আজ-কাল-পরশু-নাগরিক ঐক্য ও বাস্তবতা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
বাংলাদেশের রাজনীতি প্রধানত দুটি বড় দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সারা দেশে এই দুটি দলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। গত চারটি সাধারণ নির্বাচনে এই দুটি দল বিজয়ী হয়ে পালা করে সরকার গঠন করেছে। বহু দেশে এ রকম দ্বিদলীয় রাজনীতি রয়েছে। এটা নতুন নয়।
কিন্তু অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হয় না। এখানে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র’ চালু থাকলেও তা বাস্তব অর্থে ‘প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরতন্ত্র’। দুই প্রধান দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের কোনো চর্চা নেই। দলীয় প্রধানের একনায়কত্ব এখানে সক্রিয়। কাজেই অন্য গণতান্ত্রিক দেশের দ্বিদলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থার কোনো তুলনা করা উচিত নয়। যদি প্রধান দুই দল সুষ্ঠুভাবে দেশ, সরকার ও নিজের দল পরিচালনা করতে পারত, তাহলে এ দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতো। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী তা হয়নি। আরও দুঃখের বিষয়, প্রধান দুটি দল গত কুড়ি বছর দুর্বলভাবে দেশ পরিচালনা করে দেশের বেশির ভাগ মানুষকে হতাশ করেছে। দুই দলের কট্টর সমর্থক ও উপকারভোগীরা অবশ্য কোনো হতাশায় ভোগেন না। কারণ, ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা বেশ লাভবান হয়েছেন।
এই পটভূমিতে দুই বড় দলের বিকল্প হিসেবে একটি রাজনৈতিক শক্তির অভাব অনেকে অনেক দিন ধরে অনুভব করেছেন। দেশে যদিও আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল রয়েছে, কিন্তু নানা কারণে সেসব দল জনসমর্থন লাভ করেনি।
বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বড় দুর্বলতা হলো: সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে ব্যক্তির চেয়ে পারিবারিক ঐতিহ্য ও দলীয় প্রতীককে পছন্দ করে বেশি। এ জন্য বিগত সব সংসদ নির্বাচনে অন্য দলের অনেক যোগ্য প্রার্থী অতি নগণ্য প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। এ দেশে প্রয়াত জনপ্রিয় নেতার স্ত্রী, ছেলে বা মেয়ে পরিচয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের কী যোগ্যতা, তা অনেক ভোটার বিবেচনা করেন না। সংসদ নির্বাচন থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন—প্রায় সব নির্বাচনেই একই চিত্র। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। পারিবারিক উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অনেকে নিজ যোগ্যতাতেই রাজনীতিতে এসেছেন। তবে তাঁরা সংখ্যায় খুব কম।
বাংলাদেশে দুই প্রধান দলের বিকল্প সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে এই কারণগুলোর কথা ভুলে গেলে চলবে না। অনেক বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা তৃতীয় দল সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি।
এই পটভূমিতে বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি ও চাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না ‘নাগরিক ঐক্য’ নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁকে স্বাগত জানাই। একটি বিকল্প রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তিনি উপযুক্ত লোক, সন্দেহ নেই। তিনি কীভাবে এগোবেন, তা এখনো জনগণকে বিস্তারিত জানাননি। যেটুকু তথ্য জানা গেছে, তা দিয়ে তাঁর উদ্যোগকে মূল্যায়ন করা যায় না। তবে আশা করি, খুব শিগগির তিনি তাঁর কর্মপরিকল্পনা জনগণকে জানাবেন। তিনি কীভাবে এগোবেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভুল পদক্ষেপে তাঁর পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে।
জনাব মান্নার কয়েকটি বিষয় নিয়ে এখনই মন্তব্য করা যায়। ১. আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ না করে তাঁর নতুন একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নেওয়াটি ঠিক হয়নি। দুই নৌকায় পা রাখাকে কেউ ভালোভাবে দেখে না। ২. ‘নাগরিক ঐক্য’ রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দেওয়াও ঠিক হয়নি। (৩০০ আসনে উপযুক্ত প্রার্থী দেওয়া খুব সোজা ব্যাপার নয়।) এ ধরনের একটি ঘোষণা প্রথাগত রাজনীতির বুলির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ৩. জনাব মান্নার এ-সম্পর্কিত বক্তৃতা ও লেখালেখি থেকে একটা ভুল ধারণা হতে পারে, তিনি সিভিল সোসাইটির প্ল্যাটফর্ম থেকে দুই প্রধান দলের সমলোচনা করছেন। রাজনৈতিক দল করতে চাইলে স্পষ্টভাবে বলাই ভালো এবং প্রথম দিনই বলা ভালো। ৪. আগে কোনো বড় বা ছোট দলে সম্পৃক্ত ছিলেন, এমন নেতাদের সামনে না আনাই ভালো। এতে প্রথাগত দল ও রাজনীতির কথা মনে জাগে।
আমরা জনাব মান্না ও তাঁর সহকর্মীদের সাফল্য কামনা করি। দেশের কল্যাণে যদি নতুন একটি দল হয় ও সেই দল যদি বড় দুই দলের চেয়ে ভালো কিছু দেশকে উপহার দিতে পারে, তার চেয়ে খুশির কথা তো আর কিছু হতে পারে না। কারণ, বড় দুই দল তো বেশির ভাগ মানুষকেই হতাশ করেছে।
‘নাগরিক ঐক্য’ কীভাবে বিকশিত হবে, এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে আমি যদি এই দলের কান্ডারি হতাম, তাহলে কী করতাম সেটা এখানে বলা যেতে পারে। আমি প্রথমে যুবক (৪০-এর নিচে) ও ছাত্রদের সংগঠিত করার চেষ্টা করতাম, ছাত্র ও যুবকদের কয়েকটি দাবির ভিত্তিতে। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিদের সমস্যার কথা আমি এখন ভাবতামই না। পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে এর শাখা গঠন করতাম। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ গঠনের জন্য আন্দোলন শুরু করতাম। এটা ছাত্রদের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে আমাদের আন্দোলন হবে গঠনমূলক। ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের মতো মারদাঙ্গা নয়। সভা, সেমিনার, স্মারকলিপি প্রদান, পোস্টারিং, লিফলেট বিতরণ, ব্যাজ ধারণ ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলন হবে; ক্লাস বর্জন করে ও ক্যাম্পাসে মিছিল করে নয়। আগের স্টাইলে ছাত্ররাজনীতি এখন জনপ্রিয়তা পাবে না।
যুবকদের সংগঠিত করে দ্রব্যমূল্য, বেকার সমস্যা, বিদ্যুৎ-ঘাটতি, ঢাকার যানজট (স্থানীয় সমস্যা), বিভিন্ন জেলার প্রধান স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে স্থানীয়ভাবে আন্দোলন শুরু করতাম।
এসব আন্দোলন হবে গঠনমূলক ভঙ্গিতে। রাস্তা বন্ধ করে জনসভা নয়। এমনকি রাস্তাজুড়ে মিছিলও নয়। সভা, সেমিনার, পথসভা, মানববন্ধন, সংবাদপত্রে লেখালেখি, টক শো, প্রকাশনা, ইন্টারনেট, ব্লগ ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলন পরিচালনা করতাম।
সদস্যদের বার্ষিক চাঁদা ও শুভানুধ্যায়ীদের সহায়তার ওপর এই দল চালাতাম।
আমি এভাবে শুরু করতে চাইতাম। প্রথমে বড় বড় কথা না বলাই ভালো হবে। দেখা যাক, ছাত্র ও তরুণেরা কীভাবে সাড়া দেন। আগামী নির্বাচনে আট বিভাগে ৫০ জন যোগ্য প্রার্থী (সবাই তরুণ) দিতে পারলেই অনেক। এর মধ্যে ১০ জনও যদি জিততে পারেন, তা-ও বিরাট সাফল্য হিসেবে দেখতাম।
আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত ছাত্র ও তরুণদের মধ্যে এই দলের কার্যকলাপ সীমিত রাখতাম। সংসদ নির্বাচনের পর এই দলের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করতাম। দ্বিতীয় পর্যায়ে এটা প্রকৃত রাজনৈতিক দলের কাঠামো লাভ করবে। দলের গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র, পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি, প্রতিটি জেলায় শাখা গঠন, দ্বিবার্ষিক সম্মেলন, সদস্য সংগ্রহ অভিযান, তহবিল সংগ্রহ, প্রতি জেলায় বার্ষিক উন্নয়ন (দলের উদ্যোগে ও স্বেচ্ছাশ্রমে) কর্মসূচি নির্ধারণ ইত্যাদি কাজ এগোতে থাকবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাজের পদ্ধতির সঙ্গে এই দলের পদ্ধতির পার্থক্য থাকতে হবে। এই দল কোনোভাবেই প্রথাগত আরেকটি দল হতে পারবে না।
এই দলের একটি আকর্ষণীয় ‘উপদেষ্টা পরিষদ’ থাকবে। যাঁরা সক্রিয় রাজনীতি করবেন না কিন্তু এই দলকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবেন। এই উপদেষ্টা পরিষদে থাকবেন দেশের বিভিন্ন পেশার সম্মানিত, সফল ও কৃতী ব্যক্তিত্বরা; যাঁরা এই দলের সাফল্য কামনা করবেন। এই ‘উপদেষ্টা পরিষদ’ জনগণকে একটা আগাম ধারণা দেবে, যদি এই দল কখনো সরকার গঠন করে, তাহলে কারা সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিতে পারেন। তবে তাঁরা অবশ্যই বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের মতো হবেন না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় ও জনপ্রিয় দলকে ভোটে কাবু করা খুব সহজ কাজ নয়। মনে রাখতে হবে, এই দল দুটির ওপর অনেক মানুষ বীতশ্রদ্ধ হলেও নির্বাচনে তাদেরই ভোট দেয়। এই প্রবণতা থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে আনা খুব কঠিন। এ জন্য সময় লাগবে। এই মুহূর্তে ৩০০ আসনে নামকাওয়াস্তে প্রার্থী দেওয়া হয়তো জনাব মান্নার পক্ষে কঠিন কাজ নয়। কিন্তু ১০টি আসনেও প্রার্থীকে ধানের শীষ, নৌকা ও লাঙ্গলের (প্রতীক) বিপরীতে জিতিয়ে আনা খুব কঠিন কাজ। জনাব মান্নাকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করার জন্য আমি অনুরোধ করছি। জনাব মান্না ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা যদি আগামী সরকারেই মন্ত্রী বা এমপি হতে চান, তাহলে বিএনপি বা জাতীয় পার্টিতে যোগ দিতে পারেন। সেখানে সম্ভাবনা বেশি।
কিন্তু আগামী নির্বাচনে ‘নাগরিক ঐক্য’ থেকে বেশি কিছু আশা করা উচিত হবে না। ‘নাগরিক ঐক্য’কে খুব ধীরে এগোতে হবে। মানুষকে বুঝতে দিতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে সময়ের দরকার। মনে রাখতে হবে, ‘নাগরিক ঐক্যের’ সবচেয়ে বড় ঘাটতি হচ্ছে: সরকারে থেকে এই দল গঠিত হচ্ছে না (যেমনটি বিএনপি হয়েছে), এর নেতারা কোনো রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকারী নন। অনেকটা শূন্য থেকে এর যাত্রা শুরু হচ্ছে। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার মতো জনাব মান্না তৈরি মঞ্চ (দল) পাননি। তাঁর পেছনে আগে থেকে তৈরি কর্মী, সমর্থক ও স্তাবক দলও নেই। অনেকে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে বড় নেত্রী বলে বিবেচনা করেন। তাঁদের মতো তৈরি মঞ্চ (দল), কর্মী-বাহিনী ও স্তাবক দল পাওয়া গেলে ‘নেতা’ হতে ছয় মাস সময়ও লাগে না। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলওয়াল ভুট্টো ছাত্রাবস্থায়ই পিপিপির বড় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বেচারা ইমরান খানকে অত বড় ক্রিকেট ইমেজ সত্ত্বেও ১০ বছর ধরে তিলে তিলে তৈরি করতে হচ্ছে তাঁর দলকে। এসব দৃষ্টান্ত দেশে ও দেশের বাইরে আরও রয়েছে। রাজনীতির অঙ্গনে সবাই শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, বিলওয়াল বা রাহুল গান্ধীর মতো ভাগ্য নিয়ে জন্মান না।
জনাব মান্নাও সেই ভাগ্য নিয়ে জন্মাননি। কাজেই তাঁকে সাফল্যের দ্বারপ্রাপ্ত পৌঁছতে হলে ধীরে ধীরে এগোতে হবে। এক-দুই বছরের মধ্যে সব মাত করে দেবেন, এমন স্বপ্ন না থাকাই ভালো। তবে তিনি যে সাহস করে একটি বিকল্প প্ল্যাটফর্ম গড়তে চেয়েছেন, তা দেশে ও প্রবাসে বহু মানুষকে আশান্বিত করেছে। জনাব মান্নাকে এ জন্য আবারও অভিনন্দন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
এই পটভূমিতে দুই বড় দলের বিকল্প হিসেবে একটি রাজনৈতিক শক্তির অভাব অনেকে অনেক দিন ধরে অনুভব করেছেন। দেশে যদিও আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল রয়েছে, কিন্তু নানা কারণে সেসব দল জনসমর্থন লাভ করেনি।
বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বড় দুর্বলতা হলো: সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে ব্যক্তির চেয়ে পারিবারিক ঐতিহ্য ও দলীয় প্রতীককে পছন্দ করে বেশি। এ জন্য বিগত সব সংসদ নির্বাচনে অন্য দলের অনেক যোগ্য প্রার্থী অতি নগণ্য প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। এ দেশে প্রয়াত জনপ্রিয় নেতার স্ত্রী, ছেলে বা মেয়ে পরিচয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের কী যোগ্যতা, তা অনেক ভোটার বিবেচনা করেন না। সংসদ নির্বাচন থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন—প্রায় সব নির্বাচনেই একই চিত্র। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। পারিবারিক উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অনেকে নিজ যোগ্যতাতেই রাজনীতিতে এসেছেন। তবে তাঁরা সংখ্যায় খুব কম।
বাংলাদেশে দুই প্রধান দলের বিকল্প সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে এই কারণগুলোর কথা ভুলে গেলে চলবে না। অনেক বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা তৃতীয় দল সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি।
এই পটভূমিতে বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি ও চাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না ‘নাগরিক ঐক্য’ নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁকে স্বাগত জানাই। একটি বিকল্প রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তিনি উপযুক্ত লোক, সন্দেহ নেই। তিনি কীভাবে এগোবেন, তা এখনো জনগণকে বিস্তারিত জানাননি। যেটুকু তথ্য জানা গেছে, তা দিয়ে তাঁর উদ্যোগকে মূল্যায়ন করা যায় না। তবে আশা করি, খুব শিগগির তিনি তাঁর কর্মপরিকল্পনা জনগণকে জানাবেন। তিনি কীভাবে এগোবেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভুল পদক্ষেপে তাঁর পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে।
জনাব মান্নার কয়েকটি বিষয় নিয়ে এখনই মন্তব্য করা যায়। ১. আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ না করে তাঁর নতুন একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নেওয়াটি ঠিক হয়নি। দুই নৌকায় পা রাখাকে কেউ ভালোভাবে দেখে না। ২. ‘নাগরিক ঐক্য’ রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দেওয়াও ঠিক হয়নি। (৩০০ আসনে উপযুক্ত প্রার্থী দেওয়া খুব সোজা ব্যাপার নয়।) এ ধরনের একটি ঘোষণা প্রথাগত রাজনীতির বুলির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ৩. জনাব মান্নার এ-সম্পর্কিত বক্তৃতা ও লেখালেখি থেকে একটা ভুল ধারণা হতে পারে, তিনি সিভিল সোসাইটির প্ল্যাটফর্ম থেকে দুই প্রধান দলের সমলোচনা করছেন। রাজনৈতিক দল করতে চাইলে স্পষ্টভাবে বলাই ভালো এবং প্রথম দিনই বলা ভালো। ৪. আগে কোনো বড় বা ছোট দলে সম্পৃক্ত ছিলেন, এমন নেতাদের সামনে না আনাই ভালো। এতে প্রথাগত দল ও রাজনীতির কথা মনে জাগে।
আমরা জনাব মান্না ও তাঁর সহকর্মীদের সাফল্য কামনা করি। দেশের কল্যাণে যদি নতুন একটি দল হয় ও সেই দল যদি বড় দুই দলের চেয়ে ভালো কিছু দেশকে উপহার দিতে পারে, তার চেয়ে খুশির কথা তো আর কিছু হতে পারে না। কারণ, বড় দুই দল তো বেশির ভাগ মানুষকেই হতাশ করেছে।
‘নাগরিক ঐক্য’ কীভাবে বিকশিত হবে, এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে আমি যদি এই দলের কান্ডারি হতাম, তাহলে কী করতাম সেটা এখানে বলা যেতে পারে। আমি প্রথমে যুবক (৪০-এর নিচে) ও ছাত্রদের সংগঠিত করার চেষ্টা করতাম, ছাত্র ও যুবকদের কয়েকটি দাবির ভিত্তিতে। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিদের সমস্যার কথা আমি এখন ভাবতামই না। পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে এর শাখা গঠন করতাম। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ গঠনের জন্য আন্দোলন শুরু করতাম। এটা ছাত্রদের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে আমাদের আন্দোলন হবে গঠনমূলক। ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের মতো মারদাঙ্গা নয়। সভা, সেমিনার, স্মারকলিপি প্রদান, পোস্টারিং, লিফলেট বিতরণ, ব্যাজ ধারণ ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলন হবে; ক্লাস বর্জন করে ও ক্যাম্পাসে মিছিল করে নয়। আগের স্টাইলে ছাত্ররাজনীতি এখন জনপ্রিয়তা পাবে না।
যুবকদের সংগঠিত করে দ্রব্যমূল্য, বেকার সমস্যা, বিদ্যুৎ-ঘাটতি, ঢাকার যানজট (স্থানীয় সমস্যা), বিভিন্ন জেলার প্রধান স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে স্থানীয়ভাবে আন্দোলন শুরু করতাম।
এসব আন্দোলন হবে গঠনমূলক ভঙ্গিতে। রাস্তা বন্ধ করে জনসভা নয়। এমনকি রাস্তাজুড়ে মিছিলও নয়। সভা, সেমিনার, পথসভা, মানববন্ধন, সংবাদপত্রে লেখালেখি, টক শো, প্রকাশনা, ইন্টারনেট, ব্লগ ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলন পরিচালনা করতাম।
সদস্যদের বার্ষিক চাঁদা ও শুভানুধ্যায়ীদের সহায়তার ওপর এই দল চালাতাম।
আমি এভাবে শুরু করতে চাইতাম। প্রথমে বড় বড় কথা না বলাই ভালো হবে। দেখা যাক, ছাত্র ও তরুণেরা কীভাবে সাড়া দেন। আগামী নির্বাচনে আট বিভাগে ৫০ জন যোগ্য প্রার্থী (সবাই তরুণ) দিতে পারলেই অনেক। এর মধ্যে ১০ জনও যদি জিততে পারেন, তা-ও বিরাট সাফল্য হিসেবে দেখতাম।
আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত ছাত্র ও তরুণদের মধ্যে এই দলের কার্যকলাপ সীমিত রাখতাম। সংসদ নির্বাচনের পর এই দলের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করতাম। দ্বিতীয় পর্যায়ে এটা প্রকৃত রাজনৈতিক দলের কাঠামো লাভ করবে। দলের গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র, পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি, প্রতিটি জেলায় শাখা গঠন, দ্বিবার্ষিক সম্মেলন, সদস্য সংগ্রহ অভিযান, তহবিল সংগ্রহ, প্রতি জেলায় বার্ষিক উন্নয়ন (দলের উদ্যোগে ও স্বেচ্ছাশ্রমে) কর্মসূচি নির্ধারণ ইত্যাদি কাজ এগোতে থাকবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাজের পদ্ধতির সঙ্গে এই দলের পদ্ধতির পার্থক্য থাকতে হবে। এই দল কোনোভাবেই প্রথাগত আরেকটি দল হতে পারবে না।
এই দলের একটি আকর্ষণীয় ‘উপদেষ্টা পরিষদ’ থাকবে। যাঁরা সক্রিয় রাজনীতি করবেন না কিন্তু এই দলকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবেন। এই উপদেষ্টা পরিষদে থাকবেন দেশের বিভিন্ন পেশার সম্মানিত, সফল ও কৃতী ব্যক্তিত্বরা; যাঁরা এই দলের সাফল্য কামনা করবেন। এই ‘উপদেষ্টা পরিষদ’ জনগণকে একটা আগাম ধারণা দেবে, যদি এই দল কখনো সরকার গঠন করে, তাহলে কারা সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিতে পারেন। তবে তাঁরা অবশ্যই বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের মতো হবেন না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় ও জনপ্রিয় দলকে ভোটে কাবু করা খুব সহজ কাজ নয়। মনে রাখতে হবে, এই দল দুটির ওপর অনেক মানুষ বীতশ্রদ্ধ হলেও নির্বাচনে তাদেরই ভোট দেয়। এই প্রবণতা থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে আনা খুব কঠিন। এ জন্য সময় লাগবে। এই মুহূর্তে ৩০০ আসনে নামকাওয়াস্তে প্রার্থী দেওয়া হয়তো জনাব মান্নার পক্ষে কঠিন কাজ নয়। কিন্তু ১০টি আসনেও প্রার্থীকে ধানের শীষ, নৌকা ও লাঙ্গলের (প্রতীক) বিপরীতে জিতিয়ে আনা খুব কঠিন কাজ। জনাব মান্নাকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করার জন্য আমি অনুরোধ করছি। জনাব মান্না ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা যদি আগামী সরকারেই মন্ত্রী বা এমপি হতে চান, তাহলে বিএনপি বা জাতীয় পার্টিতে যোগ দিতে পারেন। সেখানে সম্ভাবনা বেশি।
কিন্তু আগামী নির্বাচনে ‘নাগরিক ঐক্য’ থেকে বেশি কিছু আশা করা উচিত হবে না। ‘নাগরিক ঐক্য’কে খুব ধীরে এগোতে হবে। মানুষকে বুঝতে দিতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে সময়ের দরকার। মনে রাখতে হবে, ‘নাগরিক ঐক্যের’ সবচেয়ে বড় ঘাটতি হচ্ছে: সরকারে থেকে এই দল গঠিত হচ্ছে না (যেমনটি বিএনপি হয়েছে), এর নেতারা কোনো রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকারী নন। অনেকটা শূন্য থেকে এর যাত্রা শুরু হচ্ছে। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার মতো জনাব মান্না তৈরি মঞ্চ (দল) পাননি। তাঁর পেছনে আগে থেকে তৈরি কর্মী, সমর্থক ও স্তাবক দলও নেই। অনেকে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে বড় নেত্রী বলে বিবেচনা করেন। তাঁদের মতো তৈরি মঞ্চ (দল), কর্মী-বাহিনী ও স্তাবক দল পাওয়া গেলে ‘নেতা’ হতে ছয় মাস সময়ও লাগে না। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলওয়াল ভুট্টো ছাত্রাবস্থায়ই পিপিপির বড় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বেচারা ইমরান খানকে অত বড় ক্রিকেট ইমেজ সত্ত্বেও ১০ বছর ধরে তিলে তিলে তৈরি করতে হচ্ছে তাঁর দলকে। এসব দৃষ্টান্ত দেশে ও দেশের বাইরে আরও রয়েছে। রাজনীতির অঙ্গনে সবাই শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, বিলওয়াল বা রাহুল গান্ধীর মতো ভাগ্য নিয়ে জন্মান না।
জনাব মান্নাও সেই ভাগ্য নিয়ে জন্মাননি। কাজেই তাঁকে সাফল্যের দ্বারপ্রাপ্ত পৌঁছতে হলে ধীরে ধীরে এগোতে হবে। এক-দুই বছরের মধ্যে সব মাত করে দেবেন, এমন স্বপ্ন না থাকাই ভালো। তবে তিনি যে সাহস করে একটি বিকল্প প্ল্যাটফর্ম গড়তে চেয়েছেন, তা দেশে ও প্রবাসে বহু মানুষকে আশান্বিত করেছে। জনাব মান্নাকে এ জন্য আবারও অভিনন্দন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments