কালের পুরাণ-প্রধানমন্ত্রীর নিরুত্তাপ চীন সফর by সোহরাব হাসান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে শোরগোল উঠেছিল, চীন সফরের সময় তার শতকরা এক ভাগও লক্ষ করা যায়নি। এর অর্থ এ নয় যে তিনি ভারতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে এসেছিলেন এবং চীনে সবকিছু আদায় করতে পেরেছেন।
ভারত সফর নিয়ে শোরগোল উঠেছিল দলীয় বা গোষ্ঠী স্বার্থে, আর চীন সফর নিয়ে ওঠেনি, তাও একই কারণে। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা দেশীয় তো বটেই, বৈদেশিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও ন্যূনতম মতৈক্যে আসতে পারিনি। আমাদের রাজনীতিকেরা মুখে স্লোগান দেন ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’। কাজ করেন ঠিক উল্টোটি।
ভারত সফরের আগে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘খালি হাতে ফিরলে পথে কাঁটা বিছিয়ে দেওয়া হবে।’ চীন সফরের সময়ও তাঁর অবস্থান অভিন্ন হলে জনগণ বুঝতে পারত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই বিরোধীদলীয় নেত্রী এসব কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু তাঁরা একেবারে নিশ্চুপ থাকলেন। জাতীয়তাবাদী ঘরানার কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী প্রধানমন্ত্রীকে এই বলে মৃদু ভর্ৎসনাও করেছেন, ‘ভারতের আগে তাঁর চীনে যাওয়া উচিত ছিল।’ এই বুদ্ধিজীবীরা বিএনপির আমলে সব বোমাবাজি, জঙ্গি হামলার দায়ও চাপিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ওপর। আসলে বিরোধী শিবিরের এসব গরম কথাবার্তা বা সমালোচনার উদ্দেশ্য জাতীয় স্বার্থ রক্ষা নয়, কোনো বিশেষ দেশের প্রতি তাদের রাগ বা অনুরাগ প্রকাশ করা।
নেতা-নেত্রীরা যা-ই বলুন না কেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারত ও চীন—উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার এই দেশ দুটির কাছেও বাংলাদেশ একবারে ফেলনা নয়। দেশের আমদানি বাজার বলতে গেলে এ দুটি দেশের দখলে। নিজ নিজ স্বার্থেই তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে চাইবে। প্রশ্ন হলো, আমরা কী করব? একজনকে কাছে টানতে গিয়ে আরেকজনকে দূরে ঠেলে দেব, না উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে যতটা সম্ভব জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করব? যেকোনো দুটি দেশের সঙ্গে স্বার্থের বিরোধ থাকবে, ঝগড়াঝাঁটি থাকবে, সন্দেহ-অবিশ্বাস থাকাও অস্বাভাবিক নয়। আবার সেই ঝগড়াঝাঁটি মিটিয়ে ফেলতে হবে আলোচনার মাধ্যমে। ভারত গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ কিংবা বরাক নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখলে আমরা অবশ্যই প্রতিবাদ করব। একই ভাগে ব্রহ্মপুত্রের উৎসস্থলে চীন বাঁধ দিলেও চুপচাপ বসে থাকব না। বিএনপি সরকার তথাকথিত পূর্বমুখী কূটনীতি করে ভারতের বিরাগ ভাজন হয়েছিল, আবার ঢাকায় তাইওয়ানের বাণিজ্যিক অফিস খুলতে দিয়ে চীনকেও খেপিয়ে দিয়েছিল। অর্থাৎ তারা আম-ছালা দুটোই খুইয়েছিল। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এ ধরনের আহম্মকি শুধু সরকারকে ডুবায় না, দেশকেও একঘরে করে ফেলে।
চীন ও ভারত শুধু আমাদের দুই বৃহত্ প্রতিবেশী নয়, বিশাল অর্থনীতিরও দেশ। চীন আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতির এক নম্বর শক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ভারতও দ্রুত উন্নয়নের পথে এগোচ্ছে। দুটি দেশেরই রয়েছে উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ জনশক্তি। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে তাদের সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জরুরি নিজের সক্ষমতা বাড়ানো। পশ্চিমা দেশগুলোতে বিনা শুল্কে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে কিংবা মধ্য ও নিকট প্রাচ্যে পাঠানো অদক্ষ শ্রমিকদের রেমিট্যান্সে বেশি দিন ভালো থাকা যাবে না। দেশের দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করতে দরকার অবকাঠামোর উন্নয়ন, শিল্পবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়ানো এবং বিপুল অদক্ষ জনশক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে যারাই সহযোগিতা করবে, তাদেরই স্বাগত জানাব, দুয়ার বন্ধ করে থাকব না। দেশ বিক্রি ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার সস্তা স্লোগান দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার পরিণাম হবে আত্মঘাতী।