণেই পলাশে। ভারতীয় বিমান মুক্তিবাহিনীর রণতরিকে পাকিস্তানি রণতরি মনে করে উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করতে থাকে। যদিও গানবোটগুলো মুক্তি বা মিত্রবাহিনীর কি না তা শনাক্তের জন্য ছাদে ১৫দ্ধ১০ ফুট প্রস্থের হলুদ কাপড় বিছানো। এ সময় প্যানভেল অনেক এগিয়ে। ওই জাহাজে ভারতীয় বিমান বোমা বর্ষণ করল না।
বোমার আঘাতে দুই গানবোটেই আগুন ধরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হলেন ফরিদউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন। বিপদ আন্দাজ করে অনেকে আগেই গানবোট থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছেন। তাঁরা বেশির ভাগ অক্ষত। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যাঁরা রণতরিতে ছিলেন তাঁরা হয় শহীদ, নয়তো মারাত্মকভাবে আহত।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া নৌমুক্তিযোদ্ধারা সাঁতার কেটে নদীর পাড়ে পৌঁছালে অনেকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। দুই-তিনজনকে তারা হত্যা করে। বাকিদের নির্যাতনের পর জেলে পাঠায়।
ফরিদউদ্দিন আহমেদ চাকরি করতেন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে। কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান)। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ছুটিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যাওয়ার কিছুদিন পর মুক্তিবাহিনীর নৌ-উইংয়ে অন্তর্ভুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত নৌ-অভিযানে কৃতিত্বের জন্য ফরিদউদ্দিন আহমেদকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩৬।
শহীদ ফরিদউদ্দিন আহমেদের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাগৈ গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আসাদ আলী ভূঁইয়া, মা আমেনা বেগম। স্ত্রী রুপিয়া বেগম। তাঁর এক ছেলে। শহীদ ফরিদউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী এখনো বেঁচে আছেন। ছেলে মো. আলমগীর হোসেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চাকরি করতেন। কয়েক মাস আগে অবসরে গেছেন। ছেলে জানালেন, তাঁর মা পেনশন পান। তবে আর কোনো আর্থিক সুবিধা তাঁরা পাননি।
সূত্র: মো. আলমগীর হোসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে নৌ-অভিযান, কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.