বাংলাদেশের স্থাপত্যশিল্পের পথিকৃৎ তিনি। সক্রিয় ছিলেন রাজনীতিতেও। এবারের মূল রচনা সদ্য প্রয়াত এই স্থপতিকে নিয়ে-আমাদের মজু ভাই by মতিউর রহমান
তাঁকে আমরা ডাকতাম ‘মজু ভাই’ বলে। আমাদের সেই মজু ভাই, দেশের শ্রেষ্ঠ স্থপতি মাজহারুল ইসলাম গত শনিবার গভীর রাতে আমাদের ছেড়ে গেলেন। পরিণত বয়সেই তাঁর প্রস্থান। সবার জীবনেরই এই এক অমোঘ পরিণতি—এই ভেবে সান্ত্বনা পাই। কিন্তু আমাদের বেবী আপার (সালমা ইসলাম) তো কোনো সান্ত্বনা নেই।
গত রোববার সকালে বাসভবনে দেখা হতেই জড়িয়ে ধরে বললেন, তোমাদের মজু ভাই চলেই গেলেন।
এখন স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়ছি ভারাক্রান্ত মনে। তাঁর সঙ্গে আমাদের বহুদিনের বহু আনন্দ আর উত্তেজনাভরা সময় কাটানোর ছবিগুলো মনে জেগে ওঠে। কত কিছু মনে পড়ে। কত স্মৃতি হারিয়ে গেছে।
আমার দেখা সেরা সুন্দর মানুষগুলোর মধ্যে প্রধান একজন ছিলেন তিনি। সেই সৌন্দর্য বাইরের এবং অন্তরের। এককথায় যাঁকে বলা যায় সুপুরুষ, ঠিক তাই ছিলেন তিনি। মুখখানা সব সময় স্মিত হাসিতে স্নিগ্ধ, বুদ্ধিদীপ্ত অথচ প্রসন্ন দৃষ্টি। একইভাবে মনের দিক থেকে উদার, চিন্তায় সংস্কারমুক্ত এবং সুরুচিসম্পন্ন। আবার ব্যবহারিক জীবনেও দেখেছি পোশাক-আশাক, আহার-বিহার, আচার-আচরণ, কথাবার্তায়, কর্মে-চিন্তায় কতই না আধুনিক, পরিশীলিত আর অমায়িক। রেগে যেতেন কখনো কখনো। ভয়ও পেতাম। কিন্তু তাতেও ছিল এক সৌন্দর্য। যেমন আদর্শ মানুষের কল্পনা আমরা করি, মজু ভাইয়ের মধ্যে সেই সব গুণের সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাবেশ ঘটেছিল।
মজু ভাইয়ের স্ত্রী সালমা ইসলাম, আমাদের ‘বেবী আপা’, ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে স্নাতক পর্যায়ের পাঠ শুরু করেছিলেন ইডেন কলেজে। তাঁকে পড়ালেখায় সাহায্য করতে যেত সে সময়ে ছাত্রনেত্রী মালেকা বেগম, গৃহশিক্ষক হিসেবে। ইডেন কলেজের সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে বেবী আপা সহসভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামে দিন-রাত জড়িয়ে আছি ভীষণভাবে। এক দুপুরে মালেকা আমাকে এসে বলল তাঁর বিস্ময়ের কথা। বেবী আপাকে পড়াতে গেছে তাদের বাড়িতে। দরজায় কড়া নাড়তেই এক সুদর্শন পুরুষ দরজা খুলে দেন। তাঁর সৌন্দর্যে মালেকা এতই বিস্মিত হয়ে পড়ে যে, ফিরে এসে আমাকে তাঁর (মজু ভাইয়ের) বর্ণনা না দিয়ে পারেনি।
গ্রামের নাম সুন্দরপুর
মাজহারুল ইসলামের জন্ম ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর। মুর্শিদাবাদের সুন্দরপুর গ্রামে, নানার বাড়িতে। তাঁর দাদার বাড়ি চট্টগ্রামের কুয়েপাড়ায়। শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, সচ্ছল পরিবার। দাদা ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। বাবা-চাচারা সবাই শিক্ষিত। কলকাতা ও ঢাকায় চাকরি করতেন। বাবা ওমদাতুল ইসলাম সরকারি কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক। মা জাকিয়া খাতুন। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁর স্কুল ও কলেজজীবন কেটেছে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কৃষ্ণনগরে। ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে পুরকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক, ১৯৫৭ সালে যুক্তরাজ্যের আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচার থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা। ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এখানেই লুই আই কান শিক্ষকতা করেছেন। সেই সুবাদেই লুইয়ের কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেমিনারে অভিসন্দর্ভ উপস্থাপন করেছেন। সদস্য ছিলেন প্রথম আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার জুরি বোর্ডে। দেশ-বিদেশে অনেক মর্যাদাপূর্ণ পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে আছে ‘স্বাধীনতা পদক’। বিদেশেও পেয়েছেন স্বীকৃতি-সম্মান।
মজু ভাইয়ের বাস্তুকলাবিদ
আমার সঙ্গে মজু ভাইয়ের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল, স্মৃতি হাতড়েও আর উদ্ধার করতে পারছি না। সেটি ষাটের দশকের মাঝামাঝি কোনো সময় হবে। আগেই বলেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানামুখী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক-সামাজিক কাজে কর্মচঞ্চল দিন কাটছিল আমাদের। মজু ভাইও এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত ছিলেন। কখনো নেপথ্যে, কখনো সামনে থেকে সক্রিয় ভূমিকায়।
এ ধরনেরই কোনো কর্মকাণ্ড হতে পারে তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র। পরীবাগে তাঁর প্রতিষ্ঠান বাস্তুকলাবিদের বিশাল কার্যালয়, একই সঙ্গে বাসভবন। সামনে সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা মাঠ, পাশেই পুকুর। হরেক রকমের গাছ, লতাগুল্মের সমারোহ। সেই সময়ের সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল তাঁর এই বসতবাড়ি। কে যাননি সেখানে! দেশের প্রধান সব কবি, লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীরা। মনে পড়ছে, প্যারিস থেকে ফেরার পর শিল্পী রশিদ চৌধুরীর প্রথম প্রদর্শনীটি হয়েছিল বাস্তুকলাবিদেই। ছায়ানটের অনুষ্ঠানের গানের রিহার্সেল শুধু নয়, ছায়ানটের অনুষ্ঠানও হতে দেখেছি ওই সবুজ প্রাঙ্গণে। দেখেছি, তিনি ব্যস্ত আছেন অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে, এমনকি মঞ্চ নির্মাণেও।
আমরা তখন তাঁর কাজের তাৎপর্য সম্পর্কে খুব গভীর কিছু জানতাম না। জানতাম তিনি আর্ট কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগার, নিপা ভবন—এসব অনেক আধুনিক স্থাপত্য সৃষ্টি করেছেন। এ দেশের প্রথম সুউচ্চ ইমারত ‘জীবন বীমা ভবন’-এরও নির্মাতা ছিলেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে আছে জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রূপপুর আণবিক শক্তি প্রকল্প, সড়ক ও জনপথ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। এ ছাড়া ঢাকার কিছু আবাসিক বাড়ির নকশাও তিনি করেছেন।
জানতাম, তিনি সর্বজনস্বীকৃত অত্যন্ত বড় এক স্থপতি। কিন্তু তাঁর ভেতরে কোনো অহমিকা কাজ করতে দেখিনি কখনো। সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তাঁর জীবনযাত্রা। অভিজাত, তবে আড়ম্বরহীন। পরতেন সাধারণত মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি-পাজামা, কখনো হাওয়াই শার্ট-প্যান্ট, পায়ে স্যান্ডেল শু।
মজু ভাইয়ের মধ্যে প্রাণশক্তির অপূর্ব একটি প্রকাশ আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করতাম সব সময়, যা আমাদের ভেতরেও প্রেরণা-উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলত। এত রকম, এত বৈচিত্র্যময় বিষয়ে কাজ করতেন, এত পরিশ্রম করতে পারতেন, এত গভীর নিষ্ঠা ছিল কাজের প্রতি যে সত্যি তা অতুলনীয়। যেকোনো ভালো কাজের সঙ্গে থাকতেন, নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে। কতবার কত অনুরোধ নিয়ে গেছি তাঁর কাছে। মজু ভাই আর বেবী আপা আমাদের সেই সব অনুরোধ রক্ষা করেছেন হাসিমুখে।
১৯৬৯ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হলো। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বিপুল। বরাবরের মতোই আমরা গিয়ে ধরলাম মজু ভাই-বেবী আপাকে। বলা মাত্র তাঁরা রাজি হলেন। আর্থিক সহায়তা তো করলেনই বেবী আপা, তাঁর নীল রঙের ফক্সওয়াগন গাড়িটিও দিয়ে দিলেন ত্রাণকাজে সারা দিনের জন্য।
এ রকম নানা কাজে যোগাযোগের মধ্য দিয়েই একসময় তাঁদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা নিবিড় ও প্রীতিময় হয়ে উঠেছিল। আমাদের সামনেই বেড়ে উঠছিল তাঁদের ছেলে রফিক, তান্না ও মেয়ে ডালিয়া। আরেক মেয়ে নাজিয়া তখন গুটি গুটি পায়ে সারা বাড়িতে হেঁটে বেড়ায় (বেবী আপার বোন অধ্যাপিকা নূরুন্নেসা ফয়জুন্নেসার মেয়ে, কিন্তু মজু ভাই আর বেবী আপার ভালোবাসার ছায়াতলেই তাকে বড় হতে দেখেছি)। ক্রমেই আমরা তাঁর পরিবার, তাঁর বৃহৎ স্বজনদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। কাছে থেকে তাঁকে দেখা-জানার সুযোগ হয়েছিল এভাবেই।
রাজনৈতিক জীবন
মজু ভাইকে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতেই সব থেকে ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছিলাম নানা ঘটনাপ্রবাহে সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে। দুটো স্মৃতির কথা বলা যায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির বহু গোপন সভা হয়েছিল তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে। তখন ঢাকার অত্যন্ত আধুনিক মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যের বসতবাড়ি ছিল সেটি। মজু ভাইয়ের নিজের নকশায় করা গাছগাছালিঘেরা লাল ইটের সুন্দর আধুনিক বাড়ি। সেই বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির এক গোপন সভা হবে। সময়টা ১৯৬৯-এর মাঝ নাগাদ হতে পারে। আমার দায়িত্ব পড়েছিল কমরেড বারীণ দত্ত (আবদুস সালাম) আর খোকা রায়কে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তাঁর গাড়িতে করে দুজনকে নিয়ে ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি। পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সব সদস্য সেখানে উপস্থিত।
অন্য ঘটনাটি আমার মনে আরও গভীর দাগ কেটে আছে। সেটিও ওই বছরেই। মে দিবস উপলক্ষে ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের নিয়ে একটি গোপন সভা হয়েছিল তাঁর ওই ধানমন্ডির বাড়িতে। তখন দেশে সামরিক শাসন চলছে। কমরেড মণি সিংহ এসেছিলেন সেই সভায়। তিনি সেখানে সোভিয়েত বিপ্লবের কাহিনি বলে একটি উদ্দীপনাময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যাতে চলমান ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারির গণ-অভ্যুত্থানকে আরও বড় বিপ্লবের ‘ড্রেস রিহার্সেল’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর সেই আশাবাদ সফল হয়েছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে।
মজু ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যা খুবই স্বাভাবিক ছিল তাঁর মতো মানুষের জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন সর্বাত্মকভাবে। কলকাতায় গিয়ে বহুভাবে অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাজে।
রাজনীতির প্রতি তিনি সব সময়ই সচেতন ছিলেন। সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া তাঁর জন্য স্বাভাবিক ছিল। স্বাধীনতার আগেই অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে কোষাধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বাধীনতার পরও ওই পদে সক্রিয় ছিলেন। আবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাকশাল গঠনের সময়ও তাঁর বিশেষ সক্রিয়তা লক্ষ করা গেছে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সমবায় বিষয়ে আলোচনা-পরামর্শ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত এবং হতাশ হয়ে পড়েন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত তিনি ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। এরপর ফিরে এসে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন ধীরে ধীরে। পরে মহিউদ্দিন আহমদ-আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে গঠিত বাকশালে তিনি উপদেষ্টা ছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেই বাকশালকে আওয়ামী লীগে আত্তীকরণের কাজেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
গোটা সত্তর-আশির দশক রাজনীতির উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেমন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন, তেমনি স্থাপত্যকলা ও সংস্কৃতির চর্চাও সমান তালেই অব্যাহত রেখেছেন। যদিও স্থপতি হিসেবে কাজ কমে গিয়েছিল। কবি, সাহিত্যিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদদের নিয়ে ‘চেতনা’ নামের একটি পাঠচক্র করেছিলেন। নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন তরুণ প্রজন্মের স্থপতি ও সংস্কৃতিসেবীদের।
স্থাপত্যের পথিকৃৎ
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে তিনি যখন স্থাপত্যের চর্চা শুরু করেছিলেন, তখন এ দেশে অন্যান্য শিল্পের তুলনায় স্থাপত্যশিল্প বেশ পিছিয়ে ছিল। অপরিচিত ছিল। একাগ্রচিত্তে নিরবচ্ছিন্ন স্থাপত্যকলার চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি একাধারে যেমন এ দেশে আধুনিক স্থাপত্যের বুনিয়াদ রচনা করেছেন, তেমনি এই পেশাকেও একটি আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।
তিনি বলতেন, ‘আমাদের এই ছোট্ট দেশটি আসলে খুব সুন্দর। প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধন ও ভারসাম্য রক্ষা করা স্থাপত্যপেশার মূল লক্ষ্য।’ সেই লক্ষ্যেই তিনি পশ্চিমা আধুনিকতার পাশাপাশি দেশীয় ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। স্থানীয় উপকরণের ব্যবহার, চারুশিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের, বিশেষ করে ম্যুরাল ও ভাস্কর্য সংযোজন এবং পরিবেশের বিষয়টিকে সমন্বয়ের মাধ্যমে তিনি একটি স্বকীয় স্থাপত্যরীতিও প্রবর্তন করেছিলেন। এ জন্যই তাঁকে আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎ হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে।
এ ছাড়া তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপত্যকলা চর্চার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ভূমিকা ছিল তাঁর।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় একটি ‘দ্বিতীয় রাজধানী কমপ্লেক্স’ নির্মাণের জন্য স্থপতি হিসেবে তাঁকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন ঢাকায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোনো আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন থাকুক, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। তিনিই লুই আই কানকে রাজি করিয়েছিলেন কাজটি করতে। শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদসহ অন্যান্য স্থাপত্য আজ পৃথিবীর একটি অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
মনে পড়ে সেই হাসিমুখ
নব্বইয়ের দশকে ক্রমেই স্থাপত্যকলার চর্চা কমে গেলেও তিনি কর্মময় ছিলেন তাঁর প্রিয় সব ক্ষেত্রে। এই দিনগুলোতে মজু ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কিছুটা কমে এসেছিল। নিজেও জড়িয়ে গেছি নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাজে। তবে যখনই মজু ভাই-বেবী আপার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, দেখা হয়েছে বা মাঝেমধ্যে হঠাৎ উপস্থিত হয়েছি—গালমন্দসহ ভালোবাসা পেয়েছি অনেক। অনুভব করেছি তাঁদের হূদয়ের গভীর উষ্ণতা।
মনে পড়ে, ২০০৫ সালে বাস্তুকলাবিদে তাঁর জন্মদিন পালিত হয়েছিল পারিবারিক উদ্যোগে। সুন্দর সময় কেটেছিল সেদিন। আমাদের ফটোগ্রাফার দারুণ সব ছবি তুলেছিল। অ্যালবামে সেই ছবিগুলো পেয়ে দারুণ খুশি হয়েছিলেন মজু ভাই আর তাঁর পরিবার।
