হুমায়ূন আহমেদ-মৃত্যু পরাভব মানে যার কাছে

মৃত্যু প্রতিটি জীবনেই অনিবার্য। তারপরও কোনো কোনো মৃত্যু সহজে মেনে নেওয়া যায় না। যদি সে মৃত্যু হয় প্রবাদপ্রতিম পাঠকনন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের মতো জীবন্ত কিংবদন্তির, তা হলে সে মৃত্যুসংবাদ শোকে স্তব্ধ করে দেয় কোটি মানুষকে। গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ২৪ মিনিটে যখন বাংলা ভাষার এই অতুলনীয় পাঠকনন্দিত


কথাশিল্পীর মৃত্যুসংবাদ নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় পেঁৗছায়, তখন গভীর রাতের নির্জনতাও শোকে যেন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বরেণ্য ব্যক্তিত্বরাও মধ্যরাতেই গভীর শোক প্রকাশ করেন এই ক্ষণজন্মা লেখকের মৃত্যুর খবর পেয়ে। টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্রসহ সকল গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেই শোকার্দ্র উচ্চারণ_ হুমায়ূন আহমেদ আর নেই। দুই শতাধিক গ্রন্থের লেখক, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার, কল্পবিজ্ঞান লেখক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের মেধাবী অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) ড. হুমায়ূন আহমেদ স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের বাংলাদেশের সাহিত্যে বিস্ময়কর সৃজনশীলতা দিয়ে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনা করেন, যা বাংলাদেশের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি শুধু পাল্টেই দেয়নি, সৃষ্টি করেছে তরুণ প্রজন্মের এক বিশাল পাঠকশ্রেণী, যারা বই পড়ায় নিমগ্ন হন হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্ম ঘিরে। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পেও জোয়ার আসে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের ওপর নির্ভর করে। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন লেখক আর অনেক প্রকাশকও। জমে ওঠে অমর একুশের গ্রন্থমেলা। এককথায় বাংলাদেশের সাহিত্যের দিগন্তে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের দীপ্তিতে দেদীপ্যমান হয়ে ওঠেন হুমায়ূন। এমনকি এই পাঠকপ্রিয়তা পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে 'দেশ'-এর মতো পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের চাহিদা সৃষ্টি হয়। মাত্র ৬৪ বছরের জীবনে এই জীবনবাদী কথাশিল্পী প্রতিটি মুহূর্তকে ব্যবহার করেছেন সৃষ্টিশীলতার জন্য। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়েছেন পূর্ণ সময় সাহিত্যচর্চার জন্য। গল্প-উপন্যাসে, সায়েন্স ফিকশনে যেমন তুমুল জনপ্রিয়তায় অভিষিক্ত হয়েছেন, তেমনি টেলিভিশন নাটকেও বিপুল দর্শকপ্রিয়তায় এক নতুন যুগের সূচনা করেন তিনি। তার লেখা এইসব দিনরাত্রি, অয়োময়, বহুব্রীহির মতো ধারাবাহিকগুলো সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। নাটকে পাখির ঠোঁটে উচ্চারিত 'তুই রাজাকার' সংলাপ ছড়িয়ে যায় মানুষের মুখে মুখে। বৈরী পরিবেশেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সৃষ্টি হয় তরুণ মনের জোয়ার। বাংলার লোকসঙ্গীত আর সংস্কৃতি তুলে আনেন তিনি নাটকে, চলচ্চিত্রে। আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, শ্যামল ছায়ার মতো চলচ্চিত্র শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে আবার সিনেমা হলে ফিরিয়ে নেয়। বাঙালিকে তিনি তার সৃষ্টিশীলতা দিয়ে বিপুলভাবে ঋণী করে গেছেন। মৃত্যুকেও যিনি পরাভব মানিয়েছেন নিরন্তর জীবনের জয়গান গেয়ে। তার মৃত্যু নেই।
 

No comments

Powered by Blogger.