সাদাকালো-বাজারদর, সিন্ডিকেট ও সয়াবিন কথা by আহমদ রফিক
বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যদ্রব্যের বিকল্প নেই। সে জন্যই বোধকরি এগুলোকে বলা হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় পণ,্য যা বাজার থেকে নিয়মিত কিনতে হয়। যেমন- চাল, ডাল, তেল, নুন, সবজি ইত্যাদি। হয়তো তাই নিত্যদরকারি পণ্যের বাজারদর নিয়ে ব্যবসায়ীদের এত কারসাজি। বাজারদরে ওঠানামা না বলে ওঠা বলাই সংগত।
জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়লে বাড়ে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। পত্রপত্রিকাগুলোতে শুরু হয় লেখালেখি- বাজারদরের খবরাদি নিয়ে কিংবা ব্যবসায়ী কারসাজির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।
এতে সাংবাদিকতার দায় মেটে, মেটে সমাজের দায়িত্ববান লেখককুলের; কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। নিত্যদিনের বাজারদর এতটা গুরুত্বের বলেই বোধ হয় রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এর নিয়ন্ত্রণের কথা বলে, প্রতিশ্রুতি দেয়- যাতে মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে নাজেহাল হতে না হয়। কিন্তু কার্যত দেখা যায়, সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবে সুফল দেয় না।
ব্যবসায়ীদের মুনাফাবৃত্তির কারসাজি এমনই যে তারা একেক সময় একেকটি পণ্যের ওপর বাজি ধরে এবং তারা বাজিতে জেতে। আর রাজনৈতিক আবহাওয়া যদি অনুকূল থাকে, তাহলে তো কথাই নেই- একাধিক পণ্যের দাম রেসের ঘোড়ার মতো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ছুটতে থাকে। কয়েকজনে মিলে এমন কায়দায় বাজারদর হাতের মুঠোয় ধরে রাখে যে কখনো কখনো সরকার অসহায় তাদের দাপটের কাছে।
দেড়-দুই বছর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের ডেকে বৈঠক করে বিশেষ একটি পণ্যের যুক্তিহীন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে চড়া সুরে কথা বলার ফল দাঁড়াল যে ওই দ্রব্যের মূল্য নাগালের বাইরে চলে গেল। পরে বাধ্য হয়ে তাঁকে সুর নরম করে কথা বলতে হলো। কিন্তু তাতে ভোক্তাদের যে খুব একটা সুবিধা হলো, তা নয়।
পরবর্তী বাণিজ্যমন্ত্রী আর ওই পথে হাঁটেননি। ফলে বাজারদরের দড়িটা ব্যবসায়ীদের বা 'সিন্ডিকেট'- যা-ই বলি না কেন, তাদের হাতেই ধরা আছে। তাদের যখন যেমন মর্জি, সে অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। ক্রেতারা তাদের ইচ্ছার কাছে জিম্মি। পাঁচ টাকার জিনিস সাত টাকায়, কখনো সাতের বদলে ১০ টাকায় কিনতে হয়। মানুষ ঘরে-বাইরে অর্থাৎ ঘরে-বাজারে তেতো-গলায় চেঁচামেচি করে, তারপর ঠাণ্ডা মেরে ওই চড়া দামে খাদ্যপণ্য কিনে গজগজ করে চরম বিরক্তি নিয়ে ঘরে ফেরে।
তাদের অসন্তোষ সরকারের বিরুদ্ধে। কারণ সরকারের দায় বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু তারা বাস্তবেই পারে না, না নেপথ্য যোগাযোগের কারণে করে না- তা বোঝা কঠিন। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সংসদে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের প্রাধান্য- তা যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। বিষয়টা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। আছে শিক্ষিত মননশীলদের মধ্যে- তা তারা সুশীল সমাজই হোন বা না হোন।
নিত্যদিনের কেনাকাটার জরুরি জিনিসের বাজারদরের এই যে ঊর্ধ্বগতি, তা-ই নিয়ে এতটা ভূমিকার কারণ, আমিও ওই বাজারযাত্রীদের একজন। মূল্যবৃদ্ধির আগুনে-তাপের আঁচ আমার গায়েও লাগে, যেমন লাগে আর পাঁচজন সাদামাটা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বা সাধারণ মানুষের গায়ে। হয়তো তাই দৈনিক পত্রগুলোতে বাজারদরের ঊর্ধ্বগতি, এর নেপথ্য কারণ ইত্যাদি নিয়ে এত লেখালেখি- যদিও এর ফলাফল শূন্য।
মাস কয়েক আগে সয়াবিন তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিক মহলের প্রতিবেদনে এর ব্যাখ্যা-বিচার শুরু হয়। একটিতে শিরোনাম : 'ভোজ্য তেলের দাম বাড়ার পেছনে ৫ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী'। তারপর শল্যচেরা বিশ্লেষণ মিল, পরিবেশক, পাইকারি ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্বভোগী, পণ্য সরবরাহ-নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়ে এবং যথারীতি দর বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীকুলের অসাধু তৎপরতার ধারাবাহিক বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আরেকটি নামি কাগজের সম্পাদকীয়তে লেখা হলো- 'সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধি'/'কারসাজি রোধে ব্যবস্থা নিন'। কে নেবেন ব্যবস্থা? অবশ্যই সরকার অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এখানে বলা হয়েছে বাজারের ওপর তীক্ষ্ন নজরদারির কথা। হিসাব কষে দেখিয়ে দেওয়া হলো যে ওই মূল্যবৃদ্ধির যুক্তিসংগত কারণ নেই। চাহিদা-সরবরাহ, বাজার অর্থনীতির নিয়ম ইত্যাদি উল্লেখ করে অসৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ এলো সম্পাদকীয় কলামে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমছে অথচ কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের বাজারে এর দাম বাড়ছে।
সত্যই বড় বিচিত্র এ বাংলাদেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের বাজার। এখানে দ্রব্যমূল্য ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। তাই তাদের ইচ্ছার টানে বাজারদরের স্থিতি বা ঊর্ধ্বগতি। আর একটি কাগজে এ বিষয়ে জনমত জরিপ। সবারই এককথা- 'সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সরকারি তদারকি বাড়াতে হবে'। কারো মতে, এ বিষয়ে 'সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, উচ্চপর্যায়ের বাজার মনিটরিং সেল গঠন ও মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দমন করতে হবে' ইত্যাদি সুপরামর্শ।
কিন্তু কে কান দেয় এসব সুপরামর্শে কিংবা লেখালেখির বক্তব্যে? কান দেওয়ার মতো অবস্থাই হয়তো নেই। কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকুলই তো রাজনৈতিক অঙ্গনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের অস্বাভাবিক স্বার্থের বাইরে যাওয়া কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব নয় বলে দেশে উৎপাদিত পণ্যও নিয়ন্ত্রণের আওতায় নেই। প্রান্তিক চাষি ন্যায্য দর পাচ্ছেন না, অন্যদিকে অব্যবস্থাপনা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের চাপে রাজধানী বা নগর-বন্দরের সাধারণ মানুষকে ওই সস্তা মূল্যে বিক্রির জিনিসই অস্বাভাবিক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
যথাযথ ব্যবস্থাপনা উচ্চদরের অস্বাভাবিকতা কিছুটা হলেও দূর করতে পারত। কেউ কেউ বলেন বা লেখেন টিসিবিকে সক্রিয় করে তোলার কথা। কিন্তু টিসিবির একদা কর্মকাণ্ড নিয়ে এ দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা খুব একটা মধুর নয়। তাহলে সমস্যা সমাধানের উপায় কী। টিসিবিকে ঢেলে সাজানো? কিন্তু শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তার আগাপাছতলা ঝাড়ফুঁক করা দরকার। কিন্তু সে ক্ষমতা কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আছে?
থাকলে বাজারগুলোতে লাগাতার চাঁদাবাজি বন্ধ করা যেত। যেত ঘাট থেকে বাঁকে বাঁকে চাঁদাবাজির অশুভ তৎপরতা রোধ করা। খাদ্যদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, বাজার নিয়ন্ত্রণ আইন ইত্যাদি কোনো দিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বা সুফল দেখা যায় না। ভোক্তা সুবিধা আইন, মূল্য নির্ধারণ আইনের তৎপরতা ভোক্তাসাধারণের স্বার্থনিভর নয়। কোনো ক্ষেত্রে আইনই নেই।
এককথায়, বাজার ব্যবস্থাপনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। আছে শুধু প্রতিশ্রুতি ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সমাধান দূরস্থ। বেরিয়ে আসতে হলে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে, তা যে উপায়েই হোক। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে দেশের সর্বত্র বিক্রয়কেন্দ্র সচল করা খুব দুরূহ কাজ- সন্দেহ নেই। সে ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা দরকার।
বাজার নিয়ে সাধারণ বিবেচনা ছেড়ে ফের সয়াবিন প্রসঙ্গে এলে দেখা যাবে, কয়েক মাস আগে সয়াবিন তেলের বাজারমূল্যকে যে ভূতে পেয়েছিল, এখনো সেই প্রভাবই বিরাজ করছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও সয়াবিন তেলের দাম কমা সত্ত্বেও আমাদের বাজারে তার দাম স্থিতিশীল থাকছে না। বরং দাম লাগাতার বেড়েই চলেছে। সেই কবে পাঁচ লিটার তেলের ক্যান চার শ-সাড়ে চার শ টাকা হারে বিক্রি হয়েছে, এরপর পাঁচ-সাড়ে পাঁচ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ছয়-সাড়ে ছয় শ টাকায় পৌঁছে গেছে। এর সঙ্গে বৈশ্বিক দরের মিল নেই।
ভবিষ্যৎ সময়ে নিঃসন্দেহে এ মূল্যমানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদেরও অর্থনৈতিক মেদবৃদ্ধি দেখা দেবে, আর বাড়তে থাকবে সাধারণ মানুষের বাজারদর নিয়ে হাহাকার, ক্ষোভ ও ক্রোধ। দিন কয়েক আগেকার এক খবরে প্রকাশ, ভোজ্য তেলের মূল্য নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আগের মতো কঠোর অবস্থানে নেই। ব্যবসায়ীদের প্রতি তারা যথেষ্ট নমনীয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমার বাস্তবতার নিরিখে ট্যারিফ কমিশনের মূল্য নির্ধারক প্রতিবেদন সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় মূল্যহ্রাসের উদ্যোগ নেয়নি। বরং বলা হয়েছে, রমজান মাস সামনে রেখে বর্তমান দামেই বিক্রি চলবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে রমজানে আরো অনেক পণ্যের মতো সয়াবিন তেলের দামও বাড়বে। বলতে হয় : হায় সয়াবিন! তবে সয়াবিন তেল একটি উদাহরণ মাত্র। ব্যবসায়ীকুলের মর্জিমাফিক সব পণ্যেরই দাম বাড়ে। রমজান একটা উপলক্ষ মাত্র। এক রমজান থেকে পরবর্তী রমজান- এভাবেই চলতে থাকে বাংলাদেশের বাজারদরের শ্রীবৃদ্ধি আর সাধারণ মানুষের আর্তি। সরকার যতক্ষণ দর্শক, ততক্ষণ এ ট্র্যাডিশন বন্ধ হওয়ার নয়। কিন্তু সরকারকেই ব্যবস্থাপনার হাল ধরতে হবে মানুষের সমর্থন পেতে হলে।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক
এতে সাংবাদিকতার দায় মেটে, মেটে সমাজের দায়িত্ববান লেখককুলের; কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। নিত্যদিনের বাজারদর এতটা গুরুত্বের বলেই বোধ হয় রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এর নিয়ন্ত্রণের কথা বলে, প্রতিশ্রুতি দেয়- যাতে মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে নাজেহাল হতে না হয়। কিন্তু কার্যত দেখা যায়, সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবে সুফল দেয় না।
ব্যবসায়ীদের মুনাফাবৃত্তির কারসাজি এমনই যে তারা একেক সময় একেকটি পণ্যের ওপর বাজি ধরে এবং তারা বাজিতে জেতে। আর রাজনৈতিক আবহাওয়া যদি অনুকূল থাকে, তাহলে তো কথাই নেই- একাধিক পণ্যের দাম রেসের ঘোড়ার মতো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ছুটতে থাকে। কয়েকজনে মিলে এমন কায়দায় বাজারদর হাতের মুঠোয় ধরে রাখে যে কখনো কখনো সরকার অসহায় তাদের দাপটের কাছে।
দেড়-দুই বছর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের ডেকে বৈঠক করে বিশেষ একটি পণ্যের যুক্তিহীন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে চড়া সুরে কথা বলার ফল দাঁড়াল যে ওই দ্রব্যের মূল্য নাগালের বাইরে চলে গেল। পরে বাধ্য হয়ে তাঁকে সুর নরম করে কথা বলতে হলো। কিন্তু তাতে ভোক্তাদের যে খুব একটা সুবিধা হলো, তা নয়।
পরবর্তী বাণিজ্যমন্ত্রী আর ওই পথে হাঁটেননি। ফলে বাজারদরের দড়িটা ব্যবসায়ীদের বা 'সিন্ডিকেট'- যা-ই বলি না কেন, তাদের হাতেই ধরা আছে। তাদের যখন যেমন মর্জি, সে অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। ক্রেতারা তাদের ইচ্ছার কাছে জিম্মি। পাঁচ টাকার জিনিস সাত টাকায়, কখনো সাতের বদলে ১০ টাকায় কিনতে হয়। মানুষ ঘরে-বাইরে অর্থাৎ ঘরে-বাজারে তেতো-গলায় চেঁচামেচি করে, তারপর ঠাণ্ডা মেরে ওই চড়া দামে খাদ্যপণ্য কিনে গজগজ করে চরম বিরক্তি নিয়ে ঘরে ফেরে।
তাদের অসন্তোষ সরকারের বিরুদ্ধে। কারণ সরকারের দায় বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু তারা বাস্তবেই পারে না, না নেপথ্য যোগাযোগের কারণে করে না- তা বোঝা কঠিন। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সংসদে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের প্রাধান্য- তা যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। বিষয়টা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। আছে শিক্ষিত মননশীলদের মধ্যে- তা তারা সুশীল সমাজই হোন বা না হোন।
নিত্যদিনের কেনাকাটার জরুরি জিনিসের বাজারদরের এই যে ঊর্ধ্বগতি, তা-ই নিয়ে এতটা ভূমিকার কারণ, আমিও ওই বাজারযাত্রীদের একজন। মূল্যবৃদ্ধির আগুনে-তাপের আঁচ আমার গায়েও লাগে, যেমন লাগে আর পাঁচজন সাদামাটা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বা সাধারণ মানুষের গায়ে। হয়তো তাই দৈনিক পত্রগুলোতে বাজারদরের ঊর্ধ্বগতি, এর নেপথ্য কারণ ইত্যাদি নিয়ে এত লেখালেখি- যদিও এর ফলাফল শূন্য।
মাস কয়েক আগে সয়াবিন তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিক মহলের প্রতিবেদনে এর ব্যাখ্যা-বিচার শুরু হয়। একটিতে শিরোনাম : 'ভোজ্য তেলের দাম বাড়ার পেছনে ৫ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী'। তারপর শল্যচেরা বিশ্লেষণ মিল, পরিবেশক, পাইকারি ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্বভোগী, পণ্য সরবরাহ-নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়ে এবং যথারীতি দর বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীকুলের অসাধু তৎপরতার ধারাবাহিক বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আরেকটি নামি কাগজের সম্পাদকীয়তে লেখা হলো- 'সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধি'/'কারসাজি রোধে ব্যবস্থা নিন'। কে নেবেন ব্যবস্থা? অবশ্যই সরকার অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এখানে বলা হয়েছে বাজারের ওপর তীক্ষ্ন নজরদারির কথা। হিসাব কষে দেখিয়ে দেওয়া হলো যে ওই মূল্যবৃদ্ধির যুক্তিসংগত কারণ নেই। চাহিদা-সরবরাহ, বাজার অর্থনীতির নিয়ম ইত্যাদি উল্লেখ করে অসৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ এলো সম্পাদকীয় কলামে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমছে অথচ কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের বাজারে এর দাম বাড়ছে।
সত্যই বড় বিচিত্র এ বাংলাদেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের বাজার। এখানে দ্রব্যমূল্য ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। তাই তাদের ইচ্ছার টানে বাজারদরের স্থিতি বা ঊর্ধ্বগতি। আর একটি কাগজে এ বিষয়ে জনমত জরিপ। সবারই এককথা- 'সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সরকারি তদারকি বাড়াতে হবে'। কারো মতে, এ বিষয়ে 'সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, উচ্চপর্যায়ের বাজার মনিটরিং সেল গঠন ও মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দমন করতে হবে' ইত্যাদি সুপরামর্শ।
কিন্তু কে কান দেয় এসব সুপরামর্শে কিংবা লেখালেখির বক্তব্যে? কান দেওয়ার মতো অবস্থাই হয়তো নেই। কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকুলই তো রাজনৈতিক অঙ্গনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের অস্বাভাবিক স্বার্থের বাইরে যাওয়া কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব নয় বলে দেশে উৎপাদিত পণ্যও নিয়ন্ত্রণের আওতায় নেই। প্রান্তিক চাষি ন্যায্য দর পাচ্ছেন না, অন্যদিকে অব্যবস্থাপনা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের চাপে রাজধানী বা নগর-বন্দরের সাধারণ মানুষকে ওই সস্তা মূল্যে বিক্রির জিনিসই অস্বাভাবিক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
যথাযথ ব্যবস্থাপনা উচ্চদরের অস্বাভাবিকতা কিছুটা হলেও দূর করতে পারত। কেউ কেউ বলেন বা লেখেন টিসিবিকে সক্রিয় করে তোলার কথা। কিন্তু টিসিবির একদা কর্মকাণ্ড নিয়ে এ দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা খুব একটা মধুর নয়। তাহলে সমস্যা সমাধানের উপায় কী। টিসিবিকে ঢেলে সাজানো? কিন্তু শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তার আগাপাছতলা ঝাড়ফুঁক করা দরকার। কিন্তু সে ক্ষমতা কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আছে?
থাকলে বাজারগুলোতে লাগাতার চাঁদাবাজি বন্ধ করা যেত। যেত ঘাট থেকে বাঁকে বাঁকে চাঁদাবাজির অশুভ তৎপরতা রোধ করা। খাদ্যদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, বাজার নিয়ন্ত্রণ আইন ইত্যাদি কোনো দিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বা সুফল দেখা যায় না। ভোক্তা সুবিধা আইন, মূল্য নির্ধারণ আইনের তৎপরতা ভোক্তাসাধারণের স্বার্থনিভর নয়। কোনো ক্ষেত্রে আইনই নেই।
এককথায়, বাজার ব্যবস্থাপনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। আছে শুধু প্রতিশ্রুতি ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সমাধান দূরস্থ। বেরিয়ে আসতে হলে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে, তা যে উপায়েই হোক। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে দেশের সর্বত্র বিক্রয়কেন্দ্র সচল করা খুব দুরূহ কাজ- সন্দেহ নেই। সে ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা দরকার।
বাজার নিয়ে সাধারণ বিবেচনা ছেড়ে ফের সয়াবিন প্রসঙ্গে এলে দেখা যাবে, কয়েক মাস আগে সয়াবিন তেলের বাজারমূল্যকে যে ভূতে পেয়েছিল, এখনো সেই প্রভাবই বিরাজ করছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে আবারও সয়াবিন তেলের দাম কমা সত্ত্বেও আমাদের বাজারে তার দাম স্থিতিশীল থাকছে না। বরং দাম লাগাতার বেড়েই চলেছে। সেই কবে পাঁচ লিটার তেলের ক্যান চার শ-সাড়ে চার শ টাকা হারে বিক্রি হয়েছে, এরপর পাঁচ-সাড়ে পাঁচ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ছয়-সাড়ে ছয় শ টাকায় পৌঁছে গেছে। এর সঙ্গে বৈশ্বিক দরের মিল নেই।
ভবিষ্যৎ সময়ে নিঃসন্দেহে এ মূল্যমানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদেরও অর্থনৈতিক মেদবৃদ্ধি দেখা দেবে, আর বাড়তে থাকবে সাধারণ মানুষের বাজারদর নিয়ে হাহাকার, ক্ষোভ ও ক্রোধ। দিন কয়েক আগেকার এক খবরে প্রকাশ, ভোজ্য তেলের মূল্য নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আগের মতো কঠোর অবস্থানে নেই। ব্যবসায়ীদের প্রতি তারা যথেষ্ট নমনীয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমার বাস্তবতার নিরিখে ট্যারিফ কমিশনের মূল্য নির্ধারক প্রতিবেদন সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় মূল্যহ্রাসের উদ্যোগ নেয়নি। বরং বলা হয়েছে, রমজান মাস সামনে রেখে বর্তমান দামেই বিক্রি চলবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে রমজানে আরো অনেক পণ্যের মতো সয়াবিন তেলের দামও বাড়বে। বলতে হয় : হায় সয়াবিন! তবে সয়াবিন তেল একটি উদাহরণ মাত্র। ব্যবসায়ীকুলের মর্জিমাফিক সব পণ্যেরই দাম বাড়ে। রমজান একটা উপলক্ষ মাত্র। এক রমজান থেকে পরবর্তী রমজান- এভাবেই চলতে থাকে বাংলাদেশের বাজারদরের শ্রীবৃদ্ধি আর সাধারণ মানুষের আর্তি। সরকার যতক্ষণ দর্শক, ততক্ষণ এ ট্র্যাডিশন বন্ধ হওয়ার নয়। কিন্তু সরকারকেই ব্যবস্থাপনার হাল ধরতে হবে মানুষের সমর্থন পেতে হলে।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসৈনিক
No comments