যুক্তি তর্ক গল্প-ব্যাগের বোঝা কমাতে বিদ্যার ওপর কেন কোপ? by আবুল মোমেন
শিক্ষাকে বর্তমান সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। এ সরকারের সফল মন্ত্রীদের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর নাম প্রথম দিকেই আসবে। তাঁর আন্তরিকতা এবং বিষয় সম্পর্কে ধারণা সবাইকে আশান্বিত করেছে। এই প্রথম বাংলাদেশে একটি শিক্ষানীতি সরকার কর্তৃক গৃহীত হতে বা বাস্তবায়ন শুরু হতে দেখছে মানুষ।
যেটুকু বিরোধিতা এর বিরুদ্ধে চলছে, তা চিহ্নিত অগণতান্ত্রিক শক্তির কাছ থেকেই আসছে এবং সাধারণ মানুষকে তা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারেনি।
শিক্ষা-সংস্কৃতির কোনো কোনো বিষয়ে দেশে কিছু প্রচলিত কথা ও ধারণা আছে। এসব তলিয়ে বিচার না করলে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আশঙ্কা থেকে যায়। কারণ, শিক্ষা একটি জটিল বিষয় ও এর গুরুত্ব নতুনভাবে বোঝানোর বা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কথা ঠিক, আমাদের দেশে স্কুলছাত্রদের বিশাল বিশাল ব্যাগের বোঝা টানতে দেখা যায়। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী অবগত আছেন, এ নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ব্যাগের বোঝাকে স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের বোঝা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ফলে এ রকম একটা ধারণা সমাজে, বিশেষ করে, অভিভাবকমহলে প্রচলিত আছে যে, আমাদের দেশে কোমলমতি শিশু ও বালক-বালিকাদের ওপর বিস্তর বইয়ের তথা পড়াশোনার বোঝা চাপানো হয়েছে। ব্যাগের অবস্থা দেখে এ রকম ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি বলব, বিষয়টি আরেকটু তলিয়ে দেখা ও ভাবা উচিত।
আমাদের দেশে বস্তুত পরীক্ষার ভিত্তিতে, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। ধরা যাক, বাংলা রচনার কথা, শিক্ষকেরা, ঝানু টিউটররা, পরীক্ষার জন্য সম্ভাব্য রচনার শর্টলিস্ট তৈরি করেন, যার সংখ্যা দশের বেশি হয় না। হয়তো দেখা যাবে ২০১২-এর এসএসসি পরীক্ষার জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের পাটশিল্প ২০১০-এ পরীক্ষায় এসে যাওয়ায় এবারের জন্য গুরুত্ব হারাচ্ছে। ফলে ২০১২-এর পরীক্ষার্থী বাংলাদেশের পাটশিল্প সম্পর্কে না জেনেই পরীক্ষায় পাস করে যাবে। ইতিহাস বিকৃতির কথা আমরা খুব বলি। কিন্তু আমাদের ব্যবস্থায় ছাত্রদের পক্ষে কোনো ইতিহাসই ধারাবাহিক ও সম্যকভাবে জানা হয় না। এমনকি কোনো বছর যদি আকবর বাদশাহের রাজস্বব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, তো পরের বছর সেটি গুরুত্ব হারায় এবং হয়তো সে বছর তাঁর ধর্মসংস্কারের প্রয়াস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে ছাত্ররা এক সম্রাট আকবরের ভূমিকা সম্পর্কেও খাপছাড়া ও বিচ্ছিন্ন ধারণা নিয়েই বড় হতে থাকে। পরীক্ষাভিত্তিক এই যে নির্বাচিত ন্যূনতম পঠনব্যবস্থা, তা শিক্ষাকে অসম্পূর্ণ ও জ্ঞানচর্চাকে অর্থহীন করে রাখে; বরং বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্রদের ধারণা থাকে অস্পষ্ট, মানস হয় বিভ্রান্ত। তাদের পক্ষে কোনো বিষয়ে নিজস্ব মতামত গঠন বা যৌক্তিক চিন্তার মাধ্যমে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ ও অভিমত ব্যক্ত করা সম্ভব হয় না। আমরা সমাজে প্রায় সর্ব বিষয়ে বিভ্রান্ত ও অস্পষ্ট মানসিকতার সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। এভাবে পরীক্ষাভিত্তিক খাপছাড়া শিক্ষার মাধ্যমে আমরা একটি বিভ্রান্ত ও ধোঁয়াটে মানসিকতার জাতি গঠন করছি। এ জাতি খাপছাড়া, জাতির আচার-আচরণও খাপছাড়া।