২০০৯ সালে আমরা ধানমন্ডির বেঙ্গল ক্যাফেতে মজু ভাইয়ের ৮৭তম জন্মদিনে স্বজন, সুহূদদের নিয়ে একটি ঘরোয়া আঙ্গিকের অনুষ্ঠান করেছিলাম। তখন শরীর একটু দুর্বল, স্মৃতিও খানিকটা ঝাপসা। তবে মুখে সেই স্নিগ্ধ স্মিত হাসিটি অম্লান। নানা বিষয় নিয়ে সরস কয়েকটি কথা বলেছেন একান্তে। সেই সব দিনের ঘটনাপরম্পরা, তাঁর সুদর্শন হাসিমুখ, উদার আহ্বান—কত কিছু চোখ বুজলে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে বারবার, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
এখন স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়ছি ভারাক্রান্ত মনে। তাঁর সঙ্গে আমাদের বহুদিনের বহু আনন্দ আর উত্তেজনাভরা সময় কাটানোর ছবিগুলো মনে জেগে ওঠে। কত কিছু মনে পড়ে। কত স্মৃতি হারিয়ে গেছে।
আমার দেখা সেরা সুন্দর মানুষগুলোর মধ্যে প্রধান একজন ছিলেন তিনি। সেই সৌন্দর্য বাইরের এবং অন্তরের। এককথায় যাঁকে বলা যায় সুপুরুষ, ঠিক তাই ছিলেন তিনি। মুখখানা সব সময় স্মিত হাসিতে স্নিগ্ধ, বুদ্ধিদীপ্ত অথচ প্রসন্ন দৃষ্টি। একইভাবে মনের দিক থেকে উদার, চিন্তায় সংস্কারমুক্ত এবং সুরুচিসম্পন্ন। আবার ব্যবহারিক জীবনেও দেখেছি পোশাক-আশাক, আহার-বিহার, আচার-আচরণ, কথাবার্তায়, কর্মে-চিন্তায় কতই না আধুনিক, পরিশীলিত আর অমায়িক। রেগে যেতেন কখনো কখনো। ভয়ও পেতাম। কিন্তু তাতেও ছিল এক সৌন্দর্য। যেমন আদর্শ মানুষের কল্পনা আমরা করি, মজু ভাইয়ের মধ্যে সেই সব গুণের সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাবেশ ঘটেছিল।
মজু ভাইয়ের স্ত্রী সালমা ইসলাম, আমাদের ‘বেবী আপা’, ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে স্নাতক পর্যায়ের পাঠ শুরু করেছিলেন ইডেন কলেজে। তাঁকে পড়ালেখায় সাহায্য করতে যেত সে সময়ে ছাত্রনেত্রী মালেকা বেগম, গৃহশিক্ষক হিসেবে। ইডেন কলেজের সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে বেবী আপা সহসভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামে দিন-রাত জড়িয়ে আছি ভীষণভাবে। এক দুপুরে মালেকা আমাকে এসে বলল তাঁর বিস্ময়ের কথা। বেবী আপাকে পড়াতে গেছে তাদের বাড়িতে। দরজায় কড়া নাড়তেই এক সুদর্শন পুরুষ দরজা খুলে দেন। তাঁর সৌন্দর্যে মালেকা এতই বিস্মিত হয়ে পড়ে যে, ফিরে এসে আমাকে তাঁর (মজু ভাইয়ের) বর্ণনা না দিয়ে পারেনি।
গ্রামের নাম সুন্দরপুর
মাজহারুল ইসলামের জন্ম ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর। মুর্শিদাবাদের সুন্দরপুর গ্রামে, নানার বাড়িতে। তাঁর দাদার বাড়ি চট্টগ্রামের কুয়েপাড়ায়। শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, সচ্ছল পরিবার। দাদা ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। বাবা-চাচারা সবাই শিক্ষিত। কলকাতা ও ঢাকায় চাকরি করতেন। বাবা ওমদাতুল ইসলাম সরকারি কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক। মা জাকিয়া খাতুন। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁর স্কুল ও কলেজজীবন কেটেছে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কৃষ্ণনগরে। ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে পুরকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক, ১৯৫৭ সালে যুক্তরাজ্যের আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচার থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা। ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এখানেই লুই আই কান শিক্ষকতা করেছেন। সেই সুবাদেই লুইয়ের কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেমিনারে অভিসন্দর্ভ উপস্থাপন করেছেন। সদস্য ছিলেন প্রথম আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার জুরি বোর্ডে। দেশ-বিদেশে অনেক মর্যাদাপূর্ণ পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে আছে ‘স্বাধীনতা পদক’। বিদেশেও পেয়েছেন স্বীকৃতি-সম্মান।
মজু ভাইয়ের বাস্তুকলাবিদ
আমার সঙ্গে মজু ভাইয়ের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল, স্মৃতি হাতড়েও আর উদ্ধার করতে পারছি না। সেটি ষাটের দশকের মাঝামাঝি কোনো সময় হবে। আগেই বলেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানামুখী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক-সামাজিক কাজে কর্মচঞ্চল দিন কাটছিল আমাদের। মজু ভাইও এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত ছিলেন। কখনো নেপথ্যে, কখনো সামনে থেকে সক্রিয় ভূমিকায়।
এ ধরনেরই কোনো কর্মকাণ্ড হতে পারে তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র। পরীবাগে তাঁর প্রতিষ্ঠান বাস্তুকলাবিদের বিশাল কার্যালয়, একই সঙ্গে বাসভবন। সামনে সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা মাঠ, পাশেই পুকুর। হরেক রকমের গাছ, লতাগুল্মের সমারোহ। সেই সময়ের সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল তাঁর এই বসতবাড়ি। কে যাননি সেখানে! দেশের প্রধান সব কবি, লেখক, শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীরা। মনে পড়ছে, প্যারিস থেকে ফেরার পর শিল্পী রশিদ চৌধুরীর প্রথম প্রদর্শনীটি হয়েছিল বাস্তুকলাবিদেই। ছায়ানটের অনুষ্ঠানের গানের রিহার্সেল শুধু নয়, ছায়ানটের অনুষ্ঠানও হতে দেখেছি ওই সবুজ প্রাঙ্গণে। দেখেছি, তিনি ব্যস্ত আছেন অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে, এমনকি মঞ্চ নির্মাণেও।
আমরা তখন তাঁর কাজের তাৎপর্য সম্পর্কে খুব গভীর কিছু জানতাম না। জানতাম তিনি আর্ট কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগার, নিপা ভবন—এসব অনেক আধুনিক স্থাপত্য সৃষ্টি করেছেন। এ দেশের প্রথম সুউচ্চ ইমারত ‘জীবন বীমা ভবন’-এরও নির্মাতা ছিলেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে আছে জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রূপপুর আণবিক শক্তি প্রকল্প, সড়ক ও জনপথ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। এ ছাড়া ঢাকার কিছু আবাসিক বাড়ির নকশাও তিনি করেছেন।
জানতাম, তিনি সর্বজনস্বীকৃত অত্যন্ত বড় এক স্থপতি। কিন্তু তাঁর ভেতরে কোনো অহমিকা কাজ করতে দেখিনি কখনো। সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তাঁর জীবনযাত্রা। অভিজাত, তবে আড়ম্বরহীন। পরতেন সাধারণত মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি-পাজামা, কখনো হাওয়াই শার্ট-প্যান্ট, পায়ে স্যান্ডেল শু।
মজু ভাইয়ের মধ্যে প্রাণশক্তির অপূর্ব একটি প্রকাশ আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করতাম সব সময়, যা আমাদের ভেতরেও প্রেরণা-উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলত। এত রকম, এত বৈচিত্র্যময় বিষয়ে কাজ করতেন, এত পরিশ্রম করতে পারতেন, এত গভীর নিষ্ঠা ছিল কাজের প্রতি যে সত্যি তা অতুলনীয়। যেকোনো ভালো কাজের সঙ্গে থাকতেন, নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে। কতবার কত অনুরোধ নিয়ে গেছি তাঁর কাছে। মজু ভাই আর বেবী আপা আমাদের সেই সব অনুরোধ রক্ষা করেছেন হাসিমুখে।
১৯৬৯ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হলো। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বিপুল। বরাবরের মতোই আমরা গিয়ে ধরলাম মজু ভাই-বেবী আপাকে। বলা মাত্র তাঁরা রাজি হলেন। আর্থিক সহায়তা তো করলেনই বেবী আপা, তাঁর নীল রঙের ফক্সওয়াগন গাড়িটিও দিয়ে দিলেন ত্রাণকাজে সারা দিনের জন্য।
এ রকম নানা কাজে যোগাযোগের মধ্য দিয়েই একসময় তাঁদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা নিবিড় ও প্রীতিময় হয়ে উঠেছিল। আমাদের সামনেই বেড়ে উঠছিল তাঁদের ছেলে রফিক, তান্না ও মেয়ে ডালিয়া। আরেক মেয়ে নাজিয়া তখন গুটি গুটি পায়ে সারা বাড়িতে হেঁটে বেড়ায় (বেবী আপার বোন অধ্যাপিকা নূরুন্নেসা ফয়জুন্নেসার মেয়ে, কিন্তু মজু ভাই আর বেবী আপার ভালোবাসার ছায়াতলেই তাকে বড় হতে দেখেছি)। ক্রমেই আমরা তাঁর পরিবার, তাঁর বৃহৎ স্বজনদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। কাছে থেকে তাঁকে দেখা-জানার সুযোগ হয়েছিল এভাবেই।
রাজনৈতিক জীবন
মজু ভাইকে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতেই সব থেকে ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছিলাম নানা ঘটনাপ্রবাহে সংশ্লিষ্ট থাকার সুবাদে। দুটো স্মৃতির কথা বলা যায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির বহু গোপন সভা হয়েছিল তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে। তখন ঢাকার অত্যন্ত আধুনিক মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যের বসতবাড়ি ছিল সেটি। মজু ভাইয়ের নিজের নকশায় করা গাছগাছালিঘেরা লাল ইটের সুন্দর আধুনিক বাড়ি। সেই বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির এক গোপন সভা হবে। সময়টা ১৯৬৯-এর মাঝ নাগাদ হতে পারে। আমার দায়িত্ব পড়েছিল কমরেড বারীণ দত্ত (আবদুস সালাম) আর খোকা রায়কে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তাঁর গাড়িতে করে দুজনকে নিয়ে ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি। পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সব সদস্য সেখানে উপস্থিত।
অন্য ঘটনাটি আমার মনে আরও গভীর দাগ কেটে আছে। সেটিও ওই বছরেই। মে দিবস উপলক্ষে ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের নিয়ে একটি গোপন সভা হয়েছিল তাঁর ওই ধানমন্ডির বাড়িতে। তখন দেশে সামরিক শাসন চলছে। কমরেড মণি সিংহ এসেছিলেন সেই সভায়। তিনি সেখানে সোভিয়েত বিপ্লবের কাহিনি বলে একটি উদ্দীপনাময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যাতে চলমান ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারির গণ-অভ্যুত্থানকে আরও বড় বিপ্লবের ‘ড্রেস রিহার্সেল’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর সেই আশাবাদ সফল হয়েছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে।
মজু ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যা খুবই স্বাভাবিক ছিল তাঁর মতো মানুষের জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন সর্বাত্মকভাবে। কলকাতায় গিয়ে বহুভাবে অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাজে।
রাজনীতির প্রতি তিনি সব সময়ই সচেতন ছিলেন। সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া তাঁর জন্য স্বাভাবিক ছিল। স্বাধীনতার আগেই অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে কোষাধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বাধীনতার পরও ওই পদে সক্রিয় ছিলেন। আবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাকশাল গঠনের সময়ও তাঁর বিশেষ সক্রিয়তা লক্ষ করা গেছে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সমবায় বিষয়ে আলোচনা-পরামর্শ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত এবং হতাশ হয়ে পড়েন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত তিনি ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। এরপর ফিরে এসে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন ধীরে ধীরে। পরে মহিউদ্দিন আহমদ-আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে গঠিত বাকশালে তিনি উপদেষ্টা ছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেই বাকশালকে আওয়ামী লীগে আত্তীকরণের কাজেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
গোটা সত্তর-আশির দশক রাজনীতির উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেমন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন, তেমনি স্থাপত্যকলা ও সংস্কৃতির চর্চাও সমান তালেই অব্যাহত রেখেছেন। যদিও স্থপতি হিসেবে কাজ কমে গিয়েছিল। কবি, সাহিত্যিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদদের নিয়ে ‘চেতনা’ নামের একটি পাঠচক্র করেছিলেন। নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন তরুণ প্রজন্মের স্থপতি ও সংস্কৃতিসেবীদের।
স্থাপত্যের পথিকৃৎ
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে তিনি যখন স্থাপত্যের চর্চা শুরু করেছিলেন, তখন এ দেশে অন্যান্য শিল্পের তুলনায় স্থাপত্যশিল্প বেশ পিছিয়ে ছিল। অপরিচিত ছিল। একাগ্রচিত্তে নিরবচ্ছিন্ন স্থাপত্যকলার চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি একাধারে যেমন এ দেশে আধুনিক স্থাপত্যের বুনিয়াদ রচনা করেছেন, তেমনি এই পেশাকেও একটি আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।
তিনি বলতেন, ‘আমাদের এই ছোট্ট দেশটি আসলে খুব সুন্দর। প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধন ও ভারসাম্য রক্ষা করা স্থাপত্যপেশার মূল লক্ষ্য।’ সেই লক্ষ্যেই তিনি পশ্চিমা আধুনিকতার পাশাপাশি দেশীয় ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। স্থানীয় উপকরণের ব্যবহার, চারুশিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের, বিশেষ করে ম্যুরাল ও ভাস্কর্য সংযোজন এবং পরিবেশের বিষয়টিকে সমন্বয়ের মাধ্যমে তিনি একটি স্বকীয় স্থাপত্যরীতিও প্রবর্তন করেছিলেন। এ জন্যই তাঁকে আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎ হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে।
এ ছাড়া তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপত্যকলা চর্চার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ভূমিকা ছিল তাঁর।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় একটি ‘দ্বিতীয় রাজধানী কমপ্লেক্স’ নির্মাণের জন্য স্থপতি হিসেবে তাঁকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন ঢাকায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোনো আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন থাকুক, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। তিনিই লুই আই কানকে রাজি করিয়েছিলেন কাজটি করতে। শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদসহ অন্যান্য স্থাপত্য আজ পৃথিবীর একটি অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
মনে পড়ে সেই হাসিমুখ
নব্বইয়ের দশকে ক্রমেই স্থাপত্যকলার চর্চা কমে গেলেও তিনি কর্মময় ছিলেন তাঁর প্রিয় সব ক্ষেত্রে। এই দিনগুলোতে মজু ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কিছুটা কমে এসেছিল। নিজেও জড়িয়ে গেছি নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাজে। তবে যখনই মজু ভাই-বেবী আপার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, দেখা হয়েছে বা মাঝেমধ্যে হঠাৎ উপস্থিত হয়েছি—গালমন্দসহ ভালোবাসা পেয়েছি অনেক। অনুভব করেছি তাঁদের হূদয়ের গভীর উষ্ণতা।
মনে পড়ে, ২০০৫ সালে বাস্তুকলাবিদে তাঁর জন্মদিন পালিত হয়েছিল পারিবারিক উদ্যোগে। সুন্দর সময় কেটেছিল সেদিন। আমাদের ফটোগ্রাফার দারুণ সব ছবি তুলেছিল। অ্যালবামে সেই ছবিগুলো পেয়ে দারুণ খুশি হয়েছিলেন মজু ভাই আর তাঁর পরিবার।
২০০৯ সালে আমরা ধানমন্ডির বেঙ্গল ক্যাফেতে মজু ভাইয়ের ৮৭তম জন্মদিনে স্বজন, সুহূদদের নিয়ে একটি ঘরোয়া আঙ্গিকের অনুষ্ঠান করেছিলাম। তখন শরীর একটু দুর্বল, স্মৃতিও খানিকটা ঝাপসা। তবে মুখে সেই স্নিগ্ধ স্মিত হাসিটি অম্লান। নানা বিষয় নিয়ে সরস কয়েকটি কথা বলেছেন একান্তে। সেই সব দিনের ঘটনাপরম্পরা, তাঁর সুদর্শন হাসিমুখ, উদার আহ্বান—কত কিছু চোখ বুজলে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে বারবার, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
No comments