পাহাড়ে সংঘাত-ভয়ের সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা পাহাড়ি শিশুদের কথা by ইলিরা দেওয়ান
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের গঙ্গারামমুখ, গুচ্ছগ্রাম, হাজাছড়া, চামিনীছড়াসহ প্রায় ১১টি গ্রাম ও খাগড়াছড়িতে যে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে গেল তা গণমাধ্যমের বদৌলতে দেশের আপামর জনগণ কিছুটা হলেও দেখতে পেয়েছে। বাঘাইছড়ির ঘটনার কাভারেজ দিতে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমের
সাংবাদিকেরা খাগড়াছড়ি পৌঁছার পরই তাঁদের আর বাঘাইছড়ি পর্যন্ত যেতে হয়নি, খাগড়াছড়ি সদরে ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংস ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হয়ে রয়ে গেলেন! অনেকে সেদিনের (২৩ ফেব্রুয়ারি) ঘটনার চিত্র ধারণ করতে গিয়ে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হয়েছেন। ঢাকা থেকে যাওয়া সাংবাদিকেরা সেদিন নিশ্চয় পাহাড়ের প্রকৃত অবস্থা যৎসামান্য হলেও আঁচ করতে পেরেছিলেন!
এ ধরনের ঘটনা কেবল এবার ঘটেনি। আশির দশকে যখন থেকে সমতল থেকে ছিন্নমূল বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়, মূলত তখন থেকেই পাহাড়ে সামপ্রদায়িক সহিংস ঘটনার সূত্রপাত শুরু, যা ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পরও থেমে থাকেনি। চুক্তির আগে লংগদু, লোগাং, নানিয়াচরের মতো বড় বড় হত্যাকান্ড যেমন চলেছিল, তেমনি চুক্তির পরও বাবুছড়া, মহালছড়ি, মাইচছড়ির মতো বড় বড় সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যার সর্বশেষ শিকার বাঘাইছড়ির সাজেক ও খাগড়াছড়ির সদর শহর।
পাহাড়ি নারীরা যেমন প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন, তেমনি সেখানকার শিশুরাও বেড়ে উঠছে ভয়ের সংস্কৃতির পরিবেশে। ২৩ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি সদরে সংঘটিত ঘটনার সময় সেখানকার শিশুদের দু-একটি খণ্ডচিত্র এখানে তুলে ধরতে চাইছি। দিনের সহিংস ঘটনার শুরুটা হয়েছিল মহাজনপাড়া থেকে। মহাজনপাড়ার সোমা চাকমা স্থানীয় পাবলিক ক্যান্ট. স্কুলে কেজিতে পড়ে। তার বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী, সেদিনও যথারীতি সকালে অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। তবে অবরোধ থাকায় সেদিন বাচ্চাকে স্কুলে না পাঠিয়ে বাসায় ১২ বছরের কাজের মেয়েটির কাছে রেখে যান। বেলা ১১টা থেকেই পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। কিন্তু মা-বাবা তখনো জানতেন না বাইরে কী ঘটছে। যখন জানলেন তখন বাইরে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। এরই মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি হয়। সবাই যাঁর যাঁর কর্মস্থলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে থাকেন। বিকেল পাঁচটার দিকে ধীরে ধীরে অন্যদের সঙ্গে পাহাড়ি লোকজনও ঘরে ফিরতে শুরু করে। কিন্তু এ কয়েক ঘণ্টা অসহায় শিশু দুটির ওপর যে ভয় ও আতঙ্ক ভর করেছিল পরে তারা কথা বলতেও সাহস পাচ্ছিল না!
একইভাবে মিলনপুর ও গভ. হাইস্কুলপাড়ার রাহুল চাকমা (৪), কাব্য ত্রিপুরা (৫), অতল চাকমা (৫), সিঁথি চাকমার মতো শিশুদের মনে যে ভয় ঢুকে পড়েছে, সে ভয় কবে কেটে যাবে তাদের মা-বাবাও জানেন না। অনেকে এখনো ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠে পালানোর কথা বলছে। ঘটনার দিন প্লে-গ্রুপের ছাত্র রাহুল বাবার কোলে থেকেও বারবার কাঁপছিল, এমনকি সারা দিনেও মুখে কথা ফোটেনি। রাতে কারফিউ জারির পর পরিবেশ যখন কিছুটা শান্ত হয়েছিল তখন সে কথা বলেছিল। অনুরূপভাবে মিলনপুরের শিশু অতলও বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে রামদা নিয়ে ধাওয়া করার দৃশ্য দেখে এমন কুঁকড়ে যায়, সে আর ঘর থেকে বের হতে চায়নি। এটি কেবল খাগড়াছড়ি শহরের দু-একটি চিত্র। সাজেকের গঙ্গারামমুখ, গুচ্ছগ্রাম, হাজাছড়া, চামিনীছড়াসহ কয়েকটি গ্রামের নাম না জানা কত চিজি, ধন, চিক্করা ভয়ের ভেতরে দিনযাপন করছে তার হিসাব তো আমরা জানি না।
বর্তমানে যেসব কর্মকর্তারা (বেসামরিক ও সামরিক) চাকরিসূত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামে আছেন (জেলা সদরের আওতার বাইরে) তাঁদের বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যরা সেখানে থাকেন না। তাঁদের সন্তানেরা বড় বড় শহরে থেকে ভালো স্কুলগুলোতে পড়াশোনার সুযোগ পায়। পাহাড়ে কী ঘটছে না ঘটছে বা কারা এ ঘটনায় জড়িত সে খবর হয়তো তাদের রাখার সুযোগ হয় না। কিন্তু তাদের সমবয়সী একটি পাহাড়ি শিশুকে নিজের নিরাপত্তা, পড়াশোনা ও নিরাপদ আশ্রয় নিজেকেই খুঁজতে হয়।
পাহাড়িরা এ দেশের নাগরিক ও সেই হিসেবেই তারা বাস করতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের বারবার ‘উপজাতি’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়ে তাদের মধ্যে বিদ্রোহের বীজ বোনা হয়েছিল। ’৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পরও এখনো সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে হচ্ছে। তাহলে কে কাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায়, সেটি সবার সামনে পরিষ্কার হওয়া দরকার। কাজেই কেবল নিরাপত্তার চশমা পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে বিশ্লেষণ করে সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার সরকারের আন্তরিকতা এবং সামপ্রদায়িকতা মুক্ত প্রশাসনব্যবস্থা।
এখানে আরেকটি বিষয় খুবই উদ্বেগজনক, তা হলো সাজেক ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় ‘বাঘাইহাট উচ্চবিদ্যালয়’টি শিক্ষার্থীর অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিদ্যালয়ে চার শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে বাঙালি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪০-এর মতো। কিন্তু গত ২৪ জানুয়ারি এ স্কুলের ২৮ জন পাহাড়ি শিক্ষার্থীসহ দুজন শিক্ষককে সারা দিন অবরুদ্ধ করে রাখা ও চার শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার পর পাহাড়ি অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের নিরাপত্তার অভাবে স্কুলে আর পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না। এ ঘটনার এক মাসের মধ্যে ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি আবার গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার ফলে প্রায় সব শিক্ষার্থীর বই-খাতা পুড়ে যায় (প্রথম আলো)। ২৪ জানুয়ারির ঘটনার পর যাঁদের সামর্থ্য ছিল, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের খাগড়াছড়ি নতুবা রাঙামাটিতে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯-২০ ফেব্রুয়ারির সহিংস ঘটনার পর তাঁদের সে সামর্থ্যটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। অথচ এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। এ স্কুলের তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ দূর করতে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং প্রশাসনও যাতে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা হলো ভূমি সমস্যা। কিন্তু ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর নামে যত দিন ‘শান্তকরণ’ প্রকল্প অব্যাহত থাকবে, তত দিন পাহাড়ের ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। কেননা এ ‘শান্তকরণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গেলে বসতিস্থাপনকারীদের পুনর্বাসন ও ভূমি বেদখল প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। কাজেই সবার আগে ‘অপারেশন উত্তরণ’ প্রত্যাহার করে পাহাড়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে। ভূমি কমিশন আইনের সাংঘর্ষিক দিকগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে ভূমি কমিশনকে কার্যকর করে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে। সমপ্রতি ভূমিমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের কাজ শুরু করা হবে। কিন্তু উল্লিখিত বিষয়গুলোর সুরাহা ব্যতিরেকে ভূমি জরিপ করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা যত দিন জিইয়ে থাকবে, তত দিন পাহাড়ি শিশুদের মানসিক বিকাশও জটিলভাবে গড়ে উঠবে। এর দায় রাষ্ট্র ও সরকার এড়াতে পারে না। আমরা চাই, সমপ্রতি বাঘাইহাট ও খাগড়াছড়িতে সংঘটিত সহিংস ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক এবং এ তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক। পার্বত্য চট্টগ্রামে অতীতে যেসব গণহত্যাসহ সহিংস ঘটনা ঘটেছিল, সেসব ঘটনার কোনো কোনোটির তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তদন্ত প্রতিবেদন কোনো সময় প্রকাশিত হয়নি। ফলে দোষী ব্যক্তিরা সব সময় আইনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। আমরা আর এর পুনরাবৃত্তি চাই না। পার্বত্য সমস্যার সাময়িক সমাধান নয়, একটি স্থায়ী সমাধানের পথ সরকারকেই বের করে আনতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com
এ ধরনের ঘটনা কেবল এবার ঘটেনি। আশির দশকে যখন থেকে সমতল থেকে ছিন্নমূল বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়, মূলত তখন থেকেই পাহাড়ে সামপ্রদায়িক সহিংস ঘটনার সূত্রপাত শুরু, যা ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পরও থেমে থাকেনি। চুক্তির আগে লংগদু, লোগাং, নানিয়াচরের মতো বড় বড় হত্যাকান্ড যেমন চলেছিল, তেমনি চুক্তির পরও বাবুছড়া, মহালছড়ি, মাইচছড়ির মতো বড় বড় সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যার সর্বশেষ শিকার বাঘাইছড়ির সাজেক ও খাগড়াছড়ির সদর শহর।
পাহাড়ি নারীরা যেমন প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন, তেমনি সেখানকার শিশুরাও বেড়ে উঠছে ভয়ের সংস্কৃতির পরিবেশে। ২৩ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি সদরে সংঘটিত ঘটনার সময় সেখানকার শিশুদের দু-একটি খণ্ডচিত্র এখানে তুলে ধরতে চাইছি। দিনের সহিংস ঘটনার শুরুটা হয়েছিল মহাজনপাড়া থেকে। মহাজনপাড়ার সোমা চাকমা স্থানীয় পাবলিক ক্যান্ট. স্কুলে কেজিতে পড়ে। তার বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী, সেদিনও যথারীতি সকালে অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। তবে অবরোধ থাকায় সেদিন বাচ্চাকে স্কুলে না পাঠিয়ে বাসায় ১২ বছরের কাজের মেয়েটির কাছে রেখে যান। বেলা ১১টা থেকেই পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। কিন্তু মা-বাবা তখনো জানতেন না বাইরে কী ঘটছে। যখন জানলেন তখন বাইরে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। এরই মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি হয়। সবাই যাঁর যাঁর কর্মস্থলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে থাকেন। বিকেল পাঁচটার দিকে ধীরে ধীরে অন্যদের সঙ্গে পাহাড়ি লোকজনও ঘরে ফিরতে শুরু করে। কিন্তু এ কয়েক ঘণ্টা অসহায় শিশু দুটির ওপর যে ভয় ও আতঙ্ক ভর করেছিল পরে তারা কথা বলতেও সাহস পাচ্ছিল না!
একইভাবে মিলনপুর ও গভ. হাইস্কুলপাড়ার রাহুল চাকমা (৪), কাব্য ত্রিপুরা (৫), অতল চাকমা (৫), সিঁথি চাকমার মতো শিশুদের মনে যে ভয় ঢুকে পড়েছে, সে ভয় কবে কেটে যাবে তাদের মা-বাবাও জানেন না। অনেকে এখনো ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠে পালানোর কথা বলছে। ঘটনার দিন প্লে-গ্রুপের ছাত্র রাহুল বাবার কোলে থেকেও বারবার কাঁপছিল, এমনকি সারা দিনেও মুখে কথা ফোটেনি। রাতে কারফিউ জারির পর পরিবেশ যখন কিছুটা শান্ত হয়েছিল তখন সে কথা বলেছিল। অনুরূপভাবে মিলনপুরের শিশু অতলও বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে রামদা নিয়ে ধাওয়া করার দৃশ্য দেখে এমন কুঁকড়ে যায়, সে আর ঘর থেকে বের হতে চায়নি। এটি কেবল খাগড়াছড়ি শহরের দু-একটি চিত্র। সাজেকের গঙ্গারামমুখ, গুচ্ছগ্রাম, হাজাছড়া, চামিনীছড়াসহ কয়েকটি গ্রামের নাম না জানা কত চিজি, ধন, চিক্করা ভয়ের ভেতরে দিনযাপন করছে তার হিসাব তো আমরা জানি না।
বর্তমানে যেসব কর্মকর্তারা (বেসামরিক ও সামরিক) চাকরিসূত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামে আছেন (জেলা সদরের আওতার বাইরে) তাঁদের বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যরা সেখানে থাকেন না। তাঁদের সন্তানেরা বড় বড় শহরে থেকে ভালো স্কুলগুলোতে পড়াশোনার সুযোগ পায়। পাহাড়ে কী ঘটছে না ঘটছে বা কারা এ ঘটনায় জড়িত সে খবর হয়তো তাদের রাখার সুযোগ হয় না। কিন্তু তাদের সমবয়সী একটি পাহাড়ি শিশুকে নিজের নিরাপত্তা, পড়াশোনা ও নিরাপদ আশ্রয় নিজেকেই খুঁজতে হয়।
পাহাড়িরা এ দেশের নাগরিক ও সেই হিসেবেই তারা বাস করতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের বারবার ‘উপজাতি’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়ে তাদের মধ্যে বিদ্রোহের বীজ বোনা হয়েছিল। ’৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পরও এখনো সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে হচ্ছে। তাহলে কে কাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায়, সেটি সবার সামনে পরিষ্কার হওয়া দরকার। কাজেই কেবল নিরাপত্তার চশমা পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে বিশ্লেষণ করে সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার সরকারের আন্তরিকতা এবং সামপ্রদায়িকতা মুক্ত প্রশাসনব্যবস্থা।
এখানে আরেকটি বিষয় খুবই উদ্বেগজনক, তা হলো সাজেক ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় ‘বাঘাইহাট উচ্চবিদ্যালয়’টি শিক্ষার্থীর অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিদ্যালয়ে চার শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে বাঙালি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪০-এর মতো। কিন্তু গত ২৪ জানুয়ারি এ স্কুলের ২৮ জন পাহাড়ি শিক্ষার্থীসহ দুজন শিক্ষককে সারা দিন অবরুদ্ধ করে রাখা ও চার শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার পর পাহাড়ি অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের নিরাপত্তার অভাবে স্কুলে আর পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না। এ ঘটনার এক মাসের মধ্যে ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি আবার গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার ফলে প্রায় সব শিক্ষার্থীর বই-খাতা পুড়ে যায় (প্রথম আলো)। ২৪ জানুয়ারির ঘটনার পর যাঁদের সামর্থ্য ছিল, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের খাগড়াছড়ি নতুবা রাঙামাটিতে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯-২০ ফেব্রুয়ারির সহিংস ঘটনার পর তাঁদের সে সামর্থ্যটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। অথচ এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। এ স্কুলের তিন শতাধিক শিক্ষার্থীর অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ দূর করতে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং প্রশাসনও যাতে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা হলো ভূমি সমস্যা। কিন্তু ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর নামে যত দিন ‘শান্তকরণ’ প্রকল্প অব্যাহত থাকবে, তত দিন পাহাড়ের ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। কেননা এ ‘শান্তকরণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গেলে বসতিস্থাপনকারীদের পুনর্বাসন ও ভূমি বেদখল প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। কাজেই সবার আগে ‘অপারেশন উত্তরণ’ প্রত্যাহার করে পাহাড়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে হবে। ভূমি কমিশন আইনের সাংঘর্ষিক দিকগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে ভূমি কমিশনকে কার্যকর করে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে। সমপ্রতি ভূমিমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের কাজ শুরু করা হবে। কিন্তু উল্লিখিত বিষয়গুলোর সুরাহা ব্যতিরেকে ভূমি জরিপ করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা যত দিন জিইয়ে থাকবে, তত দিন পাহাড়ি শিশুদের মানসিক বিকাশও জটিলভাবে গড়ে উঠবে। এর দায় রাষ্ট্র ও সরকার এড়াতে পারে না। আমরা চাই, সমপ্রতি বাঘাইহাট ও খাগড়াছড়িতে সংঘটিত সহিংস ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হোক এবং এ তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক। পার্বত্য চট্টগ্রামে অতীতে যেসব গণহত্যাসহ সহিংস ঘটনা ঘটেছিল, সেসব ঘটনার কোনো কোনোটির তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তদন্ত প্রতিবেদন কোনো সময় প্রকাশিত হয়নি। ফলে দোষী ব্যক্তিরা সব সময় আইনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। আমরা আর এর পুনরাবৃত্তি চাই না। পার্বত্য সমস্যার সাময়িক সমাধান নয়, একটি স্থায়ী সমাধানের পথ সরকারকেই বের করে আনতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com
No comments