নিউইয়র্কে শোকের বৃষ্টি by ইব্রাহীম চৌধুরী

এখন নিউইয়র্ক সময় বেলা ১১টা, শুক্রবার। নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ এখন ফিউনারেল হোমে (শবাগার)। একটু আগেই আমরা তিনজন হুমায়ূন আহমেদকে গোসল করালাম। তাঁর দুজন নিকটাত্মীয় আনিসুর রহমান (পাশা মামা) ও জামাল আবদীন ছিলেন সঙ্গে। জামাল আবদীন তাঁর পকেট থেকে বের করলেন একটি চিরকুট।


বললেন, শেষবার যখন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখন এই চিরকুটে হুমায়ূন লিখেছিলেন, ‘আই লস্ট মাই ভয়েজ।’ চিরকুটটি এখন তাঁর কাছে সোনার চেয়েও দামি।
নিউইয়র্কে গতকাল সারা দিনই ছিল টিপটিপ বৃষ্টি। এর মধ্যে জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে বাদ জুমা তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপর পুনরায় মরদেহ আবার ফিউনারেল হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। মরদেহ দেশে নিয়ে আসার সময় এখনো নির্ধারিত হয়নি।
দেশে কোথায় হুমায়ূন আহমেদকে সমাহিত করা হবে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। নিউইয়র্কে অবস্থানরত হুমায়ূন আহমেদের ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, অন্তিম শয়ানের ব্যাপারে লেখক কোথাও কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করে গেছেন কি না, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। সে রকম কিছু থাকলে তাঁর অন্তিম ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে। আর যদি সে রকম কিছু পাওয়া না যায়, তাহলে সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
গত বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে হুমায়ূন আহমেদের চেতনা ছিল। সার্বক্ষণিক সঙ্গে থাকা অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম বলেন, সকাল আটটার দিকেও (নিউইয়র্ক সময়) চিকিৎসকেরা তাঁকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন।
বেলভিউ হাসপাতালে গত তিন সপ্তাহ তাঁকে কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছিল। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী জটিলতার পরও তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করছিল। চিকিৎসকেরা বলেছেন, তাঁর কিডনি ও হূদযন্ত্রের অবস্থাও ভালো ছিল। ফুসফুসে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়া হচ্ছিল। সকাল ১০টা থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। যন্ত্রের সাহায্যের পরও ফুসফুস অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারছিল না। নিউইয়র্ক সময় বেলা একটা ২২ মিনিটে হুমায়ূন আহমেদের জীবনাবসান ঘটে (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)।
বেলভিউ হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী, অস্ত্রোপচার-পরবর্তী এআরডিএস (একুইট রেসপিটর ডিসট্রেস সিনড্রম) জটিলতায় তাঁর মৃত্যু ঘটেছে।
হুমায়ূন আহমেদের জীবনাবসানের সময় পাশেই ছিলেন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তাঁর স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক, শাশুড়ি তহুরা আলী, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম, লেখকের বাল্যবন্ধু ফাংশু মণ্ডল। মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে উপস্থিত হন মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিত সাহা এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এম এ মোমেন। প্রিয় লেখকের মৃত্যুসংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতালে প্রবাসীদের ভিড় জমে ওঠে। কড়া নিরাপত্তার কারণে কোনো দর্শনার্থীকে হাসপাতালে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
নিউইয়র্কে হঠাৎ বৃষ্টি
বৃহস্পতিবার সকালে নিউইয়র্কের আকাশ ছিল পরিষ্কার। কড়া রোদ্দুর সকালটি যেন নিমেষেই গুমরে উঠল। দুপুর থেকেই মেঘে ঢাকা পড়ে আকাশ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁপানো কান্নার মধ্যেই হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। কর্মপাগল নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কর্মদিনের ছন্দপতন ঘটে। ইস্ট রিভারের পাশেই বেলভিউ হাসপাতালের দশম তলায় জীবনাবসান ঘটে বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের। বেলভিউ হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন প্রবাসী মনিরুল। বিলাপ করতে করতে বললেন, নিজেকে বড় অজানা মনে হচ্ছে। নিউইয়র্কে থেকেও একনজর শেষ দেখা দেখতে পারলাম না আমার স্বপ্নের নায়ক হুমায়ূন স্যারকে।
স্বজনদের বিলাপ
স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন বিলাপ করছিলেন, ‘আমি কি আর তোমার মুখ দেখতে পারব না?’ উপস্থিত সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। শাওন বলেন, ‘দেশের এত মানুষ, কোটি লোক লেখকের জন্য দোয়া করলেন। কোনো কিছুই তাঁর কাজে এল না। আমার জন্য আর দোয়া করে কী করবেন আপনারা?’
শাওন জ্যামাইকায় তাঁদের অস্থায়ী ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করছেন। তাঁর মা তহুরা আলী মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তহুরা আলী বলছিলেন, হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মেয়ের ওপর অনেক বড় দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। দুটি শিশুপুত্রের দায়িত্ব পালনে যেন শাওন সক্ষম হয়—এ জন্য তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
ভ্রাতৃশোকে কাতর মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রথম আলোকে দেওয়া তাঁর শোক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, হুমায়ূন আহমেদ পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপন করে গেছেন। জীবনভর দেশের মানুষকে আনন্দ দিয়ে গেছেন। তাঁর জীবনাবসান ঘটেছে। দেশবাসীর কাছে ভাই হুমায়ূন আহমেদের আত্মার শান্তির জন্য দোয়া কামনা করেছেন তিনি।
জাফর ইকবাল জানান, হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরপরই হাসপাতাল থেকে দেশে তাঁদের মায়ের কাছে ফোন করেছেন। এ খবর শোনার পর মায়ের প্রতিক্রিয়া কী, সে প্রশ্নের উত্তরে মুহম্মদ জাফর ইকবাল নিরুত্তর কাঁদছিলেন। প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন খান ও সন্তানদের হাসপাতাল থেকে সংবাদ দেওয়া হয়েছে। জাফর ইকবালের মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বলে তিনি জানান।
মাজহারুল ইসলাম
নিউইয়র্কে চিকিৎসারত অবস্থায় লেখক হুমায়ূন আহমেদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম। তিনি শুধু বিলাপ করছিলেন। প্রথম আলোকে মাজহার বলেন, বেলভিউ হাসপাতালে অনকোলজি বিশেষজ্ঞ ড. মিলার অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিলে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, হুমায়ূনের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কত? জবাবে ড. মিলার বলেছিলেন, ‘শতভাগ।’ কান্না-জড়ানো কণ্ঠে মাজহারুল ইসলাম বলেন, অস্ত্রোপচারের আট দিনের মাথায় হুমায়ূন আহমেদ সুস্থ হয়ে ওঠেন। হেঁটে বাসায় আসেন। তারপর কী যে হয়ে গেল, তার কোনো উত্তর নেই।
নিষাদ ও নিনিত
প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের দুই শিশুপুত্র নিষাদ ও নিনিত। নিউইয়র্কে চিকিৎসারত অবস্থায় কেমোথেরাপি থেকে বাসায় ফিরে জড়িয়ে ধরতেন দুই শিশুপুত্রকে। ঘরের পেছনের আঙিনায় সবজি বাগান করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ বাগানের পরিচর্যা করতেন দুই পুত্রকে নিয়ে। বৃহস্পতিবার বিকেলেও সবজি বাগানে লেখকের লাগানো গাছের গোড়ায় পানি ঢালছিল নিষাদ। নিনিত খেলা করছিল আপন মনে। তাদের কিছুই বলা হয়নি। কেন এত বিলাপ চারদিকে—তাদের তা জানার বা বোঝারও কোনো অবকাশ নেই। খেলার ফাঁকে দর্শনার্থীদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিল অবোধ দুই শিশু নিষাদ ও নিনিত।
হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের জগৎ
নিউইয়র্কের বাড়িতে স্বল্পকালীন অবস্থান ছিল হুমায়ূন আহমেদের। একচিলতে লাইব্রেরিতে দেখা গেল জীবনানন্দ দাশের কবিতাসমগ্র। এর পাশের এক স্তূপ বইয়ের মধ্যে জুল ভার্নের এ জানি টু দ্য সেন্টার অব দি আর্থ, জুলিয়ান বার্নসের এ সেন্স অব এন্ডিং, স্টিফেন কিংয়ের ডুমা কি এবং জাপানি লেখক হারুকি মোরাকামির বই। নানা ধরনের বই সংগ্রহ করেছিলেন লেখক। ভেবেছিলেন, পড়ার অবকাশ পাবেন। কিন্তু তা আর হলো না।
বই দেখতে দেখতেই হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে কত কথাই না ভেসে উঠল মনে। জীবনাবসান হয়েছে এ সময়ের জনপ্রিয়তম সাহিত্যিকের। তবে কর্মজীবন ছিল অধ্যাপনার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন পড়িয়েছেন। রসায়নে নিয়েছেন পিএইচডি ডিগ্রি। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে প্রকাশের পর থেকেই লেখালেখির প্রতি মনোযোগ দেন। একসময় গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখালেখির ব্যস্ততার কারণে ছেড়ে দেন অধ্যাপনা।
১৯৮১ সালে তিনি পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমী পদক। ১৯৯৪ সালে একুশে পদক। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনবার। ৬৪ বছরের জীবন পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩২২। লেখালেখির পাশাপাশি নাটক লিখেছেন, চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, গানের সুর দিয়েছেন। ছবিও আঁকতেন তিনি। ম্যাজিক দেখিয়ে আনন্দ পেয়েছেন।
ছোট্ট লাইব্রেরিতে তাঁর সংগ্রহের বইগুলো দেখি। ভাবি, তিনি আর পড়বেন না। লিখবেন না।
বাল্যবন্ধু ফাংশু
হুমায়ূন আহমেদের বাল্যবন্ধু ফাংশু মণ্ডল সার্বক্ষণিক ছিলেন অসুস্থ লেখকের পাশে। বন্ধুর মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ ফাংশু শুধুই কাঁদছিলেন। বলছিলেন, কত দিনের কত কথা, সেই স্কুলজীবন থেকে বন্ধুত্বের যে পরশ পেয়েছিলেন, আজ তার অবসান হলো। বলেন, ‘বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য কত চেষ্টা করা হলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে আমরা অসহায়।’
অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন মুক্তধারার বিশ্বজিত সাহা। স্ত্রী রুমা সাহাকে নিয়ে প্রায়ই যেতেন হাসপাতালে। বললেন, গত ২৫ জুন হাত চেপে ধরছিলেন অর্ধচেতন হুমায়ূন আহমেদ। কথা বলতে পারছিলেন না, কিন্তু মনে হচ্ছিল কিছু যেন বলতে চাইছেন। ‘শেষ কথাটি আর জানা হলো না।’
শিম আর লাউয়ের বাগান
সবুজ ভালোবাসতেন হুমায়ূন আহমেদ। নিউইয়র্কে লেখকের নুহাশপল্লী ছিল না। নিউইয়র্কের বাড়ির পেছনের আঙিনায় সবজি চাষ করেছিলেন। কচু, লাউ আর শিমের চারা লাগিয়েছিলেন। লাউয়ের ডগায় ফুল এসেছে, শিমের চারাগাছ বাড়ন্ত এখন। আশা ছিল, নিজের লাগানো শিম আর লাউ খাবেন হাসপাতাল থেকে ফিরে। নিষাদ ও নিনিতকে সঙ্গে নিয়ে প্রবাসী লেখক গাজী কাশেম সবজি বাগান দেখাচ্ছিলেন। বলছিলেন, নিজের বাগানের শিম আর লাউ খাওয়া হলো না প্রিয় লেখকের।
শোক
হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ দেশে পাঠানোর বিষয় সমন্বয় করছে জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন। মিশনে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি এম এ মোমেন লেখকের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরও শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন।
নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো জ্যামাইকা ভিড় করছেন। সাধারণ প্রবাসী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা জ্যামাইকায় লেখকের বাসভবনের সামনে সড়কপথে দাঁড়িয়ে শোক প্রকাশ করছেন।

No comments

Powered by Blogger.