জনপ্রশাসন-কোটার নিষ্পেষণে মেধাবীরা কোণঠাসা by আলী ইমাম মজুমদার
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকর্ষণ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। এর কারণ বহুবিধ এবং এটি বড় ধরনের গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। তবে সহজভাবে দেখা যায়, বিদেশে চাকরির ভালো সুযোগ, দেশে অধিকতরও সুযোগ-সুবিধায় বেসরকারি চাকরি, সরকারি চাকরিতে তুলনামূলকভাবে বেতন-ভাতাদির
শোচনীয় অপ্রতুলতা এবং সরকারি চাকরির যুগবাহিত মর্যাদার হ্রাস এর মূল কারণ। তা সত্ত্বেও যেসব মেধাবী তরুণ-তরুণী সরকারি চাকরিতে আসতে চাইছেন বা এসেছেন, তাঁরাও সম্মুখীন হয়েছেন বা হচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার। দীর্ঘকাল এ অবস্থাটি সরকারি চাকরিতে তুলনামূলকভাবে মেধাহীনদের সমাবেশ ঘটিয়েছে। তাই আজ দায়িত্বশীল মহল থেকেই প্রস্তাব আসছে, চাকরির শীর্ষ পর্যায়ে বাইরে থেকে মেধাবীদের আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা দিয়ে নিয়ে আসার। এর জন্য কৌশলে একটি আইনি বিধান করার চেষ্টাও লক্ষণীয় হচ্ছে। কিন্তু সমস্যার গভীরে না গিয়ে এ ধরনের সমাধানের প্রয়াস বিপরীতধর্মী ফলই দেবে।
সামগ্রিক বিষয়াদি আলোচনার জন্য অনেক বড় পরিসর আবশ্যক। সেটা বর্তমান নিবন্ধে সম্ভব নয়। মেধাবীদের একটি বড় অংশ সরকারি চাকরিতে আকর্ষণ হারানোর পরও যাঁরা আসতে চাইছেন, তাঁরা যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন, তার দু-একটি প্রধান বিষয় আলোচনা করব। বলা বাহুল্য, সাংবিধানিক পদগুলো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ব্যতীত সব বেসামরিক চাকরিতে এ প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান। প্রধান প্রতিবন্ধকতাটি হচ্ছে, একটি বৈষম্যমূলক কোটাপদ্ধতি। বর্তমানে বিসিএস পরীক্ষায় নিয়োগের জন্য কোটার বিন্যাস হচ্ছে শতকরা হিসাবে—মেধা ৪৫, মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য ৩০, মহিলা ১০, জেলা ১০, উপজাতি (এ নামেই কোটাটি সংরক্ষিত আছে) ৫ এবং প্রতিবন্ধী ১। যোগ করলে ১০১ হয় বিধায় অনুসন্ধানে জেনেছি, সেই ১ শতাংশ অন্য কোনো কোটা পূরণ না হলে তা থেকে দেওয়া হয়। এসব পদের মধ্যে সনাতন ক্যাডার সার্ভিস ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, কৃষিবিজ্ঞান, প্রাণিসম্পদ ইত্যাদি রয়েছে অর্থাৎ আমরা শুধু প্রশাসন, পুলিশ, কূটনীতিক, হিসাব ও নিরীক্ষা, শুল্ক ও কর—এসব পদেই মেধাবীদের প্রবেশ সীমিত করিনি; সীমিত করেছি কলেজশিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিজ্ঞানী, প্রাণিসম্পদবিদসহ সব ক্ষেত্রেই। বছর দুই আগে থেকেই অধস্তন বিচার বিভাগেও এ কোটা পুনরায় চালু করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পৃথক জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠনের পর প্রধানত মেধাই প্রাধান্য পেত। অব্যাহতভাবে এ ধরনের নিয়োগের পরিণতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। উল্লেখ করা যায়, ৩১তম বিসিএসে প্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ৭৭৩টি পদ শূন্য রাখা হয়েছে বলে পিএসসির চেয়ারম্যান সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন (কালের কণ্ঠ, ৯ জুলাই)। অথচ সম্মিলিত মেধাতালিকায় ওপরের দিকে অবস্থান করেও অনেকে চাকরি পেলেন না। কী নির্মম পরিহাস!
