দারিদ্র্য ও ক্ষুধার রাজ্য সীমানাবিহীন by ড. আবু এন এম ওয়াহিদ

আজকের লেখাটা শুরু করতে চাই দুই বাংলার স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী কবির সুমনের গাওয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গণসংগীতের কথা দিয়ে। গানটি শিল্পীর নিজের লেখা, নাকি অন্য কেউ লিখে দিয়েছেন তা জানি না; তবে এর কথা, বাণী এবং সুর এমনভাবে আমার হৃদয় ছুঁয়েছে যে আমি আমার আজকের পাঠকদের পুরো গানটি শুধু পড়তেই বলব


না, বরং প্রত্যেকের কাছে আবদার জানাব- আপনারা এটি কবির সুমনের কণ্ঠে অন্তত একবার হলেও মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। গানের বাণী যেমন শক্তিশালী, তেমনি কবির সুমনের কণ্ঠে গানটি শুনিয়েছে চমৎকার। অনেকেই হয়তো জানেন, পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় গণসংগীত শিল্পী একসময়কার সুমন চট্টোপাধ্যায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কবির সুমন নাম নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের গানের পাখি সাবিনা ইয়াসমীনকে বিয়ে করেছেন। কবির সুমন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। আমি কলকাতার স্যাটেলাইট টেলিভিশন 'তারা চ্যানেলের' বদৌলতে সাম্প্রতিক সময়ে কবির সুমনের অনেক সাক্ষাৎকার শুনেছি। সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, গান, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, সমাজ, রাজনীতি, মনস্তত্ত্ব, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে কবির সুমনের গভীর ও সুস্পষ্ট ধারণা দেখে আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছি।
ইউটিউব হোমপেজে গিয়ে সার্চ দিলেই এই গুণী শিল্পীর গাওয়া গানটি সহজেই পেয়ে যাবেন। গানের প্রথম লাইন এ রকম : 'একটা থালায় চারটি রুটি, একটু আচার একটু ডাল...।' কবির সুমন এই গানের বাণীতে ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, দর্শন, যুদ্ধ, ধর্ম, শান্তি, সাম্প্রদায়িকতা, সমাজ, সভ্যতা, বাস্তবতা এবং মানবিক আবেদনের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। গানের সব চরণের সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত নই, তবে শেষের দুটি লাইনের মর্মার্থ আমাকে দারুণভাবে টানে। আজকের নিবন্ধে 'ক্ষিধের কিন্তু সীমান্ত নেই'- এ চরণটি নিয়ে আমি পাঠকদের সঙ্গে আমার কিছু ধারণা এবং মতামত শেয়ার করতে চাই। মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই আমরা দেখতে পাই, কোনো কোনো দেশে সম্পদের প্রাচুর্য, আবার কোথাও বা দারিদ্র্যের দারুণ কশাঘাত। কোনো দেশে মানুষ না খেয়ে মরছে, আবার কোনো দেশে হচ্ছে খাদ্যের অপচয়। বিষয়টি যে শুধু আন্তদেশীয় তা-ই নয়। এমনও দেখেছি, একই দেশে একদিকে ধনীরা বিলাসবহুল হোটেলে পার্টিতে মাতোয়ারা হয়ে দেদার খাদ্য-পানীয়ের অপচয় করছে, আর অন্যদিকে না-খাওয়া মানুষ ডাস্টবিনে কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে উচ্ছিষ্ট নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। কিন্তু এটা তো এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। কারণ, পৃথিবীতে মানুষের জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি উপাদান পরিমাণমতোই সৃষ্টি করা হয়েছে। বৈশ্বিক মাপজোখে কথাটা ষোল আনা সঠিক। বর্তমানে পৃথিবীর লোকসংখ্যা ৭০০ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। তার পরও হিসাব করলে দেখা যাবে, সারা বিশ্বে আজো যা খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় এবং জগতে অন্যান্য যত সম্পদ আছে, তা পৃথিবীর সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত। তার ওপর মানব সন্তান শুধু একখানা মুখ নিয়েই পৃথিবীতে জন্মায় না, সে সঙ্গে করে নিয়ে আসে মগজভর্তি একটি মাথা এবং কর্মচঞ্চল এক জোড়া হাত। পৃথিবীর সব সম্পদ এবং জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপাদানে মানুষের জন্মগত সমঅধিকার নিশ্চিত করা থাকলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেকোনো মানুষ নিজের আহার নিজেই জোগাড় করে নিতে পারে। সম্পদের ওপর মানুষের সমঅধিকারটাই আসল সমস্যা।
আল্লাহ মানুষের হাতে জগৎময় সব কিছুর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও সত্য যে মানুষই ডেকে এনেছে তার নিজের সর্বনাশ। প্রশ্ন করতে পারেন, কিভাবে? কালের পরিক্রমায় বিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মানুষের ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় কৃত্রিম সীমান্তের মাধ্যমে গোটা পৃথিবী বিভক্ত হয়ে গেছে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জাতিতে। তারপর জাতিসংঘ সনদ বানিয়ে মানুষ সেটাকে করেছে ঐশীগ্রন্থের মতো পবিত্র, অলঙ্ঘনীয়। আর সমস্যা সৃষ্টির এটি একটি অন্যতম কারণ। এর ফলে কিছু কিছু দেশ অসমভাবে আপনা-আপনি বিশ্বের রাশি রাশি সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আর বাকিরা জীবনের উপাদান ও খাদ্য-পানীয়ের অভাবে হা-হুতাশ করছে।
সব মানুষের একই তো উৎস। তার পরও তারা সাদা-কালো, ধনী-গরিব এবং ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে বিভক্ত হলো কিভাবে? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়। মানুষকে আল্লাহ ভিন্নরূপে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তারা পরস্পরকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে, আরো ভালো করে চিনতে পারে, জানতে পারে। ঝগড়া-ফ্যাসাদ করার জন্য নয়, কিংবা তাদের মধ্যে কেউ উত্তম, কেউ অধম- এ কারণেও নয়। কিন্তু মানুষ তার কুবুদ্ধি দিয়ে সেই ভিন্নতার সম্পূর্ণ উল্টো অর্থ বের করেছে। এই ভিন্নতার অযুহাত দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে শুরু করেছে বিদ্বেষমূলক প্রতিযোগিতা, মারামারি, হানাহানি, যুদ্ধবিগ্রহ ও স্বার্থের খেলা। সে যা-ই হোক, এ প্রসঙ্গে কবির সুমন তাঁর ওই গানে ঠিকই বলেছেন, 'ক্ষিধের কিন্তু সীমান্ত নেই, নেই চিতা নেই কবরটাও,/ যুদ্ধটাকে চিতায় তুলো, যুদ্ধটাকে কবর দাও।' যে দেশে দারিদ্র্য আছে, অভাব আছে, ক্ষিধে আছে, সে দেশের মানুষকে কৃত্রিম রাষ্ট্রীয় সীমান্ত দিয়ে আটকে রাখা যায় না। সেটা কোনো যুগে কোনো কালেই সম্ভব হয়নি, এখনো সম্ভব নয়। ক্ষিধের জ্বালায়, উন্নত জীবনের অন্বেষণে মানুষ আজ মরক্কো থেকে জিব্রাল্টার সাঁতরে স্পেনে যাচ্ছে। জীবিকার অন্বেষণে অনবরত এলোপাতাড়ি ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে। এই চলাফেরায়, এই যাওয়া-আসায় সবচেয়ে বড় বাধা আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসীমার নিয়ম-কানুন ও বাধ্যবাধকতা। মানুষের সৃষ্ট কৃত্রিম সীমান্তের কারণে মানুষ সহজে চলাফেরা করতে পারে না। রুজিরোজগারের জন্য স্বাভাবিকভাবে সহজে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারে না। সীমান্ত না থাকলে মানুষের এ অসুবিধা হতো না। ইদানীং এ অসুবিধা দূর হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। কিন্তু ইউরোপের এই ২৫-২৬টি দেশই তো পৃথিবী নয়, পৃথিবীটা আরো অনেক বড় এবং এর সমস্যাও অনেক বেশি, জটিল ও গভীর। যেসব দেশ অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং তুলনামূলকভাবে অল্প লোকসংখ্যাসহ বিশাল ভূখণ্ডের মালিক হয়ে বসে আছে, তারাই আজ জাতিসংঘ সনদের সবচেয়ে বড় পাবন্দ। তারা পুঁজিকে যত সহজে সীমান্ত পেরোতে দিতে চায়, শ্রমশক্তি বা গণমানুষকে তত সহজে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে দিতে চায় না।
আন্তর্জাতিক কমিউনিটি ও আইন বিশারদদের কাছে আমার প্রশ্ন, দারিদ্র্যের সীমান্ত নেই, ক্ষিধের সীমান্ত নেই, বলতে গেলে পুঁজিরও সীমান্ত নেই, সেখানে শ্রমশক্তি বা মানুষের চলাফেরায় রাষ্ট্রীয় সীমানা বাধা হয়ে দাঁড়াবে কেন? কতটুকু সফল হলাম জানি না, কবির সুমনের একটি গানের চরণের সূত্র ধরে প্রশ্নটি উত্থাপন করলাম। উত্তর আমার জানা নেই। এ নিয়ে যে কেউ ভাবতে পারেন, লিখতে পারেন, বলতে পারেন, আলাপ-আলোচনা করতে পারেন, তর্ক-বিতর্ক করতে পারেন। প্রশ্নটি সবার জন্য উন্মুক্ত রইল।
লেখক : অধ্যাপক-টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি,
এডিটর-জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ।
Awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.