সপ্তাহের হালচাল-আওয়ামী লীগ জিতবে, না বিএনপি? by আব্দুল কাইয়ুম

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী সমর্থনে বিএনপি চমক দেখাতে পারে বলে জানিয়েছে। অর্থাৎ, তারা বেশ শক্ত প্রার্থী দিয়ে জোরেশোরে নির্বাচনে নামতে পারে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ অপেক্ষা করছে বিএনপি কী করে, তা দেখার জন্য।


প্রধান দুটি দলের সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে যিনি জিতবেন, আগামী সাধারণ নির্বাচনে সেই দল বা জোটের জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একটু রয়েসয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আগামী সংসদ নির্বাচনের এসিড টেস্ট হয়ে যাবে।
যদিও সংসদ নির্বাচনের এখনো দেড়-দুই বছর বাকি, তাও আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের মতো ভারতের সঙ্গেও মামলায় বিজয় নিয়ে আসতে পারবেন—যদি আগামী নির্বাচনে জনগণ আবার ভোট দিয়ে তাঁদের ক্ষমতায় বসায়। কারণ, সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে মামলার রায় হবে ২০১৪ সালে। তার আগে নির্বাচন হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেন, যেহেতু তাঁদের সরকারের দৃঢ় ভূমিকার কারণেই মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলার রায় বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে, তাই ২০১৪ সালেও যদি তাঁদের সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাহলে আবার সমুদ্রসীমা-জয় নিয়ে আসা যাবে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে এত দিন নির্বাচনের বিষয়টি প্রধান ছিল না, বরং বর্জনই ছিল মূল স্লোগান। কিন্তু তাঁর মনোভাবেও কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শারমেন তাঁর সঙ্গে বৈঠকের সময় সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করলে খালেদা জিয়া ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে বলেন, বিএনপি সব সময়ই আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, তাঁর দল সরকারি দলের সঙ্গে সংলাপের জন্য প্রস্তুত। তিনি এমনকি এটাও বলেন, আনুষ্ঠানিক হোক, অনানুষ্ঠানিক হোক, যেকোনো প্রক্রিয়ায়ই এ সংলাপ চলতে পারে।
এ অবস্থায় এসেছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভূমিকা মানুষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। যদি কোনো কারণে বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে না যায়, তার প্রলম্বিত ছায়া পড়বে আগামী সংসদ নির্বাচনেও। হয়তো সে নির্বাচনেও বিএনপি বেঁকে বসবে। সেটা বিএনপির জন্য ভালো কিছু হবে না, বরং সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলে যে বিএনপি বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এই মুহূর্তে বিএনপি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ওপর। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগ বলছে, এক-এগারোতেও শিক্ষা হলো না? আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবরণে তৃতীয় একটি শক্তি-সমর্থিত সরকার সৃষ্টি করা হবে? আর বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না, এমনকি কোনো নির্বাচনও হবে না। যদি সে রকম অবস্থা সৃষ্টি করা হয়, তাহলে তো আওয়ামী লীগ যে তৃতীয় শক্তির আশঙ্কা করছে, দেশ সে পথেই যাবে। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের সম্ভাবনা কমে যাবে। বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন যদি হয়ও, সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও আসলে পরাজিত হবে। কারণ, তাদের বিজয়ের নৈতিক ভিত্তি অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়বে।
আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ভালো কর্মকৌশল হবে, বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসা। এ জন্য কোনো শর্ত আরোপ না করে আলোচনার দরজা খুলে দেওয়া। অবশ্য আন্তরিকতা না থাকলে হাজার আলোচনায়ও কোনো ফল হবে না। ১৯৯৪-৯৫ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে অচলাবস্থা কাটানোর জন্য দেশি-বিদেশি দূতিয়ালি কম হয়নি। কিন্তু ফলাফল ছিল শূন্য। এবারও তাই হবে, যদি আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানোর ব্যাপারে দুই পক্ষের আন্তরিকতা না থাকে।
বাংলাদেশের রাজনীতি বিরাট উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। এখানে যেমন এক-এগারো হয়, তেমনি আবার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সুষ্ঠু নির্বাচনও হয়। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর এক অভাবনীয় উপায়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং তাঁর অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনও হয়। প্রতিবারই দেখা গেছে, গণতন্ত্রের সংকট উত্তরণে নতুন কোনো পথ খুলে গেছে। এই আমাদের গণতন্ত্র। এর প্রাণশক্তি অফুরান।
বিএনপি চায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আওয়ামী লীগ চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিএনপি চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে অনির্বাচিত, যেহেতু তারা নির্দলীয়। আওয়ামী লীগ চায় সরকারকে হতে হবে নির্বাচিত। বিএনপি চায় নির্বাচনের সময় সংসদ থাকবে না। আওয়ামী লীগ চায় সংসদ থাকবে, কিন্তু তারা অধিবেশনে বসবে না। মতপার্থক্যের এই জট ছাড়ানো কঠিন, সন্দেহ নেই। কিন্তু অসাধ্য নয়। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে অভিন্ন উপাদানগুলো চিহ্নিত করে এমন কোনো পদ্ধতি বের করা খুবই সম্ভব, যেখানে বিএনপির কথাও থাকবে আবার আওয়ামী লীগের কথাও থাকবে। বিএনপিও কিছু পাবে, আওয়ামী লীগও কিছু পাবে। নির্বাচনের আগেই বিজয়ের দাবি করার সুযোগ কেউ কাউকে দিতে চাইবে না। তাই মাঝামাঝি একটা সমাধান বের করতে হবে এবং সেটা সম্ভব।
কীভাবে? যদি একটা প্রশ্নের অভিন্ন উত্তর পাওয়া যায়, তাহলেই সম্ভব। প্রশ্নটি হলো, এমন কোনো ব্যক্তি খুঁজে বের করা সম্ভব কি না, যাঁকে নির্বাচনকালীন সরকারের (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের) প্রধানমন্ত্রী (প্রধান উপদেষ্টা) করলে কোনো দলের আপত্তি থাকবে না? এ রকম কারও ব্যাপারে যদি একমত হওয়া যায়, তাহলে সমাধান সম্ভব। কারণ, তিনি তো নিশ্চয়ই নির্দলীয় হবেন; মানে, বিএনপির শর্ত রইল। আর তাঁকে যদি একটি সদ্য শূন্য পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে আনা হয়, তাহলে তিনি হবেন নির্বাচিত, যেটা আওয়ামী লীগের শর্ত। তাই আলোচনার প্রথম ও প্রধান কাজ হবে একজন সর্বসমর্থিত ব্যক্তি খুঁজে বের করা।
কাজটি কঠিন। ১৯৯৪-৯৫ সালে পারা যায়নি। কিন্তু তখন হয়নি বলে এখনো হবে না, তা কে বলল? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এ রকম আভাস পাওয়া গেছে, কোনো একটা সমাধান বের করা সম্ভব।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতবে, না বিএনপি জিতবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে এই কৌশলের খেলায় কে বেশি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে, তার ওপর। নির্বাচনে টাকার খেলার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু এবার হয়তো টাকার চেয়েও বেশি ভূমিকা রাখবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। একসময় বলা হতো এবং কার্যত দেখা গেছে, ১০টা হোন্ডা আর ১০টা গুন্ডা হলেই বোমাবাজি করে, ব্যালট বাক্স লুট করে নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনা যায়। এখন সেই যুগ আর নেই। হোন্ডা-গুন্ডার কথা এখন আর চিন্তাও করা যায় না। দুই দশক ধরে শোনা যাচ্ছে, নির্বাচনে কারচুপি করে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু সেটা নাকি সূক্ষ্ম কারচুপি। এমন সূক্ষ্ম যে দেখা তো যায়ই না, ধরাছোঁয়াও যায় না।
আমরা অনায়াসে বলতে পারি, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং তার পরবর্তী সময়ে দুই দল ও জোটের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করবে তাদের ভবিষ্যৎ। এখন বিএনপি সংলাপের কথা বলে আবার যদি এক দফার আন্দোলনের পথ ধরে, তাহলে সেটা হবে রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয়। ২৯ মার্চের হরতাল প্রত্যাহার করে বিএনপি যেটুকু রাজনৈতিক মুনাফা অর্জন করেছে, তার সবটাই হারাবে। বিএনপি যদি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভের আশা তাদের অনেক কমে যাবে। যদি হরতাল-অবরোধ-সরকার হটাওয়ের পথে যায়, তাহলে মানুষ দূরে সরে যাবে, তাদের জনসমর্থন কমতে থাকবে।
আর আওয়ামী লীগ যদি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে, ফলাফল প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, তাহলে তার পরিণাম শুভ হবে না। যদি আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় আসার জন্য কার্যকর উদ্যোগ না নেয়, তাহলে মানুষ তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। যদি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, দলীয় বিশৃঙ্খলা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বন্ধে অনমনীয় পদক্ষেপ না নিতে পারে, তাহলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও পরে সংসদ নির্বাচনেও তাদের আশাব্যঞ্জক ফললাভ কঠিন হবে।
সিটি করপোরেশন ও পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন যতটা না হবে ভোটের খেলা, তার চেয়েও বেশি হবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার খেলা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জয়-পরাজয় অনেকাংশে নির্ধারিত হবে তাদের রাজনৈতিক কৌশল দ্বারা। এ ব্যাপারে দল দুটি কতটা সচেতন?
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.