শুধু নিয়োগে নয় পদোন্নতিকালেও কম মেধাবীরা কোনো ফাঁকফোঁকরে টপকে যাচ্ছেন মেধাবীদের—এ বেদনাদায়ক চিত্রও দেখা যায়। এটা ঠিক, পদোন্নতি সবাই পাবে না। মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনাতেই ওপরের পদে পদোন্নতি দেওয়ার কথা। নিয়োগকালীন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মেধাতালিকায় ওপরের দিকে থাকলেও চাকরিজীবনে কেউ কেউ ভালো করেন না বলে পিছিয়ে যান, এটাও দেখা গেছে। তবে গণহারে মেধাবীরা তলিয়ে যান, আর সামনে আসেন কম মেধাবীরা, এমনটা দেখা যায়নি। কিন্তু এখন তা-ও ঘটছে। যেমন, প্রশাসন ক্যাডারে ১৯৮৫ ব্যাচে নিয়োগপ্রাপ্ত ৫৩৮ কর্মকর্তার মধ্যে ২০৮ জন যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পান। শতকরা হার ৩৮ দশমিক ৮। ব্যাচটিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁদের প্রথম ২০০ জনের মধ্যে ৭৫ জন (শতকরা ৩৭ দশমিক ৫) এবং পরবর্তী ৩৩৬ জনের মধ্যে ১৩৩ জন (শতকরা ৩৯ দশমিক ৬) পদোন্নতি পেয়েছেন। অথচ শীর্ষে অবস্থানকারী ২০০ জন মেধার ভিত্তিতেই চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তেমনি একই ক্যাডারের ১৯৮৪ ব্যাচের ৪৭৭ জন কর্মকর্তার মধ্যে প্রথম ৩০০ জনকে সম্প্রতি বিবেচনায় নিয়ে ৭৮ জনকে অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে। এর প্রথম ২০০ জনের মধ্যে ৫৩ জন এবং পরবর্তী ১০০ জনে ২৫ জন। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সময়ও বঞ্চনা, সরকারি চাকরিকে সচেতনভাবেই মেধাহীন করা হচ্ছে। পুলিশ, অধস্তন বিচার বিভাগ—সর্বত্র একই অবস্থা। এতে লাভবান হবে কে? মেধাতালিকার নিচের দিকে থাকা কর্মকর্তারা, বিভিন্ন কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত। সম্মিলিত মেধাতালিকায় অনেক নিচের দিকেই ছিল তাঁদের অবস্থান। কোটা না থাকলে তাঁদের অনেকে এসব পদে নিয়োগই পেতেন না। কিন্তু দুর্ভাগা এ জাতি সযতনে মেধাবীদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
অপরদিকে আমরা দেখি, সামরিক বাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগের জন্য ক্যাডেট বাছাই করতে মেধা ব্যতীত কোনো কোটাই নেই। মেধা এবং শুধু মেধাই সেখানে অফিসার পদে নিয়োগের মাপকাঠি। তবে সৈনিক পদে নিয়োগে জেলা কোটা অনুসরণ করা হয়। ক্যাডেট হিসেবে বাছাইয়ের পর কমিশন্ড লাভ করা পর্যন্ত কঠোর দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এর পরও বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁরা নেন পেশাগত প্রশিক্ষণ। ইংরেজি ভাষার চর্চা এবং তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান তাঁদের করে সমৃদ্ধ। তদুপরি নির্দ্বিধায় বলা চলে, অন্তত মাঝারি স্তর পর্যন্ত তাঁদের পদোন্নতি থাকে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত। শুধু মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নিয়েই তাঁরা অগ্রসর হতে থাকেন। এ কারণেই আজ বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী দক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। তাদের নিয়ে দেশ ও জাতি গর্ববোধ করে। সরকারও তাদের কোনো দায়িত্ব দিয়ে আশ্বস্ত থাকে, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি হবে বলে। তাহলে রাষ্ট্রের বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি কেন? সামরিক বাহিনীর মান আরও বৃদ্ধি পাক—এ কামনা সবার। তবে বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক উল্লেখযোগ্য কোনো প্রত্যাশিত পদক্ষেপ সাম্প্রতিককালে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর কোনোটিই নেয়নি; বরং ক্রমান্বয়ে এগুলো দুর্বল করার পদক্ষেপই লক্ষণীয় হচ্ছে।
উল্লেখ করা আবশ্যক, কিছু কিছু বেসামরিক চাকরির নিয়োগে কোটাব্যবস্থা নতুন নয়। এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে, ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সমানতালে না আসতে পারায় ভারতীয়দের জন্য কিছু কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। পরে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্যও আসে কিছু কোটা। আর পাকিস্তান সময়কালে পিছিয়ে পড়া তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশ) দাবির মুখে কেন্দ্রীয় সুপেরিয়র সার্ভিসগুলোর কয়েকটিতে প্রদেশভিত্তিক কিছু কোটা চালু ছিল। তবে এখনকার মতো সব স্তরে বাস্তবতার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণভাবে বিশাল আকারের কোটা কখনোই ছিল না। দেখা যাচ্ছে, যাদের জন্য বিশাল কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তাদের মাঝে সে সংখ্যক পরীক্ষায় পাস করা প্রার্থীই পাওয়া যায় না। ফলে পদ থাকে শূন্য। বঞ্চিত হচ্ছেন যোগ্য প্রার্থী।
