প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ-ইমদাদুল হক মিলন
বাবার মৃত্যুর পর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। চার দিন কথা বলতে পারিনি। নিঃশব্দে চোখের জলে ভেসেছি। ১৯৭১ সালের কথা। সেই ঘটনার ৪১ বছর পর গতরাত (বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই) থেকে আমি বলতে গেলে বাকরুদ্ধই হয়ে আছি।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর টিভি চ্যানেলগুলো থেকে অবিরাম ফোন এসেছে, কত বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জন ফোন করেছেন, ফোন ধরার পরই গলা বন্ধ হয়ে এসেছে। চোখের জলে গাল ভাসতে শুরু করেছে।
হুমায়ূন ভাই নেই, এই বেদনা আমি নিতে পারছি না।
গত কয়েক দিন নানা রকমের খবর রটছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল প্রচার করছিল তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন। 'কালের কণ্ঠে' সংকটাপন্ন শব্দটা লিখতে আমি মানা করলাম। এই শব্দ আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। বুধবার সন্ধ্যায় আমেরিকায় ফোন করে মাজহারের কাছে খবর নিয়েছি। তিনি বলেছেন, অবস্থার সামান্য উন্নতি দেখা যাচ্ছে। শুনে চাপ ধরা বুক খানিকটা হালকা হলো। বৃহস্পতিবার বাসায় ফিরছি, রাত ৯টার দিকে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ ফোন করলেন। কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। হুমায়ূনের খবর কী, বলো তো? মন খারাপ করা সব কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি।
আগের দিন শোনা মাজহারের উদ্ধৃতি দিলাম। তার পরও মন ভারাক্রান্ত হলো। তখনই নিউ ইয়র্কে মাজহারকে আবার ফোন করলাম। মাজহার আগের মতোই বললেন, অবস্থা তেমনই। আমি মামুন ভাইকে ফোন করে বললাম। তিনি যেন হাঁপ ছাড়লেন। থ্যাঙ্কস গড।
রাত ১১টার দিকে ফরিদুর রেজা সাগর ফোন করে বললেন, যখন তখন অশুভ সংবাদটা আসবে। মন শক্ত করো।
ঘণ্টাখানেক পর সেই সংবাদ এলো। টেলিভিশন স্ক্রলে উঠতে লাগল, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ...
এর পর থেকে আমার চারপাশে শুধুই হুমায়ূন আহমেদ। মাথা শূন্য হয়ে গেল, বুক ফাঁকা হয়ে গেল। চোখজুড়ে শুধুই হুমায়ূন আহমেদের প্রিয়মুখ। কত দিনের কত ঘটনা মনে এলো, আমাদের কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনার দিন। যে বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন, ১০-১২ বছর আগে আমরা কয়েকজন তাঁকে সেই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর হার্টের সমস্যা। এনজিওগ্রাম করাবেন। আর্কিটেক্ট করিম ভাই, অন্যপ্রকাশের মাজহার, কমল আর আমি, আমরা গেলাম তাঁর সঙ্গে।
যাওয়ার দিন সন্ধ্যাবেলাটার কথা আমার মনে আছে। আমরা সবাই ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে তাঁর দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটে। হুমায়ূন ভাই
দলামোচড়া করে দু-তিনটা শার্ট-প্যান্ট ভরলেন একটা ব্যাগে, পাসপোর্ট-টিকিট হাতে নিলেন, ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বললেন, চলো।
আমি অবাক। আপনি আমেরিকায় যাচ্ছেন, না কুতুবপুর?
নিউ ইয়র্কে তখন একটা বইমেলারও আয়োজন করেছিল মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার গেছেন। হুমায়ূন ভাই আর আমিও অতিথি। একই হোটেলে উঠেছি সবাই। কী যে আনন্দে কাটল কয়েকটা দিন। এনজিওগ্রাম করানো হলো হুমায়ূন ভাইয়ের। এক রাত হাসপাতালে থাকতে হবে। কিন্তু ওই একটা রাত একা হাসপাতালে থাকবেন তিনি, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। শিশুর মতো ছটফট করতে লাগলেন, চঞ্চল হয়ে গেলেন। আমরা নানা রকমভাবে প্রবোধ দিয়ে তাঁকে একটা রাত বেলভ্যুতে রাখতে পেরেছিলাম। চারপাশে বন্ধুবান্ধব ছাড়া তিনি থাকতেই পারতেন না। একা চলাফেরা করতে পারতেন না। তিনি চলতেন সম্রাটের মতো। চারপাশে আমরা কয়েকজন তাঁর পারিষদ।
হুমায়ূন ভাই, যে জগতে আপনি চলে গেলেন, সেখানে একা একা আপনি কেমন করে থাকবেন? সেখানে তো আপনার পাশে আপনার মা নেই, শাওন নেই, নিষাদ-নিনিত নেই, মাজহার নেই, আমরা কেউ নেই।
আমার ৫০তম জন্মদিনে আমাকে নিয়ে 'প্রথম আলো'তে একটা লেখা লিখলেন হুমায়ূন ভাই, 'কী কথা তাহার সাথে'। (এই নামে 'এনটিভি'তে আমি তখন একটা প্রোগ্রাম করতাম। হুমায়ূন ভাইকে নিতে চেয়েছি, তিনি যাননি। শাওনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।) তাঁর স্বভাব ছিল যেকোনো লেখা লিখলেই সন্ধ্যার পর বন্ধুবান্ধব নিয়ে বসে সেই লেখা পড়ে শোনাতেন। ওই লেখাটাও পড়তে লাগলেন। আমি বসে আছি তাঁর পাশে। আলমগীর রহমান, মাজহার, আর্কিটেক্ট করিম- আমরা মুগ্ধ হচ্ছি তাঁর লেখায়। আমার মুখে শোনা আমার কিশোর বয়সের এক দুর্দিনের বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি। সেই অংশটুকু পড়তে পড়তে আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন। কী গভীর ভালো তিনি আমাকে বেসেছেন, আমি ছাড়া কেউ তা জানে না।
কালের কণ্ঠে তিনি বহু লেখা লিখেছেন। শুরু থেকেই। আমি গিয়ে জোর করে তাঁর লেখা নিয়ে আসতাম। একদিন বললেন, দেড়-দুই বছরে কালের কণ্ঠে যত লেখা লিখলাম, জীবনে কোনো পত্রিকায় এত অল্প সময়ে এত লেখা আমি লিখিনি। কেন লিখেছি জানো? তোমার জন্য।
আগরতলায় বেড়াতে গিয়ে পুরনো একটা মন্দির দেখতে গিয়েছি আমরা। পুরোদল। জনা ১০-১২ লোক। সেই মন্দিরের সামনে আদুরে ছেলে যেমন করে অনেক সময় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বাবাকে, ঠিক সেভাবে দুই হাতে আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। দুজনেরই গভীর আনন্দিত হাসিমুখ। মাজহার ছবি তুললেন। হুমায়ূন ভাই হাসতে হাসতে বললেন, মনে হলো আমার একটা পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের ছেলে আছে।
আমার বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ।
ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য তিনি নিউ ইয়র্কে চলে যাওয়ার পর কালের কণ্ঠের সাহিত্য ম্যাগাজিন 'শিলালিপি'তে তাঁকে নিয়ে আমি একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করলাম। 'হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ'। একটু নতুন আঙ্গিকে লেখা। আমার স্মৃতিচারণা আর তাঁর ইন্টারভিউ। এই ইন্টারভিউটা 'অন্যদিন' পত্রিকায় একসময় ছাপা হয়েছিল। সেটাকেই নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করা। ১৩ পর্বে লেখাটা শেষ হলো।
নিউ ইয়র্কে বসে হুমায়ূন ভাই একটু রাগলেন। আমাকে নিয়ে একটা লেখা লিখলেন, 'মিলন কেন দুষ্টু'। সেই লেখায় আমাকে মৃদু বকাঝকাও করলেন। তাঁর সম্মানে কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় লেখাটা আমি ছেপে দিলাম।
কিছুদিন আগে দুই সপ্তাহের জন্য তিনি দেশে এসেছিলেন। উঠেছিলেন তাঁর প্রিয় নুহাশ পল্লীতে। সেখান থেকে এলেন ধানমণ্ডির দখিন হাওয়ায়। এক রাতে দেখা করতে গেছি। তিনি তাঁর অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমটায় চেয়ারে বসে আছেন। শাওন আছে পাশে, মাজহার আছে। একপাশে বসে আছেন স্থপতি ও লেখক শাকুর মজিদ। আলমগীর রহমান এলেন, মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণা এলো। আমি বসে আছি হুমায়ূন ভাইয়ের পায়ের কাছে। তাঁর মুখটা আর আগের মতো নেই। কালো হয়ে গেছে। মাথার চুল গেছে অনেকটা পাতলা হয়ে। আর শরীরও কেমন যেন ভারী মনে হলো আমার। ওজন কি একটু বেড়েছে?
দু-চার কথার পর হঠাৎ তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন, গভীর মায়াবী গলায় বললেন, ওই লেখাটার জন্য মন খারাপ করেছিলে? বললেন এমন করে, আমি তাঁর হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
হুমায়ূন ভাই, বৃহস্পতিবার রাত থেকে আপনার জন্য শুধু আমি নই, পুরো বাংলাদেশ কাঁদছে। অমিত হাবিবের কথা আপনার মনে আছে। কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। সংবাদপত্রজগতের অত্যন্ত মেধাবী যুবক। মাত্র এক রাতে কয়েক ঘণ্টা আপনার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছিল অমিত। আমিই তাকে আপনার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাত ১টার দিকে ফোন করে অমিত কাঁদতে লাগল। ফোনের একদিকে আমি কাঁদি, আরেক দিকে অমিত। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ আপনাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে। যে আপনার কাছে গেছে, সে তো বটেই, দূর থেকে যারা আপনাকে দেখেছে, আপনার লেখা পড়েছে, নাটক-সিনেমা দেখেছে, আপনার লেখা গানগুলো শুনেছে, তারা যেমন ভালো আপনাকে বেসেছে, পৃথিবীর খুব কম মানুষের ভাগ্যেই এ রকম ভালোবাসা জোটে। আপনি চলে গেছেন, বাংলাদেশ আজ চোখের জলে ভাসছে। আমাদের চারদিক অনেকটাই অন্ধকার। শ্রাবণ দিনে আপনি চলে গেলেন আর আমাদের আকাশ ছেয়ে গেল শ্রাবণ মেঘে। এই মেঘ চোখের জলের বৃষ্টি হয়ে ঝরছে।
হুমায়ূন ভাই, আপনার মনে আছে, একদিন নুহাশ পল্লীতে ঢোকার মুখে, গেটের বাইরের দিকটায় দুপুরের নির্জনতায় আপনি ও আমি হাঁটছিলাম। আমাদের পায়ের কাছে ফুটে আছে কিছু সাদা রঙের ছোট ছোট বুনোফুল। তেমন গন্ধ নেই। আপনি হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী ফুল, বলো তো?
