চারদিক-শিবমন্দির হত্যাকাণ্ড by স্বপন কুমার দাস
আগামীকাল ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবস। সে দিন স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল হবে গোটা জাতি। ঘরে ঘরে উড়বে লাল সূর্যখচিত সবুজ পতাকা। সারা দেশে আয়োজন করা হবে নানা অনুষ্ঠান। আনন্দ-অনুষ্ঠানে বিভোর থাকবে মানুষ। অথচ এ আনন্দের অন্তরালে আছে শোকাবহ ঘটনা, কত বেদনার ইতিহাস। তেমনি এক করুণ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি শিবমন্দির।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাই পাকিস্তানি সামরিক জান্তার যত আক্রোশ ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। তাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে প্রথম আক্রমণের শিকার হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও এর আবাসিক এলাকা। সে দিন রাতভর গণহত্যা চালিয়েও পাকিস্তানি সেনারা ক্ষান্ত হয়নি। পরদিনও তারা ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। সে দিন তাদের হাত থেকে শিবমন্দিরের সাধু-সন্তরাও রক্ষা পাননি।
বাংলা একাডেমীর পেছনে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রের উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে উঁচু চূড়াবিশিষ্ট লাল রঙের চমত্কার একটি মন্দির। অপরূপ কারুকার্যময় এ মন্দিরের নাম শ্রীশ্রী বুড়া শিবধাম। এই মন্দিরটির কারণেই এ এলাকার নাম শিববাড়ি। ঢাকা মহানগরের মধ্যে এ মন্দিরটি সর্বপ্রাচীন এবং সব থেকে বড় ও সুন্দর। পাঁচ শতাধিক বছরের প্রাচীন এ মন্দিরটি ১৯১২ সালের এক ঝড়ে বিধ্বস্ত হলে বর্ধমানের রাজা শিবভক্ত স্যার বিজয়চাঁদ ম্যাকার্থি মন্দির পুনর্নির্মাণ করে দেন। বর্ধমানের রাজা তখন বাস করতেন শিবমন্দিরের পেছনে বর্ধমান হাউসে। সে সময়ে নেপালের রাজা-রানি এ দেশে সফরে এলে এ শিবমন্দিরটি পরিদর্শনে আসতেন। কিন্তু একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর আক্রমণ থেকে ঐতিহ্যবাহী এ মন্দিরটিও রেহাই পায়নি।
২৬ মার্চ সকাল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা আগের রাতের হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ছাত্র-কর্মচারীদের হত্যা করতে থাকে। সে দিন পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যস্থল ছিল জগন্নাথ হল ও এর আশপাশের আবাসিক এলাকা। সে দিন পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় গণহত্যা সংঘটিত করে। ওই দিন খুব সকাল থেকে তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ছাত্রাবাস ও কোয়ার্টার থেকে ছাত্র-কর্মচারীদের খুঁজে খুঁজে বের করে এনে জগন্নাথ হলের খেলার মাঠে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সে দিন পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল শিববাড়িতে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে মধুর ক্যানটিনের মালিক মধুসূদন দে, তাঁর স্ত্রী, ছেলে পুত্র ও পুত্রবধূকে গুলি করে হত্যা করে। পরে ওই ঘাতক দলটি অদূরে অবস্থিত শিবমন্দিরে ঢুকে পড়ে।
তখন বেলা ১১টা। প্রাত্যহিক পূজা-অর্চনা আয়োজনে মন্দিরের সাধুসন্তরা ব্যস্ত ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেখে তাঁরা দৌড়ে আসেন এবং প্রবেশ না করার জন্য সেনাদের অনুরোধ করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা সাধুসন্তদের কথায় কর্ণপাত না করে তাঁদের অস্ত্র ঠেকিয়ে জিম্মি করে ফেলে। এ সময় মন্দিরের প্রাণপুরুষ শ্রীশ্রী স্বামী ব্রজানন্দকে সেনারা অস্ত্র ঠেকিয়ে দোতলায় তাঁর শয়নকক্ষ থেকে নিচে নামিয়ে আনে। স্বামীজি তখন অসুস্থ ছিলেন। স্বামীজি সেনাদের সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হন। সেনারা স্বামীজিকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে মন্দিরের সাতজন সাধুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে জগন্নাথ হলের বধ্যভূমির দিকে নিয়ে যায়। শিবমন্দিরের এ ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তারাপদ ঘোষ বাংলা একাডেমীর দেয়াল টপকে আত্মরক্ষা করেন।
ওই দিন জগন্নাথ হল খেলার মাঠের বধ্যভূমিতে এর আগে যাদের হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেখানে শিবমন্দিরের এই সাতজন সাধুকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। এ সাত শহীদ সাধু-সন্তর মধ্যে ছিলেন মন্দিরের প্রধান সেবায়েত শ্রী মুকুন্দ সরস্বতী বিএ, শ্রী সরজানন্দ সাধু, শ্রী রামধ্বনি সাধু, শ্রী মাধবানন্দ সাধু, শ্রী সরোজ সাধু এবং নাম বিস্মৃত হওয়া দুজন ভক্ত।
এ বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর স্বামীজি মন্দির ছেড়ে ভারতে চলে যান। ফলে মন্দিরটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে। এ সময় মন্দিরের দরজা-জানালাসহ সব জিনিস লুট হয়ে যায়। কারা যেন পাঁচ শতাধিক বছর প্রাচীন কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গটি মাটি খুঁড়ে তুলে নিয়ে যায়। এভাবেই দীর্ঘ নয় মাস এক প্রকার পরিত্যক্ত অবস্থায় মন্দিরটি পড়ে থাকে। দেশ স্বাধীন হলে স্বামী ব্রজানন্দ মন্দিরে ফিরে আসেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে আবার মন্দিরটি গড়ে তোলেন। ১৯৭৫ সালে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে সেখানেই তিনি দেহ রাখেন। এরপর থেকে তাঁর ভক্তরাই শিবমন্দিরটি দেখাশোনা করে আসছেন।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে এবং ২৬ মার্চ দিনব্যাপী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বহু রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। তবে শিবমন্দিরের নিরীহ নিরপরাধ এই সাত সাধুর হত্যাকাণ্ডের কথা তেমনভাবে আলোচিত হয়নি। এমনকি মন্দিরের ভেতর আজ পর্যন্ত তাঁদের জন্য নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিফলক। তবে প্রতিবছর ২৬ মার্চ এলে মন্দিরের ভক্তদের মন ভারী হয়ে ওঠে। সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে তাঁদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে।
বাংলা একাডেমীর পেছনে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রের উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে উঁচু চূড়াবিশিষ্ট লাল রঙের চমত্কার একটি মন্দির। অপরূপ কারুকার্যময় এ মন্দিরের নাম শ্রীশ্রী বুড়া শিবধাম। এই মন্দিরটির কারণেই এ এলাকার নাম শিববাড়ি। ঢাকা মহানগরের মধ্যে এ মন্দিরটি সর্বপ্রাচীন এবং সব থেকে বড় ও সুন্দর। পাঁচ শতাধিক বছরের প্রাচীন এ মন্দিরটি ১৯১২ সালের এক ঝড়ে বিধ্বস্ত হলে বর্ধমানের রাজা শিবভক্ত স্যার বিজয়চাঁদ ম্যাকার্থি মন্দির পুনর্নির্মাণ করে দেন। বর্ধমানের রাজা তখন বাস করতেন শিবমন্দিরের পেছনে বর্ধমান হাউসে। সে সময়ে নেপালের রাজা-রানি এ দেশে সফরে এলে এ শিবমন্দিরটি পরিদর্শনে আসতেন। কিন্তু একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর আক্রমণ থেকে ঐতিহ্যবাহী এ মন্দিরটিও রেহাই পায়নি।
২৬ মার্চ সকাল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা আগের রাতের হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ছাত্র-কর্মচারীদের হত্যা করতে থাকে। সে দিন পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যস্থল ছিল জগন্নাথ হল ও এর আশপাশের আবাসিক এলাকা। সে দিন পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় গণহত্যা সংঘটিত করে। ওই দিন খুব সকাল থেকে তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ছাত্রাবাস ও কোয়ার্টার থেকে ছাত্র-কর্মচারীদের খুঁজে খুঁজে বের করে এনে জগন্নাথ হলের খেলার মাঠে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সে দিন পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল শিববাড়িতে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে মধুর ক্যানটিনের মালিক মধুসূদন দে, তাঁর স্ত্রী, ছেলে পুত্র ও পুত্রবধূকে গুলি করে হত্যা করে। পরে ওই ঘাতক দলটি অদূরে অবস্থিত শিবমন্দিরে ঢুকে পড়ে।
তখন বেলা ১১টা। প্রাত্যহিক পূজা-অর্চনা আয়োজনে মন্দিরের সাধুসন্তরা ব্যস্ত ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেখে তাঁরা দৌড়ে আসেন এবং প্রবেশ না করার জন্য সেনাদের অনুরোধ করেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা সাধুসন্তদের কথায় কর্ণপাত না করে তাঁদের অস্ত্র ঠেকিয়ে জিম্মি করে ফেলে। এ সময় মন্দিরের প্রাণপুরুষ শ্রীশ্রী স্বামী ব্রজানন্দকে সেনারা অস্ত্র ঠেকিয়ে দোতলায় তাঁর শয়নকক্ষ থেকে নিচে নামিয়ে আনে। স্বামীজি তখন অসুস্থ ছিলেন। স্বামীজি সেনাদের সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হন। সেনারা স্বামীজিকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়ে মন্দিরের সাতজন সাধুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে জগন্নাথ হলের বধ্যভূমির দিকে নিয়ে যায়। শিবমন্দিরের এ ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তারাপদ ঘোষ বাংলা একাডেমীর দেয়াল টপকে আত্মরক্ষা করেন।
ওই দিন জগন্নাথ হল খেলার মাঠের বধ্যভূমিতে এর আগে যাদের হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেখানে শিবমন্দিরের এই সাতজন সাধুকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। এ সাত শহীদ সাধু-সন্তর মধ্যে ছিলেন মন্দিরের প্রধান সেবায়েত শ্রী মুকুন্দ সরস্বতী বিএ, শ্রী সরজানন্দ সাধু, শ্রী রামধ্বনি সাধু, শ্রী মাধবানন্দ সাধু, শ্রী সরোজ সাধু এবং নাম বিস্মৃত হওয়া দুজন ভক্ত।
এ বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর স্বামীজি মন্দির ছেড়ে ভারতে চলে যান। ফলে মন্দিরটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে। এ সময় মন্দিরের দরজা-জানালাসহ সব জিনিস লুট হয়ে যায়। কারা যেন পাঁচ শতাধিক বছর প্রাচীন কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গটি মাটি খুঁড়ে তুলে নিয়ে যায়। এভাবেই দীর্ঘ নয় মাস এক প্রকার পরিত্যক্ত অবস্থায় মন্দিরটি পড়ে থাকে। দেশ স্বাধীন হলে স্বামী ব্রজানন্দ মন্দিরে ফিরে আসেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে আবার মন্দিরটি গড়ে তোলেন। ১৯৭৫ সালে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে সেখানেই তিনি দেহ রাখেন। এরপর থেকে তাঁর ভক্তরাই শিবমন্দিরটি দেখাশোনা করে আসছেন।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে এবং ২৬ মার্চ দিনব্যাপী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বহু রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। তবে শিবমন্দিরের নিরীহ নিরপরাধ এই সাত সাধুর হত্যাকাণ্ডের কথা তেমনভাবে আলোচিত হয়নি। এমনকি মন্দিরের ভেতর আজ পর্যন্ত তাঁদের জন্য নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিফলক। তবে প্রতিবছর ২৬ মার্চ এলে মন্দিরের ভক্তদের মন ভারী হয়ে ওঠে। সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে তাঁদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে।
No comments