সব চাকরিতে নিয়োগকালে বিশাল কোটা সংরক্ষণ ও যোগ্য কেউ না থাকলে পদগুলো শূন্য রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক, তা নীতিনির্ধারকেরা ভেবে দেখেছেন কি? তেমনিভাবে জেলা কোটা উন্নত আর অনুন্নত সব জেলার জন্য আনুপাতিক হারে বণ্টনও অনাবশ্যক এবং এর মূল চেতনার পরিপন্থী। আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে অনগ্রসর জেলাগুলোকে অঞ্চলভিত্তিক দু-তিনটি গুচ্ছে বিভক্ত করে সেই গুচ্ছগুলোতে জেলা কোটার অংশটি ভাগ করা যায়। সে কোটা অনুযায়ী প্রাপ্ত পদ ওই গুচ্ছের মধ্যে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিলেও কিছুটা মেধার মূল্যায়ন হতো। আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে অগ্রসর জেলাগুলো কোটার সুবিধা পাবে কেন? তারা প্রতিযোগিতায় পারলে আসবে, না হয় আসবে না।
আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সব নাগরিকের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি-সংক্রান্ত অধ্যায়ের ১৯(১) অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের জন্য সমতা নিশ্চিত করার বিধান রয়েছে। মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত অধ্যায়ের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর উপ-অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের জন্য সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে বলে উল্লেখ রয়েছে। একই অনুচ্ছেদের ৩(ক) উপ-অনুচ্ছেদে নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে শুধু তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
এসব আলোচনা থেকে একটি সারবত্তাই বেরিয়ে আসে। বেসামরিক চাকরিতে, বিশেষ করে প্রথম শ্রেণীর পদে প্রবেশকালে প্রাধান্য দিতে হবে মেধাকেই। বিসিএস পরীক্ষায় এবং অধস্তন বিচার বিভাগের নিয়োগে মেধার কোটা ৭৫ শতাংশের কম হওয়া যথোচিত হবে না। বাকি পদগুলোয় যেসব কোটা বিদ্যমান রয়েছে, তাদের মাঝে যৌক্তিক পরিমাণে পুনর্বিন্যাস করে বরাদ্দ করা যায়। তবে প্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে অতি অবশ্যই তা মেধাতালিকায় স্থানান্তরিত হতে হবে। এটা বেসামরিক চাকরির মান বৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে। নিয়োগকালে সামান্য ব্যতিক্রম ব্যতীত (কোটা) শুধু মেধা আর পদোন্নতিকালে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকেই একমাত্র নির্দেশক হিসেবে বিবেচনায় নিলে সুফল পাবে সরকার তথা দেশ ও জনগণ।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
সামগ্রিক বিষয়াদি আলোচনার জন্য অনেক বড় পরিসর আবশ্যক। সেটা বর্তমান নিবন্ধে সম্ভব নয়। মেধাবীদের একটি বড় অংশ সরকারি চাকরিতে আকর্ষণ হারানোর পরও যাঁরা আসতে চাইছেন, তাঁরা যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন, তার দু-একটি প্রধান বিষয় আলোচনা করব। বলা বাহুল্য, সাংবিধানিক পদগুলো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ব্যতীত সব বেসামরিক চাকরিতে এ প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান। প্রধান প্রতিবন্ধকতাটি হচ্ছে, একটি বৈষম্যমূলক কোটাপদ্ধতি। বর্তমানে বিসিএস পরীক্ষায় নিয়োগের জন্য কোটার বিন্যাস হচ্ছে শতকরা হিসাবে—মেধা ৪৫, মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য ৩০, মহিলা ১০, জেলা ১০, উপজাতি (এ নামেই কোটাটি সংরক্ষিত আছে) ৫ এবং প্রতিবন্ধী ১। যোগ করলে ১০১ হয় বিধায় অনুসন্ধানে জেনেছি, সেই ১ শতাংশ অন্য কোনো কোটা পূরণ না হলে তা থেকে দেওয়া হয়। এসব পদের মধ্যে সনাতন ক্যাডার সার্ভিস ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, কৃষিবিজ্ঞান, প্রাণিসম্পদ ইত্যাদি রয়েছে অর্থাৎ আমরা শুধু প্রশাসন, পুলিশ, কূটনীতিক, হিসাব ও নিরীক্ষা, শুল্ক ও কর—এসব পদেই মেধাবীদের প্রবেশ সীমিত করিনি; সীমিত করেছি কলেজশিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিজ্ঞানী, প্রাণিসম্পদবিদসহ সব ক্ষেত্রেই। বছর দুই আগে থেকেই অধস্তন বিচার বিভাগেও এ কোটা পুনরায় চালু করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পৃথক জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠনের পর প্রধানত মেধাই প্রাধান্য পেত। অব্যাহতভাবে এ ধরনের নিয়োগের পরিণতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। উল্লেখ করা যায়, ৩১তম বিসিএসে প্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ৭৭৩টি পদ শূন্য রাখা হয়েছে বলে পিএসসির চেয়ারম্যান সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন (কালের কণ্ঠ, ৯ জুলাই)। অথচ সম্মিলিত মেধাতালিকায় ওপরের দিকে অবস্থান করেও অনেকে চাকরি পেলেন না। কী নির্মম পরিহাস!
