এইদিনে-বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হুরমত আলী by দীপংকর চন্দ
কদিন আগে একটি বইয়ের প্রথম পাতায় আটকে গিয়েছিল চোখ। সেখানে লেখা ছিল, ‘চোখ দিয়ে সব দেখা যায় না, তীক্ষ দৃষ্টি আছে কেবল হূদয়ের, ছোট্ট রাজপুত্তুরের এই কথাটি খাঁটি মানি’—অদ্ভুত সুন্দর তিনটি বাক্যে গড়া বক্তব্যটির মর্মার্থ ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল আমাকে। অবচেতনেই আমি ভেবেছিলাম, কে এই ছোট্ট রাজপুত্তুর?
কীভাবে সে অর্জন করল ঐশ্বরিক আশীর্বাদপুষ্ট এমন গুণ? আমার খুব ইচ্ছে করেছিল ছোট্ট রাজপুত্তুর হতে, কিন্তু অক্ষমতার আঘাত খুব দ্রুতই বিপর্যস্ত করেছিল আমাকে। বলতে দ্বিধা নেই, দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম আমি, মনকে প্রবোধ দিয়েছিলাম এই বলে যে, খুব কম মানুষই লাভ করে সেই ঐশ্বরিক আশীর্বাদ, যা তার হূদয়ের চোখ খুলে দেয়, প্রদান করে তীক্ষ দৃষ্টি, যা দিয়ে মানুষ দেখতে পায় অদৃশ্যের অবগুণ্ঠনে ঘেরা অতিলৌকিক দৃশ্যকে, ঘটমান বর্তমানের সংশয়াকীর্ণ মাটিতে পা রেখেও অনুভব করে স্বপ্নময় ভবিষ্যেক।
ছোট্ট রাজপুত্তুরের মতো হূদয়ের চোখ থাকা একজন মানুষ জয়দেবপুরের হুরমত আলী। ১৯৭১ সালের ঐশ্বরিক আশীর্বাদপুষ্ট দিনগুলো খুলে দিয়েছিল হুরমত আলীর হূদয়ের চোখ। সেই চোখে তিনি দেখেছিলেন একটি সোনার দেশের মানচিত্র, পতাকা, চলমান স্বাধিকার আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য ভবিষ্যেক। সুতরাং হুরমত আলী পথে নেমেছিলেন, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাল স্রোতে।
স্বাধিকারের দাবিতে মার্চের শুরু থেকেই বীরপ্রসবা জয়দেবপুরে চলছিল জঙ্গি সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল। জয়দেবপুর সদরের ভাওয়াল রাজবাড়িতে সে সময় ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কার্যালয়। এই রেজিমেন্টের অল্প কিছু সৈনিক ছাড়া বাদবাকি সবাই ছিলেন বাঙালি এবং এই বাঙালি সৈনিকেরা মনেপ্রাণে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। বাঙালি সৈনিকদের এই মুক্তিকামী মনোভাব সম্পর্কে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা তো বটেই, অবগত ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোয় বাঙালিদের আন্দোলন-সংগ্রাম দমন করার জন্য যে নীলনকশা প্রণয়ন করেছিল পাকিস্তানিরা, তার মধ্যে একটি ছিল বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকদের কৌশলে নিরস্ত্র করা। এই কৌশলের অংশ হিসেবেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের রাইফেলগুলো ১৫ মার্চ সদর দপ্তরে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ করেন। তাঁরা অস্ত্র জমা দেওয়ার বদলে কৌশলে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। সৈন্যদের এই মনোভাব টের পেয়ে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব ১৯ মার্চ এক কোম্পানি সৈন্যসহ নিজে এসে উপস্থিত হন ভাওয়াল রাজবাড়িতে।
পাকিস্তানিদের এই ষড়যন্ত্রের কথা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। বাঙালি সৈন্যদের পক্ষে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কার্যালয়ের চারপাশে গড়ে তোলে প্রতিরোধ ব্যূহ। জয়দেবপুরে অবস্থিত দুটি বৃহত্ শিল্পপ্রতিষ্ঠান—সমরাস্ত্র কারখানা ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির বিপুলসংখ্যক শ্রমিকও কাজ ফেলে নেমে আসেন পথে—১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন চূড়ান্তভাবে শুরু হওয়ার সাত দিন আগেই বীরপ্রসবা জয়দেবপুরের মাটিতে শুরু হয় সংগ্রামী সৈনিক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। সেই যুদ্ধকালে জয়দেবপুর চৌরাস্তার কাছের রাজপথে জনতার ব্যারিকেড অপসারণে উদ্যত এক পাঞ্জাবি সৈনিককে জাপটে ধরে তাঁর রাইফেল কেড়ে নেন এক বীর যুবক। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না তাঁর, অপর এক পাকিস্তানি সৈনিকের গুলিতে সেখানেই শহীদ হন তিনি—মহান সেই শহীদ প্রাণ, অমিততেজি সেই বীর যুবকই হুরমত আলী।
জয়দেবপুর চৌরাস্তার খুব কাছেই কাজিমুদ্দিন চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয় পার হলেই রকমারি পণ্যের বিপণিবিতান। বিপণিবিতানের পর খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে দাঁড়াতেই তিন দিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটা কবর চোখে পড়ল। লাল সিরামিক ইটে বাঁধানো সেই কবরের ওপর সাদা রঙের ফলক লাগানো। সেখানে লেখা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হুরমত আলীর নাম।
হুরমত আলীর বাড়িটা কবরস্থান থেকে খুব একটা দূরে নয়। বেশ কিছুদিন আগে হুরমত আলীর বাড়ীতে গিয়েছিলাম। সেখানেই কথা হলো হুরমত আলীর বড় মেয়ে হালিমা খাতুনের সঙ্গে। তাঁর বিষণ্ন বক্তব্য থেকেই জানা গেল হুরমত আলীর জীবনের ব্যক্তিগত কয়েকটি কথা। ১৯৩৯ সালে জন্ম নেওয়া হুরমত আলী পেশাদার ফুটবলার ছিলেন। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের বছর চারেকের মধ্যে তাঁর ঘরে জন্ম নেয় ফুটফুটে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে। মেয়ে হালিমা খাতুনের বয়স যখন দুই বছর এবং ছেলে সাইফুল ইসলমের বয়স যখন এক বছর, তখনই একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর শুরু। বাড়িতে শহীদ হুরমত আলীর কোনো ছবি নেই। যুদ্ধের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সবই, কিন্তু স্মৃতি? হ্যাঁ, একমাত্র তা-ই খানিকটা অবশিষ্ট আছে হালিমা খাতুনের মনে, বলতে বলতে অতীতে হারান তিনি। বাবার মুখচ্ছবি মনে করার চেষ্টা করেন কি? ঠিক বুঝতে পারি না। আমি আমার সাধারণ চোখ দিয়ে হালিমা খাতুনের অশ্রুসিক্ত চোখ দুটোই দেখি কেবল। তাঁর মনের ভেতর উঁকি দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। কারণ হূদয়ের চোখ যে সবার থাকে না!
ছোট্ট রাজপুত্তুরের মতো হূদয়ের চোখ থাকা একজন মানুষ জয়দেবপুরের হুরমত আলী। ১৯৭১ সালের ঐশ্বরিক আশীর্বাদপুষ্ট দিনগুলো খুলে দিয়েছিল হুরমত আলীর হূদয়ের চোখ। সেই চোখে তিনি দেখেছিলেন একটি সোনার দেশের মানচিত্র, পতাকা, চলমান স্বাধিকার আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য ভবিষ্যেক। সুতরাং হুরমত আলী পথে নেমেছিলেন, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন আন্দোলন-সংগ্রামের উত্তাল স্রোতে।
স্বাধিকারের দাবিতে মার্চের শুরু থেকেই বীরপ্রসবা জয়দেবপুরে চলছিল জঙ্গি সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল। জয়দেবপুর সদরের ভাওয়াল রাজবাড়িতে সে সময় ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কার্যালয়। এই রেজিমেন্টের অল্প কিছু সৈনিক ছাড়া বাদবাকি সবাই ছিলেন বাঙালি এবং এই বাঙালি সৈনিকেরা মনেপ্রাণে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। বাঙালি সৈনিকদের এই মুক্তিকামী মনোভাব সম্পর্কে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা তো বটেই, অবগত ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোয় বাঙালিদের আন্দোলন-সংগ্রাম দমন করার জন্য যে নীলনকশা প্রণয়ন করেছিল পাকিস্তানিরা, তার মধ্যে একটি ছিল বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকদের কৌশলে নিরস্ত্র করা। এই কৌশলের অংশ হিসেবেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের রাইফেলগুলো ১৫ মার্চ সদর দপ্তরে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ করেন। তাঁরা অস্ত্র জমা দেওয়ার বদলে কৌশলে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। সৈন্যদের এই মনোভাব টের পেয়ে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব ১৯ মার্চ এক কোম্পানি সৈন্যসহ নিজে এসে উপস্থিত হন ভাওয়াল রাজবাড়িতে।
পাকিস্তানিদের এই ষড়যন্ত্রের কথা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। বাঙালি সৈন্যদের পক্ষে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কার্যালয়ের চারপাশে গড়ে তোলে প্রতিরোধ ব্যূহ। জয়দেবপুরে অবস্থিত দুটি বৃহত্ শিল্পপ্রতিষ্ঠান—সমরাস্ত্র কারখানা ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির বিপুলসংখ্যক শ্রমিকও কাজ ফেলে নেমে আসেন পথে—১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন চূড়ান্তভাবে শুরু হওয়ার সাত দিন আগেই বীরপ্রসবা জয়দেবপুরের মাটিতে শুরু হয় সংগ্রামী সৈনিক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। সেই যুদ্ধকালে জয়দেবপুর চৌরাস্তার কাছের রাজপথে জনতার ব্যারিকেড অপসারণে উদ্যত এক পাঞ্জাবি সৈনিককে জাপটে ধরে তাঁর রাইফেল কেড়ে নেন এক বীর যুবক। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না তাঁর, অপর এক পাকিস্তানি সৈনিকের গুলিতে সেখানেই শহীদ হন তিনি—মহান সেই শহীদ প্রাণ, অমিততেজি সেই বীর যুবকই হুরমত আলী।
জয়দেবপুর চৌরাস্তার খুব কাছেই কাজিমুদ্দিন চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয় পার হলেই রকমারি পণ্যের বিপণিবিতান। বিপণিবিতানের পর খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে দাঁড়াতেই তিন দিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটা কবর চোখে পড়ল। লাল সিরামিক ইটে বাঁধানো সেই কবরের ওপর সাদা রঙের ফলক লাগানো। সেখানে লেখা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হুরমত আলীর নাম।
হুরমত আলীর বাড়িটা কবরস্থান থেকে খুব একটা দূরে নয়। বেশ কিছুদিন আগে হুরমত আলীর বাড়ীতে গিয়েছিলাম। সেখানেই কথা হলো হুরমত আলীর বড় মেয়ে হালিমা খাতুনের সঙ্গে। তাঁর বিষণ্ন বক্তব্য থেকেই জানা গেল হুরমত আলীর জীবনের ব্যক্তিগত কয়েকটি কথা। ১৯৩৯ সালে জন্ম নেওয়া হুরমত আলী পেশাদার ফুটবলার ছিলেন। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের বছর চারেকের মধ্যে তাঁর ঘরে জন্ম নেয় ফুটফুটে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে। মেয়ে হালিমা খাতুনের বয়স যখন দুই বছর এবং ছেলে সাইফুল ইসলমের বয়স যখন এক বছর, তখনই একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর শুরু। বাড়িতে শহীদ হুরমত আলীর কোনো ছবি নেই। যুদ্ধের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সবই, কিন্তু স্মৃতি? হ্যাঁ, একমাত্র তা-ই খানিকটা অবশিষ্ট আছে হালিমা খাতুনের মনে, বলতে বলতে অতীতে হারান তিনি। বাবার মুখচ্ছবি মনে করার চেষ্টা করেন কি? ঠিক বুঝতে পারি না। আমি আমার সাধারণ চোখ দিয়ে হালিমা খাতুনের অশ্রুসিক্ত চোখ দুটোই দেখি কেবল। তাঁর মনের ভেতর উঁকি দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। কারণ হূদয়ের চোখ যে সবার থাকে না!
No comments