ফেসবুক ভেঙে দিল সংসার by একরামুল হক
উচ্চশিক্ষিত আবিদ হাসান (ছদ্মনাম) মধ্যপ্রাচ্যের দেশ আরব আমিরাতে চাকরি করেন। ২০০৯ সালে চট্টগ্রামে এসে বিয়ে করেন শিক্ষিত এক তরুণীকে। নাম আফসিয়া হাসান (ছদ্মনাম)। কিন্তু ফেসবুকের মাধ্যমে বিয়ের আগে থেকে অন্য ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে আফসিয়ার। যা আবিদ বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের জানা ছিল না।
মধুচন্দ্রিমায় ভারতে বেড়াতে যাওয়ার পর আফসিয়ার সন্দেহজনক আচরণে ধাক্কা খান আবিদ। পরে তিনি স্ত্রীকে ফেরাতে অনেক চেষ্টা করেন। আরব আমিরাতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও আফসিয়াকে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু তাতেও পরিবর্তন হয়নি আফসিয়ার আচরণ। একপর্যায়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেন আবিদ। এ ব্যাপারে আবিদের চিঠি এবং চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম ও সালিসি পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমানের আদেশের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আমি আবিদ হাসান (ছদ্মনাম) আফসিয়া হাসনাকে (ছদ্মনাম) ২০০৯ সালের শেষের দিকে বিয়ে করি। পরে মধুচন্দ্রিমা করতে ভারতের কাশ্মীরে যাই। দাম্পত্য জীবনের কিছু দিন ভালোভাবে কাটে। এরপর আফসিয়া আমার অবাধ্য ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতে থাকে। বিয়ের পর বিভিন্ন ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে মুঠোফোনে অনৈতিক কথাবার্তা বলা ছাড়াও ফেসবুকে বেশির ভাগ সময় মনোনিবেশ এবং অমার্জিত আলাপচারিতা আমাকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তোলে। ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে কথা না বলা এবং ফেসবুকে চ্যাট না করতে তাকে অনুরোধ করি। এতে সে উত্তেজিত হয়ে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। একপর্যায়ে একদিন রাত ১০টায় আমার বাসা থেকে ও বের হয়ে যায়। এর আগেও ভারতে বেড়ানোর সময় হোটেল থেকে দুবার পালিয়ে যায়। সেখানেও অনেক খোঁজ করে পরে তাঁকে পাওয়া যায়। এসব বিষয়ে ওর মা-বাবাকে জানালে তাঁরা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি।
পরে আফসিয়ার মা-বাবা ও অভিভাবকদের অনুরোধে আমার কর্মস্থল আরব আমিরাতে তাকে (আফসিয়া) নিয়ে আসি। বিদেশে যাওয়ার পর তার আচরণ আরও খারাপ হতে থাকে। আমি সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় হতে থাকি। এ ছাড়া উচ্ছৃঙ্খলতার একপর্যায়ে ও বাসার মূল্যবান সামগ্রী ভাঙচুর ও দলিলাদি নষ্ট করে ফেলত। প্রায় সময় আমাকে মানসিক যন্ত্রণা ও হুমকি দিত। অনৈতিক চিন্তাভাবনা থেকে তাকে সুপথে আনতে এবং দাম্পত্য জীবন সুখের আশায় আমি আরব আমিরাতের স্বনামধন্য প্রেসটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে ভর্তি করিয়ে দিই তাকে। এতেও তার মধ্যে পরিবর্তনের কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। বরং সারাক্ষণ ফেসবুকে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করত। পরে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমি তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসি।
দেশে ফেরার পর তার অনৈতিক কার্যকলাপসহ যাবতীয় প্রমাণ তথা ফেসবুকে ছেলে বন্ধুর সঙ্গে চ্যাট করা এবং মুঠোফোনের খুদে বার্তার (এসএমএস) প্রমাণ তার মা-বাবার কাছে উপস্থাপন করি। এতে আফসিয়া খেপে গিয়ে আমাকে তালাকের জন্য চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে আমি একা কর্মস্থল আরব আমিরাতে চলে যাই।
বিদেশে চলে যাওয়ার পর আফসিয়ার অনৈতিক আচরণ আরও বাড়তে থাকে। তার চলাফেরা ও অবাধ্যতার ব্যাপারে জেনে তাকে শৃঙ্খল জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। ও আমার সংসার করতে আর রাজি নয়। আমার মা-বাবার সঙ্গেও ও অশোভন আচরণ করতে থাকে। এরপর গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে সে আমার অনুমতি ছাড়া বাসা থেকে স্বর্ণালংকার, ল্যাপটপ ও মূল্যবান জিনিস নিয়ে তার বাবার বাসায় চলে যায়। এ অবস্থায় তার সঙ্গে আমার সংসার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই তাকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
আদেশ: দ্বিতীয় পক্ষ (আফসিয়া) অনুপস্থিত থাকায় তালাকসংক্রান্ত চিঠির ব্যাপার তাঁর অভিমত জানা যায়নি। তা ছাড়া এসব বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা এই সালিসি পরিষদের উদ্দেশ্য নয়। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, ইন্টারনেট ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কুফলও কম নয়। যথাযথভাবে ব্যবহার না হলে এগুলো অনেক করুণ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
চিঠির বক্তব্য সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, সচেতন ব্যক্তিমাত্র স্বীকার করবেন, এ ধরনের ঘটনা একেবারে বিরল নয়। উন্নয়ন ও প্রযুক্তির কারণে দ্রুত বদলে যাওয়া পারিবারিক জীবনে আমাদের গৌরবময় মূল্যবোধের স্থান অনেকখানি সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এক ভয়াবহ দুঃসময়ে যেন আটকা পড়েছি সবাই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন সেই হতাশা প্রকাশ করেছেন তাঁর বক্তব্যে, ‘এমন সময় হেথা বৃথা তুমি, প্রিয়া,/ বসন্ত কুসুমমালা এসেছ পরিয়া/ এনেছ অঞ্চল ভরি যৌবনের স্মৃতি-/ নিভৃত নিকুঞ্জ আজি নাই কোন গীতি।/ তোমারে হেরিয়া তারা হতেছে ব্যাকুল;/ অকালে ফুটিতে চাহে সকল মুকুল।’
যা হোক, নথি পর্যালোচনায় মনে হয়েছে, বিধিবদ্ধ ৯০ দিন পার হয়েছে। সালিসি পরিষদের রীতি অনুসারে তালাক আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করা হলো।
No comments