শুধু নিয়োগে নয় পদোন্নতিকালেও কম মেধাবীরা কোনো ফাঁকফোঁকরে টপকে যাচ্ছেন মেধাবীদের—এ বেদনাদায়ক চিত্রও দেখা যায়। এটা ঠিক, পদোন্নতি সবাই পাবে না। মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনাতেই ওপরের পদে পদোন্নতি দেওয়ার কথা। নিয়োগকালীন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মেধাতালিকায় ওপরের দিকে থাকলেও চাকরিজীবনে কেউ কেউ ভালো করেন না বলে পিছিয়ে যান, এটাও দেখা গেছে। তবে গণহারে মেধাবীরা তলিয়ে যান, আর সামনে আসেন কম মেধাবীরা, এমনটা দেখা যায়নি। কিন্তু এখন তা-ও ঘটছে। যেমন, প্রশাসন ক্যাডারে ১৯৮৫ ব্যাচে নিয়োগপ্রাপ্ত ৫৩৮ কর্মকর্তার মধ্যে ২০৮ জন যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পান। শতকরা হার ৩৮ দশমিক ৮। ব্যাচটিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁদের প্রথম ২০০ জনের মধ্যে ৭৫ জন (শতকরা ৩৭ দশমিক ৫) এবং পরবর্তী ৩৩৬ জনের মধ্যে ১৩৩ জন (শতকরা ৩৯ দশমিক ৬) পদোন্নতি পেয়েছেন। অথচ শীর্ষে অবস্থানকারী ২০০ জন মেধার ভিত্তিতেই চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তেমনি একই ক্যাডারের ১৯৮৪ ব্যাচের ৪৭৭ জন কর্মকর্তার মধ্যে প্রথম ৩০০ জনকে সম্প্রতি বিবেচনায় নিয়ে ৭৮ জনকে অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে। এর প্রথম ২০০ জনের মধ্যে ৫৩ জন এবং পরবর্তী ১০০ জনে ২৫ জন। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সময়ও বঞ্চনা, সরকারি চাকরিকে সচেতনভাবেই মেধাহীন করা হচ্ছে। পুলিশ, অধস্তন বিচার বিভাগ—সর্বত্র একই অবস্থা। এতে লাভবান হবে কে? মেধাতালিকার নিচের দিকে থাকা কর্মকর্তারা, বিভিন্ন কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত। সম্মিলিত মেধাতালিকায় অনেক নিচের দিকেই ছিল তাঁদের অবস্থান। কোটা না থাকলে তাঁদের অনেকে এসব পদে নিয়োগই পেতেন না। কিন্তু দুর্ভাগা এ জাতি সযতনে মেধাবীদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
অপরদিকে আমরা দেখি, সামরিক বাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগের জন্য ক্যাডেট বাছাই করতে মেধা ব্যতীত কোনো কোটাই নেই। মেধা এবং শুধু মেধাই সেখানে অফিসার পদে নিয়োগের মাপকাঠি। তবে সৈনিক পদে নিয়োগে জেলা কোটা অনুসরণ করা হয়। ক্যাডেট হিসেবে বাছাইয়ের পর কমিশন্ড লাভ করা পর্যন্ত কঠোর দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এর পরও বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁরা নেন পেশাগত প্রশিক্ষণ। ইংরেজি ভাষার চর্চা এবং তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান তাঁদের করে সমৃদ্ধ। তদুপরি নির্দ্বিধায় বলা চলে, অন্তত মাঝারি স্তর পর্যন্ত তাঁদের পদোন্নতি থাকে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত। শুধু মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নিয়েই তাঁরা অগ্রসর হতে থাকেন। এ কারণেই আজ বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী দক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। তাদের নিয়ে দেশ ও জাতি গর্ববোধ করে। সরকারও তাদের কোনো দায়িত্ব দিয়ে আশ্বস্ত থাকে, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি হবে বলে। তাহলে রাষ্ট্রের বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি কেন? সামরিক বাহিনীর মান আরও বৃদ্ধি পাক—এ কামনা সবার। তবে বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মান বৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক উল্লেখযোগ্য কোনো প্রত্যাশিত পদক্ষেপ সাম্প্রতিককালে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর কোনোটিই নেয়নি; বরং ক্রমান্বয়ে এগুলো দুর্বল করার পদক্ষেপই লক্ষণীয় হচ্ছে।
