অর্থনীতি-জগদীশ ভগবতী, ক্ষুদ্রঋণ ও আমাদের উন্নয়ন মডেল by মামুন রশীদ

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জগদীশ ভগবতী সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংক এবং ক্ষুদ্রঋণের কার্যকারিতা বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন, যেটি টাইমস অব ইন্ডিয়া ও প্রজেক্ট সিন্ডিকেট প্রকাশ করেছে। ওই নিবন্ধে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা এবং বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রবণতা সম্পর্কে কিছু ভুল বক্তব্যও


দিয়েছেন। এ ছাড়া ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের অবদানকেও খাটো করে দেখেছেন।
শুধু বাংলাদেশই নয়, গোটা বিশ্বেই এখন ক্ষুদ্রঋণের প্রয়োজন সম্পর্কে কোনো ভূমিকার দরকার পড়ে না। বাংলাদেশ যখন চরম দারিদ্র্য নিরসনে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন অধ্যাপক মূহাম্মদ ইউনূস সাফল্যের সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির প্রবর্তন করেছেন (ব্র্যাকসহ আরও কিছু বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও এই কার্যক্রম চালাচ্ছে)। মাইক্রোক্রেডিট সামিট ক্যাম্পেইনের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রমে উৎসাহিত হয়ে ২০০৯ সালে বিশ্বে অন্তত ১২ কোটি ৮০ লাখ হতদরিদ্র পরিবার ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছে। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপের পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি হতদরিদ্র মানুষ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দৈনিক সোয়া ডলারের মতো আয় করেছে।
অধ্যাপক ভগবতী অবশ্য বিশ্বাস করেন যে মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী ভারতের আহমেদাবাদের ইলা ভাট-ই হলেন ক্ষুদ্রঋণের প্রকৃত পথিকৃৎ। ভগবতীর যুক্তি হলো, অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার দুই বছর আগে ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ইলা ভাট একটি ব্যাংক হিসেবে সেলফ-এমপ্লয়েড উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন বা সেওয়া নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। আমি ইলা ভাটের মহৎ কর্মকে খাটো করে দেখছি না। কিন্তু আমি বলতে চাই, অধ্যাপক ইউনূসই জামানতবিহীন ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে এই কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেন। যে কারণে ইউনূস আর ক্ষুদ্রঋণ পরস্পরের সমার্থক এবং বিশ্বজুড়ে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারী মানুষের ঘরে ঘরে পরিচিত বলে বিবেচিত।
অধ্যাপক ভগবতী নিজ দেশ ভারতেও দারিদ্র্যবিমোচনে ক্ষুদ্রঋণের অবদানকে খাটো করে দেখেছেন। তাঁর মতে, ১৯৯১ সালে সূচিত অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির ফলেই মূলত ভারতে নারীসহ বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আয় বেড়ে দারিদ্র্য কমেছে। অথচ এর উল্টো বক্তব্যই উঠে এসেছে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক প্রণব বর্ধনের সাম্প্রতিক একটি গ্রন্থে। অ্যাওয়েকিং জায়ান্টস, ফিট অব ক্লে: অ্যাসেসিং দ্য ইকোনমিক রাইজ অব চায়না অ্যান্ড ইন্ডিয়া শীর্ষক ওই গ্রন্থে প্রণব বর্ধন বলেছেন, ‘এনএসএসের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে উদারীকরণ হলেও ভারতে ওই সময়কালে সত্তর ও আশির দশকের তুলনায় দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য হারে অগ্রগতি হয়নি।’ ভগবতীর ভাষায়, শুধু অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে ভারতের দরিদ্র মানুষ উপকৃত হলেও সেই দেশে কিন্তু দারিদ্র্য হ্রাসে ক্ষুদ্রঋণের চাহিদাও বিন্দুমাত্র কমেনি।
১৬ কোটি মানুষ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে মোটামুটি স্থিতিশীল ধারায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে, সেটাকেও খাটো করে দেখেছেন ভগবতী। তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের নীতিমালায় ব্যর্থতার জন্য ইংল্যান্ডে লেখাপড়া করে আসা বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদদেরও সমালোচনা করেছেন। ভগবতী বলেন, ‘দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অর্থনৈতিক মতবাদই চলছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদেরা এখনো প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বা লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে প্রবৃদ্ধিকে হত্যা করে (গ্রোথ কিলিং) এমন ধরনের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পাঁকে আটকে আছেন।’
ভারতে ১৯৯২ সালে সংস্কার কর্মসূচি নেওয়ার পর যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছে, তেমনি একই সময় বাংলাদেশে যে হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, সেটিও নেহাত খারাপ নয়। বিশ্বব্যাংকের উপাত্তমতে, ১৯৯২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশে বছরে গড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার ছিল যথাক্রমে ৬.৭ ও ৫.৪ শতাংশ।
আমি অবশ্য ভগবতীকে দোষ দেব না। তিনি বরাবরই দরিদ্রবান্ধব উন্নয়ন নির্দেশনার বিপরীত প্রবৃদ্ধি মডেলে বিশ্বাসী। তাতে করে যা হওয়ার তা-ই ঘটেছে।