প্রথমে আমি চিনতে পারলাম না। আপনি বললেন, বিভূতিভূষণ এই ফুলের কথা অনেকবার লিখেছেন।
বুঝে গেলাম। ভাঁটফুল।
আপনার নুহাশ পল্লীর গেটের কাছে বছর বছর ফুটতে থাকবে ভাঁটফুল, নুহাশ পল্লীর সবুজ মাঠ আরো সবুজ হবে বর্ষার বৃষ্টিতে, আপনার ঔষধি বাগান হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। নুহাশ পল্লীর ফুলের ঝোপ রঙিন হবে বসন্তকালে, গাছপালায় বইবে চৈতালী হাওয়া, আপনার পুকুরের জলে শ্বাস ফেলতে উঠবে মাছেরা, পাখিরা মুখর হবে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায়। গভীর রাতে দূরে ডাকতে থাকবে দুরন্ত কোকিলেরা। শিউলি ফুলের মতো জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করবে আপনার তৈরি করা এক টুকরো পৃথিবী। শ্রাবণ দিনের বৃষ্টি আপনার শোকে কাতর হবে, নুহাশ পল্লীর মাঠ ভাসবে চোখের জলে, ফুলেরা ভুলে যাবে গন্ধ ছড়াতে, মুখর পাখিরা স্তব্ধ হবে, জ্যোৎস্না রাত ম্লান হবে। দুরন্ত কোকিল আর ডাকতে চাইবে না। আমাদের বইমেলাগুলো ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে, প্রকাশকরা হারাবেন উদ্দীপনা। ঈদসংখ্যাগুলো হারাবে জৌলুস। টেলিভিশন পর্দা আলোকিত হবে না আপনার নতুন নাটকে। মাইক্রোবাস ভরে আমরা আর আড্ডা দিতে যাব না নুহাশ পল্লীতে, দখিন হাওয়া মুখর হবে না হাসি-আনন্দে। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
আপনার সর্বশেষ উপন্যাস 'দেয়াল' ১৬০ পৃষ্ঠার মতো লিখে ড. আনিসুজ্জামান, ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও আমাকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। আমাদের মতামত জেনে লেখা শেষ করবেন। আপনার লেখা দেয়াল উপন্যাসে ওই ১৬০ পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছে লিখতে লিখতেই যেন উঠে চলে গেলেন আপনি। টেবিলে অসহায় ভঙ্গিতে পড়ে আছে আপনার কলম আর সাদা কাগজ।
সাদা কাগজ, তোমাকে কে বোঝাবে হুমায়ূন আহমেদ চলে যাননি। এই তো বাঙালি পাঠকের বুকশেলফগুলোতে রয়ে গেছেন তিনি, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে রয়ে গেছেন, বাংলাদেশের সিনেমায় রয়ে গেছেন। তাঁর গান রয়ে গেছে সুবীর নন্দী, শাওন আর অন্যান্য শিল্পীর কণ্ঠে। আর তিনি রয়ে গেছেন বাঙালি জাতির অন্তরে।
যে অপার্থিব জগতে আপনি আছেন, সেখানে ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন হুমায়ূন ভাই। পরম করুণাময় আপনাকে গভীর শান্তিতে রাখুক।
হুমায়ূন ভাই নেই, এই বেদনা আমি নিতে পারছি না।
গত কয়েক দিন নানা রকমের খবর রটছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল প্রচার করছিল তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন। 'কালের কণ্ঠে' সংকটাপন্ন শব্দটা লিখতে আমি মানা করলাম। এই শব্দ আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। বুধবার সন্ধ্যায় আমেরিকায় ফোন করে মাজহারের কাছে খবর নিয়েছি। তিনি বলেছেন, অবস্থার সামান্য উন্নতি দেখা যাচ্ছে। শুনে চাপ ধরা বুক খানিকটা হালকা হলো। বৃহস্পতিবার বাসায় ফিরছি, রাত ৯টার দিকে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ ফোন করলেন। কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। হুমায়ূনের খবর কী, বলো তো? মন খারাপ করা সব কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি।
আগের দিন শোনা মাজহারের উদ্ধৃতি দিলাম। তার পরও মন ভারাক্রান্ত হলো। তখনই নিউ ইয়র্কে মাজহারকে আবার ফোন করলাম। মাজহার আগের মতোই বললেন, অবস্থা তেমনই। আমি মামুন ভাইকে ফোন করে বললাম। তিনি যেন হাঁপ ছাড়লেন। থ্যাঙ্কস গড।
রাত ১১টার দিকে ফরিদুর রেজা সাগর ফোন করে বললেন, যখন তখন অশুভ সংবাদটা আসবে। মন শক্ত করো।
ঘণ্টাখানেক পর সেই সংবাদ এলো। টেলিভিশন স্ক্রলে উঠতে লাগল, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ...
এর পর থেকে আমার চারপাশে শুধুই হুমায়ূন আহমেদ। মাথা শূন্য হয়ে গেল, বুক ফাঁকা হয়ে গেল। চোখজুড়ে শুধুই হুমায়ূন আহমেদের প্রিয়মুখ। কত দিনের কত ঘটনা মনে এলো, আমাদের কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনার দিন। যে বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন, ১০-১২ বছর আগে আমরা কয়েকজন তাঁকে সেই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর হার্টের সমস্যা। এনজিওগ্রাম করাবেন। আর্কিটেক্ট করিম ভাই, অন্যপ্রকাশের মাজহার, কমল আর আমি, আমরা গেলাম তাঁর সঙ্গে।
যাওয়ার দিন সন্ধ্যাবেলাটার কথা আমার মনে আছে। আমরা সবাই ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে তাঁর দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটে। হুমায়ূন ভাই
দলামোচড়া করে দু-তিনটা শার্ট-প্যান্ট ভরলেন একটা ব্যাগে, পাসপোর্ট-টিকিট হাতে নিলেন, ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বললেন, চলো।
আমি অবাক। আপনি আমেরিকায় যাচ্ছেন, না কুতুবপুর?
নিউ ইয়র্কে তখন একটা বইমেলারও আয়োজন করেছিল মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার গেছেন। হুমায়ূন ভাই আর আমিও অতিথি। একই হোটেলে উঠেছি সবাই। কী যে আনন্দে কাটল কয়েকটা দিন। এনজিওগ্রাম করানো হলো হুমায়ূন ভাইয়ের। এক রাত হাসপাতালে থাকতে হবে। কিন্তু ওই একটা রাত একা হাসপাতালে থাকবেন তিনি, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। শিশুর মতো ছটফট করতে লাগলেন, চঞ্চল হয়ে গেলেন। আমরা নানা রকমভাবে প্রবোধ দিয়ে তাঁকে একটা রাত বেলভ্যুতে রাখতে পেরেছিলাম। চারপাশে বন্ধুবান্ধব ছাড়া তিনি থাকতেই পারতেন না। একা চলাফেরা করতে পারতেন না। তিনি চলতেন সম্রাটের মতো। চারপাশে আমরা কয়েকজন তাঁর পারিষদ।
হুমায়ূন ভাই, যে জগতে আপনি চলে গেলেন, সেখানে একা একা আপনি কেমন করে থাকবেন? সেখানে তো আপনার পাশে আপনার মা নেই, শাওন নেই, নিষাদ-নিনিত নেই, মাজহার নেই, আমরা কেউ নেই।
আমার ৫০তম জন্মদিনে আমাকে নিয়ে 'প্রথম আলো'তে একটা লেখা লিখলেন হুমায়ূন ভাই, 'কী কথা তাহার সাথে'। (এই নামে 'এনটিভি'তে আমি তখন একটা প্রোগ্রাম করতাম। হুমায়ূন ভাইকে নিতে চেয়েছি, তিনি যাননি। শাওনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।) তাঁর স্বভাব ছিল যেকোনো লেখা লিখলেই সন্ধ্যার পর বন্ধুবান্ধব নিয়ে বসে সেই লেখা পড়ে শোনাতেন। ওই লেখাটাও পড়তে লাগলেন। আমি বসে আছি তাঁর পাশে। আলমগীর রহমান, মাজহার, আর্কিটেক্ট করিম- আমরা মুগ্ধ হচ্ছি তাঁর লেখায়। আমার মুখে শোনা আমার কিশোর বয়সের এক দুর্দিনের বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি। সেই অংশটুকু পড়তে পড়তে আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন। কী গভীর ভালো তিনি আমাকে বেসেছেন, আমি ছাড়া কেউ তা জানে না।
কালের কণ্ঠে তিনি বহু লেখা লিখেছেন। শুরু থেকেই। আমি গিয়ে জোর করে তাঁর লেখা নিয়ে আসতাম। একদিন বললেন, দেড়-দুই বছরে কালের কণ্ঠে যত লেখা লিখলাম, জীবনে কোনো পত্রিকায় এত অল্প সময়ে এত লেখা আমি লিখিনি। কেন লিখেছি জানো? তোমার জন্য।
আগরতলায় বেড়াতে গিয়ে পুরনো একটা মন্দির দেখতে গিয়েছি আমরা। পুরোদল। জনা ১০-১২ লোক। সেই মন্দিরের সামনে আদুরে ছেলে যেমন করে অনেক সময় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বাবাকে, ঠিক সেভাবে দুই হাতে আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। দুজনেরই গভীর আনন্দিত হাসিমুখ। মাজহার ছবি তুললেন। হুমায়ূন ভাই হাসতে হাসতে বললেন, মনে হলো আমার একটা পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের ছেলে আছে।
আমার বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ।
ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য তিনি নিউ ইয়র্কে চলে যাওয়ার পর কালের কণ্ঠের সাহিত্য ম্যাগাজিন 'শিলালিপি'তে তাঁকে নিয়ে আমি একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করলাম। 'হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ'। একটু নতুন আঙ্গিকে লেখা। আমার স্মৃতিচারণা আর তাঁর ইন্টারভিউ। এই ইন্টারভিউটা 'অন্যদিন' পত্রিকায় একসময় ছাপা হয়েছিল। সেটাকেই নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করা। ১৩ পর্বে লেখাটা শেষ হলো।
নিউ ইয়র্কে বসে হুমায়ূন ভাই একটু রাগলেন। আমাকে নিয়ে একটা লেখা লিখলেন, 'মিলন কেন দুষ্টু'। সেই লেখায় আমাকে মৃদু বকাঝকাও করলেন। তাঁর সম্মানে কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় লেখাটা আমি ছেপে দিলাম।
কিছুদিন আগে দুই সপ্তাহের জন্য তিনি দেশে এসেছিলেন। উঠেছিলেন তাঁর প্রিয় নুহাশ পল্লীতে। সেখান থেকে এলেন ধানমণ্ডির দখিন হাওয়ায়। এক রাতে দেখা করতে গেছি। তিনি তাঁর অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমটায় চেয়ারে বসে আছেন। শাওন আছে পাশে, মাজহার আছে। একপাশে বসে আছেন স্থপতি ও লেখক শাকুর মজিদ। আলমগীর রহমান এলেন, মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণা এলো। আমি বসে আছি হুমায়ূন ভাইয়ের পায়ের কাছে। তাঁর মুখটা আর আগের মতো নেই। কালো হয়ে গেছে। মাথার চুল গেছে অনেকটা পাতলা হয়ে। আর শরীরও কেমন যেন ভারী মনে হলো আমার। ওজন কি একটু বেড়েছে?
দু-চার কথার পর হঠাৎ তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন, গভীর মায়াবী গলায় বললেন, ওই লেখাটার জন্য মন খারাপ করেছিলে? বললেন এমন করে, আমি তাঁর হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
হুমায়ূন ভাই, বৃহস্পতিবার রাত থেকে আপনার জন্য শুধু আমি নই, পুরো বাংলাদেশ কাঁদছে। অমিত হাবিবের কথা আপনার মনে আছে। কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। সংবাদপত্রজগতের অত্যন্ত মেধাবী যুবক। মাত্র এক রাতে কয়েক ঘণ্টা আপনার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছিল অমিত। আমিই তাকে আপনার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাত ১টার দিকে ফোন করে অমিত কাঁদতে লাগল। ফোনের একদিকে আমি কাঁদি, আরেক দিকে অমিত। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ আপনাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে। যে আপনার কাছে গেছে, সে তো বটেই, দূর থেকে যারা আপনাকে দেখেছে, আপনার লেখা পড়েছে, নাটক-সিনেমা দেখেছে, আপনার লেখা গানগুলো শুনেছে, তারা যেমন ভালো আপনাকে বেসেছে, পৃথিবীর খুব কম মানুষের ভাগ্যেই এ রকম ভালোবাসা জোটে। আপনি চলে গেছেন, বাংলাদেশ আজ চোখের জলে ভাসছে। আমাদের চারদিক অনেকটাই অন্ধকার। শ্রাবণ দিনে আপনি চলে গেলেন আর আমাদের আকাশ ছেয়ে গেল শ্রাবণ মেঘে। এই মেঘ চোখের জলের বৃষ্টি হয়ে ঝরছে।
হুমায়ূন ভাই, আপনার মনে আছে, একদিন নুহাশ পল্লীতে ঢোকার মুখে, গেটের বাইরের দিকটায় দুপুরের নির্জনতায় আপনি ও আমি হাঁটছিলাম। আমাদের পায়ের কাছে ফুটে আছে কিছু সাদা রঙের ছোট ছোট বুনোফুল। তেমন গন্ধ নেই। আপনি হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী ফুল, বলো তো?
প্রথমে আমি চিনতে পারলাম না। আপনি বললেন, বিভূতিভূষণ এই ফুলের কথা অনেকবার লিখেছেন।
বুঝে গেলাম। ভাঁটফুল।
আপনার নুহাশ পল্লীর গেটের কাছে বছর বছর ফুটতে থাকবে ভাঁটফুল, নুহাশ পল্লীর সবুজ মাঠ আরো সবুজ হবে বর্ষার বৃষ্টিতে, আপনার ঔষধি বাগান হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। নুহাশ পল্লীর ফুলের ঝোপ রঙিন হবে বসন্তকালে, গাছপালায় বইবে চৈতালী হাওয়া, আপনার পুকুরের জলে শ্বাস ফেলতে উঠবে মাছেরা, পাখিরা মুখর হবে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায়। গভীর রাতে দূরে ডাকতে থাকবে দুরন্ত কোকিলেরা। শিউলি ফুলের মতো জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করবে আপনার তৈরি করা এক টুকরো পৃথিবী। শ্রাবণ দিনের বৃষ্টি আপনার শোকে কাতর হবে, নুহাশ পল্লীর মাঠ ভাসবে চোখের জলে, ফুলেরা ভুলে যাবে গন্ধ ছড়াতে, মুখর পাখিরা স্তব্ধ হবে, জ্যোৎস্না রাত ম্লান হবে। দুরন্ত কোকিল আর ডাকতে চাইবে না। আমাদের বইমেলাগুলো ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে, প্রকাশকরা হারাবেন উদ্দীপনা। ঈদসংখ্যাগুলো হারাবে জৌলুস। টেলিভিশন পর্দা আলোকিত হবে না আপনার নতুন নাটকে। মাইক্রোবাস ভরে আমরা আর আড্ডা দিতে যাব না নুহাশ পল্লীতে, দখিন হাওয়া মুখর হবে না হাসি-আনন্দে। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
আপনার সর্বশেষ উপন্যাস 'দেয়াল' ১৬০ পৃষ্ঠার মতো লিখে ড. আনিসুজ্জামান, ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও আমাকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। আমাদের মতামত জেনে লেখা শেষ করবেন। আপনার লেখা দেয়াল উপন্যাসে ওই ১৬০ পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছে লিখতে লিখতেই যেন উঠে চলে গেলেন আপনি। টেবিলে অসহায় ভঙ্গিতে পড়ে আছে আপনার কলম আর সাদা কাগজ।
সাদা কাগজ, তোমাকে কে বোঝাবে হুমায়ূন আহমেদ চলে যাননি। এই তো বাঙালি পাঠকের বুকশেলফগুলোতে রয়ে গেছেন তিনি, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে রয়ে গেছেন, বাংলাদেশের সিনেমায় রয়ে গেছেন। তাঁর গান রয়ে গেছে সুবীর নন্দী, শাওন আর অন্যান্য শিল্পীর কণ্ঠে। আর তিনি রয়ে গেছেন বাঙালি জাতির অন্তরে।
যে অপার্থিব জগতে আপনি আছেন, সেখানে ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন হুমায়ূন ভাই। পরম করুণাময় আপনাকে গভীর শান্তিতে রাখুক।
No comments