দিল্লির চিঠি-ভগৎ সিংয়ের স্মৃতি by কুলদীপ নায়ার
ভগৎ সিংয়ের শাহাদাত আর পাকিস্তানের জাতীয় দিবস পড়েছে একই দিনে—২৩ মার্চ। কিন্তু পাকিস্তানে এখন ভগৎ সিংকে খুব অল্প লোকেই মনে রেখেছে। তাঁকে এবং তাঁর দুই সহযোদ্ধা সুখদেব ও রাজগুরুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার সেই ঘটনাটিকে স্মরণ করার জন্য কোনো স্মৃতিফলক নেই।
১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ লাহোর সেন্ট্রাল জেলে তাঁদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। সেই জেলখানাটি বিশেষভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। তার সেলগুলো এমনভাবে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন ওই তিন শহীদের ফাঁসির কোনো চিহ্নই কর্তৃপক্ষ রাখতে চায় না। এটা একটা দুঃখের বিষয়, কারণ দেশভাগের অনেক আগেই ভগৎ সিংয়ের আত্মবলিদানের ওই ঘটনাটি হতে পারত পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে একটা সংযোগসূত্র।
আজ থেকে তিন বছর আগে আমরা কয়েকজন লাহোরে সেই জায়গাটি খুঁজে বের করেছিলাম, যেখানে ভগৎ সিং ও তাঁর দুই কমরেডকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। যে জায়গায় তাঁদের ফাঁসিকাষ্ঠ তৈরি করা হয়েছিল, তার নাম রাখা হয়েছে শাদমান (সুখের আবাস)। ওই পাড়ার বাসিন্দাদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁরা জানেন কি না ভগৎ সিং কে ছিলেন। অনেকেই তাঁর নাম শুনেছেন। তাঁকে যে বন্দী করা হয়েছিল, ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, এ কথাও ভাসা ভাসাভাবে জানেন কেউ কেউ। পঞ্চাশের কোঠায় বয়স এমন এক ব্যক্তি বললেন, ‘আমরা যখন এখানে আসি তখন শুধুই পুলিশ কোয়ার্টার ছিল। এই কলোনি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কোয়ার্টার সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’ সে সময়ের লাহোরে ডেপুটি কমিশনার তো ভগত্ সিংয়ের নামটাই কখনো শোনেননি।
সৌভাগ্যের বিষয়, ফাঁসির জায়গাটি প্রধান সড়ক থেকে একটু দূরে। সেখানে একটা পুকুর আছে, যা কিনা ওই এলাকায় একটা প্রশান্ত ভাব এনে দিয়েছে। সেবার পাকিস্তানের জাতীয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা এড়ানোর জন্য আমরা ভগৎ সিংসহ তিন শহীদকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরের বছর সেখানে আমরা জড়ো হতেই পারিনি, কারণ সরকার সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। আর এ বছর লাহোরে একের পর এক বোমা বিস্ফোরণের কারণে আমরা ওদিকে যেতেই পারিনি।
ফাঁসির মঞ্চ যেখানে তৈরি করা হয়েছিল, তার পাশের ব্যস্ত ট্রাফিক চত্বরটি নিয়ে একটা গল্প আছে যা লোকে বহুদিন ধরে বলে আসছে। এই চত্বরই সেই জায়গা, যেখানে গুলি করা হয়েছিল আহমেদ রেজা কাসুরির বাবা, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নওয়াজ মোহাম্মদ আহমেদ খানকে। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো কাউকে ‘হুকুম দিয়েছিলেন’ তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী কাসুরিকে হত্যা করতে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে যখন বুলেট ছোড়া হয়, তখন কাসুরি ওই চত্বর পার হচ্ছিলেন। তাঁর পাশে বসেছিলেন তাঁর বাবা; ঠিক ওই ফাঁসিমঞ্চের কাছাকাছি জায়গাতেই গুরুতর জখম হন কাসুরির বাবা। ভগত্ সিং ও তাঁর দুই কমরেডের ফাঁসি কার্যকর করার পর তাঁদের দেহ শনাক্ত করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন যেসব কর্মকর্তা, কাসুরির দাদা ছিলেন তাঁদের একজন। পুরোনো লোকেরা মনে করেন, ভগৎ সিংদের ফাঁসিমঞ্চের কাছাকাছি ওই চত্বরে মোহাম্মদ আহমেদ খান যেদিন জখম হন, সেদিন থেকেই কাসুরির বংশকে পেয়ে বসে প্রতিহিংসা। পরিহাসের কথা, জুলফিকার আলি ভুট্টোকেও প্রাণ দিতে হয়েছে ফাঁসির মঞ্চে।
ভগত্ সিং ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা ধর্মনিরপেক্ষ বিপ্লবী, যাঁর কোনো সংস্কার বা বিশ্বাসের সীমান্ত ছিল না। তাঁর কাছে পৃথিবীটা ছিল ধনী ও গরিবে বিভক্ত। তাঁর পৃথিবীতে ধর্মভেদ, জাতিভেদ বলে কিছু ছিল না। ‘কেন আমি নাস্তিক’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে ভগৎ সিং লিখেছেন, ‘যে মানুষ প্রগতির পক্ষে তাকে পুরোনো বিশ্বাসের প্রত্যেকটি বিষয়কেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। যথেষ্ট যুক্তিতর্ক ও বিচার-বিবেচনার পর যদি কেউ কোনো তত্ত্ব বা দর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে তার বিশ্বাসকে স্বাগত জানাতে হয়। তার চিন্তাভাবনা ভুল বা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কিন্তু তা শোধরানোর সুযোগ আছে, কারণ সে পরিচালিত হয় বিচারবুদ্ধির দ্বারা, অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা নয়। বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক, তা মস্তিষ্ককে অকেজো করে দেয়, মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল বানিয়ে তোলে।’
বন্দিদশার পুরোটা সময় ভগৎ সিং নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। তিনি প্রচুর বই পড়তেন, পড়তে পড়তে যে কথাগুলো তাঁর ভালো লাগত, সেগুলো টুকে রাখতেন নিজের ডায়েরিতে। এমনই টুকে নিয়েছিলেন আমেরিকার সমাজতন্ত্রী ঔপন্যাসিক আপটন সিনক্লেয়ারের নোটবুক থেকে কিছু কথা। সিনক্লেয়ার লিখেছিলেন, ‘একজন মানুষকে অমরত্বে বিশ্বাসী করে তুলুন, তারপর তার সমস্ত ধনসম্পত্তি কেড়ে নিতে যান, দেখবেন সে আপনাকে অবলীলায় তার সবকিছু দিয়ে দেবে। ধর্মগুরু আর ক্ষমতাধরদের মধ্যকার আঁতাতের ফলেই তৈরি হয়েছে কারাগার, ফাঁসিকাষ্ঠ আর এই সমস্ত তত্ত্ব।’
২৩ মার্চ অতিশয় এক বেদনার দিন। প্রতিদিন সকালে যেভাবে রাজবন্দীদের সেল থেকে বের করা হতো, সেভাবেই শুরু হয়েছিল সেই দিনটিও। রাজবন্দীরা সাধারণত সারা দিন সেলের বাইরেই থাকতেন, সন্ধ্যার পর তাঁদের আবার সেলে ঢোকানো হতো। কিন্তু সেই ২৩ মার্চ কারাগারের ওয়ার্ডেনের আবির্ভাব ঘটে সন্ধ্যার বেশ আগেই। বিকেল চারটায় তিনি সব রাজবন্দীকে সেলে ফিরে যেতে বলেন। রাজবন্দীরা স্বভাবতই অবাক হন। কারণ সেলে ঢোকার সময় হতে তখন অনেক বাকি। অন্যান্য দিন সূর্যাস্তের পরও অনেকক্ষণ তাঁরা বাইরেই থাকতেন, ওয়ার্ডেনের বকাঝকা হজম করেও। কিন্তু সেদিন তাঁকে শুধু কঠোরই দেখাচ্ছিল না, তাঁর ভাবভঙ্গিতে ছিল একটা দৃঢ়তা। রাজবন্দীরা জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেননি, শুধু আপনমনে বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘ওপরের হুকুম!’ রাজবন্দীরা তখনই বুঝে ফেলেছিলেন, ভগত্ সিং ও তাঁর দুই সহযোদ্ধার ফাঁসি কার্যকর হতে যাচ্ছে।
ফাঁসিকাষ্ঠটি পুরোনো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দশাসই জল্লাদেরা বুড়ো ছিল না। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন যুবকের প্রত্যেকে দাঁড়ালেন পৃথক কাঠের পাটাতনের ওপর, প্রত্যেক পাটাতনের নিচে একটি করে পানিভরা গভীর কূপ। ভগত্ সিং রয়েছেন দুজনের মাঝখানে। প্রত্যেকের গলায় ফাঁসি পরানো হলো। তাঁরা ফাঁসির দড়িতে চুমো দিলেন। তাঁদের হাত-পা বাঁধা হলো। জল্লাদেরা ফাঁসির দড়িগুলো টানল এবং তিন যুবকের পায়ের তলা থেকে সরিয়ে নিল কাঠের পাটাতন। বড্ড রূঢ় ব্যবস্থা। তিনটি দেহ ফাঁসিকাষ্ঠের সঙ্গে ঝুলে রইল অনেকক্ষণ। তারপর তাদের নামিয়ে আনা হলো। একজন ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে দেখে তাঁদের মৃত ঘোষণা করলেন।
পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলের যে জায়গায় ভগত্ সিং ইচ্ছা করেই একটা কম শক্তিশালী বোমা ছুড়ে মেরেছিলেন, সেখানে একটা তাম্রফলক স্থাপনে সরকারের এত অনিচ্ছা কেন আমি তা কোনোভাবেই বুঝতে পারি না। ভগৎ সিং একটা দুর্বল বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন জননিরাপত্তা ও বাণিজ্য বিরোধ সংক্রান্ত দুটি বিলের প্রতি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে। তিনি বলেছিলেন, ‘বধির কানে কথা পৌঁছাতে খুব জোরে আওয়াজ দিতে হয়।’ চিরকালীন কথা। একজন ফরাসি বিপ্লবী শহিদও এ রকম এক ঘটনায় এমন কথাই বলেছিলেন, ‘কান খুলে দেওয়ার জন্য আমাদের এই ন্যায্য পদক্ষেপ।’
আমি ছয় বছর ভারতের রাজ্যসভার সদস্য ছিলাম। সে সময় বিভিন্ন দল থেকে নির্বাচিত লোকসভার সব স্পিকারকে অনুরোধ করেছিলাম, পার্লামেন্টের পাবলিক গ্যালারির যে জায়গা থেকে ভগত্ সিং বোমাটা ছুড়েছিলেন এবং যেখানে সেটা পড়েছিল সেখানের বেঞ্চে স্মারকফলক লাগানো হোক। কিন্তু আমার সে চেষ্টায় কোনো ফল হয়নি। কিন্তু ভগত্ সিংয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এটুকু কাজ আমরা অবশ্যই করতে পারি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
আজ থেকে তিন বছর আগে আমরা কয়েকজন লাহোরে সেই জায়গাটি খুঁজে বের করেছিলাম, যেখানে ভগৎ সিং ও তাঁর দুই কমরেডকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। যে জায়গায় তাঁদের ফাঁসিকাষ্ঠ তৈরি করা হয়েছিল, তার নাম রাখা হয়েছে শাদমান (সুখের আবাস)। ওই পাড়ার বাসিন্দাদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁরা জানেন কি না ভগৎ সিং কে ছিলেন। অনেকেই তাঁর নাম শুনেছেন। তাঁকে যে বন্দী করা হয়েছিল, ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, এ কথাও ভাসা ভাসাভাবে জানেন কেউ কেউ। পঞ্চাশের কোঠায় বয়স এমন এক ব্যক্তি বললেন, ‘আমরা যখন এখানে আসি তখন শুধুই পুলিশ কোয়ার্টার ছিল। এই কলোনি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কোয়ার্টার সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’ সে সময়ের লাহোরে ডেপুটি কমিশনার তো ভগত্ সিংয়ের নামটাই কখনো শোনেননি।
সৌভাগ্যের বিষয়, ফাঁসির জায়গাটি প্রধান সড়ক থেকে একটু দূরে। সেখানে একটা পুকুর আছে, যা কিনা ওই এলাকায় একটা প্রশান্ত ভাব এনে দিয়েছে। সেবার পাকিস্তানের জাতীয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতা এড়ানোর জন্য আমরা ভগৎ সিংসহ তিন শহীদকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার পরের বছর সেখানে আমরা জড়ো হতেই পারিনি, কারণ সরকার সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। আর এ বছর লাহোরে একের পর এক বোমা বিস্ফোরণের কারণে আমরা ওদিকে যেতেই পারিনি।
ফাঁসির মঞ্চ যেখানে তৈরি করা হয়েছিল, তার পাশের ব্যস্ত ট্রাফিক চত্বরটি নিয়ে একটা গল্প আছে যা লোকে বহুদিন ধরে বলে আসছে। এই চত্বরই সেই জায়গা, যেখানে গুলি করা হয়েছিল আহমেদ রেজা কাসুরির বাবা, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নওয়াজ মোহাম্মদ আহমেদ খানকে। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো কাউকে ‘হুকুম দিয়েছিলেন’ তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী কাসুরিকে হত্যা করতে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে যখন বুলেট ছোড়া হয়, তখন কাসুরি ওই চত্বর পার হচ্ছিলেন। তাঁর পাশে বসেছিলেন তাঁর বাবা; ঠিক ওই ফাঁসিমঞ্চের কাছাকাছি জায়গাতেই গুরুতর জখম হন কাসুরির বাবা। ভগত্ সিং ও তাঁর দুই কমরেডের ফাঁসি কার্যকর করার পর তাঁদের দেহ শনাক্ত করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন যেসব কর্মকর্তা, কাসুরির দাদা ছিলেন তাঁদের একজন। পুরোনো লোকেরা মনে করেন, ভগৎ সিংদের ফাঁসিমঞ্চের কাছাকাছি ওই চত্বরে মোহাম্মদ আহমেদ খান যেদিন জখম হন, সেদিন থেকেই কাসুরির বংশকে পেয়ে বসে প্রতিহিংসা। পরিহাসের কথা, জুলফিকার আলি ভুট্টোকেও প্রাণ দিতে হয়েছে ফাঁসির মঞ্চে।
ভগত্ সিং ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা ধর্মনিরপেক্ষ বিপ্লবী, যাঁর কোনো সংস্কার বা বিশ্বাসের সীমান্ত ছিল না। তাঁর কাছে পৃথিবীটা ছিল ধনী ও গরিবে বিভক্ত। তাঁর পৃথিবীতে ধর্মভেদ, জাতিভেদ বলে কিছু ছিল না। ‘কেন আমি নাস্তিক’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে ভগৎ সিং লিখেছেন, ‘যে মানুষ প্রগতির পক্ষে তাকে পুরোনো বিশ্বাসের প্রত্যেকটি বিষয়কেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। যথেষ্ট যুক্তিতর্ক ও বিচার-বিবেচনার পর যদি কেউ কোনো তত্ত্ব বা দর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে তার বিশ্বাসকে স্বাগত জানাতে হয়। তার চিন্তাভাবনা ভুল বা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কিন্তু তা শোধরানোর সুযোগ আছে, কারণ সে পরিচালিত হয় বিচারবুদ্ধির দ্বারা, অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা নয়। বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক, তা মস্তিষ্ককে অকেজো করে দেয়, মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল বানিয়ে তোলে।’
বন্দিদশার পুরোটা সময় ভগৎ সিং নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। তিনি প্রচুর বই পড়তেন, পড়তে পড়তে যে কথাগুলো তাঁর ভালো লাগত, সেগুলো টুকে রাখতেন নিজের ডায়েরিতে। এমনই টুকে নিয়েছিলেন আমেরিকার সমাজতন্ত্রী ঔপন্যাসিক আপটন সিনক্লেয়ারের নোটবুক থেকে কিছু কথা। সিনক্লেয়ার লিখেছিলেন, ‘একজন মানুষকে অমরত্বে বিশ্বাসী করে তুলুন, তারপর তার সমস্ত ধনসম্পত্তি কেড়ে নিতে যান, দেখবেন সে আপনাকে অবলীলায় তার সবকিছু দিয়ে দেবে। ধর্মগুরু আর ক্ষমতাধরদের মধ্যকার আঁতাতের ফলেই তৈরি হয়েছে কারাগার, ফাঁসিকাষ্ঠ আর এই সমস্ত তত্ত্ব।’
২৩ মার্চ অতিশয় এক বেদনার দিন। প্রতিদিন সকালে যেভাবে রাজবন্দীদের সেল থেকে বের করা হতো, সেভাবেই শুরু হয়েছিল সেই দিনটিও। রাজবন্দীরা সাধারণত সারা দিন সেলের বাইরেই থাকতেন, সন্ধ্যার পর তাঁদের আবার সেলে ঢোকানো হতো। কিন্তু সেই ২৩ মার্চ কারাগারের ওয়ার্ডেনের আবির্ভাব ঘটে সন্ধ্যার বেশ আগেই। বিকেল চারটায় তিনি সব রাজবন্দীকে সেলে ফিরে যেতে বলেন। রাজবন্দীরা স্বভাবতই অবাক হন। কারণ সেলে ঢোকার সময় হতে তখন অনেক বাকি। অন্যান্য দিন সূর্যাস্তের পরও অনেকক্ষণ তাঁরা বাইরেই থাকতেন, ওয়ার্ডেনের বকাঝকা হজম করেও। কিন্তু সেদিন তাঁকে শুধু কঠোরই দেখাচ্ছিল না, তাঁর ভাবভঙ্গিতে ছিল একটা দৃঢ়তা। রাজবন্দীরা জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দেননি, শুধু আপনমনে বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘ওপরের হুকুম!’ রাজবন্দীরা তখনই বুঝে ফেলেছিলেন, ভগত্ সিং ও তাঁর দুই সহযোদ্ধার ফাঁসি কার্যকর হতে যাচ্ছে।
ফাঁসিকাষ্ঠটি পুরোনো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দশাসই জল্লাদেরা বুড়ো ছিল না। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন যুবকের প্রত্যেকে দাঁড়ালেন পৃথক কাঠের পাটাতনের ওপর, প্রত্যেক পাটাতনের নিচে একটি করে পানিভরা গভীর কূপ। ভগত্ সিং রয়েছেন দুজনের মাঝখানে। প্রত্যেকের গলায় ফাঁসি পরানো হলো। তাঁরা ফাঁসির দড়িতে চুমো দিলেন। তাঁদের হাত-পা বাঁধা হলো। জল্লাদেরা ফাঁসির দড়িগুলো টানল এবং তিন যুবকের পায়ের তলা থেকে সরিয়ে নিল কাঠের পাটাতন। বড্ড রূঢ় ব্যবস্থা। তিনটি দেহ ফাঁসিকাষ্ঠের সঙ্গে ঝুলে রইল অনেকক্ষণ। তারপর তাদের নামিয়ে আনা হলো। একজন ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে দেখে তাঁদের মৃত ঘোষণা করলেন।
পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলের যে জায়গায় ভগত্ সিং ইচ্ছা করেই একটা কম শক্তিশালী বোমা ছুড়ে মেরেছিলেন, সেখানে একটা তাম্রফলক স্থাপনে সরকারের এত অনিচ্ছা কেন আমি তা কোনোভাবেই বুঝতে পারি না। ভগৎ সিং একটা দুর্বল বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন জননিরাপত্তা ও বাণিজ্য বিরোধ সংক্রান্ত দুটি বিলের প্রতি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে। তিনি বলেছিলেন, ‘বধির কানে কথা পৌঁছাতে খুব জোরে আওয়াজ দিতে হয়।’ চিরকালীন কথা। একজন ফরাসি বিপ্লবী শহিদও এ রকম এক ঘটনায় এমন কথাই বলেছিলেন, ‘কান খুলে দেওয়ার জন্য আমাদের এই ন্যায্য পদক্ষেপ।’
আমি ছয় বছর ভারতের রাজ্যসভার সদস্য ছিলাম। সে সময় বিভিন্ন দল থেকে নির্বাচিত লোকসভার সব স্পিকারকে অনুরোধ করেছিলাম, পার্লামেন্টের পাবলিক গ্যালারির যে জায়গা থেকে ভগত্ সিং বোমাটা ছুড়েছিলেন এবং যেখানে সেটা পড়েছিল সেখানের বেঞ্চে স্মারকফলক লাগানো হোক। কিন্তু আমার সে চেষ্টায় কোনো ফল হয়নি। কিন্তু ভগত্ সিংয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এটুকু কাজ আমরা অবশ্যই করতে পারি।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments