মুঠোফোনে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক বন্ধন
অবাধ ও সহজ যোগাযোগের মাধ্যম মুঠোফোনকে মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নষ্ট করার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা বলেছেন, মুঠোফোনের কারণে অবসর সময়টুকু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে না কাটিয়ে ফোনে কথা বলছেন অনেকেই। যা পারিবারিক অসন্তোষ সৃষ্টিরও কারণ হয়ে উঠছে।
“মুঠোফোনের অযৌক্তিক ব্যবহার তরুণ তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা, যৌন হয়রানিসহ সামাজিক অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি করছে। সব বয়সের মানুষের হাতে মুঠোফোন থাকায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যবান সময় কেড়ে নিচ্ছে মুঠোফোন কোম্পানিগুলোর রাতজাগা অফার”, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন একথা বলেন।
তিনি বলেন, “সহজলভ্যতা, উন্নত নেটওয়ার্কিং, স্বল্প মূল্যের সেবার কারণে সব পেশা ও বয়সের কাছে চলে যাচ্ছে মুঠোফোন। ফোন ব্যবহার করার ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা হারাচ্ছে তাদের মূল্যবান সময়, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে রাত জেগে মেতে উঠছে মুঠোফোন আড্ডায়। আবার পেশাজীবী যারা সারাদিন বাইরে কাজ করে ঘরে ফেরেন তারাও বাসায় ফিরে আবার ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় পরিবারের মানুষগুলো বঞ্চিত হচ্ছে তার একান্ত সান্নিধ্য থেকে।”
সমাজ পরিবর্তনে মুঠোফোনের ইতিবাচাক ব্যবহারের চেয়ে নেতিবাচক ব্যবহারই বেশি বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন।
তিনি বলেন, “সহজলভ্যতা, উন্নত নেটওয়ার্কিং, স্বল্প মূল্যের সেবার কারণে সব পেশা ও বয়সের কাছে চলে যাচ্ছে মুঠোফোন। ফোন ব্যবহার করার ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা হারাচ্ছে তাদের মূল্যবান সময়, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে রাত জেগে মেতে উঠছে মুঠোফোন আড্ডায়। আবার পেশাজীবী যারা সারাদিন বাইরে কাজ করে ঘরে ফেরেন তারাও বাসায় ফিরে আবার ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় পরিবারের মানুষগুলো বঞ্চিত হচ্ছে তার একান্ত সান্নিধ্য থেকে।”
সমাজ পরিবর্তনে মুঠোফোনের ইতিবাচাক ব্যবহারের চেয়ে নেতিবাচক ব্যবহারই বেশি বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন।
তিনি বলেন, “মুঠোফোনের মাধ্যমে অতি সহজে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে বলে অনেক সময় বেঁচে যাচ্ছে। আর সেই সময়টাও ব্যবহৃত হচ্ছে মুঠোফোনে কথা বলে। এতে মানুষের যোগাযোগ এককেন্দ্রিক হয়ে উঠছে, কমে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ।”
মুঠোফোনের যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে কিশোরীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন মাহবুবা নাসরীন। তারা যখন তখন মুঠোফোনে বন্ধু খুঁজে নিচ্ছে। তাদের সঙ্গে মিশছে, আড্ডা দিচ্ছে। আর কখনো কখনো এই সরল আড্ডাগুলোই হয়ে উঠছে যৌন হয়রানির হাতিয়ার। মুঠোফোনের সূত্র ধরেই ছেলেরা তাদের হয়রানি করছে।
অধ্যাপক মোকাদ্দেম বলেন, “মুঠোফোনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় আজকাল কিশোর-কিশোরীরা তার পাশের মানুষটিকে নিজের কথা বলে না। সেটি পরিবারে এবং পরিবারের বাইরেও। সব কথা নিজের মধ্যে চেপে রাখতে রাখতে একসময় ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছে। অনেকে আবেগ তাড়িত হয়ে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। মুঠোফোনের কল্যাণে এই যে এককেন্দ্রিকতা তার কাছে পরিবারের মানুষের উপস্থিতিকে গৌণ করে দিচ্ছে।”
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ তো বেড়েছে। যখন খুশি তখন মানুষ কথা বলতে পারছে তার প্রিয়জনের সঙ্গে। কিন্তু একই কারণে যেকোনো পরিস্থিতিতে অপ্রিয়জনের কথা, অপ্রিয় কথাও শুনতে হচ্ছে এই মুঠোফোনে।
আরিফা (ছদ্মনাম)। বয়স ৩৫। একটি কর্পোরেট হাউজে চাকরি করতেন। নিজের পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত সবকিছু নিয়ে সারাক্ষণ নাভিশ্বাস। নিজের কর্মক্ষেত্রেই একজন বন্ধু পেয়ে যান। বিভিন্ন সময় পারিবারিক অশান্তি নিয়ে আলোচনা হয়। মোবাইল ফোনের কল্যাণে সম্পর্কটা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে। মেয়েটি নতুন করে ভাবতে শুরু করে। কিন্তু বন্ধু শুভংকর হঠাৎ করেই গুটিয়ে নেন নিজেকে। মানতে পারে না আরিফা। স্বামী, সন্তান এবং সংসার ভুলে আত্মহননের পথ বেছে নেন। আত্মহননের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্বামী অমিত জেনে যান স্ত্রীর গোপন সম্পর্কের কথা।
“আমার স্ত্রী এরকম একটি সম্পর্কে জড়িয়েছে বলে অনেকদিন থেকেই অনুমান করছিলাম। কিন্তু তা যে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেবে তা আশা করিনি”, আরিফার স্বামী একথা বলেন।
স্বামীর মুঠোফোনে যৌন উত্তেজক বার্তা পড়ে প্রায় সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয় লুৎফার (ছদ্মনাম)। তার স্বামীকে এ ধরনের কথা কেউ লিখতে পারে ভাবতেও পারেনি সে।
“শরীফকে আমি তালাকই দিয়ে দিতাম। কিন্তু আমি ওকে এতো ভালোবাসি যে ওকে ক্ষমা করে দিলাম”’ লুৎফা’র স্বীকারোক্তি।
মুঠোফোনকে কেন্দ্র করে এধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠার ঘটনা অহরহই ঘটছে বলে মন্তব্য করেন মাহবুবা নাসরীন। তিনি বলেন, “আগে মানুষ তার দাম্পত্য জীবনের অশান্তির কথা পরিবারের অন্যদের সঙ্গেই আলাপ আলোচনা করতো। কিন্তু এখন যোগাযোগ সহজ হওয়ায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করে প্রথমে বন্ধুত্ব এবং পরে তা পরিণত হচ্ছে প্রেমের সম্পর্কে। ফলে ঘটছে পারিবারিক বিপর্যয়।”
মুঠোফোনের খুদে বার্তা পড়ে স্ত্রীকে অবিশ্বাস করার ঘটনা যেমন অহরহই ঘটছে, ঘটছে পারিবারিক বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও। আবার মুঠোফোনের কল্যাণেই ঢাকার রাজপথে দাঁড়িয়ে একজন বলছে আমি এখন রাজশাহী। আবার পদ্মা নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলছে আমি সদরঘাটে। এইসব অহরহ মিথ্যাচার হচ্ছে মোবাইলের কারণেই। আবার পারস্পরিক বিশ্বাসও নষ্ট হচ্ছে মোবাইল ফোনের কারণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ তথ্য কমিশনের তথ্য কমিশনার অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “মুঠোফোনটা আসলে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জিনিস। এর গোপনীয়তা রক্ষা করা দরকার। মুঠোফোনের একটি ক্ষুদে বার্তা পড়ে দাম্পত্য কলহের ঘটনা অহরহই ঘটছে। এর পেছনে রয়েছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট করার প্রবণতা।”
তিনি সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের বাইরেও প্রতিটি মানুষের নিজস্ব যে জগৎ তাকে তার মতো করে থাকতে দেয়ার পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, “মুঠোফোন ব্যবহার করলেই এমনটি হবে তা নয়। প্রত্যেককে তাদের নিজ নিজ জায়গায় দায়িত্বশীল হতে হবে।”
“কিশোর-কিশোরীরা অবশ্যই মুঠোফোন ব্যবহার করবে। তবে নিজেদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে তা ব্যবহার করতে শেখাতে হবে। কারণ স্বাধীনতা দায়িত্বশীলতার পথ ধরেই আসা উচিত। জগতের ভালো-মন্দ, ধ্বংস-সৃষ্টি এসব কিছুর মধ্যে দিয়ে তাকে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে”, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মুঠোফোন ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অধ্যাপক সাদেকা হালিম একথা বলেন। সূত্র: বাসস
No comments