শিক্ষা ও স্বদেশ-হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু ও উচ্চমাধ্যমিকের ফল by মোহীত উল আলম
লিখতে বসেছিলাম ১৯ জুলাই রাতে, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের বিপুল সাফল্য নিয়ে। প্রায় সব জাতীয় পত্রিকায় তরুণ-তরুণীদের উচ্ছ্বাসমাখা বাঁধভাঙা আনন্দের ছবি দেখে যখন নিজের ভেতরেও তারুণ্যের পুলক অনুভব করছিলাম, তখন প্রথমে ফেসবুকে খবরটা জানলাম যে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম লেখক ও
চলচ্চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ আর নেই (ইন্না লিল্লাহি...রাজেউন)। সঙ্গে সঙ্গে চোখে পানি এসে গেল। তখন বাস্তবভাবে জিনিসটা দেখতে গিয়ে বুঝলাম যে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সাফল্যের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু নয়, তাঁর জীবনকে সংযুক্তি করে দেখানোর মতো সুন্দর বিষয় আর হতে পারে না।
সারা জীবন ভালো ছাত্র ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বগুড়া জিলা স্কুল থেকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিলেন মাধ্যমিক পরীক্ষায়। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ও সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান দখল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রসায়ন বিভাগে। সেখানেও কৃতিত্বপূর্ণ ফল করে ওই বিভাগেই শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরে আমেরিকার নর্থ ডাকোটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিমার রসায়নের ওপর বিশ্বনন্দিত অধ্যাপক গ্লাসের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে অধ্যাপনায় নিযুক্ত থাকতে থাকতে একসময় সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দেওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন।
ওপরের এই বর্ণনায় যে হুমায়ূন আহমেদকে পেলাম, তাঁর সাহিত্যিক পরিচিতি ও চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা সম্পূর্ণ বাদ দিলেও ওই কৃতী শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদই আজ যে ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ তরুণ শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে সফল হয়েছে, তাদের সবার, তাদের মা-বাবা ও তাদের অভিভাবকদের কাছেও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বা আইকন হয়ে থাকতেন। অর্থাত্ বাংলাদেশের অভিভাবকশ্রেণীর লক্ষ্য থাকত, তাঁদের সন্তানেরা যেন হুমায়ূন আহমেদের মতো কৃতী হয় এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থীদেরও অভীপ্সা থাকত, হুমায়ূন আহমেদের মতো কৃতী ছাত্র ও শিক্ষক হওয়া। হুমায়ূন আহমেদের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে, তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের পরিবারের মধ্যে যেমন প্রত্যেক বাবা ও মা তাঁর ছেলে বা মেয়েকে হয়তো বলতেন, ‘বাবা, ভালো করে লেখাপড়া করো, হুমায়ূন আহমেদের মতো ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করো।’ অর্থাত্ ধরি, ১০০ বা ২০০ বা বড়জোর ৫০০টা পরিবারের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ স্রেফ তাঁর ভালো রেজাল্ট, আমেরিকার পিএইচডি ডিগ্রি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার খ্যাতির কারণে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকতেন। মা-বাবা বিমুগ্ধচিত্তে তাঁদের সন্তানদের কাছে হুমায়ূন আহমেদকে রেফারেন্স হিসেবে টানতেন।
কিন্তু সেই হুমায়ূন আহমেদ যখন নিজের চাকরিগত ক্ষুদ্র গণ্ডি ছেড়ে লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে সুনাম অর্জন করলেন, তখন তাঁর পরিচিতি বাংলাদেশ ও পৃথিবীর সব বাংলা ভাষাভাষী জগতের মধ্যে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়লেও তিনি অভিভাবক আর শিক্ষার্থীদের কাছে আর ভালো ছাত্রের আইকন হিসেবে রইলেন না। অর্থাত্ একটি খুবই ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া কোনো মা-বাবাই তাঁদের সন্তানদের বললেন না, ‘বাবা, হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখক হও।’ হুমায়ূন আহমেদের খ্যাতি ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপী হয়েছে, কিন্তু অভিভাবকশ্রেণীর মা-বাবার কাছে কিংবা শিক্ষার্থী নিজেদের কাছে তিনি আর মডেল ছাত্র হিসেবে রইলেন না। সেটা তিনি থাকতেন, যদি তিনি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপকের মধ্যে একজন হয়ে থাকতেন।
অর্থাত্ আমি যে কথাটা আনতে চাইছি, সেটা হলো, এই যে আমরা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভালো ফল আশা করি, তা আসলে খুব একটা সীমিত অর্থে, প্রায়ই পারিবারিক বা পরিচিত মহলে একটা চাকরিধারী ব্যক্তি হিসেবে যেন তারা প্রতিষ্ঠা পায়, সেই অর্থে। পড়ালেখার জোরে ছেলে বা মেয়ে চাকরি পাবে, সংসার করবে, বাড়ি বানাবে, পদবির হাঁকডাক দেখাবে, এটাই হলো গড়পড়তা বাংলাদেশের অভিভাবকশ্রেণীর সন্তানদের কাছে প্রত্যাশা। কারণ, আমাদের সমাজ একজন পড়ালেখায় ভালো চাকরিজীবীকে যতটা সম্মান করে, একজন সাহিত্যিককে তা করে না, এটাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গিটা জীবনকে ছোট করে দেখার জন্য যথেষ্ট। জীবন যেন মহাসমুদ্র নয়, জীবন যেন একটি পুকুর, যার কিনারায়-কিনারায় সাঁতরে পৌঁছানো যায়। এ দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফল হচ্ছে, ছেলে বা মেয়ে অত্যন্ত ঈর্ষণীয় ফল করে চিকিত্সক হচ্ছে টাকা কামাই করার জন্য, চিকিত্সাসেবাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। প্রকৌশলী হচ্ছে নিজের জন্য বাড়িঘর বানানোর জন্য, বাংলাদেশের সড়ক, সেতু নির্মাণ বা বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য নয়। আর ইংরেজির শিক্ষক হচ্ছে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানচর্চা বা অনুবাদকর্মে নিয়োজিত হওয়ার জন্য নয়, কিন্তু বড় বড় কোচিং সেন্টার খোলার জন্য। সংকীর্ণ ব্যক্তিগত একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেওয়াই হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার কাছে আমাদের প্রত্যাশা। এ জীবনবোধ যে সঠিক নয়, তা বোঝা যায় এ পরিসংখ্যান থেকে, যে বাংলাদেশ ৪০ বছর ধরে যত ভালো ছাত্রছাত্রীর জন্ম দিয়েছে, সে তুলনায় বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে উন্নতি সবচেয়ে কম হয়েছে, বা হয়েছে অনুল্লেখ্য। এবার যে সাত লাখের অধিক শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে সমকাল পত্রিকার (১৯ জুলাই) ভাষায় ‘স্বপ্নসারথি’ হয়েছে, আগামী ২০ বছর পর এদের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা যাবে যে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র দেশসেবা বা সমাজসেবায় নিয়োজিত আছে, আর বাকিরা সবাই, এখন আমরা যা করছি, তাই করবে। স্বার্থপরতার এক একজন চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা হবে।
ঢাকা বোর্ডের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয়বারের মতো রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ প্রথম হয়েছে। এর অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ গোলাম হোসেন সরকার সাফল্যের পেছনে কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা’র সফল প্রয়োগের ফলে কলেজের এ সাফল্য এসেছে। তিনি আরও বলেছেন, ‘শুধু মেধা থাকলে হয় না, মেধা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ করে দিতে হয়।’
চমত্কার পর্যবেক্ষণ। শুধু মেধা থাকলে হয় না, মেধার সঙ্গে দায়বদ্ধতা, দায়িত্ববোধ ও দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি মানবপ্রেম সংযুক্ত না হলে এখনকার মেধাবী শিক্ষার্থীরা কালের গর্ভে দেশ ও জাতির জন্য সম্পদ নয়, বোঝা হিসেবে পরিণত হবে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার করুণ পরিণতি তখনই হয়, যখন উচ্চ লেখাপড়া জানা শীর্ষ পদের কর্মকর্তা যে ভাষায় চিন্তা করেন বা কথা বলেন, তাঁর অধীন কেরানিও একই চিন্তা করেন ও একই ভাষায় কথা বলেন। লেখাপড়ার করুণ পরিণতি তখনই হয়, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষিত বিজ্ঞানের অধ্যাপক বিজ্ঞানের খোঁজ বাদ দিয়ে এমন একটি বিষয়ে নিয়ে মেতে থাকবেন, যে বিষয়ে তাঁকে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীও জ্ঞান দান করতে পারবে। একজন উপাচার্য সম্পর্কে শুনেছি, যদিও তিনি অর্থনীতির বা ব্যবসায়িক বিষয়ের অধ্যাপক নন, কিন্তু তিনি নাকি সর্বক্ষণ পুঁজির বাজার বা শেয়ার মার্কেট নিয়ে আলাপে মত্ত থাকেন। এখন সমাজের যে প্রকৃত অবস্থা, রাজনৈতিক দিক থেকে তাতে মনে হচ্ছে, এখনকার কৃতী শিক্ষার্থীরা যে মেধা বিকাশের সুষম পরিবেশ পাবে, তা হয়তো হবে না।
রাজউক কলেজ বা এমন ধারার সফল কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা যে শৃঙ্খলা বা পরিবেশের মাধ্যমে ভালো ফল করে এসেছে, তাদের জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণের যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে তাদের অধিকাংশের হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চশিক্ষার প্রতি রাজনৈতিক অভীপ্সা এবং সাধারণভাবে আমাদের অভিভাবকশ্রেণীর সন্তানদের জীবনের লক্ষ্যের ব্যাপারে অভিব্যক্তির মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক বিরাজ করছে, যার ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের রাজনীতির সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক ধারার। ছাত্ররাজনীতিতে তারই বহিঃপ্রকাশ হয়। সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সিলেট এমসি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাস পোড়ানোর অভিযোগ উঠলে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, সংঘর্ষটা রাজনৈতিক, কাজেই তদন্ত না করার আগে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। এর অর্থ হলো, সরকারি দল, বিরোধী দল ও অন্য দলগুলো ছাত্রসংগঠনের নেতা ও কর্মীদের প্রতিপক্ষ দলকে ঠেকানোর কাজে ব্যবহার করার অভিলাষে আশকারা দিয়ে যায়। আবার ছাত্র নামধারী সশস্ত্র ও সন্ত্রাসমুখী এসব শিক্ষার্থী বর্তমান ধারার উচ্চশিক্ষার মধ্যে কোনো চাপে থাকে না। পড়ালেখা ছেড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মেতে থাকলেও তাদের পাস বা ডিগ্রি অর্জন আটকায় না। সমগ্র ছাত্রগোষ্ঠীর তুলনায় এদের সংখ্যা কম, কিন্তু এরা রাজনৈতিক সংগঠন ও ক্ষমতাবানদের প্রশ্রয়ের কারণে কর্মসূচি নিয়ে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অচল করে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের গায়ে একটি তালা ঝুলিয়ে দিতে পারলে কর্মসূচি সফল। ফলে মেধাবী, দায়িত্ববোধসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা পাঠে মনঃসংযোগ করতে পারে না। তারা হতাশাগ্রস্ত হয়।
নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনিশ্চয়তার কথা মনে রেখে আমরা অধিকাংশ অভিভাবক যে ভুলটা করি, সেটা হচ্ছে, সন্তানাদি কোন বিষয়ে লেখাপড়া করবে, সেটা আমরা তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করি। ফলে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী মহলের মধ্যে যে ব্যাপারটি সবচেয়ে লক্ষণীয়, সেটি হচ্ছে, যার যার বিষয়ের প্রতি তার অমনোযোগিতা। এ সর্বব্যাপী অমনোযোগিতার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায়ই ভুলভাবে পছন্দ করা বিষয়ের সঙ্গে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হয়, হয় তারা বিষয়টার কাছে পরাজিত বোধ করতে থাকে, নচেত্ ঘৃণা পোষণ করতে থাকে। ফলে তারা পাঠ্যাভ্যাস না করে সময়ক্ষেপণের রাস্তা বের করতে থাকে, এবং ক্যাম্পাসে মিছিলভিত্তিক সংঘর্ষপ্রধান রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়তে তাদের তরুণরক্তে সাড়া জাগে। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, অভিভাবকের চাপানো সিদ্ধান্তই হয়তো একজন শিক্ষার্থীকে এ রকম বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়। এবং এ ধরনের বিষয়বিমুখ শিক্ষার্থীদের প্রলুব্ধ করার জন্য আদর্শ নামধারী কিন্তু বস্তুত সংঘর্ষমনস্ক দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি ক্যাম্পাসে তৈরি থাকে।
শিক্ষাকে মানবিক মূল্যবোধ অর্জন ও উদার জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে না দেখে শুধু সংসার যাপনের মাধ্যম হিসেবে দেখলে আজকের কৃতী শিক্ষার্থীদের ব্যর্থতার গহ্বরে হারিয়ে যেতে দেরি হবে না।
অধ্যাপক মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
সারা জীবন ভালো ছাত্র ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বগুড়া জিলা স্কুল থেকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিলেন মাধ্যমিক পরীক্ষায়। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ও সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান দখল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রসায়ন বিভাগে। সেখানেও কৃতিত্বপূর্ণ ফল করে ওই বিভাগেই শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরে আমেরিকার নর্থ ডাকোটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিমার রসায়নের ওপর বিশ্বনন্দিত অধ্যাপক গ্লাসের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে অধ্যাপনায় নিযুক্ত থাকতে থাকতে একসময় সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দেওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন।
ওপরের এই বর্ণনায় যে হুমায়ূন আহমেদকে পেলাম, তাঁর সাহিত্যিক পরিচিতি ও চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা সম্পূর্ণ বাদ দিলেও ওই কৃতী শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদই আজ যে ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ তরুণ শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে সফল হয়েছে, তাদের সবার, তাদের মা-বাবা ও তাদের অভিভাবকদের কাছেও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বা আইকন হয়ে থাকতেন। অর্থাত্ বাংলাদেশের অভিভাবকশ্রেণীর লক্ষ্য থাকত, তাঁদের সন্তানেরা যেন হুমায়ূন আহমেদের মতো কৃতী হয় এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থীদেরও অভীপ্সা থাকত, হুমায়ূন আহমেদের মতো কৃতী ছাত্র ও শিক্ষক হওয়া। হুমায়ূন আহমেদের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে, তাঁর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের পরিবারের মধ্যে যেমন প্রত্যেক বাবা ও মা তাঁর ছেলে বা মেয়েকে হয়তো বলতেন, ‘বাবা, ভালো করে লেখাপড়া করো, হুমায়ূন আহমেদের মতো ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করো।’ অর্থাত্ ধরি, ১০০ বা ২০০ বা বড়জোর ৫০০টা পরিবারের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ স্রেফ তাঁর ভালো রেজাল্ট, আমেরিকার পিএইচডি ডিগ্রি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার খ্যাতির কারণে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকতেন। মা-বাবা বিমুগ্ধচিত্তে তাঁদের সন্তানদের কাছে হুমায়ূন আহমেদকে রেফারেন্স হিসেবে টানতেন।
কিন্তু সেই হুমায়ূন আহমেদ যখন নিজের চাকরিগত ক্ষুদ্র গণ্ডি ছেড়ে লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে সুনাম অর্জন করলেন, তখন তাঁর পরিচিতি বাংলাদেশ ও পৃথিবীর সব বাংলা ভাষাভাষী জগতের মধ্যে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়লেও তিনি অভিভাবক আর শিক্ষার্থীদের কাছে আর ভালো ছাত্রের আইকন হিসেবে রইলেন না। অর্থাত্ একটি খুবই ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া কোনো মা-বাবাই তাঁদের সন্তানদের বললেন না, ‘বাবা, হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখক হও।’ হুমায়ূন আহমেদের খ্যাতি ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপী হয়েছে, কিন্তু অভিভাবকশ্রেণীর মা-বাবার কাছে কিংবা শিক্ষার্থী নিজেদের কাছে তিনি আর মডেল ছাত্র হিসেবে রইলেন না। সেটা তিনি থাকতেন, যদি তিনি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপকের মধ্যে একজন হয়ে থাকতেন।
অর্থাত্ আমি যে কথাটা আনতে চাইছি, সেটা হলো, এই যে আমরা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভালো ফল আশা করি, তা আসলে খুব একটা সীমিত অর্থে, প্রায়ই পারিবারিক বা পরিচিত মহলে একটা চাকরিধারী ব্যক্তি হিসেবে যেন তারা প্রতিষ্ঠা পায়, সেই অর্থে। পড়ালেখার জোরে ছেলে বা মেয়ে চাকরি পাবে, সংসার করবে, বাড়ি বানাবে, পদবির হাঁকডাক দেখাবে, এটাই হলো গড়পড়তা বাংলাদেশের অভিভাবকশ্রেণীর সন্তানদের কাছে প্রত্যাশা। কারণ, আমাদের সমাজ একজন পড়ালেখায় ভালো চাকরিজীবীকে যতটা সম্মান করে, একজন সাহিত্যিককে তা করে না, এটাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গিটা জীবনকে ছোট করে দেখার জন্য যথেষ্ট। জীবন যেন মহাসমুদ্র নয়, জীবন যেন একটি পুকুর, যার কিনারায়-কিনারায় সাঁতরে পৌঁছানো যায়। এ দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফল হচ্ছে, ছেলে বা মেয়ে অত্যন্ত ঈর্ষণীয় ফল করে চিকিত্সক হচ্ছে টাকা কামাই করার জন্য, চিকিত্সাসেবাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। প্রকৌশলী হচ্ছে নিজের জন্য বাড়িঘর বানানোর জন্য, বাংলাদেশের সড়ক, সেতু নির্মাণ বা বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য নয়। আর ইংরেজির শিক্ষক হচ্ছে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানচর্চা বা অনুবাদকর্মে নিয়োজিত হওয়ার জন্য নয়, কিন্তু বড় বড় কোচিং সেন্টার খোলার জন্য। সংকীর্ণ ব্যক্তিগত একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেওয়াই হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার কাছে আমাদের প্রত্যাশা। এ জীবনবোধ যে সঠিক নয়, তা বোঝা যায় এ পরিসংখ্যান থেকে, যে বাংলাদেশ ৪০ বছর ধরে যত ভালো ছাত্রছাত্রীর জন্ম দিয়েছে, সে তুলনায় বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে উন্নতি সবচেয়ে কম হয়েছে, বা হয়েছে অনুল্লেখ্য। এবার যে সাত লাখের অধিক শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে সমকাল পত্রিকার (১৯ জুলাই) ভাষায় ‘স্বপ্নসারথি’ হয়েছে, আগামী ২০ বছর পর এদের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা যাবে যে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র দেশসেবা বা সমাজসেবায় নিয়োজিত আছে, আর বাকিরা সবাই, এখন আমরা যা করছি, তাই করবে। স্বার্থপরতার এক একজন চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা হবে।
ঢাকা বোর্ডের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয়বারের মতো রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ প্রথম হয়েছে। এর অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ গোলাম হোসেন সরকার সাফল্যের পেছনে কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা’র সফল প্রয়োগের ফলে কলেজের এ সাফল্য এসেছে। তিনি আরও বলেছেন, ‘শুধু মেধা থাকলে হয় না, মেধা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ করে দিতে হয়।’
চমত্কার পর্যবেক্ষণ। শুধু মেধা থাকলে হয় না, মেধার সঙ্গে দায়বদ্ধতা, দায়িত্ববোধ ও দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি মানবপ্রেম সংযুক্ত না হলে এখনকার মেধাবী শিক্ষার্থীরা কালের গর্ভে দেশ ও জাতির জন্য সম্পদ নয়, বোঝা হিসেবে পরিণত হবে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার করুণ পরিণতি তখনই হয়, যখন উচ্চ লেখাপড়া জানা শীর্ষ পদের কর্মকর্তা যে ভাষায় চিন্তা করেন বা কথা বলেন, তাঁর অধীন কেরানিও একই চিন্তা করেন ও একই ভাষায় কথা বলেন। লেখাপড়ার করুণ পরিণতি তখনই হয়, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষিত বিজ্ঞানের অধ্যাপক বিজ্ঞানের খোঁজ বাদ দিয়ে এমন একটি বিষয়ে নিয়ে মেতে থাকবেন, যে বিষয়ে তাঁকে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীও জ্ঞান দান করতে পারবে। একজন উপাচার্য সম্পর্কে শুনেছি, যদিও তিনি অর্থনীতির বা ব্যবসায়িক বিষয়ের অধ্যাপক নন, কিন্তু তিনি নাকি সর্বক্ষণ পুঁজির বাজার বা শেয়ার মার্কেট নিয়ে আলাপে মত্ত থাকেন। এখন সমাজের যে প্রকৃত অবস্থা, রাজনৈতিক দিক থেকে তাতে মনে হচ্ছে, এখনকার কৃতী শিক্ষার্থীরা যে মেধা বিকাশের সুষম পরিবেশ পাবে, তা হয়তো হবে না।