উল্লেখ করা আবশ্যক, কিছু কিছু বেসামরিক চাকরির নিয়োগে কোটাব্যবস্থা নতুন নয়। এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে, ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সমানতালে না আসতে পারায় ভারতীয়দের জন্য কিছু কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। পরে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্যও আসে কিছু কোটা। আর পাকিস্তান সময়কালে পিছিয়ে পড়া তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশ) দাবির মুখে কেন্দ্রীয় সুপেরিয়র সার্ভিসগুলোর কয়েকটিতে প্রদেশভিত্তিক কিছু কোটা চালু ছিল। তবে এখনকার মতো সব স্তরে বাস্তবতার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণভাবে বিশাল আকারের কোটা কখনোই ছিল না। দেখা যাচ্ছে, যাদের জন্য বিশাল কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তাদের মাঝে সে সংখ্যক পরীক্ষায় পাস করা প্রার্থীই পাওয়া যায় না। ফলে পদ থাকে শূন্য। বঞ্চিত হচ্ছেন যোগ্য প্রার্থী।
সব চাকরিতে নিয়োগকালে বিশাল কোটা সংরক্ষণ ও যোগ্য কেউ না থাকলে পদগুলো শূন্য রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক, তা নীতিনির্ধারকেরা ভেবে দেখেছেন কি? তেমনিভাবে জেলা কোটা উন্নত আর অনুন্নত সব জেলার জন্য আনুপাতিক হারে বণ্টনও অনাবশ্যক এবং এর মূল চেতনার পরিপন্থী। আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে অনগ্রসর জেলাগুলোকে অঞ্চলভিত্তিক দু-তিনটি গুচ্ছে বিভক্ত করে সেই গুচ্ছগুলোতে জেলা কোটার অংশটি ভাগ করা যায়। সে কোটা অনুযায়ী প্রাপ্ত পদ ওই গুচ্ছের মধ্যে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিলেও কিছুটা মেধার মূল্যায়ন হতো। আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে অগ্রসর জেলাগুলো কোটার সুবিধা পাবে কেন? তারা প্রতিযোগিতায় পারলে আসবে, না হয় আসবে না।
আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সব নাগরিকের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি-সংক্রান্ত অধ্যায়ের ১৯(১) অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের জন্য সমতা নিশ্চিত করার বিধান রয়েছে। মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত অধ্যায়ের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর উপ-অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের জন্য সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে বলে উল্লেখ রয়েছে। একই অনুচ্ছেদের ৩(ক) উপ-অনুচ্ছেদে নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে শুধু তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
এসব আলোচনা থেকে একটি সারবত্তাই বেরিয়ে আসে। বেসামরিক চাকরিতে, বিশেষ করে প্রথম শ্রেণীর পদে প্রবেশকালে প্রাধান্য দিতে হবে মেধাকেই। বিসিএস পরীক্ষায় এবং অধস্তন বিচার বিভাগের নিয়োগে মেধার কোটা ৭৫ শতাংশের কম হওয়া যথোচিত হবে না। বাকি পদগুলোয় যেসব কোটা বিদ্যমান রয়েছে, তাদের মাঝে যৌক্তিক পরিমাণে পুনর্বিন্যাস করে বরাদ্দ করা যায়। তবে প্রাধিকার কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে অতি অবশ্যই তা মেধাতালিকায় স্থানান্তরিত হতে হবে। এটা বেসামরিক চাকরির মান বৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে। নিয়োগকালে সামান্য ব্যতিক্রম ব্যতীত (কোটা) শুধু মেধা আর পদোন্নতিকালে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকেই একমাত্র নির্দেশক হিসেবে বিবেচনায় নিলে সুফল পাবে সরকার তথা দেশ ও জনগণ।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
No comments