বলা দরকার, এত অব্যবস্থার ভেতরেও কেউ কেউ সঠিক পথে জ্ঞানচর্চা করছে, মেধা ও মননের যথাযথ ব্যবহার করছে। তার পেছনে মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্র, কিছু প্রকৃত শিক্ষক, কিছু সচেতন অভিভাবকের ভূমিকাও মানতে হবে। কিন্তু এই অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র আদতেই মুষ্টিমেয়। এঁরা ব্যতিক্রম।
দেখা যাচ্ছে, সরকার ব্যাগের বোঝা ও বইয়ের বোঝা নিয়ে সত্যিই উদ্বিগ্ন এবং এই উদ্বেগ থেকে এবার বাংলা বইয়ের গদ্য-পদ্যের সংখ্যা কমিয়ে বইয়ের বোঝা ও ব্যাগের বোঝা লাঘবের উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি কিন্তু মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার নিদান হলো। কারণ, আমাদের দেশে উন্নত বিশ্বের তুলনায় পঠনপাঠন খুবই কম হয়। এ ব্যবস্থায় উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পাস করেও একজন ছাত্রী বা ছাত্র তার ভাষার শ্রেষ্ঠ সব কবি-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদের লেখা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয় না। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো সম্পর্কে তার জানা থাকে না। তাদের সাহিত্যবোধ, বিজ্ঞানচেতনা, সাংস্কৃতিক রুচি, ইতিহাসচেতনা, সমাজভাবনা কিছুই প্রায় তৈরি হয় না। নিজ ভাষার সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পী ও শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম কোনগুলো, তার কিছুই তারা বলতে পারে না। ভাসা ভাসা খাপছাড়াভাবে জানার ফলে সঠিক মূল্যায়ন ও নিজস্ব মতামত দেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয় না। ধার করা চিন্তা দিয়ে কি মৌলিক মানুষ আর অগ্রসর জাতি গঠন সম্ভব?
পশ্চিমে স্কুলেই ছাত্ররা তাদের দেশ ও ভাষার শ্রেষ্ঠ চিন্তা-চেতনা ও সাহিত্যসম্ভারের সঙ্গে পরিচিত হয়। রুশ দেশে স্কুলেই তলস্তয় দস্তয়েভস্কি-চেখভের মতো মহৎ ও সিরিয়াস সাহিত্য পড়ে ছাত্ররা। বলা বাহুল্য, মূল বই-ই তারা পড়ে, কোনো সংক্ষিপ্ত শিশুতোষ বা কিশোর ভাষ্য নয়।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, যে বয়সে যে রকম মানসিক খাদ্য দরকার, তা না পেতে পেতে আমাদের মনের ক্ষুধামান্দ্য রোগ দেখা দেয়। অসুস্থ মন স্বাদ পায় না, আরও ভয়াবহ হলো, হজম হয় না ভালো। পরীক্ষা তো পাস করতে হবে, সনদপত্র তো লাগবে, জিপিএ-৫ বা সোনালি ৫-ও পেতে হবে। পেতে হবে সহজে। ফলে দুর্বল হজমশক্তির কথা বিবেচনা করে কম খাদ্যই তাদের দেওয়া হচ্ছে। এভাবে আমরা শিক্ষার নামে আত্মপ্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজেদেরই নিজেরা বোকা বানিয়ে চলেছি। প্রকৃত পড়াশোনা শিকেয় তুলে পরীক্ষা-পরীক্ষা খেলায় মেতেছি। তাতে ফাটাফাটি ফলাফল হচ্ছে—প্রথম দিকে শত শত সোনালি ৫ ছিল, এখন হাজার হাজার হচ্ছে, অচিরে তা লাখের কোটা ছোঁবে, আশা করা যায়। কোনো কোনো স্কুল ছাত্রদের শুধু পরীক্ষার ওপর রাখে—সাপ্তাহিক-দৈনিক পরীক্ষার মাধ্যমেই পড়াশোনা চলে, বছর পার হয়। কোচিং সেন্টারগুলো মডেল টেস্টের মাধ্যমে ছাত্রদের পরীক্ষার বৈতরণী সহজে ও সফলভাবে পার হওয়ার কৌশল শেখায়।
এর সঙ্গে পড়াশোনা, জ্ঞানচর্চার কোনো সম্পর্ক হতে পারে না, তা নেইও। ফলে আমাদের শিক্ষা হলো পরীক্ষা পাস করার একটি ব্যবস্থা, জ্ঞানচর্চা, জীবনচর্চায় ভূমিকা পালনের কোনো সুযোগ বা ক্ষমতা তার নেই। ফলে স্কুলে জ্ঞানচর্চার কোনো পরিবেশ নেই, আছে পরীক্ষার খবরদারি, ভয়, শাসন। ঋতুচক্রের মতো ছাত্রের জীবন পরীক্ষাচক্রে বাঁধা। আর এ ব্যবস্থায় থাকতে থাকতে শিক্ষকদের সঙ্গেও জ্ঞানের কোনো সম্পর্ক থাকে না। তাঁরা মুখস্থ বিদ্যা বছরের পর বছর পুনরুক্তি করে চলেন। রবীন্দ্রনাথ কল্পনা করেছিলেন স্কুলে স্কুলে জ্ঞানের দেয়ালি উৎসব চলবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, আলোকিত মানুষ তৈরির কারখানা। কিন্তু আদতে এগুলো বিদ্যার গোডাউন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তামাদি মালে ঠাসা, এখানে বিদ্যার প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ছাত্রের মধ্যে জানা-বোঝার প্রাণবন্ত আগ্রহ বজায় রাখাও সম্ভব নয়। আমাদের কৃষি বিভাগের গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের ঢঙে বলা যায়, আমাদের স্কুলগুলো হলো শিশুনির্জীবকরণ প্রকল্প।
এবার শুরুর কথায় ফিরে আসি। না, আমাদের দেশে পড়াশোনার চাপ বেশি নেই, পদ্ধতির কারণে পরীক্ষার চাপ বেশি হওয়ায় পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করার চাপ প্রচণ্ড। তদুপরি বিভিন্ন রকম কর্তৃপক্ষ ও নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষার চাপে শিক্ষকেরা চরমভাবে বিভ্রান্ত এবং সব মিলিয়ে হতাশ ও হতোদ্যম। স্কুলগুলো চরমভাবে একঘেয়ে পৌনঃপুনিক, চিন্তার দিক থেকে এগুলো স্থবির এবং প্রায়ই তামাদি। স্কুলে পড়াশোনার পেছনে কোনো সতেজ মন, সৃজনশীল চিন্তা, নিদেন মানবিক ভালোবাসা ও স্নেহপূর্ণ চিত্ত কাজ করে না। আর স্কুলের আগে-পরে কোচিংয়ের চাপ মেটাতে ছাত্ররা অধিকাংশ সময় বইখাতা সব ব্যাগের মধ্যেই রাখে। স্কুলে যদি সঠিকভাবে পড়ানো হয়, যথাযথ আসবাব থাকে, শিক্ষক যদি দায়িত্বশীল ও শিক্ষকতায় আন্তরিক হন, প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে যদি স্কুলে স্কুলে প্রাণবন্ত সৃজনশীল শিক্ষককুল ছাত্রদের পাশে থাকেন, তাহলে বইয়ের বোঝা ছাত্রদের টানতে হতো না। কিছু থাকবে শ্রেণীকক্ষে, কিছু লাইব্রেরিতে এবং কিছু থাকবে ছাত্রের ও বাড়ির সংগ্রহে, অনেকটাই থাকবে তাদের নিয়মিত পাঠাভ্যাসে গড়ে ওঠা আপন স্মৃতিতে। শাস্ত্রে বলেছে, ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ। পঠনপাঠনই ছাত্রদের তপস্যা। কিন্তু পরীক্ষার কারণে বা ডিগ্রি ও সনদপত্রই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হওয়ায় ছাত্ররা আজীবন পরীক্ষাভিত্তিক পাঠেই অভ্যস্ত থাকে—প্রাইমারি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত বাস্তবতা এ-ই। ফিডিং বোতলের মাপা খাবার শৈশবে ছাড়াতে না পারলে পরিণত মানুষ হব কী করে?
ব্যাগের বোঝা কমাতে গিয়ে আবারও বিদ্যার ওপর কোপ দেওয়াকে কিছুতেই সমর্থন করা যাবে না। পরীক্ষার জুজু থেকে মুক্তি দিয়ে ছাত্রদের পড়ার আনন্দ-উৎসবে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যবস্থা করুন। তার জন্য পড়ার আয়োজনটা ছোট না করে কী করে বাড়ানো যায়, তা ভাবুন। পরীক্ষা নামের জুজুবুড়ির উৎপাত দূর হলে, নিদেন কিছুটা কমলে ব্যাগবুড়োও উধাও হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
শিক্ষা-সংস্কৃতির কোনো কোনো বিষয়ে দেশে কিছু প্রচলিত কথা ও ধারণা আছে। এসব তলিয়ে বিচার না করলে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আশঙ্কা থেকে যায়। কারণ, শিক্ষা একটি জটিল বিষয় ও এর গুরুত্ব নতুনভাবে বোঝানোর বা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ কথা ঠিক, আমাদের দেশে স্কুলছাত্রদের বিশাল বিশাল ব্যাগের বোঝা টানতে দেখা যায়। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী অবগত আছেন, এ নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ব্যাগের বোঝাকে স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের বোঝা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ফলে এ রকম একটা ধারণা সমাজে, বিশেষ করে, অভিভাবকমহলে প্রচলিত আছে যে, আমাদের দেশে কোমলমতি শিশু ও বালক-বালিকাদের ওপর বিস্তর বইয়ের তথা পড়াশোনার বোঝা চাপানো হয়েছে। ব্যাগের অবস্থা দেখে এ রকম ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি বলব, বিষয়টি আরেকটু তলিয়ে দেখা ও ভাবা উচিত।
আমাদের দেশে বস্তুত পরীক্ষার ভিত্তিতে, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। ধরা যাক, বাংলা রচনার কথা, শিক্ষকেরা, ঝানু টিউটররা, পরীক্ষার জন্য সম্ভাব্য রচনার শর্টলিস্ট তৈরি করেন, যার সংখ্যা দশের বেশি হয় না। হয়তো দেখা যাবে ২০১২-এর এসএসসি পরীক্ষার জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের পাটশিল্প ২০১০-এ পরীক্ষায় এসে যাওয়ায় এবারের জন্য গুরুত্ব হারাচ্ছে। ফলে ২০১২-এর পরীক্ষার্থী বাংলাদেশের পাটশিল্প সম্পর্কে না জেনেই পরীক্ষায় পাস করে যাবে। ইতিহাস বিকৃতির কথা আমরা খুব বলি। কিন্তু আমাদের ব্যবস্থায় ছাত্রদের পক্ষে কোনো ইতিহাসই ধারাবাহিক ও সম্যকভাবে জানা হয় না। এমনকি কোনো বছর যদি আকবর বাদশাহের রাজস্বব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, তো পরের বছর সেটি গুরুত্ব হারায় এবং হয়তো সে বছর তাঁর ধর্মসংস্কারের প্রয়াস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে ছাত্ররা এক সম্রাট আকবরের ভূমিকা সম্পর্কেও খাপছাড়া ও বিচ্ছিন্ন ধারণা নিয়েই বড় হতে থাকে। পরীক্ষাভিত্তিক এই যে নির্বাচিত ন্যূনতম পঠনব্যবস্থা, তা শিক্ষাকে অসম্পূর্ণ ও জ্ঞানচর্চাকে অর্থহীন করে রাখে; বরং বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্রদের ধারণা থাকে অস্পষ্ট, মানস হয় বিভ্রান্ত। তাদের পক্ষে কোনো বিষয়ে নিজস্ব মতামত গঠন বা যৌক্তিক চিন্তার মাধ্যমে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ ও অভিমত ব্যক্ত করা সম্ভব হয় না। আমরা সমাজে প্রায় সর্ব বিষয়ে বিভ্রান্ত ও অস্পষ্ট মানসিকতার সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। এভাবে পরীক্ষাভিত্তিক খাপছাড়া শিক্ষার মাধ্যমে আমরা একটি বিভ্রান্ত ও ধোঁয়াটে মানসিকতার জাতি গঠন করছি। এ জাতি খাপছাড়া, জাতির আচার-আচরণও খাপছাড়া।
বলা দরকার, এত অব্যবস্থার ভেতরেও কেউ কেউ সঠিক পথে জ্ঞানচর্চা করছে, মেধা ও মননের যথাযথ ব্যবহার করছে। তার পেছনে মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্র, কিছু প্রকৃত শিক্ষক, কিছু সচেতন অভিভাবকের ভূমিকাও মানতে হবে। কিন্তু এই অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্র আদতেই মুষ্টিমেয়। এঁরা ব্যতিক্রম।
দেখা যাচ্ছে, সরকার ব্যাগের বোঝা ও বইয়ের বোঝা নিয়ে সত্যিই উদ্বিগ্ন এবং এই উদ্বেগ থেকে এবার বাংলা বইয়ের গদ্য-পদ্যের সংখ্যা কমিয়ে বইয়ের বোঝা ও ব্যাগের বোঝা লাঘবের উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি কিন্তু মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার নিদান হলো। কারণ, আমাদের দেশে উন্নত বিশ্বের তুলনায় পঠনপাঠন খুবই কম হয়। এ ব্যবস্থায় উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পাস করেও একজন ছাত্রী বা ছাত্র তার ভাষার শ্রেষ্ঠ সব কবি-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদের লেখা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয় না। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলো সম্পর্কে তার জানা থাকে না। তাদের সাহিত্যবোধ, বিজ্ঞানচেতনা, সাংস্কৃতিক রুচি, ইতিহাসচেতনা, সমাজভাবনা কিছুই প্রায় তৈরি হয় না। নিজ ভাষার সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পী ও শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম কোনগুলো, তার কিছুই তারা বলতে পারে না। ভাসা ভাসা খাপছাড়াভাবে জানার ফলে সঠিক মূল্যায়ন ও নিজস্ব মতামত দেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয় না। ধার করা চিন্তা দিয়ে কি মৌলিক মানুষ আর অগ্রসর জাতি গঠন সম্ভব?
পশ্চিমে স্কুলেই ছাত্ররা তাদের দেশ ও ভাষার শ্রেষ্ঠ চিন্তা-চেতনা ও সাহিত্যসম্ভারের সঙ্গে পরিচিত হয়। রুশ দেশে স্কুলেই তলস্তয় দস্তয়েভস্কি-চেখভের মতো মহৎ ও সিরিয়াস সাহিত্য পড়ে ছাত্ররা। বলা বাহুল্য, মূল বই-ই তারা পড়ে, কোনো সংক্ষিপ্ত শিশুতোষ বা কিশোর ভাষ্য নয়।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, যে বয়সে যে রকম মানসিক খাদ্য দরকার, তা না পেতে পেতে আমাদের মনের ক্ষুধামান্দ্য রোগ দেখা দেয়। অসুস্থ মন স্বাদ পায় না, আরও ভয়াবহ হলো, হজম হয় না ভালো। পরীক্ষা তো পাস করতে হবে, সনদপত্র তো লাগবে, জিপিএ-৫ বা সোনালি ৫-ও পেতে হবে। পেতে হবে সহজে। ফলে দুর্বল হজমশক্তির কথা বিবেচনা করে কম খাদ্যই তাদের দেওয়া হচ্ছে। এভাবে আমরা শিক্ষার নামে আত্মপ্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজেদেরই নিজেরা বোকা বানিয়ে চলেছি। প্রকৃত পড়াশোনা শিকেয় তুলে পরীক্ষা-পরীক্ষা খেলায় মেতেছি। তাতে ফাটাফাটি ফলাফল হচ্ছে—প্রথম দিকে শত শত সোনালি ৫ ছিল, এখন হাজার হাজার হচ্ছে, অচিরে তা লাখের কোটা ছোঁবে, আশা করা যায়। কোনো কোনো স্কুল ছাত্রদের শুধু পরীক্ষার ওপর রাখে—সাপ্তাহিক-দৈনিক পরীক্ষার মাধ্যমেই পড়াশোনা চলে, বছর পার হয়। কোচিং সেন্টারগুলো মডেল টেস্টের মাধ্যমে ছাত্রদের পরীক্ষার বৈতরণী সহজে ও সফলভাবে পার হওয়ার কৌশল শেখায়।
এর সঙ্গে পড়াশোনা, জ্ঞানচর্চার কোনো সম্পর্ক হতে পারে না, তা নেইও। ফলে আমাদের শিক্ষা হলো পরীক্ষা পাস করার একটি ব্যবস্থা, জ্ঞানচর্চা, জীবনচর্চায় ভূমিকা পালনের কোনো সুযোগ বা ক্ষমতা তার নেই। ফলে স্কুলে জ্ঞানচর্চার কোনো পরিবেশ নেই, আছে পরীক্ষার খবরদারি, ভয়, শাসন। ঋতুচক্রের মতো ছাত্রের জীবন পরীক্ষাচক্রে বাঁধা। আর এ ব্যবস্থায় থাকতে থাকতে শিক্ষকদের সঙ্গেও জ্ঞানের কোনো সম্পর্ক থাকে না। তাঁরা মুখস্থ বিদ্যা বছরের পর বছর পুনরুক্তি করে চলেন। রবীন্দ্রনাথ কল্পনা করেছিলেন স্কুলে স্কুলে জ্ঞানের দেয়ালি উৎসব চলবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, আলোকিত মানুষ তৈরির কারখানা। কিন্তু আদতে এগুলো বিদ্যার গোডাউন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তামাদি মালে ঠাসা, এখানে বিদ্যার প্রাণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ছাত্রের মধ্যে জানা-বোঝার প্রাণবন্ত আগ্রহ বজায় রাখাও সম্ভব নয়। আমাদের কৃষি বিভাগের গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের ঢঙে বলা যায়, আমাদের স্কুলগুলো হলো শিশুনির্জীবকরণ প্রকল্প।
এবার শুরুর কথায় ফিরে আসি। না, আমাদের দেশে পড়াশোনার চাপ বেশি নেই, পদ্ধতির কারণে পরীক্ষার চাপ বেশি হওয়ায় পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করার চাপ প্রচণ্ড। তদুপরি বিভিন্ন রকম কর্তৃপক্ষ ও নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষার চাপে শিক্ষকেরা চরমভাবে বিভ্রান্ত এবং সব মিলিয়ে হতাশ ও হতোদ্যম। স্কুলগুলো চরমভাবে একঘেয়ে পৌনঃপুনিক, চিন্তার দিক থেকে এগুলো স্থবির এবং প্রায়ই তামাদি। স্কুলে পড়াশোনার পেছনে কোনো সতেজ মন, সৃজনশীল চিন্তা, নিদেন মানবিক ভালোবাসা ও স্নেহপূর্ণ চিত্ত কাজ করে না। আর স্কুলের আগে-পরে কোচিংয়ের চাপ মেটাতে ছাত্ররা অধিকাংশ সময় বইখাতা সব ব্যাগের মধ্যেই রাখে। স্কুলে যদি সঠিকভাবে পড়ানো হয়, যথাযথ আসবাব থাকে, শিক্ষক যদি দায়িত্বশীল ও শিক্ষকতায় আন্তরিক হন, প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে যদি স্কুলে স্কুলে প্রাণবন্ত সৃজনশীল শিক্ষককুল ছাত্রদের পাশে থাকেন, তাহলে বইয়ের বোঝা ছাত্রদের টানতে হতো না। কিছু থাকবে শ্রেণীকক্ষে, কিছু লাইব্রেরিতে এবং কিছু থাকবে ছাত্রের ও বাড়ির সংগ্রহে, অনেকটাই থাকবে তাদের নিয়মিত পাঠাভ্যাসে গড়ে ওঠা আপন স্মৃতিতে। শাস্ত্রে বলেছে, ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ। পঠনপাঠনই ছাত্রদের তপস্যা। কিন্তু পরীক্ষার কারণে বা ডিগ্রি ও সনদপত্রই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হওয়ায় ছাত্ররা আজীবন পরীক্ষাভিত্তিক পাঠেই অভ্যস্ত থাকে—প্রাইমারি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত বাস্তবতা এ-ই। ফিডিং বোতলের মাপা খাবার শৈশবে ছাড়াতে না পারলে পরিণত মানুষ হব কী করে?
ব্যাগের বোঝা কমাতে গিয়ে আবারও বিদ্যার ওপর কোপ দেওয়াকে কিছুতেই সমর্থন করা যাবে না। পরীক্ষার জুজু থেকে মুক্তি দিয়ে ছাত্রদের পড়ার আনন্দ-উৎসবে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যবস্থা করুন। তার জন্য পড়ার আয়োজনটা ছোট না করে কী করে বাড়ানো যায়, তা ভাবুন। পরীক্ষা নামের জুজুবুড়ির উৎপাত দূর হলে, নিদেন কিছুটা কমলে ব্যাগবুড়োও উধাও হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments