রাজনীতি-নৈতিকতা বড় নাকি সংসদ সদস্য পদ? by নুরুল ইসলাম বিএসসি

যারা বাম দল করেন, অনেকে বিশ্বাস করেন তারা একটা নীতির ওপর চলেন এবং নীতির প্রশ্নে কোনো সময় আপস করেন না। বাম দলের অনেক নেতাই এখনও নীতির প্রশ্নে আপসহীন। সংবিধান সংশোধনের আগে বামসহ অনেকের মতো আমরা আশা করেছিলাম, যেহেতু দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি সংসদে আছে, '৭২-এর সংবিধানই হুবহু স্থাপন করা


হবে, কিন্তু হয়নি। আমি নিজেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছিলাম, কিন্তু কিছু হয়নি। রাষ্ট্রের কাজ চালাতে শেখ হাসিনাকে অনেক বাস্তবতার সম্মুখীন শুধু নয়; দলের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে অনেক না বলা কথা হজম করে থাকতে হয়। এ মুহূর্তে '৭২-এর সংবিধানে হুবহু ফেরত গেলে দেশে কী হতে পারে আমাদের অনেকের চেয়ে তিনি বেশি বুঝতে পারেন। বিসমিল্লাহ রাখা হয়েছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও রাখা হয়েছে, ইসলামপন্থি দলগুলোর যেখানে খুশি হওয়ার কথা, সেখানে তাদের হরতালের কর্মসূচি প্রমাণ করে, '৭২-এর সংবিধানে পুনঃপ্রবর্তন করা হলে এ দেশে এরা কী করত। আম যখন কাঁচা থাকে ছিঁড়ে নেওয়া যায়। কিন্তু লাল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলে মিষ্টি আম খাওয়া যায়। আম পাকলেই মিষ্টি হয়। এ জন্যই বলা যায়, ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়। শেখ হাসিনা ধৈর্যধারণ করতে চান। বারবার বিরোধী নেত্রীকে আহ্বান করেন, তিনি আসেন না। এটা যতটা রাজনৈতিক এর চেয়েও বেশি বিদ্বেষজনিত কারণ। উন্নতির ক্ষয় নেই, তেমনি প্রতিরোধের নেই পরিণতি। হিংসার পরিণতি ভালো হয় না। চুন তার নিজস্ব হাঁড়ি সাবাড় করে। হিংসা মানুষের মন কলুষিত করে।
আমি সংবিধান নিয়ে কথা বলার জন্য আজকে কলম ধরিনি। বাম রাজনীতি যারা করেন এবং যারা সরকারে যুক্ত হয়েছেন, তাদের নিয়ে কিছু কথা বলা আজকের প্রয়াস।
যারা বাম দল করেন, সংবিধান সংশোধনের আগে '৭২-এর সংবিধানে ফেরত যাওয়া না হলে রাস্তা গরম করার কথা বলেছিলেন। অবশ্য তাদের দু'জন নোট অব ডিসেন্টও দিয়েছেন। বাম দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য ছাঁটাই প্রস্তাবও এনেছিলেন। ওই ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর বক্তৃতাও করেছিলেন। কিন্তু কণ্ঠভোটে সব বাতিল হয়ে যায়। পরে যখন বিভক্তি ভোটের প্রশ্ন আসে, তাদের সবাই হ্যাঁ লবিতে গিয়ে হ্যাঁ ভোট দিয়ে যার যার আসনে বসে পড়েন।
প্রশ্ন হলো, 'না' ভোট দিলে কী ফলাফল হতো? সংবিধান সংশোধনী কখনও আটকে থাকত না। যেহেতু তারা সবাই নৌকা নিয়ে ভোট করেছিলেন, মাঝপথে সংসদ সদস্য পদ হারাতে হতো। এটা যারা 'হ্যাঁ' ভোট দিয়েছেন তারাও বোঝেন এবং জানেন। সংসদ সদস্য পদ বাঁচিয়ে রাখতে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছেন। এই কথাটি এখন না উঠলেও একদিন না একদিন উঠবে এবং ইতিহাসের পাতায় তা লেখা থাকবে।
বাম দল যারা করেন, তাদের অনেকের সঙ্গে পাহাড়িদের সংযোগ আছে। পাহাড়িদের তারা আদিবাসী হিসেবে দেখতে চান। প্রকৃতপক্ষে পাহাড়ে আদিবাসী নেই। তারা সবাই উপজাতি। উপজাতি একটা নয়, কয়েকটা। তাদের বেশিরভাগ মঙ্গোলিয়ান বা চীনা বংশোদ্ভূত। সমতল ভূমির অনেক বৌদ্ধ হিন্দুদের সঙ্গে কয়েকশ' বছর আগে দাঙ্গায় টিকতে না পেরে পাহাড়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।
প্রশ্ন আসে, বাম দল, যারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, আদিবাসী ও ইসলাম নিয়ে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা তো এখন নীতি বিসর্জন দিয়ে সংসদ সদস্য পদ রক্ষা করলেন। তাদের পরবর্তী কার্যক্রম কী হয় দেখার বিষয়। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল তারা কিছু একটা করে দেখাবেন, নাহ, কিছুই দেখালেন না। এখন সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকবেন, এটি সবার জানা।
গ্যাস-তেল নিয়ে বামরা যে কথাগুলো বলছেন ওখানেও শব্দের চাষ করা হয়েছে। ভালো ভালো কথা আছে। কিন্তু বাস্তবতা নেই। বঙ্গোপসাগরে তেলকূপগুলো সিমেন্টের ব্লক দিয়ে কেউ ভাগ করে রাখেনি বা পুকুর কেটে বাংলাদেশের জন্য আলাদা মজুদও করে রাখেনি। মিয়ানমার বা ভারত তার এলাকায় কূপ খনন করে টান মারলে আমাদের গ্যাস যে ওদিকে প্রবাহিত হবে না, এমন নিশ্চয়তা এক্সপার্টের দাবিদাররা দিতে পারেন? যে এলাকা নিয়ে এখন চুক্তি করা হয়েছে, সেটার একটু পরই মিয়ানমার দাবি করছে এলাকাটা। সরকার যাবে কোনদিকে? বসে থাকলে সময় চলে যাবে।
একটা সরকার চুক্তি করতেই পারে। বসে থাকলে ওই গ্যাসক্ষেত্রের সম্পদ অন্যরা টেনে নিয়ে যেতে পারে। কথা হলো স্বচ্ছতা নিয়ে। দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের অধিকারী সরকার দেশের বিপক্ষে বা জনতার বিপক্ষে কোনো চুক্তি করবে_ এটা বিশ্বাস করা যায় না। বামের কিছু অংশ সরকারে আছে। আবার খোলস পাল্টিয়ে বিএনপিতে আছে। জিয়ার সময়ও তারা জিয়ার সঙ্গে থাকতে বিব্রতবোধ করেনি। যে দল ক্ষমতায় যায়, এরা তাদের কাঁধে ভর করে নিজেদের এজেন্ডাগুলো করিয়ে নিতে চায়। কিন্তু হয় না। এর চেয়ে বরং নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে এগোনোর চেষ্টা করলে দীর্ঘমেয়াদি হলেও একটা ফল বেরিয়ে আসত। পাকিস্তান আমল থেকে বামদের বিরুদ্ধে এতই অপপ্রচার চালানো হয়েছে, যার রেশ এখনও শেষ হয়নি। এবার একটা বড় সুযোগ ছিল, যা শেখ হাসিনার প্রজ্ঞার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে।

নুরুল ইসলাম বিএসসি : সংসদ সদস্য
 

No comments

Powered by Blogger.