জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি গবেষণা by ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম
কোনো স্থানের দৈনিক বৃষ্টিপাত, উষ্ণতা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ ও চাপ, সূর্যালোক প্রভৃতির সামগ্রিক অবস্থাকে ওই স্থানের নির্দিষ্ট দিনের আবহাওয়া বলে। বৃষ্টিপাত, উষ্ণতা, আর্দ্রতা ইত্যাদি সর্বদাই পরিবর্তনশীল হওয়ায় কোনো কোনো স্থানের আবহাওয়াও পরিবর্তনশীল। কোনো এলাকার সাধারণত ৩০-৪০ বছরের গড় আবহাওয়াকে জলবায়ু বলে।
আর জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, কোনো এলাকার গড় তাপমাত্রা, চাপ, বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক ধারার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। কৃষি হচ্ছে খামারকরণ এবং বনায়নের মাধ্যমে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ উৎপাদন। প্রকৃতপক্ষে পশুপাখি পালন, মৎস্য চাষ, উপকারী পোকামাকড় (যেমন- মৌ চাষ, রেশম চাষ) ও জীবের লালন-পালনও কৃষির আওতাভুক্ত। কৃষি অনেকটাই জলবায়ুনির্ভর। কারণ পৃথিবীতে কেবল সবুজ উদ্ভিদ ক্লোরোফিল নামক সবুজ কণিকা ও বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে। সে জন্য পৃথিবীর সব জীবই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবুজ গাছপালার ওপর নির্ভরশীল। কৃষি যেমন জলবায়ুনির্ভর, তেমনি কোনো এলাকার জলবায়ুও কৃষি কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি কৃষি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মানব সভ্যতার বিকাশও ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কারণ কেবল কৃষিই মানুষের খাদ্যের জোগান দিয়ে থাকে। সরবরাহ করে শিল্পের কাঁচামাল। সুতরাং কৃষির কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক কৃষিকাজে নিয়োজিত। আমাদের জিডিপির শতকরা ২৪ ভাগ আসে কৃষি থেকে এবং প্রায়ই ৭০ ভাগ লোক কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হলে জনবহুল বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। বাধাগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের প্রতিটি ধাপের বাস্তবায়নও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে। সুতরাং আজকের আলোচ্য বিষয় অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক।
জলবায়ু পরিবর্তন : জলবায়ু পরিবর্তন এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। এ আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন ১৮৯৬ সালে সুইডিশ কেমিস্ট সেভানতে অরহেনিয়াস। তিনি বলেছিলেন, দ্রুত শিল্পবিপ্লবের লক্ষ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যাপক পোড়ানোর ফলে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে পৃথিবীকে মানুষের জন্য বিপজ্জনক করে তুলতে পারে। তিনিই প্রথম 'গ্রিনহাউস ইফেক্ট' শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রায় ৬০ বছর পর ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব অসেনোগ্রাফি, অরহেনিয়াসের দাবির সত্যতার প্রমাণ পান। তার পর থেকেই হৈচৈ শুরু হয়। গবেষণায় আজ এটা প্রমাণিত যে প্রাকৃতিক ও মানব কর্মকাণ্ডের যৌথ ক্রিয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জলবায়ুর অন্য উপাদানগুলোর তারতম্য ঘটিয়ে এক অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ধারা সৃষ্টি করেছে। এ পরিবর্তন আমাদের উন্নয়ন এমনকি অস্তিত্বের জন্যও এক বিরাট হুমকি।
জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্যনিরাপত্তা : নানা কারণে পৃথিবীর সব মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সর্বদাই এক বিশাল চ্যালেঞ্জিং বিষয় হিসেবে বিবেচিত ছিল। বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল বলেছিলেন- 'মৃত্যুর পর স্মৃতিসৌধে মর্যাদা লাভের চেয়ে বেঁচে থাকার জন্য উদরের চাহিদা পূরণে যত্নবান হওয়াকে শ্রেয়তর মনে করি।' ওল্ড টেস্টামেন্টেও ক্ষুধা যে একটি অভিশাপ তার উল্লেখ রয়েছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে- সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যনিরাপত্তা। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- পৃথিবীতে এখনো গড়ে শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ খাদ্যাভাবে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগছে। খাদ্য ও কৃষির গুরুত্ব বোঝাতে সবুজ বিপ্লবের জনক নোবেল বিজয়ী নরম্যান বোরলগ ২০০০ সালে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন- 'নিঃসন্দেহে ক্ষুধা উন্নয়ন ও শান্তির অন্যতম বাধা।' বিজ্ঞানভিত্তিক বাণিজ্যিক কৃষির ব্যাপক প্রচলন ঘটে বিংশ শতাব্দীতে। উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি চালু হওয়ার আগে কৃষিতে অন্তত চারবার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন বা বিপ্লব সংঘটিত হয়, তন্মধ্যে গত শতাব্দীতে সংঘটিত সবুজ বিপ্লব সমধিক উল্লেখযোগ্য। ডারউইন প্রকাশিত বিভিন্ন জীবের প্রজাতির মধ্যকার পার্থক্য এবং মেন্ডেল উদ্ভাবিত বংশগতি স্থানান্তর সূত্র ছিল সবুজ বিপ্লবের মূল প্রেরণা। শিল্পবিপ্লবের পর সবুজ বিপ্লবই হচ্ছে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব। দানাশস্যের ফলন বিস্ময়করভাবে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। সবুজ বিপ্লব অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের ভবিষ্যদ্বাণীকে ভুল প্রমাণিত করেছিল। সবুজ বিপ্লবের জন্য ব্যবহৃত কৃষি প্রযুক্তিগুলো অর্থাৎ উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাতের নিবিড় চাষ, অধিক হারে সিনথেটিক রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার, পানি সেচ এবং কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার নতুন উপসর্গ তথা পরিবেশদূষণ সৃষ্টি করছে। মৃত্তিকার উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করছে।
বায়োটেকনোলজি ও জিন প্রকৌশল : অধুনা জিন প্রকৌশল, কোষ ও কলা চাষাবাদবিষয়ক প্রযুক্তিকে সাধারণভাবে বায়োটেকনোলজি বা জৈবপ্রযুক্তি বিবেচনা করা হয়। তবে জাতিসংঘের বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি কনভেনশনের মতে, সুনির্দিষ্ট ব্যবহারের লক্ষ্যে যেকোনো উৎপাদন বা পরিবর্তন অথবা কোনো প্রক্রিয়া যা জৈব ব্যবস্থা, জীব অথবা এদের উদ্ভূত প্রযুক্তিকে জৈব প্রযুক্তি বলা হয়। কৃষিতে চাহিদামতো উন্নত ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ঘাত সহনশীল ফসলের জাত সৃষ্টিতে বায়োটেকনোলজি অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে চলেছে। প্রচলিত উদ্ভিদ ও প্রাণীতে সুনির্দিষ্ট কৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী যেকোনো জীবের জিনের অনুপ্রবেশ কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত জিনকে বিতাড়িত করে কাঙ্ক্ষিত জাত সৃষ্টিই আধুনিক জৈব প্রযুক্তি। জিন প্রকৌশল প্রয়োগে আধুনিক বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে আমরা কৃষিতে নিম্নলিখিত সুবিধা পেতে পারি : (১) উচ্চ ফলনশীল ফসল ও প্রাণীর জাত সৃষ্টি; (২) জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ঘাতের (খরা, লবণাক্ততা, বন্যা, ক্ষারত্ব, তাপমাত্রা, আলোক তীব্রতা ইত্যাদি) প্রতি অসংবেদনশীল বা সংবেদনশীল জাত সৃষ্টি। (৩) উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন দ্রব্যাদি উৎপাদন যেমন- (উচ্চ ভিটামিন 'এ' ও আয়রনসমৃদ্ধ, গোল্ডেন রাইস); (৪) কম রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ও কৃষি রসায়ননির্ভর নয়, এমন কাঙ্ক্ষিত জাত সৃষ্টি, যা পরিবেশদূষণ হ্রাস করবে; (৫) নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন রাসায়নিক দ্রব্যাদি (যেমন- অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ইত্যাদি) উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন; (৬) দূষিত পরিবেশ (যেমন- ভূমি, জলাশয়, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা) পুনরুদ্ধারে সক্ষম অণুজীবের সৃষ্টি এবং এদের প্রয়োগ। 'একুশ শতকে সবুজ বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় খাদ্য উৎপাদনে আরেকটি বিপ্লব তথা 'নীল বিপ্লব' প্রয়োজন। নতুন জ্ঞাননির্ভর বায়োটেকনোলজি অবশ্যই এ নতুন পথের সন্ধান দেবে। একবিংশ শতাব্দীতে পানির দুষপ্রাপ্যতা বিবেচনায় আমাদের প্রতি বিন্দুতে অধিক দানা (more crop per drop) বিশিষ্ট ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে হবে।
প্রয়োজন সমস্যাভিত্তিক কৃষি গবেষণা : দেশে গত ২০ বছরে কৃষিজমি কমেছে ৫০ লাখ একর। অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে প্রতিদিন গড়ে ২২০ একর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। বেশির ভাগ নদ-নদী নাব্যতা হারিয়েছে এবং ভূগর্ভস্থ পানিতল ক্রমেই নিচে নামছে। কৃষিজমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পোলট্রি, লাইভস্টক এবং মৎস্য চাষে অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ও বৃদ্ধিকারকের যথেচ্ছ ব্যবহার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলছে। লবণাক্ততা ও আর্সেনিক বিষাক্ততা জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমাচ্ছে। বর্তমান প্রচলিত প্রযুক্তির প্রয়োগে দানাশস্যের ফলনও স্থিতিশীলভাবে বাড়ছে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে আমাদের চাই নতুন প্রযুক্তি, যা পরিবেশবান্ধব এবং অনেক দক্ষ। এটি খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য চাই জ্ঞাননির্ভর ও টেকসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন। প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা, যেন সমস্যাভিত্তিক ধারাবাহিক গবেষণায় কৃষিতে প্রযুক্তিগত ও জ্ঞানের নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন হয়। শুধু ধানের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে শস্যচাষে বৈচিত্র্য আনা, পরিবেশ ও জমির উর্বরতা সংরক্ষণ করতে পারলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি অনেকটা এড়ানো সম্ভব হবে। একই সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভ্যাসেও বৈচিত্র্য আনা জরুরি। নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে চাই বিশ্বমানের মৌলিক ও ফলিত গবেষণা। আমাদের দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি বিশ্বমানের মৌলিক গবেষণার ধারা আজও খুব একটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর প্রধান কারণ গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও অবকাঠামোর অপ্রতুলতা। ক্রমহ্রাসমান কৃষি ভূমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য জোগানের জন্য আনুভূমিক কৃষির পরিবর্তে উল্লম্ব কৃষি অ্যাপ্রোচ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বায়োটেকনোলজি ও জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে বালাই, খরা, লবণাক্ততা, পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত অন্যান্য ঘাত সহনশীল, উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন ও কম উৎপাদন খরচবিশিষ্ট উচ্চ ফলনশীল জাত উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। নিবিড়ভাবে একক শস্যজাত বা প্রজাতির চাষ জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করছে। ফলে স্থানীয় জাতগুলো ক্রমে বিলুপ্ত হচ্ছে।
সম্পদের সুষম বণ্টন প্রয়োজন : যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি বলেছিলেন- 'মানব সভ্যতা অদ্যাবধি যত সমস্যা মোকাবিলা করেছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাটি হলো তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক।' জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি কমানোর জন্য চাই গতানুগতিক ধারার জীবনব্যবস্থায় যথাযথ পরিবর্তন। নরমেন বোরলগ তাঁর নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন- 'পরিবর্তন আমাদের আবশ্যক, অন্যথায় আমরা প্রজাতি হিসেবে ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হবো।' জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি কাটিয়ে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। তবে যেকোনো পরিবর্তনের জন্য চাই সরকার, রাজনীতিবিদ, জনগণ, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও গণমাধ্যমসহ সবার একযোগে পরিকল্পিত ও সতত প্রচেষ্টা। খাদ্যনিরাপত্তায় সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয় হচ্ছে ধনী দেশগুলোর অতিরিক্ত ভোগের মানসিকতা। প্রকৃতপক্ষে জলবায়ুর পরিবর্তন সত্ত্বেও পৃথিবীতে উৎপাদিত সর্বমোট খাদ্য দিয়ে জনগণকে খাদ্যনিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানী বোরলগ বলেছিলেন- দারিদ্র্য হচ্ছে সমতার ভিত্তিতে খাদ্য বণ্টনের অভাবের ফল, যা দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে আরো প্রকট হয়ে থাকে। সবশেষে মহাত্মা গান্ধীর একটি উক্তি স্মরণ করে প্রবন্ধের সমাপ্তি টানছি। মহাত্মা গান্ধী বলেন, এ পৃথিবী প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই সন্তোষজনকভাবে সরবরাহ করতে সক্ষম, কিন্তু প্রতিটি মানুষের লালসা চরিতার্থ করতে সক্ষম নয়।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বায়োটেকনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
জলবায়ু পরিবর্তন : জলবায়ু পরিবর্তন এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। এ আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন ১৮৯৬ সালে সুইডিশ কেমিস্ট সেভানতে অরহেনিয়াস। তিনি বলেছিলেন, দ্রুত শিল্পবিপ্লবের লক্ষ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যাপক পোড়ানোর ফলে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে পৃথিবীকে মানুষের জন্য বিপজ্জনক করে তুলতে পারে। তিনিই প্রথম 'গ্রিনহাউস ইফেক্ট' শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রায় ৬০ বছর পর ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব অসেনোগ্রাফি, অরহেনিয়াসের দাবির সত্যতার প্রমাণ পান। তার পর থেকেই হৈচৈ শুরু হয়। গবেষণায় আজ এটা প্রমাণিত যে প্রাকৃতিক ও মানব কর্মকাণ্ডের যৌথ ক্রিয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জলবায়ুর অন্য উপাদানগুলোর তারতম্য ঘটিয়ে এক অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ধারা সৃষ্টি করেছে। এ পরিবর্তন আমাদের উন্নয়ন এমনকি অস্তিত্বের জন্যও এক বিরাট হুমকি।
জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্যনিরাপত্তা : নানা কারণে পৃথিবীর সব মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সর্বদাই এক বিশাল চ্যালেঞ্জিং বিষয় হিসেবে বিবেচিত ছিল। বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল বলেছিলেন- 'মৃত্যুর পর স্মৃতিসৌধে মর্যাদা লাভের চেয়ে বেঁচে থাকার জন্য উদরের চাহিদা পূরণে যত্নবান হওয়াকে শ্রেয়তর মনে করি।' ওল্ড টেস্টামেন্টেও ক্ষুধা যে একটি অভিশাপ তার উল্লেখ রয়েছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে- সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যনিরাপত্তা। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- পৃথিবীতে এখনো গড়ে শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ খাদ্যাভাবে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগছে। খাদ্য ও কৃষির গুরুত্ব বোঝাতে সবুজ বিপ্লবের জনক নোবেল বিজয়ী নরম্যান বোরলগ ২০০০ সালে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন- 'নিঃসন্দেহে ক্ষুধা উন্নয়ন ও শান্তির অন্যতম বাধা।' বিজ্ঞানভিত্তিক বাণিজ্যিক কৃষির ব্যাপক প্রচলন ঘটে বিংশ শতাব্দীতে। উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি চালু হওয়ার আগে কৃষিতে অন্তত চারবার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন বা বিপ্লব সংঘটিত হয়, তন্মধ্যে গত শতাব্দীতে সংঘটিত সবুজ বিপ্লব সমধিক উল্লেখযোগ্য। ডারউইন প্রকাশিত বিভিন্ন জীবের প্রজাতির মধ্যকার পার্থক্য এবং মেন্ডেল উদ্ভাবিত বংশগতি স্থানান্তর সূত্র ছিল সবুজ বিপ্লবের মূল প্রেরণা। শিল্পবিপ্লবের পর সবুজ বিপ্লবই হচ্ছে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব। দানাশস্যের ফলন বিস্ময়করভাবে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। সবুজ বিপ্লব অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের ভবিষ্যদ্বাণীকে ভুল প্রমাণিত করেছিল। সবুজ বিপ্লবের জন্য ব্যবহৃত কৃষি প্রযুক্তিগুলো অর্থাৎ উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাতের নিবিড় চাষ, অধিক হারে সিনথেটিক রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার, পানি সেচ এবং কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার নতুন উপসর্গ তথা পরিবেশদূষণ সৃষ্টি করছে। মৃত্তিকার উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করছে।
বায়োটেকনোলজি ও জিন প্রকৌশল : অধুনা জিন প্রকৌশল, কোষ ও কলা চাষাবাদবিষয়ক প্রযুক্তিকে সাধারণভাবে বায়োটেকনোলজি বা জৈবপ্রযুক্তি বিবেচনা করা হয়। তবে জাতিসংঘের বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি কনভেনশনের মতে, সুনির্দিষ্ট ব্যবহারের লক্ষ্যে যেকোনো উৎপাদন বা পরিবর্তন অথবা কোনো প্রক্রিয়া যা জৈব ব্যবস্থা, জীব অথবা এদের উদ্ভূত প্রযুক্তিকে জৈব প্রযুক্তি বলা হয়। কৃষিতে চাহিদামতো উন্নত ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ঘাত সহনশীল ফসলের জাত সৃষ্টিতে বায়োটেকনোলজি অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে চলেছে। প্রচলিত উদ্ভিদ ও প্রাণীতে সুনির্দিষ্ট কৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী যেকোনো জীবের জিনের অনুপ্রবেশ কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত জিনকে বিতাড়িত করে কাঙ্ক্ষিত জাত সৃষ্টিই আধুনিক জৈব প্রযুক্তি। জিন প্রকৌশল প্রয়োগে আধুনিক বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে আমরা কৃষিতে নিম্নলিখিত সুবিধা পেতে পারি : (১) উচ্চ ফলনশীল ফসল ও প্রাণীর জাত সৃষ্টি; (২) জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ঘাতের (খরা, লবণাক্ততা, বন্যা, ক্ষারত্ব, তাপমাত্রা, আলোক তীব্রতা ইত্যাদি) প্রতি অসংবেদনশীল বা সংবেদনশীল জাত সৃষ্টি। (৩) উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন দ্রব্যাদি উৎপাদন যেমন- (উচ্চ ভিটামিন 'এ' ও আয়রনসমৃদ্ধ, গোল্ডেন রাইস); (৪) কম রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ও কৃষি রসায়ননির্ভর নয়, এমন কাঙ্ক্ষিত জাত সৃষ্টি, যা পরিবেশদূষণ হ্রাস করবে; (৫) নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন রাসায়নিক দ্রব্যাদি (যেমন- অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ইত্যাদি) উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন; (৬) দূষিত পরিবেশ (যেমন- ভূমি, জলাশয়, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা) পুনরুদ্ধারে সক্ষম অণুজীবের সৃষ্টি এবং এদের প্রয়োগ। 'একুশ শতকে সবুজ বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় খাদ্য উৎপাদনে আরেকটি বিপ্লব তথা 'নীল বিপ্লব' প্রয়োজন। নতুন জ্ঞাননির্ভর বায়োটেকনোলজি অবশ্যই এ নতুন পথের সন্ধান দেবে। একবিংশ শতাব্দীতে পানির দুষপ্রাপ্যতা বিবেচনায় আমাদের প্রতি বিন্দুতে অধিক দানা (more crop per drop) বিশিষ্ট ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে হবে।
প্রয়োজন সমস্যাভিত্তিক কৃষি গবেষণা : দেশে গত ২০ বছরে কৃষিজমি কমেছে ৫০ লাখ একর। অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে প্রতিদিন গড়ে ২২০ একর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। বেশির ভাগ নদ-নদী নাব্যতা হারিয়েছে এবং ভূগর্ভস্থ পানিতল ক্রমেই নিচে নামছে। কৃষিজমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পোলট্রি, লাইভস্টক এবং মৎস্য চাষে অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ও বৃদ্ধিকারকের যথেচ্ছ ব্যবহার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলছে। লবণাক্ততা ও আর্সেনিক বিষাক্ততা জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমাচ্ছে। বর্তমান প্রচলিত প্রযুক্তির প্রয়োগে দানাশস্যের ফলনও স্থিতিশীলভাবে বাড়ছে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে আমাদের চাই নতুন প্রযুক্তি, যা পরিবেশবান্ধব এবং অনেক দক্ষ। এটি খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য চাই জ্ঞাননির্ভর ও টেকসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন। প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা, যেন সমস্যাভিত্তিক ধারাবাহিক গবেষণায় কৃষিতে প্রযুক্তিগত ও জ্ঞানের নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন হয়। শুধু ধানের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে শস্যচাষে বৈচিত্র্য আনা, পরিবেশ ও জমির উর্বরতা সংরক্ষণ করতে পারলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি অনেকটা এড়ানো সম্ভব হবে। একই সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভ্যাসেও বৈচিত্র্য আনা জরুরি। নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে চাই বিশ্বমানের মৌলিক ও ফলিত গবেষণা। আমাদের দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি বিশ্বমানের মৌলিক গবেষণার ধারা আজও খুব একটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর প্রধান কারণ গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও অবকাঠামোর অপ্রতুলতা। ক্রমহ্রাসমান কৃষি ভূমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য জোগানের জন্য আনুভূমিক কৃষির পরিবর্তে উল্লম্ব কৃষি অ্যাপ্রোচ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বায়োটেকনোলজি ও জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে বালাই, খরা, লবণাক্ততা, পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত অন্যান্য ঘাত সহনশীল, উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন ও কম উৎপাদন খরচবিশিষ্ট উচ্চ ফলনশীল জাত উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। নিবিড়ভাবে একক শস্যজাত বা প্রজাতির চাষ জীববৈচিত্র্যকে বিপন্ন করছে। ফলে স্থানীয় জাতগুলো ক্রমে বিলুপ্ত হচ্ছে।
সম্পদের সুষম বণ্টন প্রয়োজন : যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি বলেছিলেন- 'মানব সভ্যতা অদ্যাবধি যত সমস্যা মোকাবিলা করেছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাটি হলো তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক।' জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি কমানোর জন্য চাই গতানুগতিক ধারার জীবনব্যবস্থায় যথাযথ পরিবর্তন। নরমেন বোরলগ তাঁর নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন- 'পরিবর্তন আমাদের আবশ্যক, অন্যথায় আমরা প্রজাতি হিসেবে ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হবো।' জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি কাটিয়ে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। তবে যেকোনো পরিবর্তনের জন্য চাই সরকার, রাজনীতিবিদ, জনগণ, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও গণমাধ্যমসহ সবার একযোগে পরিকল্পিত ও সতত প্রচেষ্টা। খাদ্যনিরাপত্তায় সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয় হচ্ছে ধনী দেশগুলোর অতিরিক্ত ভোগের মানসিকতা। প্রকৃতপক্ষে জলবায়ুর পরিবর্তন সত্ত্বেও পৃথিবীতে উৎপাদিত সর্বমোট খাদ্য দিয়ে জনগণকে খাদ্যনিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানী বোরলগ বলেছিলেন- দারিদ্র্য হচ্ছে সমতার ভিত্তিতে খাদ্য বণ্টনের অভাবের ফল, যা দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে আরো প্রকট হয়ে থাকে। সবশেষে মহাত্মা গান্ধীর একটি উক্তি স্মরণ করে প্রবন্ধের সমাপ্তি টানছি। মহাত্মা গান্ধী বলেন, এ পৃথিবী প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই সন্তোষজনকভাবে সরবরাহ করতে সক্ষম, কিন্তু প্রতিটি মানুষের লালসা চরিতার্থ করতে সক্ষম নয়।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বায়োটেকনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
No comments