প্রবৃদ্ধিতে মোহাচ্ছন্ন অর্থনীতিবিদেরা প্রায়ই সামাজিক ন্যায়বিচার ও ইক্যুইটির কথা ভুলে যান। জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ, বিশেষত সামাজিক খাতের সূচকগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের চেয়ে বেশ এগিয়ে রয়েছে। এমনকি কয়েকটি সূচকে রীতিমতো ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনেও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য প্রতিফলিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যেসব দেশ মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে, সেগুলোর একটি হলো বাংলাদেশ।’
ভারতের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের একজন ও ক্যামব্রিজে অধ্যয়নকারী নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনও বাংলাদেশের সামাজিক খাত ও দারিদ্র্য বিমোচন, গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতির কথা হরহামেশাই উল্লেখ করে থাকেন।
জগদীশ ভগবতী গ্রামীণ ব্যাংককে একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিদেশ থেকে পাওয়া বিপুল অঙ্কের অর্থ দিয়ে গ্রামীণের লোকসান ঢাকার প্রচেষ্টা চালানোর জন্য ইউনূসকে সন্দেহ করা হয়।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, গ্রামীণ ব্যাংক ১৯৯০-এর দশকেই যেকোনো ধরনের বিদেশি অর্থ নেওয়া বন্ধ রেখেছে। এতে আমানতের পরিমাণ ১০৪ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা এই ব্যাংকের দেওয়া ক্ষুদ্রঋণের চেয়ে ৫০ কোটি ডলার বেশি। অধিকন্তু গ্রামীণের ব্যালেন্স শিট বা স্থিতিপত্র নিয়মিতভাবে পেশাদার অ্যাকাউন্ট্যান্সি ফার্ম বা হিসাব নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিরীক্ষিত হয়ে আসছে। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র তিন বছরই লোকসানের মুখে পড়েছে গ্রামীণ ব্যাংক, যা একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশে যেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অনেক ব্যাংককে আর্থিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা নিতে হয়েছে, সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক কখনোই এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়েনি।
প্রকৃতপক্ষে, অধ্যাপক ইউনূসের একটি অন্যতম দর্শন হলো, দানখয়রাত দারিদ্র্যবিমোচন করতে পারে না। সে আলোকেই তিনি সামাজিক ব্যবসার নামে দারিদ্র্যবিমোচনের নতুন আরেকটি মডেল নিয়ে এসেছেন। এই ব্যবসায়ের বিনিয়োগকারী ও মালিকেরা ধীরে ধীরে পুঁজি পুষিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু কোনো রকম লভ্যাংশ পান না।
তথ্য ও যুক্তির বিচারে অধ্যাপক ভগবতীর নিবন্ধটি বিভ্রান্তিকর। তিনি এমন এক সময় এটি লিখেছেন, যখন বাংলাদেশের জনগণ আশা করছে, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার শিগগির অবসান ঘটবে, গ্রামীণের অচলাবস্থার কারণে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যাপকভাবে বিপত্তির মুখে রয়েছে এবং এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘মুনাফার জন্য’ থেকে ‘মুনাফামুখী’ হয়ে ওঠা নিয়ে আলোচনা চলছিল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক তাদের তিন দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে দিকনির্দেশনা দিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্যক্তি হিসেবে ইউনূসও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কোনো ভুল ব্যাখ্যা বা বিভ্রান্তিকর বিশ্লেষণ দেশে ৮০ লাখেরও বেশি গ্রাহক আর বিশ্বে ক্ষুদ্রঋণশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একদা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাস করা হলেও সরকার, বেসরকারি খাত ও এনজিওনির্বিশেষে সবার অবদানের সুবাদে সেই দেশটিই এত দিনে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরযোগ্য বা সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে। আর্থসামাজিক খাতের সাফল্যগুলো বহির্বিশ্বে তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশের এখন অধিকসংখ্যক পণ্ডিত বা মেধাবী লোক ও সজ্জন বন্ধু দরকার। দেশ সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে আন্তরিকতাবিবর্জিত বক্তব্য দিলে তা জাতিকে হয়তো মর্মাহত করবে না, কিন্তু সাহায্যও করবে না।
ভগবতীর লেখা নিবন্ধে প্রমাণিত হয় যে পরিত্যক্ত চেয়ারে বসে বসে ‘রাজা-উজির মারা’র মতো বক্তব্য দেবে এমন অর্থনীতিবিদও আছেন। এ ধরনের অর্থনীতিবিদেরা তাঁদের সেই সব সহকর্মীকেই বেশি সমালোচনা করেন যাঁরা শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে মানবজাতির উন্নয়নে অবদান রাখছেন। এই দুই ধরনের অর্থনীতিবিদের মধ্যে সন্দেহাতীতভাবে ভগবতী আগের দলে আর অধ্যাপক ইউনূস পরের দলে পড়েন। আর এই সবকিছুর ওপরে কথা হলো, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার পর থেকেই দরিদ্রবান্ধব অর্থনৈতিক নীতিমালা, আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস এবং অবিচার দূর করার মাধ্যমে অনেক দূর এগিয়েছে। যদিও আমাদের যেতে হবে আরও অনেক দূর। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজন পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জবাবদিহি সৃষ্টি।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.