মিল্ক ভিটার দুটি তদন্তে প্রমাণ, মামলা করেছে দুদকও-৪২ লাখ টাকা আত্মসাৎ , তবু চাকরিতে পুনর্বহাল by আবুল হাসনাত

মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষের একাধিক তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। তদন্ত করে দুদক মামলাও করেছে। কিন্তু ৪২ লাখ ৬৩ হাজার ৫১৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বরখাস্ত হয়ে আবার চাকরি ফিরে পেয়েছেন মো. খায়রুল ইসলাম আলমাজী।


মিরপুরে মিল্ক ভিটার দুগ্ধ কারখানার বিক্রয়কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক থাকাকালে খায়রুল এই টাকা আত্মসাৎ করেন। গত বছরের ২৩ এপ্রিল এ জন্য তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্ত এ বছরের ১ এপ্রিল তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়। এবার তিনি কেন্দ্রীয় গুদামে দায়িত্ব পেয়েছেন।
এই রহস্যের মূলে আছেন মিল্ক ভিটার পরিচালনাকারী বাংলাদেশ দুগ্ধ উত্পাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান হাসিব খান। খায়রুল তাঁর আত্মীয়।
জানতে চাইলে হাসিব খান প্রথম আলোকে বলেন, খায়রুল ইসলাম আলমাজীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়, এটা সত্য। এখন তাঁর কাছ থেকে আত্মসাত্ করা অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে।
মিল্ক ভিটার ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরও খায়রুল ইসলামকে কেন চাকরিতে বহাল করা হলো, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে হাসিব খান বলেন, ‘আমি জেনে আপনাকে জানাব।’ আত্মীয় হওয়ায় তাঁকে পুনর্বহাল করা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আত্মীয় হওয়ার কারণে তাঁকে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি।’
মিল্ক ভিটা সূত্র এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে দেখা যায়, এই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল মিল্ক ভিটার দুগ্ধ কারখানার তত্কালীন ব্যবস্থাপক (বিপণন) মো. মহিউদ্দিন মিয়াকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। ১১ এপ্রিল ওই কমিটি প্রাথমিক প্রতিবেদন দেয়। এরপর হয় অধিকতর তদন্ত। মিল্ক ভিটার তত্কালীন উপব্যবস্থাপক (ক্রয় ও পরিকল্পনা) মো. ছিদ্দিকুর রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি ওই বছরের ২৪ মে খায়রুল ইসলাম আলমাজীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেয়।
এসব প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৫ জুন মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় মিরপুর মিল্ক ভিটা বিক্রয়কেন্দ্রের অব্যবস্থাপনা, আর্থিক অনিয়ম/তহবিল তছরুফ, কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা, এর আগে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে প্রকৃত অবস্থার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি মো. সফিকুর রহমানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটি গত বছরের ১৭ নভেম্বর প্রতিবেদন দেয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, খায়রুল ইসলাম আলমাজী ২০০৯ সালের ১৫ জুন থেকে ২০১১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মিল্ক ভিটার পণ্য বিক্রির ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ১৭৩ টাকা আত্মসাত্ করেন। ১ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত আত্মসাত্ করেন তিন লাখ ২৫ হাজার ৯৭৪ টাকা। আর ১২ এপ্রিল পর্যন্ত পণ্যের মজুদ ঘাটতি দেখিয়ে তিনি আত্মসাত্ করেন ১৫ লাখ ৩৭০ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, খায়রুল ইসলাম আলমাজী তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। মালামাল উত্তোলন, বিক্রি ও বিক্রীত অর্থ ব্যাংকে জমা দেওয়ার দায়িত্ব এককভাবে তাঁর ওপর ছিল। তাই বিক্রীত অর্থ ও মজুদ ঘাটতি—সব মিলিয়ে ৪২ লাখ ৬৩ হাজার ৫১৭ টাকা আত্মসাতের দায় তাঁর ওপর এককভাবে বর্তায়।
এত কিছুর পরও খায়রুলের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি মিল্ক ভিটা। সূত্রমতে, মিল্ক ভিটার তখনকার জিএম নাসিম আহমেদ ডিজিএম (বিপণন) শফিকুল ইসলামকে এসব তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু কোনো মামলা হয়নি।
তবে খায়রুল ইসলাম আলমাজীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের ঘটনার অনুসন্ধান শেষে গত ২২ এপ্রিল দুদক রূপনগর থানায় মামলা করে।
জানতে চাইলে রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিকদার মো. শামীম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনই এর তদন্ত করছে। এ ক্ষেত্রে থানার পক্ষ থেকে কোনো কিছু করার এখতিয়ার নেই। থানা শুধু মামলার রেকর্ড রেখেছে।
মিল্ক ভিটার একাধিক সূত্র জানায়, তদন্তে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে এককভাবে খায়রুল ইসলাম আলমাজীকে দায়ী করা হলেও গত বছর চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। বাকিরা হলেন—তত্কালীন ব্যবস্থাপক (বিপণন) মহিউদ্দিন মিঞা, উপব্যবস্থাপক ও বিক্রয়কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম, বিপণন বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক মো. আলিমুন্নবী। এই তিনজনকেও গত এপ্রিলে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।
এই তিন ভুক্তভোগীর একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে চুরি করল এবং যারা চুরি ধরল তাদের সবাইকেই শাস্তি দেওয়া হলো। এটা কেমন বিচার?’
জানা গেছে, বরখাস্তের পর থেকে এই তিন ভুক্তভোগী কর্মকর্তার প্রতি মাসের বেতন থেকে ১৫ হাজার টাকা করে কেটে নেওয়া হচ্ছে। তাঁদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট এবং ইনসেনটিভ বোনাসও বন্ধ।
মিল্ক ভিটার মহাব্যবস্থাপক আলতাফ হোসেন বলেন, শ্রমিক আইন অনুযায়ী, তিন মাসের বেশি বরখাস্ত রাখা যায় না। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই এসব অভিযোগের বিষয়ে এগোতে হয়। এ জন্য ব্যবস্থা নিতে দেরি হচ্ছে।
তদন্তে খায়রুলকে এককভাবে দোষী বলা হলেও আরও তিনজনকে কেন শাস্তি দেওয়া হলো জানতে চাইলে আলতাফ হোসেন বলেন, পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে সাময়িকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মহাব্যবস্থাপক আলতাফ হোসেন গত বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। তাঁর নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ-নীতিমালা ও চাকরিবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। দুদক বিষয়টি তদন্ত করছে এবং ইতিমধ্যে আলতাফ হোসেনকে তলবও করেছে।

No comments

Powered by Blogger.