মত দ্বিমত-হিলারির সফর ইতিবাচক by শমসের মবিন চৌধুরী

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তাঁর এ সফর বিশ্লেষণ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী এবং বিএনপির সহসভাপতি ও চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক সমন্বয়কারী শমসের মবিন চৌধুরী


যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরকে দলীয়-ভাবে দেখার সুযোগ নেই। আমরা বিষয়টিকে দেশ হিসেবেই দেখি। আমরা সবাই জানি যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ও আমাদের বড় উন্নয়ন সহযোগী। আর হিলারি ক্লিনটন দক্ষ ও প্রজ্ঞাবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মার্কিন প্রশাসনের খুবই প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্ব। তাঁর বাংলাদেশ সফর দুই দেশের সম্পর্কের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা এই সফরকে খুবই ইতিবাচক বলে মনে করছি।
সব বিবেচনাতেই যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুপক্ষীয়। অর্থনৈতিক, কারিগরি, সামরিক ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমরা নানাভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়ে থাকি। বাংলাদেশের অনুকূলে এই সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পাক, এটা আমাদের চাওয়া। আমাদের তৈরি পোশাকের প্রায় ৪০ শতাংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তবে ইউরোপের অন্য অনেক দেশের মতো আমরা যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাই না। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এটা আমাদের বড় চাওয়া। এ জন্য কংগ্রেসে আইন পাস করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সরকার এ চেষ্টা করে এলেও এ ক্ষেত্রে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি। এটা আমাদের জন্য হতাশাজনক। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প ও এর রপ্তানির বিষয়টি শুধু বাণিজ্যিক স্বার্থেই নয়, আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। এঁদের অধিকাংশই আবার নারী। সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও এই শিল্প ভূমিকা রাখছে। ফলে এই শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার প্রত্যাশা করতেই পারি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। কোনো ক্ষেত্রেই নীতিগত কোনো বিরোধ নেই, একমাত্র ফিলিস্তিন ইস্যু ছাড়া। বাংলাদেশ একটি মুসলিম ও একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশ। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এ দেশটিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা করে যাওয়া।
এমনই একটি বাস্তবতায় হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করেছেন। ফলে এসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনার একটি বড় সুযোগ এই সফরের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে আর রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরাও বিএনপির পক্ষ থেকে এসব বিষয় তুলে ধরেছি। অতীতে বিএনপিও ক্ষমতায় ছিল; ফলে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হিলারির সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয় তুলে ধরেছেন। আমরা আসলে হিলারির বাংলাদেশ সফরকে একটি বৃহত্তর পরিসরে দেখতে চাই, তবে এটাও ঠিক যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বাংলাদেশ সফর করেন, তখন বাংলাদেশর রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই উত্তপ্ত। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা গুম হয়েছেন। এর সঙ্গে সরকারের সম্পৃক্তার প্রশ্নটি উঠে এসেছে। পাশাপাশি বড় ইস্যুটি হচ্ছে আগামীতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে জনগণের ভোটাধিকার বা মতামতের প্রতিফলন ঘটবে কি না।
আমরা জানি, পঞ্চদশ সংশোধনী জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। এটা বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর বড় প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া সুশাসনের বিষয়টিও একটি প্রশ্ন হিসেবে উঠে এসেছে। দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পে অর্থায়ন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান। তারা এই প্রকল্পে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছে এবং সরকারকে তা জানিয়েছে। এত বড় একটি প্রকল্পে এ ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা এবং সেই কারণে ঋণ-সহায়তা স্থগিত হওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি পদ্মা সেতুর প্রশ্নে জাইকা ও এডিবি একই ধরনের ভূমিকা নিয়েছে। হিলারি যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছেন, তখন এ বিষয়গুলো তাঁর বিবেচনার মধ্যে ছিল। ব্যক্তিগতভাবেও বাংলাদেশের কিছু বিষয় নিয়ে হিলারির আগ্রহ ও উদ্বেগ রয়েছে। অনেক দিক রয়েছে, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তাধারা অনুযায়ী হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করার পর হিলারি ক্লিনটন দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অশান্তি, সংঘাতময় পরিস্থিতি ও মানবাধিকার প্রশ্নে কথা বলেছেন। হরতালের রাজনীতি নিয়েও তিনি তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আগেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সবার অংশগ্রহণে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। হিলারির সফরেও এ প্রসঙ্গটি গুরুত্ব পেয়েছে। এই সফরের সময় হিলারি বাংলাদেশের যুব প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজনীতির বাইরে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। এর বাইরে তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশের সুশীল সমাজের দুজন প্রতিনিধির সঙ্গে। আমরা মনে করি, স্বল্প সময়ের মধ্যে হলেও এই সফরে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা ও মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছে। এটাই এই সফরের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে আমি মনে করি।
প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। তিনি শুধু ভারতের অর্থমন্ত্রীই নন, সরকারের অন্যতম নীতিনির্ধারকও। ভারত যে এক দলের সঙ্গে সম্পর্কে বিশ্বাস করে না, সেটা তিনি এবার পরিষ্কার করে বলে গেছেন। এর আগেই বাংলাদেশ সফর করে গেলেন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের দুর্নীতির বিষয়টি স্পষ্ট করেই বলে গেছেন। বলেছেন, দেশের অবকাঠামোগত সমস্যার কথা। গ্যাস, বিদ্যুৎ—এসব ঘাটতির কথা। দুর্নীতি দূর না হলে ও অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো দূর করতে না পারলে যে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তা কঠিন হয়ে পড়বে, তা তিনি খোলামেলাভাবেই বলে গেছেন। এ ধরনের বিষয় নিয়ে জাপান কখনো আগে এত স্পষ্টভাবে কিছু বলেনি।
পুরো বিষয়টি মূল্যায়ন করলে যা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে তা হচ্ছে, দেশে একটি গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, গুম, হামলা, মামলা এসব করে সরকার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এক উদ্বেগজনক অবস্থায় নিয়ে গেছে। বলা যায়, রাজনৈতিকভাবে সরকার এক ধরনের হীনম্মন্যতার পরিচয় দিচ্ছে। সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়টিই এখন সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশ ছোট হলেও জনসংখ্যা অনেক বেশি। এখন সরকার যদি নির্বাচনের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ না দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে নির্মূল করার চেষ্টা করতে থাকে, তবে আর যা-ই হোক দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে এই যে বিদেশি মেহমানেরা আমাদের এসব বিষষ স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন।
আমরা মনে করি, সরকার একতরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী করে যে রাজনৈতিক সংকটের সূচনা করছে, তা আজ এত বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এই সংকটের মোকাবিলা করা। আমরা জানি যেকোনো সংকট সমাধানের পথ সংলাপ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও একই ধরনের কথা বলে গেছেন। আসলে পুরো বিষয়টি নির্ভর করে সরকারের ওপর। আমাদের প্রধান চাওয়া, জনগণকে তাদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। আমরা এমনভাবে ভোট অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা চাই, যাতে নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে। ভোটের ফলাফল পাল্টে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারই সেটা অতীতে নিশ্চিত করেছে। ফলে এ ধরনের সরকারের বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি একটা জনদাবিতে পরিণত হয়েছে। পত্রপত্রিকার বিভিন্ন জরিপেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। সরকার যদি এ বিষয়টি মেনে নিয়ে সংলাপের উদ্যোগ নেয়, তবে তা সফল হবে। এখানে লোক দেখানো কিছু করার সুযোগ নেই। এখন এই সংলাপ কীভাবে, কোথায় হবে তা নিয়ে নানা কিছু শোনা যাচ্ছে। আমাদের বক্তব্য, এটা যেকোনো জায়গায়ই হতে পারে। আর শেষ পর্যন্ত তো তা নিয়ে সংসদে যেতেই হবে। প্রস্তুতিমূলক পর্ব সংসদের বাইরে হলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
শমসের মবিন চৌধুরী: বিএনপির সহসভাপতি ও চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক সমন্বয়কারী।

No comments

Powered by Blogger.