সমাবর্তন বক্তৃতা-আদর্শ পুরুষের নাম কৃষক by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
মানুষের প্রাথমিক পঞ্চ প্রয়োজন—অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার মধ্যে চারটিরই উৎস উদ্ভিদ। পরিবেশের মক্ষীরানি সেই উদ্ভিদের শিশুর মতো মেজাজ, যুবকের মতো দেমাক এবং বৃদ্ধের মতো অনুকম্পাপ্রার্থী। সেই উদ্ভিদকে আমরা পোষ মানাই ও আদর-যত্ন করি। প্রতিদানে আমরা অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও ওষুধ পাই।
আইনে ‘কৃষি’ বলতে আজ নানা কাজ বোঝায়। ফলমূলসহ সকল প্রকার উদ্ভিজ্জ, ফসল উৎপাদন, ফসল তোলা, সংরক্ষণ এবং প্রারম্ভিক প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যবহার; বনজ সম্পদ উন্নয়ন ও সংরক্ষণ এবং প্রারম্ভিক প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যবহার; পশুপালন, প্রজনন ও পশুসম্পদ উন্নয়ন, মৎস্য, শক্ত খোসাযুক্ত জলজ প্রাণী এবং সরকার কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, মনুষ্য-খাদ্য হিসেবে ঘোষিত অন্য কোনো জলজ প্রাণীর চাষ, প্রজনন ও উন্নয়ন এবং এ সম্পর্কিত নানাবিধ কাজ আজ কৃষির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
উচ্চফলনশীল বীজ বা সার এবং কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার করে আমরা আমাদের শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পেরেছি। খাদ্যে আমরা প্রায় স্বয়ম্ভরও হয়েছি। আশঙ্কাবাদীদের ধারণা যে এর ফলে আমাদের দেশের খাদ্যশস্য উত্তরাধিকারসূত্রে যেসব আত্মরক্ষামূলক প্রতিষেধক গুণাবলি পেয়ে আসছিল নতুন প্রকৌশলে উৎপাদিত শস্যের পক্ষে তা অর্জন করা কঠিন। তাঁদের মতে, অনুপ্রাণিত প্রতিষেধকের চেয়ে সহজাত প্রতিষেধক ক্ষমতা অনেক বেশি সাশ্রয়ী ও ঝুঁকিহীন।
একসময় আমাদের বিদেশি পরামর্শদাতারা সুপারিশ করেন আমরা যেন কৃষির পরিবর্তে শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করি। বলা হয়, খাদ্যসংকটের সময় প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা এমন কিছু কঠিন হবে না। আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক খাদ্যশস্যের বাজার অদৃশ্যহস্ত নয়, দৃশ্যহস্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও চালিত। নিজের খাদ্যসংস্থান নিশ্চিত না করে কোনো দেশ রপ্তানি করবে না। এ অভিজ্ঞতায় আমাদের প্রথম প্রয়াস হবে খাদ্য উৎপাদনে শুধু স্বয়ম্ভরতা নয়, উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে সংগঠিত হওয়া। কৃষিক্ষেত্রে সার, সেচ, মাড়াই, ঝাড়ন-বাছনে যে অপচয় ঘটে তা হ্রাস করতে পারলে আমাদের শুধু উৎপাদনব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে না, পরিবেশের ওপরও এর এক মঙ্গলময় প্রভাব পড়বে।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিনির্ভরতা কমেছে। গ্রামেও কৃষিক্ষেত্রের বাইরে মানুষ জীবিকার সন্ধান পাচ্ছে। যন্ত্রের প্রয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি আজ শুধু কৃষি নয়, তা আজ কৃষি-বাণিজ্য। সেই বাণিজ্যে জীববৈচিত্র্য বড় নয়, সেখানে উৎপাদন বৃদ্ধি, মুনাফা বৃদ্ধি ও উৎপাদনের ব্যয় হ্রাস বড় কথা।
দরিদ্র দেশের ভেষজ উদ্ভিদ ও খাদ্যশস্যকে মানব উত্তরাধিকার বলে উন্নত দেশগুলো মুক্তদ্বার প্রবেশাধিকার চায়। আবার ওই সব ভেষজ উদ্ভিদ থেকে উৎপন্ন নির্যাস-ঔষধাদিকে পেটেন্ট-কপিরাইটের জালে দাবি করে যক্ষের ধনের মতো তারা আটকে রাখতে চায়। যে দেশের উদ্ভিদ সে দেশের জনগণ ওই মানব অধিকারের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়।
তত্ত্বগতভাবে দরিদ্র দেশের পরিবেশ সম্পর্কে দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের অনেক কিছু জানা থাকলেও তাদের চিন্তা-চেতনায় সরেজমিনে না জানার একটা ঘাটতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে গবেষণার অভাবের ফলে দেশের নীতি-নির্ধারকের ওপর মুষ্টিমেয় গবেষক ও বৈজ্ঞানিকদের তেমন প্রভাব নেই। দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি সুস্পষ্ট নীতি-নির্ধারণের জন্য বড় অন্তরায়।
রাসায়নিক সার উল্লেখযোগ্যভাবে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু সেই সার, মাটি, জল ও বাতাস দূষিত করে গ্রিনহাউস গ্যাস বা সবুজঘর বিষাক্ত বায়ুর জন্ম দিয়েছে। রাসায়নিক সারে জলে দ্রবণযোগ্য নির্দিষ্ট মাত্রায় নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম এবং ফরফরাস জাতীয় যেসব পুষ্টিদায়ক পদার্থ পাওয়া যায় তার গলন-নিঃসরণে মাটি এবং স্বাদু পানির উৎস, দূষিত হওয়ার ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে যে নব-প্রবর্তনা ঘটে তার প্রতি মানুষ সাধারণত সংশয়শীল হয়। নতুন ওষুধ, বীজ, সার ইত্যাদি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা গরিব দেশের ওপর দিয়ে চলে। স্বাস্থ্য ও খাদ্য এবং উন্নয়নের নামে আমাদের ওপর যেসব নমুনা জরিপ হয় সে-সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আমাদের দেশে অস্ট্রেলিয়ার ভেজজাতীয় পশুখাদ্য ডাল হিসেবে চালু করার চেষ্টা হয়েছিল।
টেকসই উন্নয়নের ছত্রিশ রকম সংজ্ঞা। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ডেভিড পিয়ার্স বলছেন, টেকসই উন্নয়ন বলতে মাথাপিছু ভোগ, সম্পদের ব্যবহার, জাতীয় আয় বা উন্নয়নের যেকোনো স্বীকৃত সূচককে বোঝায়, যা বর্ধিষ্ণু বা বর্ধিষ্ণু না হলেও ক্ষয়িষ্ণু নয়। এখন ইংরেজি তিন ‘ই’-র দ্বারা এনভায়রনমেন্ট, ইকোনমি ও ইকুইটি অর্থা পরিবেশ, অর্থনীতি ও ন্যায়ের নাম উচ্চারণ করেন পরিবেশবাদীরা তিন-সত্যি করে। সবুজবাদীরা বলছেন, ভোগবিলাসে অভ্যস্ত মার্কিনি জীবনধারার মান অর্জন করতে গেলে চীনের আরও তিনটি গ্রহ লাগবে।
আমাদের টিকে থাকার অর্থনীতিকে টেকসই অর্থনীতিতে উত্তরণ ঘটাতে হবে। ইউনেসকোর এক প্রস্তাবে বলা হয়: ‘প্রত্যেক প্রজন্ম জল, বায়ু ও মৃত্তিকা পৃথিবীতে যে বিশুদ্ধ ও অদুষ্ট অবস্থায় পেয়েছিল সে অবস্থায় রেখে যাবে।’ পৃথিবীকে আমরা যেভাবে পেয়েছি সেভাবে রক্ষা করার এই প্রস্তাবে একধরনের রক্ষণশীলতা রয়েছে। আমাদের বিবেচনা করতে হবে, আমরা পৃথিবীতে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছি আগামীকালের প্রজন্ম তা যেন অন্তত ভোগ করতে পায়।
অনুমান-পরীক্ষা-সমাধান পন্থায় পরিবেশ দূষিত না করে কৃষির উন্নতির জন্য নতুন আবিষ্কার সম্ভব। ইস্ট ছত্রাক ব্যবহার করে যে অরাসায়নিক সার তৈরি করার কথা হচ্ছে তা নাইট্রোজেন আহরণ করে। খাদ্যশস্যের পুষ্টি বিধান সহজতর করে। এই নিউট্রিস্মার্ট সার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, থাইল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে। এই সার পানি ও বাতাসের গুণগতমানের উন্নতি বিধান করে।
গত পাঁচ শ বছরে ক্রমাগতভাবে পরিবেশ অস্থিতিশীল ও দুস্থ হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর কৃষিজমির শতকরা চল্লিশ ভাগের ওপর মারাত্মক দুর্গতি ঘটেছে এবং শতকরা ছাব্বিশ ভাগ বিভিন্ন মাত্রায় দুর্দশাগ্রস্ত। সেই দুর্দশা রোধে দেশে-বিদেশে নানা গবেষণা হচ্ছে।
কম্পিউটার, উপগ্রহের সাহায্যে মানচিত্র অঙ্কন এবং দূর-অবধান জাতীয় প্রযুক্তির বদৌলতে পরিবেশবিষয়ক বিতর্ক-বিরোধ সমাধানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষণে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষক, কৃষিশিক্ষা ও কৃষিগবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের একটা সমন্বিত প্রয়াস নিতে হবে। সদুদ্দেশ্যে ভূমি সংস্কারের কথা ছিল। সেই সংস্কার কেন অর্জিত হলো না এবং কী উপায়ে তা অর্জন সম্ভব তা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
কৃষিজাত শস্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে পরিবেশ-দূষণ প্রতিরোধে জৈবডিজেল তৈরির সম্ভাবনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। নিয়মিত ডিজেলের সঙ্গে জৈবডিজেল ব্যবহার করে উপকার পাওয়া গেছে এবং ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। আমাদের দেশে ধানের তুষ ও পাথরকুচি থেকে বিদ্যুৎ তৈরির চেষ্টা হয়েছে। ভেরেন্ডা ও রেড়ী থেকে জৈবতেল আহরণ করা সম্ভব কি না, আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
কৃষির ভবিষ্যত্ নিয়ে নিরাশাবাদীরা বলেন, চাষযোগ্য জমি বাড়ছে না, ক্রমাগতভাবে কমছে এবং তার ওপর চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, ক্ষারবৃদ্ধি ও জৈবপুষ্টির অভাবে বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমি আজ বড় বিপন্ন। সেচের ক্ষেত্রে অপরিমিত পানি ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে ক্ষার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী দু দশকে দেশে যে পরিমাণ খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হবে তার চাহিদা মেটাতে না পারলে দেশে দারুণ অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে।
আশাবাদীরা অবশ্য মনে করেন কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগে একরপ্রতি উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। কৃষি, বীজ, সার ও সেচ—প্রতিটি ক্ষেত্রে সুব্যবস্থার ফলে প্রভূত উন্নতি সাধন সম্ভব। আর কৃষি শুধু কৃষি থাকবে না, কৃষিশিল্পের বিকাশ ঘটবে।
বিশ্বের বহু দেশ একফসলি। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ায় বছরে ১০০ ধরনের ফসল ফলানো যায়। আমাদের শস্যের বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। সোনামুগের মতো সুগন্ধি ডাল ও দাদখানির মতো নানা ধরনের চাল হারিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ১৪০০ রকমের ধান ছিল আমাদের দেশে। উচ্চফলনশীল ধানের দাপটে যেন ধানের উত্তরাধিকার বিনষ্ট না হয়ে যায়। শস্যবৈচিত্র্য রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় বীজ সংগ্রহাগার এবং সংগ্রহ খামারশালা গড়ে তুলতে এবং একটা অনুপ্রাণিত উদ্যোগের একান্ত প্রয়োজন।
আমরা বহু দিন থেকে শুনে আসছি কৃষক আমাদের মেরুদণ্ড। আমি কৃষককে আদর্শ পুরুষ বা রোল মডেল বলতে চাই। কৃষক ভালো করেই জানে তার ধর্মঘটের কোনো অবকাশ নেই। ভূমিকর্ষণ, বীজবপন, চারারোপণ এবং শস্য মাড়াই সব কঠিন কাজ ঠিক সময়ে সমাধা না করলে সব পরিশ্রম পণ্ড হয়ে যেতে পারে। শিক্ষায়তনে ঈপ্সিত উদ্দেশ্য অর্জনে ছাত্র-শিক্ষক কৃষকের অভ্যাস ও অধ্যবসায় অর্জন করলে দেশ উপকৃত হবে। অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্বল্প সময়ে ১৪০ জন পিএইচডি, ৯৩১ জন এমএস এবং ৮২ জন ছাত্রছাত্রীকে বিএস ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষার পাশাপাশি উন্নত গবেষণার মাধ্যমে ইতিমধ্যে উন্নতমানের শিম, মুগডাল, আপেলকুল, মুলা, মটরশুঁটি, সুগন্ধি ধান, পেয়ারাসহ ২৫টি ফসলের জাত এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
আজ যাঁরা সনদ পেলেন তাঁদেরকে এবং তাঁদেরঅভিভাবকদের আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আমাকে সমাবর্তন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও তাঁর সহকর্মীদের আমি অশেষ ধন্যবাদ জানাই। আপনারা সবাই ভালো থাকুন। পরম করুণাময় আপনাদের সবার সহায় হোন।
বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেওয়া সমাবর্ত বক্তৃতা।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।
উচ্চফলনশীল বীজ বা সার এবং কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার করে আমরা আমাদের শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পেরেছি। খাদ্যে আমরা প্রায় স্বয়ম্ভরও হয়েছি। আশঙ্কাবাদীদের ধারণা যে এর ফলে আমাদের দেশের খাদ্যশস্য উত্তরাধিকারসূত্রে যেসব আত্মরক্ষামূলক প্রতিষেধক গুণাবলি পেয়ে আসছিল নতুন প্রকৌশলে উৎপাদিত শস্যের পক্ষে তা অর্জন করা কঠিন। তাঁদের মতে, অনুপ্রাণিত প্রতিষেধকের চেয়ে সহজাত প্রতিষেধক ক্ষমতা অনেক বেশি সাশ্রয়ী ও ঝুঁকিহীন।
একসময় আমাদের বিদেশি পরামর্শদাতারা সুপারিশ করেন আমরা যেন কৃষির পরিবর্তে শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করি। বলা হয়, খাদ্যসংকটের সময় প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা এমন কিছু কঠিন হবে না। আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক খাদ্যশস্যের বাজার অদৃশ্যহস্ত নয়, দৃশ্যহস্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও চালিত। নিজের খাদ্যসংস্থান নিশ্চিত না করে কোনো দেশ রপ্তানি করবে না। এ অভিজ্ঞতায় আমাদের প্রথম প্রয়াস হবে খাদ্য উৎপাদনে শুধু স্বয়ম্ভরতা নয়, উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে সংগঠিত হওয়া। কৃষিক্ষেত্রে সার, সেচ, মাড়াই, ঝাড়ন-বাছনে যে অপচয় ঘটে তা হ্রাস করতে পারলে আমাদের শুধু উৎপাদনব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে না, পরিবেশের ওপরও এর এক মঙ্গলময় প্রভাব পড়বে।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিনির্ভরতা কমেছে। গ্রামেও কৃষিক্ষেত্রের বাইরে মানুষ জীবিকার সন্ধান পাচ্ছে। যন্ত্রের প্রয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি আজ শুধু কৃষি নয়, তা আজ কৃষি-বাণিজ্য। সেই বাণিজ্যে জীববৈচিত্র্য বড় নয়, সেখানে উৎপাদন বৃদ্ধি, মুনাফা বৃদ্ধি ও উৎপাদনের ব্যয় হ্রাস বড় কথা।
দরিদ্র দেশের ভেষজ উদ্ভিদ ও খাদ্যশস্যকে মানব উত্তরাধিকার বলে উন্নত দেশগুলো মুক্তদ্বার প্রবেশাধিকার চায়। আবার ওই সব ভেষজ উদ্ভিদ থেকে উৎপন্ন নির্যাস-ঔষধাদিকে পেটেন্ট-কপিরাইটের জালে দাবি করে যক্ষের ধনের মতো তারা আটকে রাখতে চায়। যে দেশের উদ্ভিদ সে দেশের জনগণ ওই মানব অধিকারের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়।
তত্ত্বগতভাবে দরিদ্র দেশের পরিবেশ সম্পর্কে দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের অনেক কিছু জানা থাকলেও তাদের চিন্তা-চেতনায় সরেজমিনে না জানার একটা ঘাটতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে গবেষণার অভাবের ফলে দেশের নীতি-নির্ধারকের ওপর মুষ্টিমেয় গবেষক ও বৈজ্ঞানিকদের তেমন প্রভাব নেই। দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি সুস্পষ্ট নীতি-নির্ধারণের জন্য বড় অন্তরায়।
রাসায়নিক সার উল্লেখযোগ্যভাবে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু সেই সার, মাটি, জল ও বাতাস দূষিত করে গ্রিনহাউস গ্যাস বা সবুজঘর বিষাক্ত বায়ুর জন্ম দিয়েছে। রাসায়নিক সারে জলে দ্রবণযোগ্য নির্দিষ্ট মাত্রায় নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম এবং ফরফরাস জাতীয় যেসব পুষ্টিদায়ক পদার্থ পাওয়া যায় তার গলন-নিঃসরণে মাটি এবং স্বাদু পানির উৎস, দূষিত হওয়ার ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে।
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে যে নব-প্রবর্তনা ঘটে তার প্রতি মানুষ সাধারণত সংশয়শীল হয়। নতুন ওষুধ, বীজ, সার ইত্যাদি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা গরিব দেশের ওপর দিয়ে চলে। স্বাস্থ্য ও খাদ্য এবং উন্নয়নের নামে আমাদের ওপর যেসব নমুনা জরিপ হয় সে-সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আমাদের দেশে অস্ট্রেলিয়ার ভেজজাতীয় পশুখাদ্য ডাল হিসেবে চালু করার চেষ্টা হয়েছিল।
টেকসই উন্নয়নের ছত্রিশ রকম সংজ্ঞা। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ডেভিড পিয়ার্স বলছেন, টেকসই উন্নয়ন বলতে মাথাপিছু ভোগ, সম্পদের ব্যবহার, জাতীয় আয় বা উন্নয়নের যেকোনো স্বীকৃত সূচককে বোঝায়, যা বর্ধিষ্ণু বা বর্ধিষ্ণু না হলেও ক্ষয়িষ্ণু নয়। এখন ইংরেজি তিন ‘ই’-র দ্বারা এনভায়রনমেন্ট, ইকোনমি ও ইকুইটি অর্থা পরিবেশ, অর্থনীতি ও ন্যায়ের নাম উচ্চারণ করেন পরিবেশবাদীরা তিন-সত্যি করে। সবুজবাদীরা বলছেন, ভোগবিলাসে অভ্যস্ত মার্কিনি জীবনধারার মান অর্জন করতে গেলে চীনের আরও তিনটি গ্রহ লাগবে।
আমাদের টিকে থাকার অর্থনীতিকে টেকসই অর্থনীতিতে উত্তরণ ঘটাতে হবে। ইউনেসকোর এক প্রস্তাবে বলা হয়: ‘প্রত্যেক প্রজন্ম জল, বায়ু ও মৃত্তিকা পৃথিবীতে যে বিশুদ্ধ ও অদুষ্ট অবস্থায় পেয়েছিল সে অবস্থায় রেখে যাবে।’ পৃথিবীকে আমরা যেভাবে পেয়েছি সেভাবে রক্ষা করার এই প্রস্তাবে একধরনের রক্ষণশীলতা রয়েছে। আমাদের বিবেচনা করতে হবে, আমরা পৃথিবীতে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছি আগামীকালের প্রজন্ম তা যেন অন্তত ভোগ করতে পায়।
অনুমান-পরীক্ষা-সমাধান পন্থায় পরিবেশ দূষিত না করে কৃষির উন্নতির জন্য নতুন আবিষ্কার সম্ভব। ইস্ট ছত্রাক ব্যবহার করে যে অরাসায়নিক সার তৈরি করার কথা হচ্ছে তা নাইট্রোজেন আহরণ করে। খাদ্যশস্যের পুষ্টি বিধান সহজতর করে। এই নিউট্রিস্মার্ট সার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, থাইল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে। এই সার পানি ও বাতাসের গুণগতমানের উন্নতি বিধান করে।
গত পাঁচ শ বছরে ক্রমাগতভাবে পরিবেশ অস্থিতিশীল ও দুস্থ হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর কৃষিজমির শতকরা চল্লিশ ভাগের ওপর মারাত্মক দুর্গতি ঘটেছে এবং শতকরা ছাব্বিশ ভাগ বিভিন্ন মাত্রায় দুর্দশাগ্রস্ত। সেই দুর্দশা রোধে দেশে-বিদেশে নানা গবেষণা হচ্ছে।
কম্পিউটার, উপগ্রহের সাহায্যে মানচিত্র অঙ্কন এবং দূর-অবধান জাতীয় প্রযুক্তির বদৌলতে পরিবেশবিষয়ক বিতর্ক-বিরোধ সমাধানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষণে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষক, কৃষিশিক্ষা ও কৃষিগবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের একটা সমন্বিত প্রয়াস নিতে হবে। সদুদ্দেশ্যে ভূমি সংস্কারের কথা ছিল। সেই সংস্কার কেন অর্জিত হলো না এবং কী উপায়ে তা অর্জন সম্ভব তা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
কৃষিজাত শস্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে পরিবেশ-দূষণ প্রতিরোধে জৈবডিজেল তৈরির সম্ভাবনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। নিয়মিত ডিজেলের সঙ্গে জৈবডিজেল ব্যবহার করে উপকার পাওয়া গেছে এবং ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। আমাদের দেশে ধানের তুষ ও পাথরকুচি থেকে বিদ্যুৎ তৈরির চেষ্টা হয়েছে। ভেরেন্ডা ও রেড়ী থেকে জৈবতেল আহরণ করা সম্ভব কি না, আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
কৃষির ভবিষ্যত্ নিয়ে নিরাশাবাদীরা বলেন, চাষযোগ্য জমি বাড়ছে না, ক্রমাগতভাবে কমছে এবং তার ওপর চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, ক্ষারবৃদ্ধি ও জৈবপুষ্টির অভাবে বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমি আজ বড় বিপন্ন। সেচের ক্ষেত্রে অপরিমিত পানি ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে ক্ষার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী দু দশকে দেশে যে পরিমাণ খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হবে তার চাহিদা মেটাতে না পারলে দেশে দারুণ অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে।
আশাবাদীরা অবশ্য মনে করেন কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগে একরপ্রতি উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। কৃষি, বীজ, সার ও সেচ—প্রতিটি ক্ষেত্রে সুব্যবস্থার ফলে প্রভূত উন্নতি সাধন সম্ভব। আর কৃষি শুধু কৃষি থাকবে না, কৃষিশিল্পের বিকাশ ঘটবে।
বিশ্বের বহু দেশ একফসলি। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ায় বছরে ১০০ ধরনের ফসল ফলানো যায়। আমাদের শস্যের বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। সোনামুগের মতো সুগন্ধি ডাল ও দাদখানির মতো নানা ধরনের চাল হারিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ১৪০০ রকমের ধান ছিল আমাদের দেশে। উচ্চফলনশীল ধানের দাপটে যেন ধানের উত্তরাধিকার বিনষ্ট না হয়ে যায়। শস্যবৈচিত্র্য রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় বীজ সংগ্রহাগার এবং সংগ্রহ খামারশালা গড়ে তুলতে এবং একটা অনুপ্রাণিত উদ্যোগের একান্ত প্রয়োজন।
আমরা বহু দিন থেকে শুনে আসছি কৃষক আমাদের মেরুদণ্ড। আমি কৃষককে আদর্শ পুরুষ বা রোল মডেল বলতে চাই। কৃষক ভালো করেই জানে তার ধর্মঘটের কোনো অবকাশ নেই। ভূমিকর্ষণ, বীজবপন, চারারোপণ এবং শস্য মাড়াই সব কঠিন কাজ ঠিক সময়ে সমাধা না করলে সব পরিশ্রম পণ্ড হয়ে যেতে পারে। শিক্ষায়তনে ঈপ্সিত উদ্দেশ্য অর্জনে ছাত্র-শিক্ষক কৃষকের অভ্যাস ও অধ্যবসায় অর্জন করলে দেশ উপকৃত হবে। অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্বল্প সময়ে ১৪০ জন পিএইচডি, ৯৩১ জন এমএস এবং ৮২ জন ছাত্রছাত্রীকে বিএস ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষার পাশাপাশি উন্নত গবেষণার মাধ্যমে ইতিমধ্যে উন্নতমানের শিম, মুগডাল, আপেলকুল, মুলা, মটরশুঁটি, সুগন্ধি ধান, পেয়ারাসহ ২৫টি ফসলের জাত এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
আজ যাঁরা সনদ পেলেন তাঁদেরকে এবং তাঁদেরঅভিভাবকদের আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আমাকে সমাবর্তন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও তাঁর সহকর্মীদের আমি অশেষ ধন্যবাদ জানাই। আপনারা সবাই ভালো থাকুন। পরম করুণাময় আপনাদের সবার সহায় হোন।
বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেওয়া সমাবর্ত বক্তৃতা।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।
No comments