রাজউক কলেজ বা এমন ধারার সফল কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা যে শৃঙ্খলা বা পরিবেশের মাধ্যমে ভালো ফল করে এসেছে, তাদের জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণের যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে তাদের অধিকাংশের হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চশিক্ষার প্রতি রাজনৈতিক অভীপ্সা এবং সাধারণভাবে আমাদের অভিভাবকশ্রেণীর সন্তানদের জীবনের লক্ষ্যের ব্যাপারে অভিব্যক্তির মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক বিরাজ করছে, যার ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের রাজনীতির সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক ধারার। ছাত্ররাজনীতিতে তারই বহিঃপ্রকাশ হয়। সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সিলেট এমসি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাস পোড়ানোর অভিযোগ উঠলে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, সংঘর্ষটা রাজনৈতিক, কাজেই তদন্ত না করার আগে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। এর অর্থ হলো, সরকারি দল, বিরোধী দল ও অন্য দলগুলো ছাত্রসংগঠনের নেতা ও কর্মীদের প্রতিপক্ষ দলকে ঠেকানোর কাজে ব্যবহার করার অভিলাষে আশকারা দিয়ে যায়। আবার ছাত্র নামধারী সশস্ত্র ও সন্ত্রাসমুখী এসব শিক্ষার্থী বর্তমান ধারার উচ্চশিক্ষার মধ্যে কোনো চাপে থাকে না। পড়ালেখা ছেড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মেতে থাকলেও তাদের পাস বা ডিগ্রি অর্জন আটকায় না। সমগ্র ছাত্রগোষ্ঠীর তুলনায় এদের সংখ্যা কম, কিন্তু এরা রাজনৈতিক সংগঠন ও ক্ষমতাবানদের প্রশ্রয়ের কারণে কর্মসূচি নিয়ে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অচল করে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের গায়ে একটি তালা ঝুলিয়ে দিতে পারলে কর্মসূচি সফল। ফলে মেধাবী, দায়িত্ববোধসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা পাঠে মনঃসংযোগ করতে পারে না। তারা হতাশাগ্রস্ত হয়।
নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনিশ্চয়তার কথা মনে রেখে আমরা অধিকাংশ অভিভাবক যে ভুলটা করি, সেটা হচ্ছে, সন্তানাদি কোন বিষয়ে লেখাপড়া করবে, সেটা আমরা তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করি। ফলে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী মহলের মধ্যে যে ব্যাপারটি সবচেয়ে লক্ষণীয়, সেটি হচ্ছে, যার যার বিষয়ের প্রতি তার অমনোযোগিতা। এ সর্বব্যাপী অমনোযোগিতার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায়ই ভুলভাবে পছন্দ করা বিষয়ের সঙ্গে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হয়, হয় তারা বিষয়টার কাছে পরাজিত বোধ করতে থাকে, নচেত্ ঘৃণা পোষণ করতে থাকে। ফলে তারা পাঠ্যাভ্যাস না করে সময়ক্ষেপণের রাস্তা বের করতে থাকে, এবং ক্যাম্পাসে মিছিলভিত্তিক সংঘর্ষপ্রধান রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়তে তাদের তরুণরক্তে সাড়া জাগে। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, অভিভাবকের চাপানো সিদ্ধান্তই হয়তো একজন শিক্ষার্থীকে এ রকম বিপদের মধ্যে ঠেলে দেয়। এবং এ ধরনের বিষয়বিমুখ শিক্ষার্থীদের প্রলুব্ধ করার জন্য আদর্শ নামধারী কিন্তু বস্তুত সংঘর্ষমনস্ক দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি ক্যাম্পাসে তৈরি থাকে।
শিক্ষাকে মানবিক মূল্যবোধ অর্জন ও উদার জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে না দেখে শুধু সংসার যাপনের মাধ্যম হিসেবে দেখলে আজকের কৃতী শিক্ষার্থীদের ব্যর্থতার গহ্বরে হারিয়ে যেতে দেরি হবে না।
অধ্যাপক মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
No comments