গোধূলির ছায়াপথে-আজকের তাজা খবর by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
তাজা খবরের পেছনে ধাবিত সবাই। কার না পছন্দ টাটকা মাছ, সবজি। খবরের কাগজে ছাপা হওয়ার আগেই খবর হয়ে পড়ে বাসি। টেলিভিশন রাত ১২টা পর্যন্ত গলাধঃকরণ করছে টাটকা খবর। কাগজওয়ালা নাস্তানাবুদ, কীভাবে নতুন খবর খদ্দেরের কাছে পৌঁছানো যায়।
আজকের কাগজে: দুর্নীতি খুঁজে পেয়েছে কানাডা, পরোয়ানা দিয়ে আযাদকে খুঁজে পায়নি পুলিশ, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের অনশন কর্মসূচি, তদন্তে ব্যর্থতায় সৌদি আরবের হতাশা। খবরগুলোর নিচে লাল কালিতে গিন্নির মন্তব্য: ১. এ আর এমন কী, ২. খুবই স্বাভাবিক, ৩. এক মিনিটের ব্যাপার, ৪. হতাশ হওয়ারই কথা। প্রতিদিন কাগজ পড়ি, নিচে তার মন্তব্য উপভোগ করি। মাঝেমধ্যে আমিও—এভাবে চলছে নীরব খেলা। কদিন আগে লব্ধ প্রতিষ্ঠিত লেখক বের করেছেন কালকে জয় করার উদ্দেশ্যে গ্রন্থ: প্রতিদিনের তাজা খবরের নির্ঘণ্ট।
‘আর্থ ডে’ বা মৃত্তিকা দিবস পালিত হলে কথা ছিল রাতে এক ঘণ্টা অন্ধকারে থাকবে এবং এভাবে বিজলির সাশ্রয় হবে। গতকাল ইন্টারনেটে ছবি এসেছে, টোকিও, সিঙ্গাপুরের রাত সাড়ে আটটার আগে ও পরের রাতের ছবি, যেখানে শহর দুটিতে ছিল প্রথমে প্রজ্বলিত বিজলি ও পরে প্রায় অন্ধকার। ঢাকার ছবি সবচেয়ে মজার, আগে ও পরে শুধু অন্ধকার। টাটকা খবর হলো: পৃথিবীর কাছে ঢাকা শহর অন্ধকার দিয়ে ঢাকা। অন্ধকারের আবার আগে-পরে কী।
সায়মন ড্রিংকে আবার দেখলাম ‘রূপসী বাংলায়’, পূর্বতন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে; তাঁর সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছিল ৪০ বছর আগে। ১৬ বছর বয়সে এই তরুণ ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ভারতে এবং যৌবনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে হয়েছিলেন একাত্ম, জীবনে প্রত্যক্ষ করেছেন ২২টি যুদ্ধবিপ্লব ও বিদ্রোহ। রবীন্দ্র-বিধৌত বাংলাদেশে এসে জীবনের সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন এবং সেদিন পেলেন সম্মান। ওই দিন সবার সঙ্গে এক টেবিলে খানা খেলাম, ওদের কথা শুনলাম। কিন্তু যে জন্য এ ঘটনার উল্লেখ, তা এখন বলছি। স্বাধীনতার পর গেলাম শান্তিনিকেতন, পেলাম পণ্ডিত রবিশঙ্করকে। নানা কথার পর বললাম, ‘আপনাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি অভিবাদন এবং শিগগিরই আপনাকে দেওয়া হবে দ্বৈত নাগরিকত্ব।’ তিনি ভীষণ খুশি হলেন, বললেন, ‘হয়তো পাব না, কিন্তু আপনার কথাতেই পেয়ে গেলাম। সবার ভালোবাসাই আমার নাগরিকত্ব।’ ফিরে এসে অনেক দেয়ালের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করলাম। কিছুই হলো না, অধিক সন্ন্যাসীর সমাগমে বিনষ্ট গাজন। আজকের সমাবেশে মন খুঁজে ফিরছিল রবিশঙ্করকে। তিনি অনুপস্থিত, অথচ তাঁর জন্যই ছিল আজ আমার নিভৃত ফুলের সাজি।
উইন্টার গার্ডেনে পরিবেশিত ভোজসভার স্যুপ মুখে নিচ্ছিলেন পুরোনো বন্ধু শেহাবউদ্দিন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে প্রথম রাষ্ট্রদূত, যিনি পাকিস্তানের ডিপ্লোমেটিক সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। বললাম, ‘তোমার লেখা আত্মজীবনীতে প্রাঞ্জলভাবে অভ্যুত্থানের কথা বর্ণিত হয়েছে, যা অন্য বইতে তা পাইনি।’ শেহাবউদ্দিন চিরকালই মধুর স্বভাবের। বললেন, ‘স্বাধীনতা পদকের পানে চেয়ে স্বাধীনতা চাইনি, দোস্ত। স্বাধীন হয়েছি, এটাই গর্ব।’ অন্যদের দিকে তাকালাম, সবার দানই উল্লেখযোগ্য। শেহাবউদ্দিন বিনয়ী বলে তাঁর ভাগ্যে জুটেছে অদ্য ভোজসভার নিমন্ত্রণপত্রটুকু। ‘স্বাধীনতা দিনের গান’ গানের সম্পাদক হিসেবে আমি। ডা. দীপু মনি জানেন, শত গান আমরাই গেয়েছিলাম, তাই ভোজসভার আমন্ত্রণ। তাই বা মন্দ কী।
সম্পাদকেরা প্রায় সবাই আমার বন্ধু। সুযোগ পেলে তাঁদের উসকে দিই। আগামীর জন্য প্রয়োজন ভালো খবর তৈরির কারখানা, অভাবিত কারখানা, যার খবর আছে সম্পাদকদের। সম্পাদকদের একটি সেমিনারে উপস্থিত কুয়ালালামপুরে। প্রধান বক্তা জানালেন: স্বপ্ন ছাড়া জীবন নেই, খবরের কাগজে মানুষ দেখতে চায় সেই স্বপ্নের বিস্তার। মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর কারিগর তিনজন: পত্রিকা সম্পাদক, চলচ্চিত্র স্রষ্টা ও টেলিভিশন স্রষ্টা, আগামী দিনের স্বপ্ননির্মাতা এঁরাই। জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে। বললেন, ‘পত্রিকা সম্পাদক চয়ন করবেন দেশের সবচেয়ে পজিটিভ চিত্র, বিদেশের পজিটিভ চিত্র, সেগুলোই ভেঙে ভেঙে হবে পরিবেশিত। সম্পাদক জানেন কোনটি চির সত্য এবং কোনটি সত্যি হিসেবে প্রকাশ হতে চলেছে আগামী দিনে। খবরের কাগজে একটু একটু করে ছড়িয়ে দিতে হবে সেই স্বপ্ন, যেমনটি করে থাকেন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রযোজকেরা।’
সুযোগ এলে বললাম লেখকদের কথা, স্বপ্ন ছড়ান যাঁরা মানুষের চোখে, যেমনটি ছড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। দগ্ধ পৃথিবীতে লেখক তাঁর মন নিয়ে সৃষ্টি করতে পারবেন নতুন পৃথিবী, যেখানে পাওয়া যাবে উত্তম খবর, উত্তম দুনিয়ার উত্তম মানুষদের ছবি। সঞ্চালক বললেন, ‘খুব সুন্দর আপনার কথা। আমরা শুনেছি নতুন বাংলাদেশের কথা, যেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা লেখকদের। তাঁরাই আসলে আপনাদের স্বপ্নের সোনার বাংলাকে নিয়ে আসবেন সবার সামনে।’
এবার দুটি গল্প।
গিন্নি বাজারে পাঠাচ্ছেন ছোকরা ছেলেকে।
বললেন: টাটকা মাছ আনবি না। ছোকরা অবাক। ম্যাডাম বলেন কী।
ঠিক তা-ই। যে ফল, সবজি, মাছ যত টাটকা, তাতে তত ফর্মালিনের বিষ।
আবার এদিকে যে খবর যত টাটকা, তাতেই চমক, তাতেই বিক্রি।
আমার এক বন্ধু কয়েক মাস পরপরই আমেরিকা থেকে ঢাকা আসেন। পিতা মৃত্যুশয্যায়, প্রতিবারই প্রায়মৃত পিতা উঠে বসেন। অনেক টাকা খরচ হলেও বন্ধু খুশিমনেই ফিরে যান কর্মস্থলে। এবার এসেছেন, খুশিমনে ফেরা হলো না। এবারের খবর: তিনি নেই।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
‘আর্থ ডে’ বা মৃত্তিকা দিবস পালিত হলে কথা ছিল রাতে এক ঘণ্টা অন্ধকারে থাকবে এবং এভাবে বিজলির সাশ্রয় হবে। গতকাল ইন্টারনেটে ছবি এসেছে, টোকিও, সিঙ্গাপুরের রাত সাড়ে আটটার আগে ও পরের রাতের ছবি, যেখানে শহর দুটিতে ছিল প্রথমে প্রজ্বলিত বিজলি ও পরে প্রায় অন্ধকার। ঢাকার ছবি সবচেয়ে মজার, আগে ও পরে শুধু অন্ধকার। টাটকা খবর হলো: পৃথিবীর কাছে ঢাকা শহর অন্ধকার দিয়ে ঢাকা। অন্ধকারের আবার আগে-পরে কী।
সায়মন ড্রিংকে আবার দেখলাম ‘রূপসী বাংলায়’, পূর্বতন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে; তাঁর সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছিল ৪০ বছর আগে। ১৬ বছর বয়সে এই তরুণ ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ভারতে এবং যৌবনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে হয়েছিলেন একাত্ম, জীবনে প্রত্যক্ষ করেছেন ২২টি যুদ্ধবিপ্লব ও বিদ্রোহ। রবীন্দ্র-বিধৌত বাংলাদেশে এসে জীবনের সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন এবং সেদিন পেলেন সম্মান। ওই দিন সবার সঙ্গে এক টেবিলে খানা খেলাম, ওদের কথা শুনলাম। কিন্তু যে জন্য এ ঘটনার উল্লেখ, তা এখন বলছি। স্বাধীনতার পর গেলাম শান্তিনিকেতন, পেলাম পণ্ডিত রবিশঙ্করকে। নানা কথার পর বললাম, ‘আপনাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি অভিবাদন এবং শিগগিরই আপনাকে দেওয়া হবে দ্বৈত নাগরিকত্ব।’ তিনি ভীষণ খুশি হলেন, বললেন, ‘হয়তো পাব না, কিন্তু আপনার কথাতেই পেয়ে গেলাম। সবার ভালোবাসাই আমার নাগরিকত্ব।’ ফিরে এসে অনেক দেয়ালের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করলাম। কিছুই হলো না, অধিক সন্ন্যাসীর সমাগমে বিনষ্ট গাজন। আজকের সমাবেশে মন খুঁজে ফিরছিল রবিশঙ্করকে। তিনি অনুপস্থিত, অথচ তাঁর জন্যই ছিল আজ আমার নিভৃত ফুলের সাজি।
উইন্টার গার্ডেনে পরিবেশিত ভোজসভার স্যুপ মুখে নিচ্ছিলেন পুরোনো বন্ধু শেহাবউদ্দিন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে প্রথম রাষ্ট্রদূত, যিনি পাকিস্তানের ডিপ্লোমেটিক সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। বললাম, ‘তোমার লেখা আত্মজীবনীতে প্রাঞ্জলভাবে অভ্যুত্থানের কথা বর্ণিত হয়েছে, যা অন্য বইতে তা পাইনি।’ শেহাবউদ্দিন চিরকালই মধুর স্বভাবের। বললেন, ‘স্বাধীনতা পদকের পানে চেয়ে স্বাধীনতা চাইনি, দোস্ত। স্বাধীন হয়েছি, এটাই গর্ব।’ অন্যদের দিকে তাকালাম, সবার দানই উল্লেখযোগ্য। শেহাবউদ্দিন বিনয়ী বলে তাঁর ভাগ্যে জুটেছে অদ্য ভোজসভার নিমন্ত্রণপত্রটুকু। ‘স্বাধীনতা দিনের গান’ গানের সম্পাদক হিসেবে আমি। ডা. দীপু মনি জানেন, শত গান আমরাই গেয়েছিলাম, তাই ভোজসভার আমন্ত্রণ। তাই বা মন্দ কী।
সম্পাদকেরা প্রায় সবাই আমার বন্ধু। সুযোগ পেলে তাঁদের উসকে দিই। আগামীর জন্য প্রয়োজন ভালো খবর তৈরির কারখানা, অভাবিত কারখানা, যার খবর আছে সম্পাদকদের। সম্পাদকদের একটি সেমিনারে উপস্থিত কুয়ালালামপুরে। প্রধান বক্তা জানালেন: স্বপ্ন ছাড়া জীবন নেই, খবরের কাগজে মানুষ দেখতে চায় সেই স্বপ্নের বিস্তার। মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর কারিগর তিনজন: পত্রিকা সম্পাদক, চলচ্চিত্র স্রষ্টা ও টেলিভিশন স্রষ্টা, আগামী দিনের স্বপ্ননির্মাতা এঁরাই। জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে। বললেন, ‘পত্রিকা সম্পাদক চয়ন করবেন দেশের সবচেয়ে পজিটিভ চিত্র, বিদেশের পজিটিভ চিত্র, সেগুলোই ভেঙে ভেঙে হবে পরিবেশিত। সম্পাদক জানেন কোনটি চির সত্য এবং কোনটি সত্যি হিসেবে প্রকাশ হতে চলেছে আগামী দিনে। খবরের কাগজে একটু একটু করে ছড়িয়ে দিতে হবে সেই স্বপ্ন, যেমনটি করে থাকেন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রযোজকেরা।’
সুযোগ এলে বললাম লেখকদের কথা, স্বপ্ন ছড়ান যাঁরা মানুষের চোখে, যেমনটি ছড়িয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। দগ্ধ পৃথিবীতে লেখক তাঁর মন নিয়ে সৃষ্টি করতে পারবেন নতুন পৃথিবী, যেখানে পাওয়া যাবে উত্তম খবর, উত্তম দুনিয়ার উত্তম মানুষদের ছবি। সঞ্চালক বললেন, ‘খুব সুন্দর আপনার কথা। আমরা শুনেছি নতুন বাংলাদেশের কথা, যেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা লেখকদের। তাঁরাই আসলে আপনাদের স্বপ্নের সোনার বাংলাকে নিয়ে আসবেন সবার সামনে।’
এবার দুটি গল্প।
গিন্নি বাজারে পাঠাচ্ছেন ছোকরা ছেলেকে।
বললেন: টাটকা মাছ আনবি না। ছোকরা অবাক। ম্যাডাম বলেন কী।
ঠিক তা-ই। যে ফল, সবজি, মাছ যত টাটকা, তাতে তত ফর্মালিনের বিষ।
আবার এদিকে যে খবর যত টাটকা, তাতেই চমক, তাতেই বিক্রি।
আমার এক বন্ধু কয়েক মাস পরপরই আমেরিকা থেকে ঢাকা আসেন। পিতা মৃত্যুশয্যায়, প্রতিবারই প্রায়মৃত পিতা উঠে বসেন। অনেক টাকা খরচ হলেও বন্ধু খুশিমনেই ফিরে যান কর্মস্থলে। এবার এসেছেন, খুশিমনে ফেরা হলো না। এবারের খবর: তিনি নেই।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments