বিশেষ সাক্ষাত্কার-তদন্তের ওপর নির্ভর করছে কাদের বিচার হবে by শফিক আহমেদ

[যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রস্তুতি এগিয়েচলছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আহ্বায়ক লে. জেনারেল এম হারুন-অর-রশিদ (অব.)-এর দুটি সাক্ষাত্কার ছাপা হলো।  সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।]


প্রথম আলো  যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ার সর্বশেষ অবস্থা বলুন-
শফিক আহমেদ  ১৯৭১ সালে যারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করেছে; তারা কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। সে জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন পাস করেছে। এ আইনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। বিচার কীভাবে হবে, তাও দেওয়া আছে। সুতরাং আমরা ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল করছি না।
প্রথম আলো  তদন্তকারী সংস্থা কাদের নিয়ে গঠিত হচ্ছে?
শফিক আহমেদ  সাবেক আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর—এমন পদমর্যাদাসম্পন্ন এবং গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের নিয়ে তদন্তকারী সংস্থা গঠিত হতে পারে। লোক বাছাইয়ে চারিত্রিক দৃঢ়তা, অঙ্গীকার, বিশ্বস্ততা, কঠিন শ্রমদানে সক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় দেখা হবে; যাতে তদন্তকাজে কোনো ভুলভ্রান্তি বা ব্যতয় না ঘটে।
প্রথম আলো  ট্রাইব্যুনাল গঠন কত দূর?
শফিক আহমেদ  আজকেই (বৃহস্পতিবার) আমরা একটি বৈঠকে বসেছিলাম। হাইকোর্টে কর্মরত এক বা দুজন এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজের সমন্বয়ে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা করেছি। এ ছাড়া জেলা ও হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতা রয়েছে—এমন লোকদের দিয়ে গঠিত হবে প্রসিকিউশন টিম। ১২ জনও থাকতে পারে। তদন্তকারী সংস্থা, ট্রাইব্যুনাল ও প্রসিকিউশন—এই তিনটির ব্যাপারেই আমরা মোটামুটি একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছি।
প্রথম আলো  পুরোনো হাইকোর্ট ভবনের প্রস্তুতি কত দূর?
শফিক আহমেদ  তত্কালীন পূর্ব পকিস্তানের প্রধান বিচারপতির এজলাসই হবে বিচারকক্ষ। আমরা এটা খুব সুন্দরভাবে সাজিয়েছি। বিদেশি পর্যবেক্ষক, মিডিয়া, প্রসিকিউশন, তদন্তকারী সংস্থা, ডিফেন্স কাউন্সিলরদের জন্য পৃথক বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সজ্জিতকরণের কাজ আগামী ২৪ মার্চের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছি।
প্রথম আলো  তাহলে প্রস্তুতি চূড়ান্ত বলা যায়? বাজেট বরাদ্দ?
শফিক আহমেদ  প্রায় চূড়ান্ত। বাজেটে ১০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রয়েছে।
প্রথম আলো  বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের একটা কথা পত্রিকায় এসেছে।
শফিক আহমেদ  বার কাউন্সিলের নিয়ম হলো, সেখানে আবেদন করতে হবে। তারা অনুমোদন দিলে যেকোনো বিদেশি আইনজীবী শুনানিতে অংশ নিতে পারবেন; সরকারের কোনো আপত্তি নেই। আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি।
প্রথম আলো  স্থানীয় সরকারমন্ত্রী প্রতীকী বিচারের কথা বলছেন। তিনি বলেছেন, ১০ বা ২০ হাজার লোকের বিচার হবে না—সংশোধিত আইনে কি এ রকম কিছু রয়েছে?
শফিক আহমেদ  না। কাদের বিচার করা হবে আর কাদের হবে না, তা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে তদন্তের ওপর। তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। নতুন আইনে প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠানের কোনো কথা বলা নেই।
প্রথম আলো  সাধারণ নাগরিকও তো সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে সরাসরি তদন্তকারী সংস্থার শরণাপন্ন হতে পারবে? সরকারের কোনো ভূমিকা রাখার দরকার নেই?
শফিক আহমেদ  অবশ্যই। ভুক্তভোগী যে কেউ তথ্য-প্রমাণ নিয়ে প্রতিকারপ্রার্থী হতে পারবেন। স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থার কাছে যে কেউ অভিযোগ নিয়ে আসতে পারবেন।
প্রথম আলো  এ বিষয়ে আর কোনো বিধিবিধান তৈরি করার বিষয় আছে কিনা?
শফিক আহমেদ  সরকারের হাতে আর কিছু নেই। ট্রাইব্যুনাল তার দরকারমতো বিধি করে নেবে। আইন সেই এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালকে দিয়েছে। আমরা তো আইনে কিছু সংশোধনী এনেছি। আগে ছিল শুধু অক্সিলারি ফোর্সের বিচার হবে। এখন যেকোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে। ব্যক্তির দ্বারা কাউকে খুন বা অপহরণের নজির আছে। বুদ্ধিজীবীদের তো দলবদ্ধভাবে ধরে নেওয়া হলো।
প্রথম আলো  আচ্ছা, প্রস্তাবিত ট্রাইব্যুনাল তো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে পারবে।
শফিক আহমেদ  নিশ্চয়। মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ, সেখানে তো গণহত্যা পরিষ্কার লেখা আছে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এর বিচার ৩৮ বছর পরে কেন? এর উত্তর হলো, অপরাধের বিচারের কোনো সময়সীমা নেই। ১০০ বছর পরেও বিচার চলে। আর আমাদের বিচারকেরা আন্তর্জাতিক মানের। তাই কম্বোডিয়ার মতো বিচারক ধার করে আমাদের বিচার চালাতে হবে না।
প্রথম আলো  আইসিসি বলেছিল যে তারা বাংলাদেশকে কারিগরি সহায়তা দেবে। তাহলে আপনারা কি কোনো বিদেশি সহায়তা নিচ্ছেন না?
শফিক আহমেদ  ট্রাইব্যুনাল যদি মনে করেন, তাহলে তারা আইসিসির কাছ থেকে কোনো সহায়তা নিতে পারেন। এ বিষয়ে সরকারের কোনো বক্তব্য নেই।
প্রথম আলো  পাকিস্তানের হাইকমিশনারের মন্তব্য নাকচ করে আপনার দেওয়া বক্তব্যের পর সে দেশের সরকারের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া মিলেছে কিনা?
শফিক আহমেদ  না। তবে একটি কথা এখানে পরিষ্কার করে বলা দরকার। পাকিস্তানি হাইকমিশনার বলেছেন, ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আবার বিচার কী? আমরা তো ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল গঠন করছি না। আমরা তো যুদ্ধবন্দীদের বিচার করছি না। আমরা বিচার করছি, যারা এ দেশে বসবাস করছেন এবং যাঁরা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন।
প্রথম আলো  আপনার সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফরে অ্যাটর্নি জেনারেলও সঙ্গী ছিলেন। এই বিচারের বিষয়টি নিয়ে ওয়াশিংটনে আলোচনা করেছেন কিনা? তাদের কেমন মনোভাব দেখলেন?
শফিক আহমেদ  খুবই ইতিবাচক মতবিনিময় হয়েছে। তারা একটি বিষয় পুনর্ব্যক্ত করেছে যে বিচারের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে। আমি লাইব্রেরি অব কংগ্রেস পরিদর্শন করেছি। তারা আশ্বস্ত করেছে যে তখনকার পত্রপত্রিকার দরকারি ক্লিপিং আমাদের সরবরাহ করা হবে। এ বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করতে আমরা ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাসকে ইতিমধ্যে নির্দেশ দিয়েছি।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
শফিক আহমেদ  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.