চারদিক-শেখর, তুই কি শুনতে পাচ্ছিস? by খালেদা নেওয়াজ
কী উত্তর দেব শেখরের কাছে? নিম্ন আদালতে আসামিদের জামিন নামঞ্জুর হলেও হাইকোর্ট থেকে একজন আসামির জামিন মঞ্জুর হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা আপিল আজ চেম্বার জজের আদালতে শুনানি হবে। হাইকোর্টে স্বপন শেখের জামিন মঞ্জুর হওয়ায় আরেক আসামি হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেছে।
প্রচণ্ড শঙ্কা কাজ করছে। আজ যদি ওদের জামিন হয়ে যায়, কোনো দিন আর জানতে পারব না ভাইটি শেষ মুহূর্তে বাঁচার জন্য কীভাবে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে ছিল। চেম্বার জজের আদালতে যে আসামির শুনানি হবে, সে-ই প্রথম ছিনতাইকারী তাজুল ওরফে তাজুর কাছ থেকে শেখরের মোবাইলটি ক্রয় করে। তাজুল ওরফে তাজুর জামিনের শুনানিও আজ হাইকোর্টে হবে।
শেখর গত বছরের ১৬ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে রাত ১১টায় উত্তরায় ওর শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। পরের দিন ১৭ নভেম্বর সকালে গাজীপুরের শালনা ফ্লাইওভার থেকে পুলিশ শেখরের লাশ উদ্ধার করে। হাইকোর্টে জামিনের জন্য আবেদনকারী আসামি তাজুল ১৭ নভেম্বর দিবাগত রাত দেড়টায় শালনা ফ্লাইওভার থেকে দুই মাইল উত্তরে গিয়ে স্বপন শেখের কাছে ফোন করে জানায়, একটি মোবাইল আছে, সে কিনবে কি না। পরে মোবাইল ট্রাকিং করে দেখা যায়, স্বপন শেখ ও তাজুল শেখরের মোবাইল থেকে প্রচুর কথা বলেছে। স্বপন শেখের দেওয়া তথ্যানুযায়ী যে মাইক্রোতে করে শেখরকে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা, সেই কালো কাচ দেওয়া মাইক্রোবাসের ড্রাইভার ও তাজুলকে আটক করা হয়। ১৬ নভেম্বর শেখরকে হত্যা করে শালনা ব্রিজে ফেলে দেওয়ার পর তারা একই মাইক্রোবাস নিয়ে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত ছিনতাই করেছে বলে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার কাছে স্বীকার করেছে।
শেখর, তোর জন্য কিছুই করতে পারছি না। অশ্রু ফেলে ফেলে দুচোখ যদি অন্ধ হয়ে যায়, অথবা তোর মতো করে গলাটিপে আমাদেরও ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়, তবেই কি এ অপরাধী চক্র থেকে মুক্তি ঘটবে? যে সমাজ প্রতিনিয়ত অপরাধী দানব তৈরি করছে, সে সমাজে বেঁচে থাকাটাই পরম বিস্ময়ের ব্যাপার। যে ছেলেটি শ্রমিকের ঘাম গায়ে মেখে বৈষম্যহীন সমাজের কল্পনা করে রাস্তায় ঠেলাগাড়িওয়ালার কষ্ট দেখে ঠেলাগাড়ি ঠেলছিল, সেই ছেলেটিকে গলাটিপে হত্যা করল ছিনতাইকারী নামক সন্ত্রাসীরা।
প্রতিদিন অসংখ্য খবর আসে পত্রিকার পাতায়। মনে হতো, এগুলো শুধুই খবর। এ খবর আমাদের জীবনে ঘটবে না। ধামরাই ব্রিজে পড়ে থাকা লাশ, মহাখালীতে ছুরিকাঘাতে একজনের অপমৃত্যু—এ ধরনের খবর আর কত পড়তে হবে? মাইক্রোবাসের কালো কাচের আড়ালে ওরা শেখরের গলাটাও টিপে ধরল। প্রতিবাদী শেখর মায়ের দেওয়া মোবাইল ফোনটি ছিনতাইকারীদের দিতে চায়নি। একটি মৃত্যু, একটি সাজানো সংসারের অপমৃত্যু। শেখরের ছেলে মিথ রাতের আকাশে তারার মধ্যে ওর বাবাকে খুঁজে ফিরে। মা-বাবা, ভাই-বোনদের আর্তচিত্কার দেখে দেখে ভোঁতা হয়ে গেছে যেখানে অনুভূতিযন্ত্র, সেখানে আমার ভাইটির মৃত্যু বুঝিয়ে দিল আর সবার বুকে কেমন করে বাজে এ যন্ত্রণা। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ শেখর জন্মেছিল। ফুলের মতো ফুটফুটে ভাইটি সবার কোলেই ফুল হয়ে ফুটে থাকত। পড়াশোনা শেষ করে কম্পিউটার সায়েন্সে। ছাত্রমৈত্রী করার সূত্রে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের মেয়ের জামাই সফিক ভাইয়ের সঙ্গে শেখরের পরিচয় ছিল। হাল ধরল ফ্যাশন হাউস চিলেকোঠার। হয়ে উঠল চিলেকোঠার একজন অন্যতম কর্ণধার। চিলেকোঠা নিয়ে যখন অসংখ্য কল্পনা ডানা মেলছিল, তখনই জীবনটাকে ছিনিয়ে নিল ছিনতাইকারীরা। গলাটিপে ফেলে দিয়ে এল শালনা ব্রিজে।
মা এখনো নাশতা নিয়ে শেখরের জন্য অপেক্ষা করে। কীভাবে সান্ত্বনার দেব তাঁকে। ওর ছোট্ট ছেলে মিথ এখনো পথ চেয়ে থাকে, কখন বাবা আসবে? ছোট্ট শেখরকে কোলে নিয়ে যখন বলতাম, ‘ঘুমিয়ে পড়। শেখর সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়ত।’ এখন ওর কবরে গিয়ে চিত্কার করে ডাকি, ‘আর ঘুমাসনে ভাই। এবার উঠে পড়।’ জীবনের কাছে এত অসহায় কখনো হইনি। বাবা একজন নামকরা আইনজীবী। আমি নিজেও আইন পেশায় নিয়োজিত। তবু জানি না ভাই হত্যার বিচার পাব কি না। আদৌ সব হত্যাকারী ধরা পড়বে কি না। আবার ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলে যদি বেরিয়ে যায়, সেই আশঙ্কা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাইবোনেরা পাথর হয়ে গেছে। আড়ালে চোখের পানি মুছতে মুছতে রুমালটা এখন পর্যন্ত শুকানোর সময় পায় না। কবে এমন সময় আসবে, যখন আর কোনো মায়ের বুক খালি হবে না? ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তানের চিত্কারে পৃথিবী কেঁদে উঠবে না। সত্যিকারের সামাজিক ন্যায়বিচার পেতে আর কত দিন সময় লাগবে? মাকে বলতাম, মা আমরা তোমার পাঁচ আঙুলে ফুটে থাকা পাঁচটি তারা। একটি তারা নিভে গেছে। সেই যন্ত্রণায় মা কুঁকুড়ে ওঠে। ২৬ মার্চ শেখরের জন্মদিন। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আজ সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে থাকা শেখরের রক্তাক্ত মুখ।
শেখর, তুই কি শুনতে পাচ্ছিস? তোর অসহায় বোন তোকে খুঁজছে। তোকে যারা হত্যা করল, তোদের মতো ছেলেদের যারা হত্যা করে, তারা কি এভাবেই আমাদের সারাজীবন অসহায় করে রাখবে? বিচার কি হবে না ওদের?
শেখর গত বছরের ১৬ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে রাত ১১টায় উত্তরায় ওর শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। পরের দিন ১৭ নভেম্বর সকালে গাজীপুরের শালনা ফ্লাইওভার থেকে পুলিশ শেখরের লাশ উদ্ধার করে। হাইকোর্টে জামিনের জন্য আবেদনকারী আসামি তাজুল ১৭ নভেম্বর দিবাগত রাত দেড়টায় শালনা ফ্লাইওভার থেকে দুই মাইল উত্তরে গিয়ে স্বপন শেখের কাছে ফোন করে জানায়, একটি মোবাইল আছে, সে কিনবে কি না। পরে মোবাইল ট্রাকিং করে দেখা যায়, স্বপন শেখ ও তাজুল শেখরের মোবাইল থেকে প্রচুর কথা বলেছে। স্বপন শেখের দেওয়া তথ্যানুযায়ী যে মাইক্রোতে করে শেখরকে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা, সেই কালো কাচ দেওয়া মাইক্রোবাসের ড্রাইভার ও তাজুলকে আটক করা হয়। ১৬ নভেম্বর শেখরকে হত্যা করে শালনা ব্রিজে ফেলে দেওয়ার পর তারা একই মাইক্রোবাস নিয়ে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত ছিনতাই করেছে বলে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার কাছে স্বীকার করেছে।
শেখর, তোর জন্য কিছুই করতে পারছি না। অশ্রু ফেলে ফেলে দুচোখ যদি অন্ধ হয়ে যায়, অথবা তোর মতো করে গলাটিপে আমাদেরও ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়, তবেই কি এ অপরাধী চক্র থেকে মুক্তি ঘটবে? যে সমাজ প্রতিনিয়ত অপরাধী দানব তৈরি করছে, সে সমাজে বেঁচে থাকাটাই পরম বিস্ময়ের ব্যাপার। যে ছেলেটি শ্রমিকের ঘাম গায়ে মেখে বৈষম্যহীন সমাজের কল্পনা করে রাস্তায় ঠেলাগাড়িওয়ালার কষ্ট দেখে ঠেলাগাড়ি ঠেলছিল, সেই ছেলেটিকে গলাটিপে হত্যা করল ছিনতাইকারী নামক সন্ত্রাসীরা।
প্রতিদিন অসংখ্য খবর আসে পত্রিকার পাতায়। মনে হতো, এগুলো শুধুই খবর। এ খবর আমাদের জীবনে ঘটবে না। ধামরাই ব্রিজে পড়ে থাকা লাশ, মহাখালীতে ছুরিকাঘাতে একজনের অপমৃত্যু—এ ধরনের খবর আর কত পড়তে হবে? মাইক্রোবাসের কালো কাচের আড়ালে ওরা শেখরের গলাটাও টিপে ধরল। প্রতিবাদী শেখর মায়ের দেওয়া মোবাইল ফোনটি ছিনতাইকারীদের দিতে চায়নি। একটি মৃত্যু, একটি সাজানো সংসারের অপমৃত্যু। শেখরের ছেলে মিথ রাতের আকাশে তারার মধ্যে ওর বাবাকে খুঁজে ফিরে। মা-বাবা, ভাই-বোনদের আর্তচিত্কার দেখে দেখে ভোঁতা হয়ে গেছে যেখানে অনুভূতিযন্ত্র, সেখানে আমার ভাইটির মৃত্যু বুঝিয়ে দিল আর সবার বুকে কেমন করে বাজে এ যন্ত্রণা। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ শেখর জন্মেছিল। ফুলের মতো ফুটফুটে ভাইটি সবার কোলেই ফুল হয়ে ফুটে থাকত। পড়াশোনা শেষ করে কম্পিউটার সায়েন্সে। ছাত্রমৈত্রী করার সূত্রে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের মেয়ের জামাই সফিক ভাইয়ের সঙ্গে শেখরের পরিচয় ছিল। হাল ধরল ফ্যাশন হাউস চিলেকোঠার। হয়ে উঠল চিলেকোঠার একজন অন্যতম কর্ণধার। চিলেকোঠা নিয়ে যখন অসংখ্য কল্পনা ডানা মেলছিল, তখনই জীবনটাকে ছিনিয়ে নিল ছিনতাইকারীরা। গলাটিপে ফেলে দিয়ে এল শালনা ব্রিজে।
মা এখনো নাশতা নিয়ে শেখরের জন্য অপেক্ষা করে। কীভাবে সান্ত্বনার দেব তাঁকে। ওর ছোট্ট ছেলে মিথ এখনো পথ চেয়ে থাকে, কখন বাবা আসবে? ছোট্ট শেখরকে কোলে নিয়ে যখন বলতাম, ‘ঘুমিয়ে পড়। শেখর সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়ত।’ এখন ওর কবরে গিয়ে চিত্কার করে ডাকি, ‘আর ঘুমাসনে ভাই। এবার উঠে পড়।’ জীবনের কাছে এত অসহায় কখনো হইনি। বাবা একজন নামকরা আইনজীবী। আমি নিজেও আইন পেশায় নিয়োজিত। তবু জানি না ভাই হত্যার বিচার পাব কি না। আদৌ সব হত্যাকারী ধরা পড়বে কি না। আবার ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলে যদি বেরিয়ে যায়, সেই আশঙ্কা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাইবোনেরা পাথর হয়ে গেছে। আড়ালে চোখের পানি মুছতে মুছতে রুমালটা এখন পর্যন্ত শুকানোর সময় পায় না। কবে এমন সময় আসবে, যখন আর কোনো মায়ের বুক খালি হবে না? ভাইবোন, স্ত্রী-সন্তানের চিত্কারে পৃথিবী কেঁদে উঠবে না। সত্যিকারের সামাজিক ন্যায়বিচার পেতে আর কত দিন সময় লাগবে? মাকে বলতাম, মা আমরা তোমার পাঁচ আঙুলে ফুটে থাকা পাঁচটি তারা। একটি তারা নিভে গেছে। সেই যন্ত্রণায় মা কুঁকুড়ে ওঠে। ২৬ মার্চ শেখরের জন্মদিন। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আজ সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে থাকা শেখরের রক্তাক্ত মুখ।
শেখর, তুই কি শুনতে পাচ্ছিস? তোর অসহায় বোন তোকে খুঁজছে। তোকে যারা হত্যা করল, তোদের মতো ছেলেদের যারা হত্যা করে, তারা কি এভাবেই আমাদের সারাজীবন অসহায় করে রাখবে? বিচার কি হবে না ওদের?
No comments