খোলা চোখে-একাত্তরের গণহত্যা ও ‘ক্ষমা প্রার্থনা’র রাজনীতি by হাসান ফেরদৌস

বাংলাদেশ আবারও দাবি তুলেছে একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে তাঁর দপ্তরে ডেকে এনে এই ক্ষমা প্রার্থনার দাবি তুলেছিলেন। পররাষ্ট্রসচিবও সে দাবির পুনরাবৃত্তি করেছেন।


পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে, নতুন করে এ নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। ১৯৭৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান—এ তিন দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে সে প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেছে। পেছনে নয়, আসুন এগোই—এই বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানি মুখপাত্র।
সামনে এগোনো নিয়ে কোনো পক্ষেরই আপত্তি নেই, কিন্তু সামনে এগোতে হলে কখনো কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। যেকোনো গাড়ির চালককে জিজ্ঞেস করলেই সে কথা জানা যাবে। একাত্তরের গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনার দাবি বাংলাদেশের জন্য একটি নীতিগত অগ্রাধিকার। স্বাধীনতার পর গত ৩৯ বছরে প্রায় সব সরকারই ক্ষমা প্রার্থনার দাবি তুলেছে, কখনো সরবে, কখনো কিঞ্চিত চিঁচিঁ স্বরে। সে দাবির জবাবে আনুষ্ঠানিকভাবে আইন পরিষদে প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে পাকিস্তান কখনোই ক্ষমা চায়নি—ঠিক যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস একটি সর্বসম্মত প্রস্তাবে দাসপ্রথার জন্য কৃষ্ণকায়দের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছে। অথবা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে দেশের আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্য-বঞ্চনার জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। শুধু ক্ষমা চাওয়াই নয়, ওই দুটি দেশ আদিবাসীদের ক্ষতিপূরণের দাবিও মেনে নিয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান বড়জোর দেঁতো হাসি দিয়ে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করে ‘ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট’-এর নীতিবাক্য শুনিয়েছে।
বাংলাদেশের ভেতরে আমরা অনেকেই ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে থাকি। পাকিস্তানেও কিছু লোক আছেন, যাঁরা এ দাবির সমর্থন করেন। তাঁদের কেউ কেউ লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন। কিন্তু সবই হয়েছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তা গৃহীত হয়নি। ফলে এ জাতীয় দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষমাপ্রার্থনা নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। একাত্তরের গণহত্যায় পাকিস্তানের ভূমিকা প্রমাণিত সত্য। সীমিত পর্যায়ে হলেও হামুদুর রহমান কমিশনের বিলম্বে প্রকাশিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে পাকিস্তান নিজেও তা মেনে নিয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে এমন একটি অপরাধের বোঝা পাকিস্তানের সরকার ও সে দেশের মানুষের কাঁধে তত দিন চেপে থাকবে, যত দিন না ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে এর সমাপ্তি বা ক্লোজার অর্জিত হয়। নিজের নৈতিক স্বস্তি ও চৈতন্যের শুদ্ধির জন্য পাকিস্তান ও সে দেশের মানুষেরই উচিত নিজ উদ্যোগে সে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া।
ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন কোনো ব্যাপার নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নািস বাহিনীর নরমেধযজ্ঞের পর এ প্রশ্ন একটি নীতিগত দাবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। শুধু ক্ষমা প্রার্থনাই নয়, সেই অপরাধীদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ এ দাবির অপরিহার্য অংশ। ইহুদি নিধনের অপরাধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জার্মানি ৮০০ কোটি ডলার প্রদান করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অন্যায়ভাবে জাপানি-আমেরিকানদের অন্তরীণ রাখার অপরাধের জন্য আমেরিকা ক্ষমা প্রার্থনার পাশাপাশি যেসব জাপানি-আমেরিকান এখনো বেঁচে আছেন, তাঁদের বা তাঁদের বংশধরদের প্রত্যেককে ২০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়। বস্তুত ফ্যাসিবাদের সমর্থক প্রতিটি দেশই কোনো না কোনোভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। এসব ক্ষমা অধিকাংশই এসেছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থাত্ আইন পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের কাছ থেকেও ক্ষমা প্রার্থনা আমরা দেখেছি, কিন্তু তাকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা বলে গণ্য করা হয়নি। জাপানের কথা ধরুন। গত ষাট বছরে জাপানের প্রায় প্রতিটি সরকারপ্রধান কোনো না কোনো সময় জাপানের কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাও চেয়েছেন। এমনকি সম্রাট হিরোহিতও একাধিকবার তাঁর ব্যক্তিগত অনুতাপের কথা বলেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯৯৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পঞ্চাশতম বার্ষিকীর সময় জাপানের পার্লামেন্টে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত এ বিতর্ক থামেনি।
যে কজন লেখক-গবেষক ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে নিরীক্ষা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন শহরের এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেলিসা নোবলস তাঁদের অন্যতম। এ প্রশ্নে ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ দি পলিটিকস অব অফিশিয়াল অ্যাপোলজিস (ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউইয়র্ক)। সেখানে অধ্যাপক নোবলসের যুক্তি, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান যতই দুঃখ প্রকাশ বা এমনকি ক্ষমা প্রার্থনা করুন না কেন, আইন পরিষদে সে ক্ষমা প্রার্থনার সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে তর্ক শেষ হওয়ার নয়। আইন পরিষদের প্রস্তাব মানে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিতর্ক করা বা জাতীয় পর্যায়ে একধরনের সংলাপ চালানো। কোনো সরকারপ্রধান যখন ক্ষমা প্রার্থনা করেন বা দুঃখ প্রকাশ করেন—যেমন পাকিস্তানি রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল মোশাররফ ২০০২ সালে ঢাকায় এসে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন—সেটি তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতিরই প্রকাশ। এ নিয়ে দেশের মানুষ বা জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁর হয়তো কোনো মতবিনিময়ই হয়নি। ফলে তেমন দুঃখপ্রকাশকে আনুষ্ঠানিক ব্যাপার বলে ভাবার কোনো কারণ নেই।
উদাহরণ হিসেবে আমেরিকায় দাসপ্রথার ব্যাপারটি ভাবুন। গত ১০০ বছরে আমেরিকার ভেতরে ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে এ ব্যাপারে অসংখ্যবার ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। এমনকি একাধিক অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে সেখানকার আইন পরিষদের প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমেও ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ উভয়েই ব্যক্তিগতভাবে দাসপ্রথার জন্য আমেরিকার শ্বেতকায়দের পক্ষে দেশের ও আফ্রিকার কৃষ্ণকায়দের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু তার পরও বিতর্ক শেষ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে ও ২০০৯ সালে মার্কিন সিনেটে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে এ প্রশ্নের সমাপ্তি টানা হয়। দেশের দুই প্রধান দলের পক্ষে সিনেটর হারকিন (ডেমোক্রেট) ও স্যাম ব্রাউনকে (রিপাবলিকান) নিজ নিজ দলের হয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে সে সময় বলেছিলেন, শুধু এই প্রস্তাব গ্রহণের ভেতর দিয়ে দাসপ্রথার মতো একটি জঘন্য অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয়তো হবে না, কিন্তু সেই প্রায়শ্চিত্ত অর্জনের পথে এ ক্ষমাপ্রার্থনা অবশ্যই প্রথম পদক্ষেপ।
সাম্প্রতিক সময়ে দীর্ঘ তর্ক-বিতর্কের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীদের প্রতি শত শত বছরের বৈষম্য ও নির্যাতনের জন্য। কানাডাও ক্ষমা চেয়েছে তার দেশের আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের কাছে। এ তিন দেশেই আদিবাসীদের সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
একাত্তরের প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের মতান্তর তিনটি বিষয় নিয়ে—একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা, একাত্তর-পূর্ব সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা ও বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের স্বদেশে প্রত্যর্পণ। ১৯৭৪ সালে ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তার কোথাও এ তিনটি প্রশ্নের কোনোটিই স্থান পায়নি। সে চুক্তিপত্রের মূল বিষয় ছিল ভারতে আটক পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যর্পণ ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। আমরা জানি, সে চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি কার্যত তুলে নেয়, ভারত থেকেও সব বন্দী পাকিস্তানি সেনা দেশে ফিরে যায়। তাহলে গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার কী হলো? ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল ত্রিদেশীয় চুক্তি স্বাক্ষরের পর যে যৌথ বিবৃতি গৃহীত হয়, তাতে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের প্রধান আজিজ আহমদের বরাতে বলা হয়, ‘তাঁর সরকার (অর্থাত্ পাকিস্তান) একাত্তরে যে অপরাধ “হয়তো সংঘটিত হয়েছে” তার প্রতি নিন্দা ও দুঃখ প্রকাশ করে (‘হিস গভর্নমেন্ট কনডেমন্ড অ্যান্ড ডিপলি রিগ্রেটেড অ্যানি ক্রাইম দ্যাট মে হ্যাভ বিন কমিটেড’)।’ অর্থাত্ ‘অপরাধ’ হলেও হয়ে থাকতে পারে। হয়ে থাকলে পাকিস্তান এর জন্য দুঃখিত আর না হলে তো কথাই নেই। সোজা কথায়, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ জাতীয় কথার মারপ্যাঁচে পাকিস্তান ক্ষমাপ্রার্থনার ব্যাপারটির ইতি টানার চেষ্টা করে।
এরপর আরও দুবার পাকিস্তান সরকারি পর্যায়ে একাত্তরের গণহত্যার জন্য ‘দুঃখ প্রকাশ’ করে—উভয়বারই তারা গণহত্যা শব্দটি এড়িয়ে যায়। ১৯৭৪ সালের জুনের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় সরকারি সফরে আসেন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। সে সময় তাঁর সম্মানে প্রদত্ত এক নাগরিক সংবর্ধনায় ভুট্টো বলেছিলেন, ‘একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, তার জন্য আমি শোক প্রকাশ করছি।’ একই সভায় তিনি ‘মহানবীর নামে আপনাদের কাছে তওবা করছি’ বলে বিলাপও করেন। নিউইয়র্ক টাইমস তাঁর সেই কুম্ভীরাশ্রুকে ‘ভুট্টোর ক্ষমা প্রার্থনা’ শিরোনামে প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। কিন্তু ভুট্টো তাঁর ভাষণের কোথাও একবারের জন্য গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার করেননি, এমনকি ক্ষমা প্রার্থনার কথাও উল্লেখ করেননি। (সেই সফরের সময় ভুট্টো বাংলাদেশ ও তার মানুষদের কী অবজ্ঞার চোখে দেখেছিলেন, সে বিবরণ পড়ার জন্য বর্তমান লেখকের গ্রন্থ ১৯৭১: বন্ধুর মুখ, শত্রু ছায়া, প্রথমা প্রকাশন, পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি)।
অন্য যে পাকিস্তানি সরকারপ্রধান একাত্তরের গণহত্যার জন্য ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেন, তিনি হলেন সাবেক সামরিক একনায়ক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। ২০০২ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় সরকারি সফরে গিয়ে মোশাররফ সাভার স্মৃতিস্তম্ভের মন্তব্যের খাতায় লিখেছিলেন, ‘আপনাদের পাকিস্তানি ভাই ও বোনেরা একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য আপনাদের বেদনার সঙ্গে একাত্মবোধ করে। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ে যে মাত্রাতিরিক্ত ঘটনা ঘটে, তা দুঃখজনক।’ পরে রাষ্ট্রীয় ভোজে ভাষণ দিতে গিয়ে মোশাররফ তাঁর দুঃখের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন, সঙ্গে এ কথা যোগ করেন যে, ‘এই ট্র্যাজেডি, যা আমাদের দুই দেশের ওপর ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে, এর জন্য আমরা দুঃখিত।’
মোশাররফের ওই দুঃখপ্রকাশকে তত্কালীন বাংলাদেশে অনেকেই একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা বলে তাঁকে বাহবা দিয়েছিলেন। সে সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। সেই রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় মোশাররফের ভাষণের জবাবে বেগম জিয়া বললেন, ‘একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য এমন খোলামেলা বক্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কোনো সন্দেহ নেই, এ বক্তব্য পুরোনো ক্ষত মেটাতে সাহায্য করবে। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই এবং ভাইয়ের মতো একযোগে কাজ করতে চাই।’
কী আশ্চর্য! এক জেনারেল এসে একাত্তরের গণহত্যাকে ‘দুঃখজনক ঘটনাবলি’ বলে লেকচার দিয়ে গেলেন, আর আমরা তাতেই খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলাম!
খোদ পাকিস্তানের ভেতরেই অনেকে এ দুঃখ প্রকাশ যথেষ্ট নয় বলে এর সমালোচনা করেছিলেন। পাকিস্তানের বেসরকারি মানবাধিকার কমিশন পত্রিকায় পূর্ণপাতা বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছিল, মোশাররফ দুঃখ প্রকাশ করে ঠিক করেছেন, কিন্তু শুধু দুঃখ প্রকাশই যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানের ৫১টি সুশীল সমাজভুক্ত প্রতিষ্ঠান সে সময় এক যৌথ বিবৃতিতে জানায়, একাত্তরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা গণহত্যা। মোশাররফের দুঃখপ্রকাশের ভেতর দিয়ে সেই গণহত্যার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার অনুভূতি প্রকাশিত হলেও তা যথেষ্ট নয়। পাকিস্তান এখনো পুরোপুরি ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। পাকিস্তান ও তার নাগরিকদের পক্ষে সে সময় একটি মিছিল বের করে বলা হয়, একাত্তরের গণহত্যার জন্য আমরা তোমাদের (বাংলাদেশের) কাছে ক্ষমা চাইছি।
প্রায় একই সময় করাচির ডন পত্রিকায় আমির আকিল লিখেছিলেন, ‘সবাই বলছে, সময় এসেছে ক্ষমা করার ও পুরোনো ঘটনা ভুলে যাওয়ার। আমাদের ক্ষমা করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে শুধু বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু ভুলে যাওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, এর জবাবে বলা যায়, বাংলাদেশ সে ঘটনা কখনোই ভুলবে না, আর আমাদের (পাকিস্তানিদের) তা কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। ১৯৭১ সালের ঘটনাবলির পেছনে যে সত্য নিহিত, তা এখনো আমাদের চৈতন্যে প্রবেশ করেনি, অথবা তা আমাদের সম্মিলিত স্মৃতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত হতে দেওয়া হয়নি। আর সে জন্য প্রয়োজন, সে সময় কী ঘটেছিল এবং কেন ঘটেছিল, তা উপলব্ধি করা। যাতে এই ঘটনা আর কখনো না ঘটে তা নিশ্চিত করতেই দরকার এ উপলব্ধির।’
আমার মনে হয়, আমির আকিল ঠিকই বলেছেন। ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি পাকিস্তানিদের নিজেদের দায়ভার এবং তাদের চৈতন্যের শুদ্ধির জন্যই ক্ষমাপ্রার্থনা প্রয়োজন। প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তারা কাকে দেখে—একজন খুনিকে, নাকি ঘাতকের অনুতপ্ত উত্তরসূরিকে?—এ প্রশ্নের জবাব কেবল তারাই দিতে পারবে। এ নিয়ে তাই আমার কোনো দাবি নেই, কোনো উদ্বেগও নেই। আমার সরকার এ নিয়ে শোরগোল বাঁধাক, আমি তা-ও চাই না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলি, ক্ষমা ভিক্ষার আগ পর্যন্ত সে ঘাতককে ঘৃণার অধিকারও আমার কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। কোনো শুকনো দুঃখপ্রকাশ বা এমনকি আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনার ফলেও একাত্তরের বিভীষিকা আমরা ভুলব না। একাত্তরের সেই ঘাতকদেরও আমরা কখনো ক্ষমা করব না। তবে আমি এ কথাও মানি, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুই প্রতিবেশী দেশ। দুই দেশ যদি একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে, তাতে উভয়েরই লাভ। কিন্তু সে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অর্জনের লক্ষ্যে সামনে এগোতে হলে পিছে ফিরে তাকাতেই হবে। পেছনে এখনো যে রক্তের করাল চিহ্ন, তা স্বীকার না করে এগোনোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

১৫ মার্চ ২০১০, নিউইয়র্ক
 হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.