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মনস্তাত্ত্বিক বাধা ছিল। তার ঐতিহাসিক কারণও আছে। পঁচাত্তরের পর যাঁরা এ দেশ শাসন করেছেন, তাঁরা ভারত-সোভিয়েত বলয় থেকে বেরিয়ে আসার নামে এক হাত মধ্যপ্রাচ্যে এবং আরেক হাত চীনের দিকে বাড়িয়ে দেন। মাঝখানে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছে পাকিস্তান। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এসে দুই বিশাল প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য আনার উদ্যোগ নেন। সেবার তিনি এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হয়েছেন বলা যাবে না। সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল দুই তরফেই। ইতিমধ্যে মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় বিপুল পানি গড়িয়েছে। বাংলাদেশের ডান পন্থার রাজনীতির প্রতি পশ্চিমেরও মোহ কেটে গেছে। আশা করি চীনেরও। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এগোলে চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা কঠিন নয়।
এ প্রেক্ষাপটে আড়াই মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি ও বেইজিং সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ভারত বা চীন থেকে তিনি কত বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও মঞ্জুরি আদায় করে নিতে পেরেছেন, কতটি চুক্তি করেছেন, স্বাগতিক দেশের নেতাদের কাছ থেকে কী কী আশ্বাস পেয়েছেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো দীর্ঘদিনের মনস্তাত্ত্বিক বাধাটি সরিয়ে ফেলা। এত দিন ধারণা করা হতো, চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক করতে হলে ভারতের সঙ্গে বৈরিতা দেখাতে হবে। কিংবা ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলে চীনের বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে। সারা বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধের দিন শেষ হলেও বাংলাদেশের একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে এটি পুরোপুরি রয়ে গেছে। সীমান্ত বিরোধ, পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি সত্ত্বেও ভারত ও চীন ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে পারলে আমরা কেন পারব না? মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের পছন্দ না করলেও ভারত ও চীন সেখানে চুটিয়ে ব্যবসা করছে, বিনিয়োগ করছে। কিন্তু বাংলাদেশে কেউ বিনিয়োগ করতে এলেই ‘সার্বভৌমত্ব গেল’ ‘সার্বভৌমত্ব গেল’ বলে আমরা চিত্কার করি। কী চুক্তি হচ্ছে, তার শর্ত কতটা দেশের স্বার্থানুকূল হলো—তা বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য হচ্ছে কোন দেশের সঙ্গে চুক্তিটি হলো। এ কূপমণ্ডূকতার কোনো চিকিৎসা নেই। অথচ এটা সবাই জানে যে চীন ও ভারত জাতীয় স্বার্থের বাইরে কিছু করে না, বিদেশ নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো ঝগড়ায়ও লিপ্ত হয় না।
ভারত ও চীনের সঙ্গে আমাদের পর্বতপ্রমাণ বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। চীনের অনুকূলে বছরে এ ঘাটতির পরিমাণ ৩৮০ কোটি ডলার, ভারতের অনুকূলে ২৬০ কোটি ডলার। অথচ স্রেফ রাজনৈতিক কারণে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টিই সামনে আনেন, চীনের কথা বেমালুম ভুলে যান। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে অনেক পত্রিকা পরিসংখ্যান তুলে দিয়ে বলেছে, বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে ফেলতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময়ও তারা সে কথাটি জোর দিয়ে বললে প্রধানমন্ত্রীর হাত শক্তিশালী হতো। স্বাগতিক দেশ ভাবত, গোটা দেশ প্রধানমন্ত্রীর পেছনে আছে। অতএব, তাঁকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত বা চীন সফর কতটা সফল হয়েছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণের সময় এখনো আসেনি। তবে একটি কথা জোর দিয়ে বলা যায়, এর মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। প্রশ্ন হলো সেই সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব কি না। পারলে দেশের উন্নতি হবে, মানুষের অভাব-দারিদ্র্য কিছুটা হলেও কমবে। আর না পারলে পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর ভাষায়, সহস্র বছর ঘাস খেয়ে থাকতে হবে। চীন বা ভারত নিজের স্বার্থ বিকিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে না। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে। আলপিন থেকে পরোটা আমদানি করে কোনো দেশ টিকে থাকতে পারবে না। আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। সমুদ্রবন্দর খুলে দিতে হবে চীন, ভারত, ভুটান, নেপালসহ সব প্রতিবেশী দেশের জন্য।
শেখ হাসিনা চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কিছু উদাহরণ টানতে গিয়ে পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু একাত্তরের কথা বলেননি। বলা হয়তো কূটনৈতিক শিষ্টাচারও নয়। তবে চীন যে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তা ঐতিহাসিক সত্য। কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই। যখন যার সঙ্গে সদ্ভাব থাকলে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া যাবে, তার সঙ্গে সেটি রক্ষা করতে হবে। আবার কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে অন্যের সঙ্গে শত্রুতা করাও ঠিক হবে না। চলতি বছর বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৩৫ বছর পূর্ণ হবে। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে ১৯৭৫ সালের ২ অক্টোবর, তার আগেই ঘাতকদের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। চীনের সঙ্গে আমরা বন্ধুত্ব করব, কিন্তু একাত্তরের কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, যেমন ভুলে যাওয়া যাবে না আমেরিকার বিরোধিতার কথাও। ১৯৭১ সালে যে দেশ সহায়তা করেছে, পরবর্তীকালে তারা আমাদের জন্য ক্ষতিকর কিছু করলে তার বিরোধিতাও করতে হবে। আবার পরবর্তীকালের বন্ধু হলে একাত্তরে তার শত্রুতার কথাও ভুলে যাব না। এটিই হলো ইতিহাসের সত্য। একে অগ্রাহ্য করা কঠিন। জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দল একমত হলে বিদেশিরাও সমঝে চলবে।
চীনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন ৯১ জন। এর মধ্যে মন্ত্রী, আমলা, সাবেক আমলা, সাংবাদিকও রয়েছেন। নেতাদের রাষ্ট্রীয় সফরে এত বিরাট লটবহরের কী প্রয়োজন, বোধগম্য নয়। যাঁরা যান তাঁরাও কি দেশটি দেখার সুযোগ পান? স্বাগতিক দেশের সব আয়োজনে মনোযোগ থাকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। সেখানে সফরসঙ্গীদের কোনো কাজ থাকে না। তার পরও প্রতিবার বিশাল বাহিনী নিতে হয় তাঁদের খুশি করতে। তাঁদের মধ্যে এমন ভাগ্যবান লোকও আছেন, যাঁরা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়ের আশীর্বাদ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বাকশাল, নকশাল, নরম বা গরম জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে পার্থক্য খুবই কম। দেশের যে গরিব জনগণ প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-সাংসদ-আমলাদের বেতন-ভাতা জোগান, তার সফরসঙ্গীদের বিদেশ ভ্রমণের ব্যয় বহন করেন, তাদের জন্য তারা কী করেছেন—একবার ভেবে দেখছেন কি?
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
ভারত সফরের আগে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘খালি হাতে ফিরলে পথে কাঁটা বিছিয়ে দেওয়া হবে।’ চীন সফরের সময়ও তাঁর অবস্থান অভিন্ন হলে জনগণ বুঝতে পারত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই বিরোধীদলীয় নেত্রী এসব কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু তাঁরা একেবারে নিশ্চুপ থাকলেন। জাতীয়তাবাদী ঘরানার কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী প্রধানমন্ত্রীকে এই বলে মৃদু ভর্ৎসনাও করেছেন, ‘ভারতের আগে তাঁর চীনে যাওয়া উচিত ছিল।’ এই বুদ্ধিজীবীরা বিএনপির আমলে সব বোমাবাজি, জঙ্গি হামলার দায়ও চাপিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ওপর। আসলে বিরোধী শিবিরের এসব গরম কথাবার্তা বা সমালোচনার উদ্দেশ্য জাতীয় স্বার্থ রক্ষা নয়, কোনো বিশেষ দেশের প্রতি তাদের রাগ বা অনুরাগ প্রকাশ করা।
নেতা-নেত্রীরা যা-ই বলুন না কেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারত ও চীন—উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার এই দেশ দুটির কাছেও বাংলাদেশ একবারে ফেলনা নয়। দেশের আমদানি বাজার বলতে গেলে এ দুটি দেশের দখলে। নিজ নিজ স্বার্থেই তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে চাইবে। প্রশ্ন হলো, আমরা কী করব? একজনকে কাছে টানতে গিয়ে আরেকজনকে দূরে ঠেলে দেব, না উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে যতটা সম্ভব জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করব? যেকোনো দুটি দেশের সঙ্গে স্বার্থের বিরোধ থাকবে, ঝগড়াঝাঁটি থাকবে, সন্দেহ-অবিশ্বাস থাকাও অস্বাভাবিক নয়। আবার সেই ঝগড়াঝাঁটি মিটিয়ে ফেলতে হবে আলোচনার মাধ্যমে। ভারত গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ কিংবা বরাক নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখলে আমরা অবশ্যই প্রতিবাদ করব। একই ভাগে ব্রহ্মপুত্রের উৎসস্থলে চীন বাঁধ দিলেও চুপচাপ বসে থাকব না। বিএনপি সরকার তথাকথিত পূর্বমুখী কূটনীতি করে ভারতের বিরাগ ভাজন হয়েছিল, আবার ঢাকায় তাইওয়ানের বাণিজ্যিক অফিস খুলতে দিয়ে চীনকেও খেপিয়ে দিয়েছিল। অর্থাৎ তারা আম-ছালা দুটোই খুইয়েছিল। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এ ধরনের আহম্মকি শুধু সরকারকে ডুবায় না, দেশকেও একঘরে করে ফেলে।
চীন ও ভারত শুধু আমাদের দুই বৃহত্ প্রতিবেশী নয়, বিশাল অর্থনীতিরও দেশ। চীন আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতির এক নম্বর শক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ভারতও দ্রুত উন্নয়নের পথে এগোচ্ছে। দুটি দেশেরই রয়েছে উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ জনশক্তি। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে তাদের সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জরুরি নিজের সক্ষমতা বাড়ানো। পশ্চিমা দেশগুলোতে বিনা শুল্কে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে কিংবা মধ্য ও নিকট প্রাচ্যে পাঠানো অদক্ষ শ্রমিকদের রেমিট্যান্সে বেশি দিন ভালো থাকা যাবে না। দেশের দুর্বল অর্থনীতিকে সবল করতে দরকার অবকাঠামোর উন্নয়ন, শিল্পবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়ানো এবং বিপুল অদক্ষ জনশক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে যারাই সহযোগিতা করবে, তাদেরই স্বাগত জানাব, দুয়ার বন্ধ করে থাকব না। দেশ বিক্রি ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার সস্তা স্লোগান দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার পরিণাম হবে আত্মঘাতী।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীন ও ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মনস্তাত্ত্বিক বাধা ছিল। তার ঐতিহাসিক কারণও আছে। পঁচাত্তরের পর যাঁরা এ দেশ শাসন করেছেন, তাঁরা ভারত-সোভিয়েত বলয় থেকে বেরিয়ে আসার নামে এক হাত মধ্যপ্রাচ্যে এবং আরেক হাত চীনের দিকে বাড়িয়ে দেন। মাঝখানে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছে পাকিস্তান। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এসে দুই বিশাল প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য আনার উদ্যোগ নেন। সেবার তিনি এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হয়েছেন বলা যাবে না। সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল দুই তরফেই। ইতিমধ্যে মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় বিপুল পানি গড়িয়েছে। বাংলাদেশের ডান পন্থার রাজনীতির প্রতি পশ্চিমেরও মোহ কেটে গেছে। আশা করি চীনেরও। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এগোলে চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা কঠিন নয়।
এ প্রেক্ষাপটে আড়াই মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি ও বেইজিং সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ভারত বা চীন থেকে তিনি কত বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও মঞ্জুরি আদায় করে নিতে পেরেছেন, কতটি চুক্তি করেছেন, স্বাগতিক দেশের নেতাদের কাছ থেকে কী কী আশ্বাস পেয়েছেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো দীর্ঘদিনের মনস্তাত্ত্বিক বাধাটি সরিয়ে ফেলা। এত দিন ধারণা করা হতো, চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক করতে হলে ভারতের সঙ্গে বৈরিতা দেখাতে হবে। কিংবা ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলে চীনের বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে। সারা বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধের দিন শেষ হলেও বাংলাদেশের একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে এটি পুরোপুরি রয়ে গেছে। সীমান্ত বিরোধ, পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি সত্ত্বেও ভারত ও চীন ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে পারলে আমরা কেন পারব না? মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের পছন্দ না করলেও ভারত ও চীন সেখানে চুটিয়ে ব্যবসা করছে, বিনিয়োগ করছে। কিন্তু বাংলাদেশে কেউ বিনিয়োগ করতে এলেই ‘সার্বভৌমত্ব গেল’ ‘সার্বভৌমত্ব গেল’ বলে আমরা চিত্কার করি। কী চুক্তি হচ্ছে, তার শর্ত কতটা দেশের স্বার্থানুকূল হলো—তা বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য হচ্ছে কোন দেশের সঙ্গে চুক্তিটি হলো। এ কূপমণ্ডূকতার কোনো চিকিৎসা নেই। অথচ এটা সবাই জানে যে চীন ও ভারত জাতীয় স্বার্থের বাইরে কিছু করে না, বিদেশ নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো ঝগড়ায়ও লিপ্ত হয় না।
ভারত ও চীনের সঙ্গে আমাদের পর্বতপ্রমাণ বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। চীনের অনুকূলে বছরে এ ঘাটতির পরিমাণ ৩৮০ কোটি ডলার, ভারতের অনুকূলে ২৬০ কোটি ডলার। অথচ স্রেফ রাজনৈতিক কারণে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টিই সামনে আনেন, চীনের কথা বেমালুম ভুলে যান। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে অনেক পত্রিকা পরিসংখ্যান তুলে দিয়ে বলেছে, বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে ফেলতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময়ও তারা সে কথাটি জোর দিয়ে বললে প্রধানমন্ত্রীর হাত শক্তিশালী হতো। স্বাগতিক দেশ ভাবত, গোটা দেশ প্রধানমন্ত্রীর পেছনে আছে। অতএব, তাঁকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত বা চীন সফর কতটা সফল হয়েছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণের সময় এখনো আসেনি। তবে একটি কথা জোর দিয়ে বলা যায়, এর মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। প্রশ্ন হলো সেই সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব কি না। পারলে দেশের উন্নতি হবে, মানুষের অভাব-দারিদ্র্য কিছুটা হলেও কমবে। আর না পারলে পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর ভাষায়, সহস্র বছর ঘাস খেয়ে থাকতে হবে। চীন বা ভারত নিজের স্বার্থ বিকিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে না। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে। আলপিন থেকে পরোটা আমদানি করে কোনো দেশ টিকে থাকতে পারবে না। আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। সমুদ্রবন্দর খুলে দিতে হবে চীন, ভারত, ভুটান, নেপালসহ সব প্রতিবেশী দেশের জন্য।
শেখ হাসিনা চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কিছু উদাহরণ টানতে গিয়ে পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু একাত্তরের কথা বলেননি। বলা হয়তো কূটনৈতিক শিষ্টাচারও নয়। তবে চীন যে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তা ঐতিহাসিক সত্য। কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই। যখন যার সঙ্গে সদ্ভাব থাকলে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া যাবে, তার সঙ্গে সেটি রক্ষা করতে হবে। আবার কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে অন্যের সঙ্গে শত্রুতা করাও ঠিক হবে না। চলতি বছর বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৩৫ বছর পূর্ণ হবে। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে ১৯৭৫ সালের ২ অক্টোবর, তার আগেই ঘাতকদের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। চীনের সঙ্গে আমরা বন্ধুত্ব করব, কিন্তু একাত্তরের কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, যেমন ভুলে যাওয়া যাবে না আমেরিকার বিরোধিতার কথাও। ১৯৭১ সালে যে দেশ সহায়তা করেছে, পরবর্তীকালে তারা আমাদের জন্য ক্ষতিকর কিছু করলে তার বিরোধিতাও করতে হবে। আবার পরবর্তীকালের বন্ধু হলে একাত্তরে তার শত্রুতার কথাও ভুলে যাব না। এটিই হলো ইতিহাসের সত্য। একে অগ্রাহ্য করা কঠিন। জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দল একমত হলে বিদেশিরাও সমঝে চলবে।
চীনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন ৯১ জন। এর মধ্যে মন্ত্রী, আমলা, সাবেক আমলা, সাংবাদিকও রয়েছেন। নেতাদের রাষ্ট্রীয় সফরে এত বিরাট লটবহরের কী প্রয়োজন, বোধগম্য নয়। যাঁরা যান তাঁরাও কি দেশটি দেখার সুযোগ পান? স্বাগতিক দেশের সব আয়োজনে মনোযোগ থাকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। সেখানে সফরসঙ্গীদের কোনো কাজ থাকে না। তার পরও প্রতিবার বিশাল বাহিনী নিতে হয় তাঁদের খুশি করতে। তাঁদের মধ্যে এমন ভাগ্যবান লোকও আছেন, যাঁরা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়ের আশীর্বাদ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বাকশাল, নকশাল, নরম বা গরম জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে পার্থক্য খুবই কম। দেশের যে গরিব জনগণ প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী-সাংসদ-আমলাদের বেতন-ভাতা জোগান, তার সফরসঙ্গীদের বিদেশ ভ্রমণের ব্যয় বহন করেন, তাদের জন্য তারা কী করেছেন—একবার ভেবে দেখছেন কি?
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments