বাংলাদেশ যত দিন থাকবে তত দিন হুমায়ূন থাকবে by ডা. এম এ করীম
চেম্বার থেকে বাসায় ফিরছি, রাত তখন প্রায় ১২টা বাজে। বন্ধু মামুনুর রশীদ ফোন করে জানাল, 'তুই হুমায়ূনের খবর জানিস? শুনলাম সে আর নেই।' আমি হতবাক! এ ব্যাপারে আমার একমাত্র সোর্স হলো অন্যপ্রকাশের মাযহারের স্ত্রী স্বর্ণা। তাঁর কাছ থেকেই আমার বাল্যবন্ধুর খবর পাই। ফোন করলাম স্বর্ণাকে।
ফোন করতেই ওপার থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। বুঝলাম, বন্ধু আর নেই। সৃষ্টিশীলতার সব শাখায় যার কৃতিত্ব, অবিস্মরণীয় সেই সফল অধ্যাপক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার- সর্বোপরি আমার বাল্যবন্ধু আমাদের ছেড়ে চলে গেল (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়- হুমায়ূন শরৎচন্দ্রকে ছাড়িয়ে গেছে। সুনীলের বিবেচনায় হুমায়ূন বাংলা ভাষার গর্ব। আমার বিবেচনায় হুমায়ূন এ উপমহাদেশের গর্ব। আমাকে প্রায়ই বলত, করীম, মানুষের জীবন এত অল্প কেন? যেখানে কচ্ছপের জীবন অনেক দীর্ঘ। আমার মনে হয়, এত অল্প সময়ে মানুষ কিছুই দিতে পারে না। ও যখন ধরতে পারল ওর ক্যান্সার হয়েছে, তখন সে আমাকে বলল, তুই তো ডাক্তার। তুই কলাম লিখিস রাজনীতি নিয়ে। এই যে 'কোলন ক্যান্সারের' লক্ষণগুলো নিয়ে তো লিখতে পারিস। দৃঢ়বিশ্বাস নিয়ে সে নিউ ইয়র্ক গেল। চিকিৎসার জন্য। মহাদেব সাহার মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করছে, বন্ধু হুমায়ূন তুই চলে গেলি, কোথায় গেলি? স্কুলে আমি ও হুমায়ূন একসঙ্গে পড়াশোনা করতাম। আমি হোস্টেলে ছিলাম। ও এসে বলল, চল তোকে আর হোস্টেলে থাকতে হবে না আমাদের বাসায় থাকবি। বাসায় এলাম এবং এ পরিবারের সদস্য হয়ে গেলাম। মাঝেমধ্যেই বলত, 'তুই আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাস?' আমি বললাম, 'হ্যাঁ, এই যে তুই হঠাৎ করে আনমনা হয়ে যাস। তোকে ডাক দিলে তুই সাড়া দিস না। এটা আমার কাছে অবাক মনে হয়। বলি, 'তুই কী চিন্তা করিস?' উত্তরে বলে, সেটা আমি নিজেই জানি না। আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাই। আজ সত্যি সত্যিই সে হারিয়ে গেল। কিন্তু না, হারিয়ে তুই যাবি না বন্ধু। তুই বাংলায় থাকবি, এ দেশের মানুষের অন্তরে তুই মিশে থাকবি। তোকে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। তুই আসছিস। কথা বলবি না। আমাদের সঙ্গে কথা না বললেও আমরা বলব। আমি ডাকব- বাচ্চু, তোকে যে 'দেওয়াল' লিখতে হবে? কিন্তু আমার সে স্বপ্নও পূর্ণ হলো না। মৃত্যু তোকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। কেউ আর আমাকে ডেকে বলবে না- 'করীম' আজ গাছের ছাল ভর্তা করেছি, ভাত খা। নুহাশ পল্লীর পুকুরের মাছ রান্না করেছি, খা। আমরা পারলাম না তোকে আমাদের কাছে রাখতে। কিন্তু না! তুই যে মৃত্যুঞ্জয়ী। মহাদেব সাহার সুরে আমি বলতে চাই- তুই জয় করেছিস মৃত্যুকে। কালের পর কাল তোর রচনা থেকে যাবে। তুই শুধু জনপ্রিয় নস, জনপ্রিয়তম নস, তুমি কালজয়ী, সর্বকালজয়ী, যত দিন বাংলা ভাষা থাকবে, তত দিন তুই থাকবি, তুই বেঁচে থাকবি, তুই মানুষকে যেভাবে আবিষ্কার করেছিলি, একই মানুষ, স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক, উদ্ভট : এই যে একই মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকত্ব, অস্বাভাবিকত্ব- এ তোর আবিষ্কার। তোর চোখই ছিল ক্যামেরা, অন্তরভেদী, তোর পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল অসাধারণ, তোর চরিত্র নির্মাণ ছিল অসাধারণ। আহা! তুই কী-সব অসাধারণ চরিত্র নির্মাণ করেছিস, এই যে মানুষের মধ্যে তুই যে রস সঞ্চার করেছিস, এই যে আনন্দে ভাসিয়ে দিয়েছিস মানুষকে একই সঙ্গে কাঁদিয়েছিস, এই যে আনন্দ-বেদনার, সুখ-দুঃখের অপরূপ ভাষ্যকার তুই। তোর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে তুই অমর, তোকে শেষ অভিবাদন জানাই, তুই যেখানেই থাক, তুই আমাদের মাঝেই থাকবি। বাংলার এই জল-হাওয়া-মৃত্তিকার মধ্যে তুই মিশে থাকবি। তুই হয়ে থাকবি বাংলাদেশের হৃদয়। বাংলাদেশের ঘাস-ফুল-লতা-পাতা ও শ্যামল প্রকৃতি। তোকে আবার ভালোবাসা জানাই। তুই যে অনন্তলোকে চলে গেছিস, সেখানে পৌঁছে দিতে চাই আমার এই অশ্রুবিন্দু, আমার এই ভালোবাসা।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।
No comments