চারদিক-তবে কি আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা নন? by দীপ্তি লাহিড়ী

মাটির দোতলা বাড়ি। পাকিস্তানি সেনারা এসেছে শুনে তিনি দোতলায় চলে যান। নিচ থেকে দোতলায় ওঠার দরজার একটি কপাট বন্ধ করে তার পাশে গিয়ে বসেন। হাতে একটি রামদা। সে সময় প্রতিদিনই যে রামদা তিনি ধার করে রাখতেন! বাড়ির ভেতর ঢুকে এক পাকিস্তানি সেনা যখন দোতলায় উঠতে যান, তখনই রামদার কোপ দিয়ে তাঁকে


হত্যা করেন। দ্বিতীয় সেনাসদস্য দোতলায় উঠতে গেলে তাঁকেও একইভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। হানাদারেরা ভেবেছিল, অনেক মুক্তিযোদ্ধা বুঝি বাড়িটির দোতলায় লুকিয়ে আছে। তাই আরও শক্তি সঞ্চয় করার জন্য তারা চলে যায়। যাওয়ার আগে বাড়িতে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
এতক্ষণ যাঁর কথা বললাম, তিনি আমার বাবা। প্রতুল চন্দ্র গোস্বামী। পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার বল্লভপুর গ্রামের গোস্বামীবাড়ির বাসিন্দা আমরা। বড় বাড়ি। গোসাইবাড়ি হিসেবে এক নামে সবাই চেনে।
বাবার জন্ম হয় ১৯১৮ সালে চাটমোহর উপজেলার বল্লভপুর গ্রামে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। আত্মীয়-শরিকসহ আমাদের বিশাল পরিবার। সাত বছর বয়সে মাকে হারান। হোমিওপ্যাথি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। হোমিও চিকিৎসক হিসেবে এলাকায় তাঁর সুনাম ছিল। এলাকার সবাই তাঁকে ভালোবাসত, সমীহ করত।
পাকিস্তানি সেনারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে চলে যাওয়ার পর বাবা ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে মারতে পারেনি। কিন্তু ধরা পড়ে যান এলাকার মুসলিম লীগের সদস্য রাজাকারদের কাছে। তারা বাবাকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এর পর থেকে বাবার আর কোনো খবর আমরা পাইনি।
১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল তাড়াশে অভিযান চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের মূল টার্গেট ছিল আমাদের বাড়ি। কেননা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ওই এলাকায় আমাদের বাড়িই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মূল আখড়া। ট্রেনিং থেকে খাওয়াদাওয়া—সবকিছুই এখানে হতো। ভোরে তিন দিক থেকে তাড়াশ আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। খবর জানামাত্রই বাবা আমাদের সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। আমাকেসহ পরিবারের সবাইকে তিনি পাঠিয়ে দেন পাশের গ্রামের নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু কোনোমতেই তিনি বাড়ি ছাড়তে রাজি হলেন না। তাঁর এক কথা, ‘আমি চলে গেলে সবকিছু লুট হয়ে যাবে।’ ওই দিনই আমাদের বাড়িতে হামলা হয়। তাড়াশ দখল করে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। পরে সামান্য কিছু টাকা ও শুকনো খাবার নিয়ে আমরা ভারতের পথে পা বাড়াই। বাবার দেখা আর পাইনি।
ডিসেম্বরের শেষের দিকে দেশে ফিরে আসি। পরিচিতজনদের কাছে বাবার বীরত্বগাথার কথা জানতে পারি। চারদিকে তখন যুদ্ধের চিহ্ন। সমগ্র দেশটাই যেন পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। একটা প্রলয় যেন বয়ে গেছে আমাদের বাড়িটির ওপর দিয়ে। বাড়ির একটা অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। টিনের চাল, মাটির দেয়াল ফুটো হয়ে গেছে। বুঝিবা গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে। বাড়ির ভেতর সবকিছুই লন্ডভন্ড। রক্তের পুরোনো দাগ। ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন মা। সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় তিন সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় আমার মায়ের কঠিন জীবনসংগ্রাম। তাঁর মনে ক্ষীণ আশা কখনো নিভতে দেখিনি—তাঁর স্বামী একদিন ফিরে আসবেনই। বাবাকে আমরা আর খুঁজে পাইনি। তিনি নিহত হয়েছেন? নিরুদ্দেশ? কোনো কিছুই আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে শাশ্বত, স্নেহময় সম্পর্কের আধার বাবার আদর। বাবা মানে পরম আশ্রয়। পরম নির্ভরতার স্থান। পনেরো বছর বয়সেই বাবাকে হারিয়েছি। বাবার সঙ্গে শেষ দেখা ওই একাত্তরের ২৭ এপ্রিল। বাবার মাথার চুলগুলোতে তখন পাক ধরেছে। চোখে উঠে এসেছে চশমা। আপাতকঠোর হলেও দুই ঠোঁটের ফাঁকে স্মিত এক টুকরো হাসি সব সময় লেগেই থাকত তাঁর।
আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন যুদ্ধের সূচনালগ্নে। দুজন পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করেছেন। তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা নন? রাজাকাররা তাঁকে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার পর থেকেই তিনি নিখোঁজ। যিনি কিনা দুজন হানাদারকে হত্যা করেছেন, তাঁকে হানাদারেরা বাঁচিয়ে রাখবে, তা হতে পারে না। আমার বাবা কি শহীদ নন? আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের ধারার সঙ্গে মিশে আছে তাঁর রক্ত? তাও আমরা জানি না। দেশের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম নেই। নাম নেই শহীদের তালিকায়। লাখো শহীদের এ দেশে আরও অনেক শহীদ আছেন, যাঁদের নাম তালিকায় নেই। যাঁদের খবর গত ঊনচল্লিশ বছরেও দেশবাসী জানতে পারেনি। নাম না-জানা এমন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা জরুরি নয় কি?

No comments

Powered by Blogger.